বেঁচে থাকলে এ বছর ৯৩-তে পা দিতেন। জন্মদিনে হয়তো সকালে উঠে খোঁপায় লাগিয়ে দিতে বলতেন প্রিয় ফুল। শুভেচ্ছা আর ফুলের তোড়ার বান ডাকত বাড়িতে। মিষ্টি হাসির একফালি ছবি দিনভর ভেসে বেড়াত টিভির পরদায়। কিন্তু এসব কিছুই তিনি করলেন না। কারণ, তিনি আর নেই। তাঁকে ছাড়া এই প্রথম ২৮ সেপ্টেম্বর পালন করল ভারতবাসী, চোখে জল নিয়ে।
লতা মঙ্গেশকর। সুরসম্রাজ্ঞী। সুরের দেবী। জীবন্ত সরস্বতী। এমন কত নামেই তো তাঁকে ডেকেছি আমরা। আলোচনা করেছি তাঁর সাত দশকের কেরিয়ার নিয়ে। এবার গান নিয়ে নয়, অন্য এক লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে কথা বলা যাক চলুন। জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করি এমন এক স্বাধীন নারীর প্রতিমূর্তি হিসেবে, যিনি জীবনভর উপার্জন করেছেন নিজের এবং গোটা পরিবারের জন্য, একটাকাও কর ফাঁকি না-দিয়ে বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েছেন। অথচ এর জন্য মিডিয়ায় তাঁর নামে কোনও হইহুল্লোড় হতে দেননি কখনও। নিজের আয়ব্যয়, সম্পত্তি, বাড়ি, গাড়ি, আয়কর নিয়ে থেকেছেন অন্তরালে, রহস্যময়ী দেবীর মতো, সংযমী সাধকের মতো।

চল্লিশের দশকে মারাঠি ছবি ‘পহিলি মঙ্গলাগৌড়’-এ শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় ও গান গাইবার শুরুয়াত লতার। ক্যামেরায় মুখ দেখানোর সামান্য পারিশ্রমিক জুটলেও গান গাওয়া ছিল বিনামূল্যে। কল্পনা করুন পাঠক, লতা মঙ্গেশকর জীবনের প্রথম পেশাদারী গানটি গেয়েছিলেন বিনামূল্যে। গাইয়েছিলেন অভিনেত্রী নন্দার বাবা মিস্টার বিনায়ক, যিনি কিনা সে সময়ে এক মরাঠি ফিল্ম সংস্থায় কাজ করতেন। এরপর প্রায় বছর ছয়েক লতাকে এভাবেই কাজ করতে হয় মরাঠি ছবিতে, যার জন্য তিনি খুব বেশি একটা পারিশ্রমিক পেতেন না। কিশোরীবেলা পেরিয়ে কুড়ি বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জীবনের প্রথম সুপারহিট গানটি গাইলেন লতা মঙ্গেশকর— আয়েগা আয়েগা আয়েগা আনেওয়ালা। ছবির নাম ‘মহল’। কত পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন, সে কথা আজ আর জানা না-গেলেও এই গান দিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন পেশাদারী জগতে, তার শেষ হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে এসে, যখন তাঁর গানের বাজারজাত মূল্য লক্ষ-কোটি ছাড়িয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ ২০২২ সালে লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুকালে তাঁর ‘নেট ওয়র্থ’ ছিল ৩৬৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে রয়েছে তাঁর সমস্ত রেকর্ড করা গানের রয়্যালটি, তাঁর সারাজীবনের মঞ্চানুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত টাকা, তাঁর বিশাল বাড়ি, একাধিক বিলাসবহুল দামি গাড়ি, পুরস্কারমূল্য এবং যাবতীয় লগ্নি। রয়েছে বাবার নামে তৈরি করা দীননাথ মঙ্গেশকর ট্রাস্টের পুঁজিও। লতাজির মৃত্যুর পর তাই প্রাথমিকভাবে মিডিয়ার ধারণা ছিল যে এই ট্রাস্টই হবে তাঁর বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, কারণ লতা অবিবাহিত ছিলেন। লতার আইনজীবীদের তরফেও তেমন ইঙ্গিত মিলেছিল। তবে পরে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, লতার ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরই (যিনি লতার মুখাগ্নিও করেছিলেন) সম্ভবত এই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।

এখানে বলবার কথা এইটিই যে, লতা মঙ্গেশকর বললেই আমাদের সামনে যে মানুষটির ছবি ভেসে ওঠে তিনি দৈবী, পবিত্র, নম্র, মিতবাক, মৃদুভাষী, সহাস্য এবং কোমলহৃদয়। অথচ ভাবুন পাঠক, ‘স্বাধীন আত্মাভিমানী নারী’ বললে কি এমন একটি চেহারার কথা ভাবতে পারি আমরা? নিঃসন্দেহে পারি না। কারণ, নারী-স্বাধীনতা এখনও আমাদের কাছে গুটিকয় স্টিরিওটাইপেই আটকে রয়েছে। সেগুলো কী? ধরুন, স্বাধীন স্বোপার্জনকারী প্রত্যয়ী নারীকে তার অধিকারের জন্য নিরন্তর আস্তিন গুটিয়ে লড়ে যেতে হবে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, তাকে দিশিবিলিতি সব পোশাকে স্বচ্ছন্দ হতে হবে, চিৎকার করে বলতে হবে নিজের অধিকারের কথা, কোমলতার আবরণ খসিয়ে কঠোর গাম্ভীর্যের বর্ম এঁটে উচিত কথা শোনাতে হবে সমাজকে, নাহলে কেউ তাতে কর্ণপাত করবে না। লতা মঙ্গেশকরের অবস্থান এই ছবির ঠিক বিপরীত মেরুতে।
অথচ, সেই তিনিই হয়ে উঠতে পারতেন ভারতীয় স্বাধীন আত্মাভিমানী নারীর এক সার্থক রোল মডেল, যিনি এই সবকটি স্টিরিওটাইপ চুরমার করে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের অনন্যা মূর্তি। পুরুষ গায়ক, এমনকী অনেক নায়কের চেয়েও তাঁর রোজগার ছিল বেশি। ছবির টায়টল কার্ডে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে তাঁর নাম লেখা থাকত সবার ওপরে, এমনকী তালিকায় বোন আশা থাকলেও নাম প্রথমে আসত দিদিরই। তাঁর মিষ্টি হাসি আর নম্র স্বভাবের অন্তরালে তাঁর বজ্রকঠিন প্রত্যয়ের কথা আজ হয়তো আমরা সকলেই জানি। তাঁর ভাই হৃদয়নাথ (যিনি শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন দিদির সবথেকে কাছের, সবথেকে প্রিয়জন) একদা ফিল্মফেয়ার পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সঙ্গীত অনেক গুরুর কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু দিদির কাছ থেকে শিখেছি আত্মসম্মান। আত্মবিশ্বাসী থেকেও কীভাবে অহংকার আর ঔদ্ধত্য থেকে দূরে থাকতে হয়, এ শিক্ষাও দিদির কাছে পাওয়া। তিনি তো বরাবরই সবার উপরে। তবু চিরদিন নিজেকে বলেছেন, আমি নিজে কিছুই অর্জন করতে পারিনি। সবটুকু পাওয়াই ঐশ্বরিক দান।’

ঠিক সেভাবেই নিজের বৈভব, বিত্ত চিরকাল লতাজি রেখেছেন চর্চা থেকে দূরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। দক্ষিণ মুম্বইয়ের পেডার রোডে তাঁর ‘প্রভা কুঞ্জ ভবন’ বিলাসে ব্যসনে টেক্কা দিতে পারে বাঘা বলিউডি নায়ক-নায়িকাকে। লতাজির গাড়ির সংগ্রহও ছিল দেখবার মতো। পঞ্চাশের দশকেই নিজের রোজগারে কিনেছিলেন হিলম্যান কোম্পানির গাড়ি। পরে যোগ হয় তাঁর শখের শেভ্রোলে। এছাড়াও ছিল বুইক, ক্রাইসলারের মতো বিলাসবহুল গাড়ি। ‘বীর জ়ারা’ ছবির সমস্ত সুপারহিট গান গেয়ে ২০০৪ সালে যশ চোপড়ার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন ই-ক্লাস মার্সিডিজ়। অথচ সেসব নিয়ে মিডিয়াতে কোনও মাতামাতি হতে দেননি সুরের রানি। হেডলাইন হতে দেননি নিজের আয়কর নিয়েও। তাঁর মৃত্যুর পর জানা যায়, ষাট বছর ধরে লতার উপার্জনের খুঁটিনাটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিল ভারতের আয়কর বিভাগ, কিন্তু কখনও এতটুকু নিয়মভঙ্গের অভিযোগ তুলতে পারেনি। মামলা মকদ্দমা হয়েছে, কিন্তু শেষমেশ জয়ী হয়েছেন গায়িকাই।
বম্বে হাইকোর্টে রাখা লতার আয়কর সংক্রান্ত ষাট বছরের নথিপত্তরে দেখা যায় কীভাবে একটু একটু করে আদালতের চোখেও সম্মানের আসন আদায় করেছেন তিনি। গোড়ার দিকে (পঞ্চাশের দশকে) যাঁর উল্লেখ হয়েছে ‘আ সিংগার বাই প্রফেশন’ হিসেবে, তাঁকেই ষাটের দশকে ‘আ ওয়েল-নোন প্লেব্যাক সিংগার’ এবং শেষমেশ সত্তরে এসে ‘অ্যাকনোলেজড প্লেব্যাক সিঙ্গার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৬৩ সাল। মনে করুন পাঠক, যখন ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগো’ গেয়ে প্রধানমন্ত্রীর চোখে জল এনে দিচ্ছেন লতা মঙ্গেশকর, ইন্দো-চিন যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভারতবাসী আশ্রয় পাচ্ছে লতার সুরে, ঠিক সে বছরেই আয়কর বিভাগ তাঁর বিরুদ্ধে উপার্জনের পরিমাণ গোপনের অভিযোগ তুলছে। কিন্তু ধোপে টেঁকেনি কোনওকিছুই। আজকের যুগে, যখন আইপিএল কেলেঙ্কারিতে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া, চিটফান্ডের নামে বিপুল টাকা তছরূপ বা এসএসসি দুর্নীতিতে উদ্ধার হওয়া টাকার পাহাড় দেখা ভারতবাসীর কাছে জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এহেন সংযমের পরিচয় কি নজিরবিহীন বলে মনে হয় না?

আর শুধু কি সংযম? লতাজির জনকল্যাণমূলক কাজের খোঁজও অনেকেই রাখেন না। ১৯৮৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপজয়ী দলের জন্য গান গেয়ে টাকা তুলে দেবার ঘটনাটি অবশ্য এখন প্রায় সর্বজনবিদিত ‘৮৩’ ছবির কল্যাণে। তবে এই ঘটনা ছাড়াও ২০০১ সালে পুণেতে দীননাথ মেমোরিয়াল হাসপাতাল তৈরি, কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গিহানায় নিহত জওয়ানদের জন্যে এক কোটি টাকা দান, এমন বহু বহু ঘটনা রয়েছে, যা মিডিয়াতে প্রচার করতে চাননি লতাজি। কোভিডের সময়েও মহারাষ্ট্র সরকারের কোভিড রিলিফ ফান্ডে লক্ষাধিক টাকা দান করেছেন তিনি। তৈরি করেছিলেন মাস্টার দীননাথ মঙ্গেশকর ট্রাস্ট যা কাজ করবে দুঃস্থ মেধাবীদের জন্য।
তাহলে এতসব কথার অবতারণা কেন আজ? জন্মদিনে গানের ডালিই তো যথেষ্ট ছিল, এ কথা বলতেই পারেন ভক্তজনে। উত্তরে বলি, তাঁর সঙ্গীত নিয়ে আলোচনার ধৃষ্টতা রাখি না। তাঁর নিরলস সাধনা, তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ওঠাপড়া, কোনওকিছু নিয়েই বিশাল গুরুগম্ভীর প্রবন্ধরচনার প্রচেষ্টা এ নয়। এ কেবল ফিরে দেখা সেই আদ্যন্ত ভারতীয় নারীকে, যাঁকে কখনও পরতে হয়নি বিদেশি পোশাক, একটি কথাও বলতে হয়নি চিৎকৃত স্বরে, মিডিয়াতে তৈরি করতে হয়নি হেডলাইন। স্বাধীন আত্মবিশ্বাসী দৃঢ়চেতা সুদৃপ্ত নারীর স্টিরিওটাইপ অনায়াসে ভাঙতে ভাঙতে তিনি যেন গেয়ে উঠেছেন, ‘কোই না রোকো দিল কি উড়ান কো… দিল উয়ো চলা!’
ছবি সৌজন্য: Apnaarchive, Indiatv
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!