নিয়ম মতে প্রতি একশো বছরে অতিমারীর আবির্ভাব হয় এবং সেই অতিমারী বছর দুয়েকের জন্য তার স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। একটা নীরব শোকাবহ বছর আমরা কটিয়েছি বন্দিদশায়। প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে অগণিত মৃত্যুর মিছিল। এ বছরের প্রথম দুটো মাস একরকম কাটলেও বিপর্যয় আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। হাসিখুশি মুখে একের পর এক সর্বনাশ করে চলেছে ক্ষুদ্র এক পরজীবী জীবাণু। তার প্রতাপে এবার বাঙালির শেষ মেরুদণ্ডটি ভেঙে পড়ে গেল। মহীরুহের ছায়া সরে গিয়ে নিঃস্ব হল সাহিত্যজগৎ।

শঙ্খ ঘোষ নামটির আগে ‘প্রয়াত’ শব্দটি বসাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ তাঁর নামের সঙ্গে ওইটি বড় বেমানান। আর থাকা না থাকার মধ্যে রয়েছে একটা বিরাট ব্যবধান। বাংলা সাহিত্যে শুধু নক্ষত্রপতনই হল না, বাংলা সাহিত্যজগৎ হারাল এক অভিভাবককে। এটা বিবৃতি দেওয়ার সময় নয়, তবুও কর্মক্ষেত্রের তাগিদে কলমকে সচল রাখতেই হচ্ছে। ভারাক্রান্ত মন বোধহয় স্মৃতির ঝাঁপি হাতড়ে বেড়ায়।

মনে পড়ে ঈশ্বরচন্দ্র আবাসনে তাঁর বসার ঘরের বুকশেলফ উপচে পড়ে মেঝে থেকে ঘরের সিলিং ছুঁয়েছে গ্রন্থসম্ভার। সেই বইয়ের অরণ্যে তাঁর নিবিড় আলিঙ্গনে সিক্ত ও ধন্য হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার সারা জীবনের সঞ্চয়। কত কথা বলেছি, কত তুচ্ছ অনুরোধ করেছি, কথা রেখেছেন প্রতিবার। মিষ্টিমুখ না-করিয়ে কোনওদিন বাড়ি থেকে বিদায় নিতে দেননি। যতবার বলেছি ‘আসি’, দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছেন আমি সিঁড়ি নেমে রাজপথে পৌঁছনো পর্যন্ত। প্রবীণ কবির মতো প্রাজ্ঞ দূরত্ন না-রেখে সোৎসাহে আলোচনা করেছেন তাঁর দেখা হিন্দি ছবি নিয়ে, কিংবা কখনও মিষ্টির রেকাবি হাতে নিয়ে বলেছেন, “লিখে দেব তোমার বইয়ের ভূমিকা, যদি বিনা বাক্যব্যয়ে সবগুলো মিষ্টি খেয়ে নাও।” 

Shankha Ghosh reading BB

বুকশেলফ উপচে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত রাখা বইয়ের সঙ্গে নিভৃতিযাপন

পরিণত বয়সেই প্রস্থান। তবু কোথাও যেন রয়ে গেল এক অপার নিঃসীম শূন্যতা। এই শূন্যতা কিসের? প্রতিবাদের কণ্ঠ আজ স্তব্ধ। কবিতার শব্দে, ছন্দে প্রাসঙ্গিকতা, সাহসিকতার অভাব। তাঁর কবিতার মূল্যায়ণ করার মত জ্ঞান বা ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস আমার নেই। কবিকে একবার বলেই ফেলেছিলাম যে তাঁর অনেক কবিতার শব্দবিন্যাস, বিশ্লেষণ অনেক সময় বড় দুর্বোধ্য মনে হয়। অন্যদিকে আবার এমন অনেক কবিতা রয়েছে, যেখানে আজকের সময়কে আশ্চর্য স্পষ্ট, একমুখীভাবে প্রকাশ করেছেন পাঠকের কাছে। সেগুলি পড়লে তাঁর বক্তব্য নিয়ে কোথাও কোনও ধন্দ থাকার কথা নয়। থাকেওনি। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘গোয়েবলস ১৯৩৩’ শীর্ষক কবিতায় দেখতে পাই বর্তমান সমাজকে।

‘আমার মহান নেতা, হে মহিমাময়
আপনারই নির্দেশে আমি প্রচারসচীব, আমি জানি
এই নবসৃষ্টিকালে সত্য নয় ন্যায় নয় একমাত্র লক্ষ্য হলো জয়
একমাত্র লক্ষ্য হলো জনমনে অবশতা আনা
এবং বশ্যতা
একমাত্র লক্ষ্য হলো অলীক আশ্বাস আর আশা
পরিসংখ্যানের ভারে যে-কোনো মোহন প্রতিশ্রুতি
যে-কোনো আহুতি’

 

আরও পড়ুন: হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা: অলোকরঞ্জনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য

তাঁর মতো কাব্যসাধকের অন্য একটি পরিচয় হল তিনি রবীন্দ্রউপাসক। রবীন্দ্রজীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর তথ্য তাঁর আয়ত্তে। রবীন্দ্রানুরাগীদের তিনি কাছের মানুষ। রবীন্দ্রসৃষ্টির মূল্যায়ণ ও বিশ্লেষণে ভরে উঠেছে ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’, ‘এ আমির আবরণ’, ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি গ্রন্থের পাতা। তাঁর বিন্যাসে ঋদ্ধ হয়েছে কলকাতা দূরদর্শনের একাধিক রবীন্দ্রবিষয়ক অনুষ্ঠান যার মধ্যে রয়েছে ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’, রবীন্দ্রচিত্রকলা বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘রূপের অদৃশ্য অন্তঃপুরে’, ‘জন্মদিনের ধারা’ ইত্যাদি। সে কথা শুনেছি আমার মা মধুশ্রী মৈত্রের কাছে, যিনি দূরদর্শনের প্রোগ্রাম এগজিকিউটিভ ছিলেন সেই সময়। তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার বাঁধনটি বুঝেছিলাম অনেক পরে, বড় হয়ে। 

Shankha Ghosh handwriting
নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রকবিতার উদ্ধৃতি

তাঁর একাধিক গদ্যগ্রন্থে রবীন্দ্র-বিশ্লেষণ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। ফিরে পড়েছি একই জায়গা। একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘এ আমির আবরণ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের সংগীতজীবন এবং কথা আর সুর নিয়ে লিখতে গিয়ে এক জায়গায় তাঁর উক্তি,

‘আমার তো মনে হয়, সমস্ত শিল্পই এই নিজেকে জানার শিল্প। কেননা, এক হিসেবে, নিজেকে জানার সম্পূর্ণতাই সকলকে জানারও পাথেয়। এ ধারণার মধ্যে কেবল প্রাচীন উপনিষদকে খুঁজতে গেলে ভুল করব আমরা, এ আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় অর্জিত বোধ। আমরা দেখতে পাব যে আধুনিকেরাও কেবলই লড়াই করছেন এই আত্মবোধের সঙ্কট নিয়ে। টমাস মানের মতো শ্রেষ্ঠ একজন আধুনিককেও বলতে হয় তাই: জীবনের প্রধান তিনটে বাণীর একটি হচ্ছে এই যে, মানুষ যখন সত্যি সত্যি নিজেকে জানে তখনই সে হয়ে ওঠে আরেকজন মানুষ।’

একটি মাত্র জীবনে কবি কি পেরেছেন নিজেকে জানতে?

সম্ভবত না। সমাজের নীরব চিৎকার শুনতে শুনতে পৃথিবীর এক কঠিন সময়ে তাঁর প্রস্থান। প্রতিবাদের কলম এবং কণ্ঠ নিয়ে আবার ফিরে আসার অঙ্গীকারের কথা কোথাও দেখি না। তাও আমরা অপেক্ষা করে থাকব কবি হিসেবে তাঁকে আবার সাদরে গ্রহণ করার জন্য। কারণ যখন বর্তমান প্রজন্মের কটিবন্ধে বাঁধা ছোট ছোট গণতন্ত্র আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভ্রুকুটি, তখন তো শঙ্খ ঘোষকে বড় প্রয়োজন সমাজের।

Soumitra Chatterjee and Shankha Ghosh
দুই বন্ধুর একান্ত আলাপ

মন বলে আবার তিনি ফিরে এসে লিখবেন ‘ইছামতির মশা’, ‘দিনগুলি রাতগুলি’, ‘বাউল’, ‘কবর’ ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। নির্ভীক অনর্গল উচ্চারণে বলে উঠবেন,
‘এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’

 

*সমস্ত ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *