রাণুমাসির হাতে সারা বছরই কোনও না কোনও সেলাই দেখেছি। কখনও সোয়েটার বা টুপি, কখনও লেস, কখনও চটের আসনে ক্রসস্টিচের নকশা- মোটমাট তাঁর হাত খালি থাকত না।
রাণুমাসি আমাদের আত্মীয় নন। হাওড়ার শিবপুরে যে মস্ত বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম, সেই বাড়িরই একতলায় রাণুমাসিরাও ভাড়া থাকতেন। বাড়িটা একটা পুরনো জমিদারবাড়ির অংশ। এদিক ওদিক করে সেই বাড়িতে বাড়িওলারা চারঘর ভাড়াটে বসাতে পেরেছিলেন। সবগুলো অংশ সমান নয়। আমাদের ভাগে দুটো ঘর পড়লেও রাণুমাসিরা একখানা ঘরেই থাকতেন। রাণুমাসির ছেলে ফল্গু আমার সমবয়সী ছিল। এক ক্লাসেও পড়তাম আমরা, যদিও স্কুল আলাদা।
ফল্গুর সঙ্গে বন্ধুত্বের টানেই ওদের ঘরে যেতাম খুব। রাণুমাসিকে কখনও দুপুরে ঘুমোতে দেখিনি। বাড়ির অন্য মেয়ে, গিন্নিদের একটা আড্ডার আসর জমত তেতলায় আভামাসিদের ঘরের সামনে টানা দালানে। সেখানেও তিনি তেমন যেতেন না। তাঁকে সর্বদা কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত দেখতাম। একটু নেপালি ধাঁচের চেহারা ছিল তাঁর। যদিও আমার মা বলতেন, বাঙালিদের মধ্যে অমন চেরা চেরা চোখ আর বোঁচা নাক ঢের দেখা যায়।
আমার অবাক লাগত ওঁদের ঘরের টানটান করে টাঙানো পর্দা দেখে। বাড়ির আর কোনও পরিবার অমন টানটান করে ফ্রিল দেওয়া, লেস লাগানো পর্দা টাঙাত না। রাণুমাসিদের ঘরের প্রতিটি জিনিসে যেন ওঁর শিল্পকর্মের ছোঁয়া লেগে থাকত। টেবিলঢাকনি, চেয়ারের পিঠের ঢাকনি, টুলের ঢাকনি- সব কিছুতে ফুলতোলা। রাণুমাসির মেয়ে অমলাদি কিন্তু ঠোঁট উল্টোত, ‘দূর দূর! মার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, সবকিছুতে ফুলপাতা তুলছে। শুধু সময় নষ্ট।’
ওদের বাড়ির চায়ের কেটলিরও একটা জামা ছিল। তাতে রাণুমাসি দুটো মজার পুতুল আর একটা চায়ের কাপ এমব্রয়ডারি করে রেখেছিলেন। নীল কাপড়ের টোপরের মতো ওই কেটলির মোটা জামাটা আমার খুব মজার লাগত। পরে বড় হয়ে অবশ্য জেনেছি ওটাকে ‘টিকোজি’ বলে, চা গরম রাখতে সাহায্য করে।

খুবই সাধারণ অবস্থা ছিল ওই বাড়িটার চার ভাড়াটে পরিবারের। তারমধ্যেও রাণুমাসিদের অবস্থা বোধহয় সবচেয়ে খারাপ ছিল… দালানে মেয়েদের আড্ডা থেকে তেমনটাই যেন কানে আসত। ফল্গুর বাবা কী চাকরি করতেন জানি না। অন্য সবার ঘরে যেমন আত্মীয়স্বজন আসাযাওয়া করত, ওদের ঘরে তেমনটাও দেখিনি।
কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থা যা-ই হোক, বাড়ির মধ্যে ওদের ঘরটাই ছিল সবচেয়ে টিপটপ। রাণুমাসি কোথাও একটু ধুলো পড়তে দিতেন না। শীতকালে অমলাদি আর ফল্গুর বিনুনি-ডিজাইন, উঁচু বা ভি-গলা চমৎকার ফিটিং করা সোয়েটার দেখে আমাদের হিংসে হত। রাণুমাসির মতো উলের সোয়েটার, মাফলার, ব্লাউজ বুনতে কেউ পারত না। অন্য মহিলারা উল কিনে তাঁকে দিয়ে বুনিয়ে নিতেন সেটাও দেখেছি।
আমাদেরই মতো কয়লার আঁচে, তোলা উনুনে রান্না হত ওঁদের। কিন্তু কী কৌশলে যে ওই উনুনেই কেক বিস্কুট বানাতেন রাণুমাসি- সে এক রহস্যময় ব্যাপার। একটা অ্যালুমিনিয়মের ডেকচিতে বালিটালি দিয়ে কীভাবে যেন করতেন। বিস্কুটগুলো ঠিক দোকানের মতো মাপে মাপে কাটা থাকত না, একটু ত্যাড়াবেঁকা হত। কিন্তু দারুণ মুচমুচে, ভারি সুস্বাদ।

বড়দিনের সময় আমার বাবাও একটা ফ্রুটকেক কিনে আনতেন, হলদেটে সেলোফেন পেপারে মোড়া, আমারা বলতাম ‘সিন কাগজ’। কিন্তু রাণুমাসি বাড়িতে তাঁর ওই ডেকচিতে এক মস্তবড়, ভারী নরম কেক বানিয়ে বাড়ির সব বাচ্চাদের খাওয়াতেন। বাড়ির তৈরি সেই গরম কেকের স্বাদ আলাদা, কার টুকরোতে ক’টা কিসমিস পড়েছে আমরা তার প্রতিযোগিতা করতাম।
অমলাদি যে পাড়ার ছেলে বাবলুদার সঙ্গে প্রেম করছে, সেটাও আমরা সবাই জানতাম। ফল্গু বা আমার হাত দিয়েই ওরা লুকিয়ে চিঠি চালাচালি করত। বাবলুদা সবে কলেজে পড়া শেষ করে ওর বাবার সঙ্গে আদালতে যাচ্ছে তখন। ওর বাবা ছিলেন নামী উকিল। পাড়ায় ওদের বাড়িটাই সবচেয়ে ঝকঝকে রং করা, সামনে একটুকরো বাগানও ছিল। আমরা ভাবতাম বিয়েটা কবে হবে! ফল্গু বলত অমলাদির নাকি ইচ্ছে মাংসের পোলাও খাওয়ানো হয়। তখন মধ্যবিত্ত বাঙালিঘরে বিরিয়ানি অচেনা নাম। বিয়েবাড়িতে হলদে রঙের নিরিমিষ পোলাও হত।
এর মধ্যেই একদিন হৈচৈ কাণ্ড বেধে গেল। বাবলুদার বাবা এসে খুব অপমান করে গেলেন ফল্গু আর অমলাদির বাবাকে। কী চিৎকার চেঁচামেচি একতলায়। দোতলার বারান্দায় সবাই দাঁড়িয়ে গেল। এমনকী উল্টোদিকের বাড়ির শীলুরা উঁকিঝঁকি দিতে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে জানা গেল, রাণুমাসি নাকি অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া মেয়ে। ফল্গুর বাবা ওই আশ্রমেই চাকরি করেন, সেই সূত্রেই পরিচয় ও বিয়ে। আরও সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, রাণুমাসি নাকি খ্রিস্টান আর এই বিয়ের জন্যই ফল্গুর বাবাকে তাঁর নিজের পরিবার ত্যাগ করেছে। খ্রিস্টান মেমরা ওই আশ্রমটা চালায়।
ফলে, কীভাবে রাণুমাসি কেক বিস্কুট বানাতে শিখেছেন বা মেমেদের মতো উল বুনতে পারেন, সেই রহস্য তেতলার মেয়েলি আড্ডায় পরিষ্কার হয়ে গেল। বাবলুদার বাবা তর্জনগর্জন করে বলে গিয়েছিলেন জাতজন্মহীন খ্রিস্টান মায়ের মেয়েকে তিনি কিছুতেই ঘরে তুলবেন না। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, অমলাদিও তার মায়ের ওপর চোটপাট করতে লাগল এই ঘটনার পর। আমাদের ঘর থেকে তার উঁচু গলা শোনা যেত। রাণুমাসি এমনিতেই কম কথা বলতেন, আরও যেন চুপচাপ হয়ে গেলেন। আমাকে ডেকে একদিন মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে একটা লেসের খুঞ্চিপোশ দিলেন। কী সুন্দর করে যে বানিয়েছিলেন!

তার দু’সপ্তাহের মধ্যে ওঁরা বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেলেন। যাবার সময় ফল্গুটা দেখাও করে গেল না। ওদের ঘরটা অচিরেই ভাড়া হয়ে গেল। এক বৃদ্ধ দম্পতি এলেন, সঙ্গে তাঁদের অবিবাহিত স্কুলটিচার মেয়ে। তিনজনেই ভীষণ খিটখিটে। বাড়ির বাচ্চারা সিঁড়িতে দালানে রোয়াকে হুটোপাটি করে খেললেই বেরিয়ে এসে বকতেন। খুব মনে পড়ত আমার রাণুমাসি ফল্গু আর আর অমলাদির কথা, যদিও আর কোনওদিন দেখা হয়নি।
বড় হয়ে কতবার ভেবেছি, একবার কোনওভাবে যদি দেখা হয়, ফল্গুর বাবাকে একটিবার প্রণাম করব তাঁর উদারতার জন্য। রাণুমাসিকে প্রণাম করব এত সুন্দর করে সংসার করার জন্য। সেই খুঞ্চিপোশটা এখনও আমার কাছে আছে। পুরনো হয়ে লেসের কাজ হলদেটে হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আশ্চর্য! ওটা হাতে নিলে যেন বড়দিনে রাণুমাসির বানানো সেই গরম কেকের গন্ধ পাই।
*ছবি সৌজন্য: 31daily, findingzest, Pinterest
চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।