জোস্টিন গার্ডার-এর সোফিস ওয়র্ল্ড বইয়ের কোনও এক জায়গায় পড়েছিলাম এবং মনে গেঁথে গেছে, এই অসীম মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থা ঠিক খরগোশের লোমে পিঁপড়ের মতো। বার বার ওপরে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়…। আমরাও তাই। হাজার চেষ্টা করেও মহাবিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য উদ্ধার করতে পারছি না, কেবলই চেষ্টা করছি আর বিফল হচ্ছি! সেই নাথিংনেস থেকে এতবড় বিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি, আজও তা অজানা। মহাবিশ্ব কতদূর ব্যাপ্ত, কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, কোনও বিরাট শিশু এই বিশ্ব নিয়ে খেলছে কিনা জানি না, তবে এইটুকু তো জানি, অসীম ব্রহ্মাণ্ডের অংশ, আমাদের এই টুকরো সৌরজগৎ সূর্যকেন্দ্রিক। আর সৌরমণ্ডলে সূর্য সমস্ত শক্তির উৎস! এ কথা কোপারনিকাসের হাত ধরে আজকের ছোট বাচ্চারাও জানে।

বিজ্ঞানের দৌলতে আমরা জানি যে, সূর্যের সমস্ত শক্তির উৎস নিউক্লিয়ার ফিউশন। প্রোটন-প্রোটন ফিউশন হয়ে যে হিলিয়াম তৈরি, সে যে অনন্তকাল চলবে না, তা-ও আমরা জানিরেড জায়ান্ট থেকে হোয়াইট ডোয়ার্ফ… সে সব হতে হতে এখনও পাঁচ বিলিয়ন বছরের বেশি। যাক নিশ্চিন্তি! 

কিন্তু বহু বহু বছর আগে, প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের কাছে এ সবই ছিল অজানা। ওরকম চকচকে ঝকঝকে প্রখর তেজওয়ালা চোখ রাঙানো এদিক থেকে ওদিক ছুটে যাওয়া আগুনের গোলা তাদের কাছে তখন ভগবানতুল্য! যে আকাশে উঠলেই প্রগাঢ় অন্ধকার দূর হয়, পাখিরা জেগে ওঠে আর পৃথিবী ঝলমলিয়ে ওঠে, তাকে প্রণাম না করে কী করা! গ্রিক পুরাণ অনুসারে, হেলিওস নামে সূর্যদেবতা রোজ রথে চেপে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাড়ি দিত। তারপর এলেন অ্যাপোলো, সূর্যদেবতার আর এক রূপ। রোম সাম্রাজ্যে সূর্য স্বনামেই পূজিত হতেন। 

The Egyptian Sun God Ra
পিরামিডের উপর বর্ষিত হচ্ছে মিশরীয় সূর্যদেবতা ‘রা’-এর আশীর্বাদ

গ্রিসের হেলিওস‘, চিনের জিহে‘, মিশরের সূর্যদেবতা রাবা আমাদের দেশের সূর্যদেব বা আদিত্য‘, এটাই প্রমাণ করে পৃথিবীর সর্বত্র আমরা সেই শক্তির উৎসর কাছে নতজানু। এ দেশে সূর্যপুজোর সব চেয়ে ধুমধাম বোধহয় ঝাড়খণ্ড, বিহারে, ছটপুজোকে কেন্দ্র করে। শক্তিদায়ী সূর্য আর তাঁর বোন ছঠি মাঈয়া (মতান্তরে তাঁর স্ত্রী) যিনি আমাদের সন্তানদের রক্ষা করেন, তাঁদের পুজোর দিন হল ছট। ষষ্ঠী মাতার অপভ্রংশ হলো ছঠি মাতা বা ছঠি মাঈয়া। এই ছঠি মা আবার ব্রহ্মার মানসপুত্রীও।

The Women praying to Sun God
ছট মূলত সন্তানদের কল্যাণকামনায় সূর্যদেবের অর্চনা

ছট ব্রতকথায় উল্লেখ আছে, অনেককাল আগে, রাজা প্রিয়ব্রত তাঁর সন্তানের প্রাণরক্ষার্থে ছঠি মায়ের পুজো শুরু করেন। ওদিকে এও কথিত আছে, সত্যযুগে রাবণ বধ করে অযোধ্যা ফিরে যাবার পর রামসীতা শুরু করেন সূর্যদেবের পুজো। তারপর দ্বাপরে, দ্রৌপদী পাণ্ডবদের মঙ্গল কামনায় রাখেন ছট ব্রত। আর তেজস্বী সূর্যপুত্র কর্ণ যে বরাবর তার পিতৃদেবের পূজারী, সে তো সবাই জানে। কাজেই এই পুজোর প্রচলন কবে প্রথম হয়েছিল, তা সঠিক জানা যায় না। তবে আজও কার্তিক মাসের চতুর্থী থেকে ষষ্ঠী-সপ্তমী পর্যন্ত শুদ্ধাচারে পূজিত হন শক্তির উৎস আদিত্য।

প্রথম দিনে, বাড়িঘর পরিষ্কার করে শুদ্ধাচারে স্নান সেরে “নাহায়, খায়”, পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া সাত্ত্বিক খাবারভাত, ডাল আর লাউ থাকবেই। দ্বিতীয় দিনে “খরনা”-তে নির্জলা উপোস শেষে সূর্যাস্তের পর ক্ষীর খাওয়া ও নুন ছাড়া খাবার খাওয়া ও পরের দিনের যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে নেবার দিনতৃতীয় দিন “সন্ধ্যা অর্ঘ্য”, সারাদিন উপোস থেকে  বিকেলে সূর্যাস্তে নদীর ধারে সূর্যদেবকে দুধ অর্পনওই দিনই গৃহস্থের ঘরে ঠেকুয়া তৈরি করা হয়। চতুর্থ দিন “ঊষা অর্ঘ্য”। ওইদিন ভোরে আবারও নদীর ধারে সূর্য বন্দনা আর ডালি সাজিয়ে ফল, মিষ্টি ও ঠেকুয়া অর্পন। তারপর বড়দের প্রণাম করে চারদিনের ছট পরবের শেষ হয়।

The morning and Evening offering
আগের দিন সূর্যাস্তে সন্ধ্যা অর্ঘ্য (বাঁয়ে), পরদিন ভোরে উষা অর্ঘ্য (ডাইনে) ছটের নিয়ম

এই ঠেকুয়া প্রসাদ কার কার না ভালো লাগে বলো! কুঁড়েঘর বা রাজপ্রাসাদ, যেখানেই এই ঠেকুয়া বানানো হোক না কেন, একটু হয়তো মেওয়া কম পড়ে বা ঘিয়ের বদলে তেল দেওয়া হয়। স্বাদ আর ভালোবাসা কিন্তু দুটোরই অতুলনীয়..

ঠেকুয়া  বা খাজুরি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ও নেপালের তরাই অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। আর বানানোর পদ্ধতি এক একটা বাড়িতে এক এক রকমকেউ আটা-গুড় দিয়ে করে, কেউ আটার বদলে ময়দা। কেউ ময়দার সঙ্গে সুজি আর চিনি মিশিয়ে করে। সে রকমফের যাইহোক… আমরা বাঙালিরা সবেতেই আছিঅষ্টমীর খিচুড়ি, রথের গজা, নতুন ধানের নবান্ন, সংক্রান্তির পিঠে তো আছেইখ্রিস্টমাসের কেক, ঈদের সিমুই, ছটের ঠেকুয়া, সে-ও বাদ যাবে কেন?

The Thekua
প্রসাদী ঠেকুয়া

সূর্য নাহয় আমাদের বাঁচার রসদ যোগাচ্ছে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে, তারপর মানুষের মগজ যেই না আগুন আবিষ্কার করল, অমনি শুরু হল নানান স্বাদের রেসিপি…। সর্ব শক্তির উৎসের প্রিয় খাবার, ঠেকুয়া বানানোর পদ্ধতি লিখে ফেলি। এটা ওই বহুরকম ঠেকুয়া রেসিপি থেকে আমার মায়ের সবচেয়ে পছন্দের একটি, যে রকম করে বছরের পর বছর মা বানিয়ে আসছেন..

কী কী লাগবে:

ময়দা এক বাটি
নারকেল কোরা আধবাটি
চিনি আধবাটি নিয়ে গুঁড়ো করতে হবে
ঘি বা সাদা তেল – ৬-৭ টেবিলচামচ, যাতে ময়দা মেখে ময়ান দিয়ে দলা পাকানো যায়
আমন্ড কুচি – ২-৩ চামচ
কাজু কুচি – ২-৩ চামচ
কিসমিস কুচি -১ চামচ
সাত-আটটা ছোট এলাচ গুঁড়ো করা
গুঁড়ো দুধ আধ বাটি
জল পরিমাণ মতো (প্রায় ১/৪ বাটি). যাতে রুটি পরোটার মতো শক্ত ডো মাখা হয়
ভাজার জন্য তেল বা ঘি

নুন একদম লাগবে না!

Thekua on Chhat
আমার মায়ের বানানো ঠেকুয়া

প্রণালী: 

ময়দায় আগে তেল বা ঘি ময়ান দিয়ে তারপর গুঁড়ো দুধ, নারকেল কোরা, চিনিগুঁড়ো, বাকি সব দিয়ে ভালো করে মেখে নিয়ে গোল গোল লেচি কেটে হাতে করে নানান আকার দিয়ে, কিম্বা ছাঁচে দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। তারপর ঢিমে আঁচে ডুবো তেলে বা ঘিয়ে মুচমুচে করে ভেজে নিলেই রেডি! 

আমরা যারা বিজ্ঞান নিয়ে বাঁচি আর বিজ্ঞান দিয়ে বাঁচি, তারাও নতমস্তকে স্বীকার করি, সূর্য আছে বলেই এত রূপের খেলা রঙের মেলা অসীম সাদায় কালোয়… পুজো করি বা না করি, সেই অসীম শক্তির উৎসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে যে প্রসাদ, তা নাহয় বিনম্রতায় তুলে নিলাম হাতে!

*ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *