আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০]

সমবেত বিপন্নতা

‘সেইসব দিন কবে চলে গেছে অস্ট্রেলিয় ঘোড়া জূটে ব্রুহামে অতীত!
পারস্য আতরদান, গজলগোলাপী সন্ধ্যা, বাঘমুণ্ডি ছড়ির দাপট,
হীরের আঙটির থেকে হিংস্রধার আভিজাত্য সাতচেরা সূর্যের বিদায়
কাঁচের শামদান ঘিরে নাচঘরে অন্ধ পূর্বপুরুষের ধূমাঙ্ক বিস্মৃতি–‘

                                                                  —গীতা চট্টোপাধ্যায়

আমার বেড়ে ওঠা ছিল কলকাতার গা ঘেঁসে থাকা এক প্রায়- মফস্বলে। বড় পুকুর, কালী মন্দির, নারকোল গাছের সারি, বটতলা, নিঃঝুম রাস্তা, মরে যাওয়া বাসের খোল, বন্ধ কারখানার গেট, ধু ধু মাঠ, কুয়াশাজড়ানো গঙ্গার ধার, শ্মশানের পাশে ভূতুড়ে কুটির, হ্যাজাকের আলোয় সন্ধের বাজার, তাসের আড্ডা, পাগলের চিৎকার নিয়ে সে এক রহস্যময় মহাদেশ মনে হত। রোজ রাতে বিশাল পুকুরে ঝপাং ঝপাং করে আওয়াজ হত। সাঁতার কাটত কারা যেন! জানি না কারা। কোনওদিন তাদের মুখ দেখিনি। তবুও সেই সাঁতারের শব্দ শোনার জন্য উন্মুখ থাকতাম রোজ রাতে। বাড়িতে কারেন্ট ছিল না বহুকাল। ঝুলপড়া কেরোসিনের গন্ধে একটা পোড়া দুধের আভাস মিলত। সেই গন্ধ গায়ে মাখতে মাখতে, আর দেওয়ালের গায়ে ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা ছায়াগুলো দেখতে দেখতে আমি কুঁকড়ে যেতাম।

আমি যখন লিখতে শুরু করলাম, স্বাভাবিকভাবেই উপাদানের অভাব হয়নি, কারণ আমার পাড়া এবং তার সন্নিহিত মানুষজন অবিরল কাঁচামাল সরবরাহ করেছে। রেসিডেন্ট পাগল ছিল দুজন, যাদের একজন স্থানীয় ভাতের হোটেলে পেটচুক্তিতে কাজ করত। তার জীবনের একমাত্র নেশা ছিল নক্সা করা দশ পয়সা জমানো। আরেকজন কিছুই করত না, শুধু ঘুরে বেড়াত আর বিড়ি চেয়ে খেত। তারপরে সংখ্যাটা তিনে বাড়ল। পাগলি এল। দুপুর রোদে ঘুরে ঘুরে চিৎকার করে হাসত আর বেড়ালের পেছনে লাগত। পোদ্দারজেঠু কী করত কেউ জানে না। লোকে বলে নকশাল করত। আবার কেউ বলে পুলিশের স্পাই। সে সারাদিন খৈনি ডলতে ডলতে সারা পাড়া চক্কর কাটত আর মুখে মুখে ছড়া বলত। কালীমন্দিরের পুরুতের দুঃখ ছিল তার থালায় প্রণামী পড়ে না। সে সন্ধে হলে গান ধরত, আর সেটাই সারাক্ষণ গেয়ে যেত—‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল সকলি ফুরায়ে যায় মা’। ছিল পটকাদা। মেটালবক্সের একদা কেরানি, পরে সব হারিয়ে চায়ের দোকান মূলধন। ছিল ডাক্তারের বাগান নামক বিশাল একটি পাঁচিলঘেরা অঞ্চল, যার এককোনায় দাঁড়ানো বাড়ির বাসিন্দা বাইরে বেরত না। এরকম পরিবেশে লেখার চরিত্র, প্লট জুটে যায় ঠিক। তৈরি হয়ে যায় স্বতন্ত্র ভাষাও। কারণ আমাদের বহিরঙ্গে নাগরিকতা ছিল না। যেহেতু ছিল না, তার ভাষা অনেকদিন অনায়ত্ত ছিল আমাদের। ভাষা কিছুমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত হয় পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও চরিত্রাবলি দিয়ে। যে ভাষায় মফস্বলের গল্প লেখা হবে, সে ভাষায় সেক্টর ফাইভের গল্প লেখা যাবে না, এই সহজ সত্যিটা ইদানীংকার শান্তিকল্যাণের ঢালাও স্রোতে সবাই ভুলেছি। কিন্তু শুরুর দিকে আমি মোটামুটিভাবে খুঁজে পেয়ে গিয়েছিলাম আমার লিখনভঙ্গিমা, যা ওই অঞ্চল ছাড়া তৈরি হত না।

Kerosene lamp
ঝুলপড়া কেরোসিনের গন্ধে একটা পোড়া দুধের আভাস মিলত

আর এখান থেকে আমাদের সংকটের শুরু। আমরা মানে, যারা দুই হাজার সালের পরবর্তী সময়ে গদ্য লিখতে শুরু করেছি, এবং বহতা নাগরিকতার আঁচ গায়ে নিয়েও কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিলাম যাতে পুরোটা দাহ্য না হই। আমরা কমলকুমার মজুমদারের ইশারায় টালমাটাল হয়েছি। বীতশোক ভট্টাচার্য ও গীতা চট্টোপাধ্যায় পড়তে গিয়ে শিহরিত হয়েছি। অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র অথবা আনসারউদ্দীন, আমরা পড়তে গিয়ে ভারতচেতনার বানান শিখেছি। না, সরল গদ্য আমাদের আকৃষ্ট করেনি। অনেকে বলেছেন ভাষা হবে সরল সহজ। কেউ কেউ গম্ভীর গলায় রায় দিয়েছেন ভাষাকে হতে হবে শুকনো মাছের কাঁটার মত মেদহীন ও লিকলিকে। গদ্যকে হতে হবে ঝরঝরে। আমরা জানি, এ সবই এক বিশেষ সময়ের বিশেষ আধুনিকতার দাবি, যা দিয়ে আমাদের অতিকথা ও পুরাণ সমন্বিত মাটির কোনওদিন কিছু এসে যেত না। এই অনৈতিহাসিক দাবিকে আমরা পাত্তা দিইনি, কারণ আমাদের ভাষাপ্রকল্পের সৌধে বসিয়েছিলাম রামপ্রসাদ সেন ও রামকৃষ্ণ পরমহংসকে। সবাই হয়ত অত ভেবে লিখিনি। কিন্তু ওই সময়টার লিটল ম্যাগাজিনের লেখাগুলোকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, সবার লিখনভঙ্গীমাতেই স্বতন্ত্র হবার একটা কাঁচা চেষ্টা ছিল। তার হয়ত একটা বড় কারণ এই যে নাগরিকতা আমাদের চিন্তায় যতটা ছিল, যাপনে আসেনি। নগরে তো সব স্থাপত্য আর সমস্ত রাস্তা এক ছাঁচের ও সরল। সহজ ঝরঝরে কঙ্কালের হাড়ের মত লিকলিকে গদ্যের বালখিল্য দাবি সম্ভবত এই নাগরিক উচ্চাশার থেকে আসে, যেখানে নিজেদের অ্যাকসেপ্টেবল হবার তাগিদ সারাক্ষণ কাজ করে। তার পরিবর্তে আমরা রহস্য চেয়েছিলাম।

কিন্তু প্রথমে হুড়মুড়ে আধুনিকীকরণ ও তার পরে সোশাল মিডিয়ার আগমন আমাদের এই প্রকল্পকে সংকটে ফেলে দেয়। পাড়ায় পাড়ায় পুরনো বাড়ি ফাটিয়ে মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং মাথা তোলে। পুকুর বুজে যায়। বন্ধ কারখানায় গজিয়ে ওঠে শপিং মল। মুদির দোকানঘর ভেঙে এসটিডি বুথ, তা পালটে সাইবার ক্যাফে এবং সবশেষে সেটাও উঠে যায়। স্মার্টফোন সার্ভিস সেন্টার তৈরি হয় সেখানে। এত এত বদলে আমরা হতচকিত হই। একইসঙ্গে দেখি সোশাল মিডিয়ার বিস্ফার, যেখানে সম্পূর্ণ অভিনব আধারে লেখালেখি হচ্ছে। তাদের কিছুর সঙ্গেই কানেক্ট করা কঠিন হয় দিনে দিনে। আমরা তখন বুঝতে পারি, আমাদের দরকার এক নতুন ভাষা। দুই হাজার সালে রাণাঘাট প্ল্যাটফর্মের গন্ধমেখে যে ভাষা আমাদের কাছে এসেছিল, এতদিনে তা বিপন্ন। নতুন সময়, ভার্চুয়াল পৃথিবী ও উদ্দাম নাগরিক স্রোতকে যদি ধরতে হয়, বিশ্বস্ত ফুটিয়ে তুলতে হয় আজকের পৃথিবীর চলন যদি, তাহলে ভাষাকে সেই বদলানো সময়ের সঙ্গে তাল রাখতেই হবে। লিখনভঙ্গীমাকে হতে হবে আধুনিকোত্তর, হয়ত উত্তর-আধুনিক। কিন্তু আমরা অস্তিত্বে ভ্যাবাচ্যাকা ও আনস্মার্ট। ততোধিক ক্যাবলাকরুণ আমাদের কাগজগুলো। আমরা দলাদলি জানি, গোষ্ঠীবদ্ধতা জানি, জানি চিরাচরিত ক্ষমতাকেন্দ্রের দফতরে কামান দাগতে। কিন্তু হদিশ রাখিনি দফতর কবে পালটে গেছে। তার দরজা এখন বায়বীয়, আর তাই ধরা অত সহজ নয়। দ্রুত পরিপার্শ্ব বদলেছে, কিন্তু তাকে করায়ত্ত করবার মত ভাষা আমাদের হাতে নেই। আমরা জানি না কোন কাঠামোতে নতুন যুগের সাহিত্য হতে পারে, যা কানেক্ট করবে। আর জানি না বলেই মূলধারা হোক অথবা সমান্তরাল, আমরা পাঠকের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। পাঠক বাংলা বইয়ের থেকে মুখ ফেরান। এক একটা বইকে পঞ্চাশ কপি বিক্রির পরেই দ্বিতীয় সংস্করণের ঘোষণা করতে হয়, বাধ্য হয়ে প্রিন্ট অন ডিমান্ড চালু করতে হয়, প্রকাশককে গ্রহণ করতে হয় উঞ্ছবৃত্তি। এগুলোর জন্য শুধু মানুষের পাঠাভ্যাস কমে যাওয়াকে দায়ী করলে চলবে না। সেটা তো আছেই, কিন্তু কেন কমে গেল, কেন আমরাও আর কানেক্ট করতে পারি না, তাকেও দেখতে হবে।

না, সরল গদ্য আমাদের আকৃষ্ট করেনি। অনেকে বলেছেন ভাষা হবে সরল সহজ। কেউ কেউ গম্ভীর গলায় রায় দিয়েছেন ভাষাকে হতে হবে শুকনো মাছের কাঁটার মত মেদহীন ও লিকলিকে। গদ্যকে হতে হবে ঝরঝরে। আমরা জানি, এ সবই এক বিশেষ সময়ের বিশেষ আধুনিকতার দাবি, যা দিয়ে আমাদের অতিকথা ও পুরাণ সমন্বিত মাটির কোনওদিন কিছু এসে যেত না। এই অনৈতিহাসিক দাবিকে আমরা পাত্তা দিইনি, কারণ আমাদের ভাষাপ্রকল্পের সৌধে বসিয়েছিলাম রামপ্রসাদ সেন ও রামকৃষ্ণ পরমহংসকে।

মূলধারার সাহিত্য আগে বেস্টসেলার দিত। কিছু কিছু বই বহুকাল মুখে মুখে ফিরত আমাদের মা কাকিমাদের। বুদ্ধদেব গুহ থেকে নারায়ণ সান্যাল, আশাপূর্ণা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়— সকলেই আম-পাঠককে টেনে রাখতে পারতেন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে মূলধারাও তা পারছে না। শেষ কোন বই দুপুরবেলা আমাদের মায়েরা পড়তে পড়তে ঘুমিয়েছেন, তা খোঁজ করলে দেখা যাবে প্রায় সবকটাই ওই সুনীল, বুদ্ধদেব বা রমাপদ চৌধুরীর লেখা। তাঁদের অর্জন পরবর্তী লেখকদের অনায়ত্ত থেকেছে। প্যারালালের সান্ত্বনা এটা হতে পারত যে তার কোনওদিনই বিশাল মাত্রায় পাঠক ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে প্যারালালের ছিল স্বাতন্ত্র্যের আভিজাত্য। সেটা এখন আর নেই, কারণ ওই ভাষাহীনতা। যে ভাষা নিয়ে আমরা লিখতে এসেছিলাম ক্রমে দেখলাম সমসময়কে আধারিত করার জন্য তা যথেষ্ট নয়। তাই বেশিরভাগই ফিরে গেলাম সংবাদপত্রশাসিত জগতের ভাষায়, কারণ এক্সপেরিমেন্টের অনিশ্চয়তার থেকে তা বেশি নিরাপদ। আর এক শ্রেণির লেখক আদতে মূলধারার হয়েও লিখতে আসেন বিকল্প জায়গাগুলোতে, কারণ মূলধারায় তাঁরা সুযোগ পান না। তাঁদের লেখার আঙ্গিকও তাই সেরকমই থেকে গেছে, যা দিয়ে না হয় পাঠকের কাছে পৌঁছানো, আর না হয় অভিনব নিরীক্ষা।

open book in bed
শেষ কোন বই দুপুরবেলা আমাদের মায়েরা পড়তে পড়তে ঘুমিয়েছেন

এমন নয় যে আমাদের গল্প উপন্যাসে শহরের বিস্তার প্রচুর এসেছিল আগেও। আমরা গ্রাম মফস্সল ও আঞ্চলিকতায় বেশি স্বচ্ছন্দ থেকেছি। কিন্তু তখনও একজন মতি নন্দী অথবা একজন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ছিলেন, যাঁদের স্টাইল আমাদের আর্বানিটি চেনাত। এখন নগরের কথাকার সেরকম কেউ নেই। অপরদিকে যে গ্রাম-মফস্বল ছিল আমাদের চিত্রণের করায়ত্ত তার চেহারা গত দুই দশকে এতই পালটে গেল যে আমরা তাকে ধরতে পারলাম না। আশির দশকের দৃষ্টি নিয়ে এখনও পড়ে থাকলাম। এটা সংকট তো বটেই, এবং এর দায়ভার মূলধারা ও প্যারালাল দু-পক্ষকেই নিতে হবে। আমরা ছিলাম মার্ক্স ও কোকাকোলার সন্তান, কিন্তু আমাদের মননে এখনও লুপ্তমায়ার অবশেষ। তাই আমাদের বেশিরভাগ বই যেগুলো লেখা হয় এবং চিন্তাশীল বলে খ্যাতি পায়, তারা নস্টালজিয়া সম্বলিত, ছোটবেলায় কী সুন্দর দিন ছিল সেসব নিয়ে অর্থহীন চর্বণ, যাকে একপ্রকার মায়াবি ভাবালুতার প্রলেপ পড়িয়ে হাজির করা হয়। আর জনপ্রিয় সাহিত্য বলতে ভূত-প্রেত-তন্ত্র হরর গোয়েন্দা সম্বলিত লেখাপত্র, যারা সময়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন একপ্রকার নিরালম্ব অবস্থানে বাস করে। এই দুই প্রকার সাহিত্যসম্ভারের মধ্যে একটা মিল অবশ্য আছে। উভয়েই টাইম-অ্যাগনস্টিক। এদের কোনও লেখা যদি পড়া হয়, বোঝা যাবে না সেটা উনিশশো নব্বই সালের লেখা, না কি দু’হাজার কুড়ির। এক শান্ত ও নিশ্চল গ্রামসমাজের ভাষাপ্রাচীর বেষ্টিত হয়ে আমরা নিরুদ্বেগে বসে থাকি। বস্তাপচা কিছু পরীক্ষা করি বটে, তাতে কারোর কিছু এসে যায় না।

এই আমাদের সংকট। আমাদের সম্মিলিত লেখালেখি এতটা রাস্তা হেঁটে এসে হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যারা দ্রোহ ভালবেসেছিলাম, যারা চেয়েছিলাম লেখা হোক সার্কাসের মতো আশ্চর্যময় ও কল্পনাপ্রবণ, তারা আজ ক্লান্ত। নতুন পথের সন্ধান এক্ষণ আর কেউ আমাদের দেবে না। নিজেদের ট্র্যাক্টর চালিয়ে রাস্তা বানাতে হবে।  কিন্তু ট্র্যাক্টর অথবা রাস্তা, কেউ প্রস্তুত কী না আমরা জানি না।

ছবি সৌজন্য: WikimediaLibreshot

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *