অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে আমি প্রথম দেখি মঞ্চে। মিনার্ভা রেপার্টরির পরিবেশনায় ‘দেবী সর্পমস্তা’ নাটকে, দ্বৈত ভূমিকায়। তখন ওঁর নাম নাট্যজগতের বাইরে খুব একটা কেউ জানতেন না। সেদিন তাঁকে দেখে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছিলেন, “এই ছেলেটা যদি সিনেমায় আসে, বাঙালি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা যোগ্য উত্তরসূরী পাবে।” কথাটায় সেদিন পুরোপুরি একমত হতে অসুবিধে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, একটু দ্রুতই কি সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছেন না বন্ধু?
তারপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে বহু মরা মাছ ভেসে গেছে। তাঁর বহুমুখী অভিনয় প্রতিভার জেরে অনির্বাণ এখন বাংলা সিনেমা, সিরিজ, বিজ্ঞাপন সবেতেই পরিচালকদের নারায়ণশিলা হয়ে উঠেছেন। অঞ্জলি জুয়েলার্সের গ্রহরত্নের বিজ্ঞাপন, রিয়ালিটি শোয়ের সস্তা ভাঁড়ামো থেকে শুরু করে টানটান থ্রিলার, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের চিত্ররূপ, ব্যোমকেশ বক্সি- সর্বঘটেই অনির্বাণ নামক কাঁঠালি কলাটি ছুঁইয়ে রাখছেন নির্মাতারা। আমার নিজের জ্ঞান সেই সময়ের থেকে বিশেষ না বাড়লেও সাংবাদিক বন্ধুর সেই কথাটির সম্পূর্ণ অর্থ সময়ের ঘষায় আর একটু পরিষ্কার হয়েছে আমার কাছে। অন্তত আমার তাই ধারণা ছিল।

কিন্তু, পরিচালক অনির্বাণের প্রথম প্রচেষ্টা ‘মন্দার’ দেখে উপলব্ধি করলাম, যে সেই উক্তি এবং অনির্বাণের সম্ভাবনার সম্পূর্ণ পরিধি- এর সিকিভাগও জানা হয়নি আমার। এই উপলব্ধির বেশ কয়েকটা স্তর আছে। প্রথমত, ওই সর্বঘটে কাঁঠালি কলা অবতারে দর্শন করে অনির্বাণের প্রতিভা সম্বন্ধে ধারণাটা কেমন ঘেঁটে গিয়েছিল। ‘মন্দার’ দেখে তাঁর নিজস্ব চিন্তা, মনন, শিল্পীসত্তা কোন তরঙ্গে বিচরণ করে, তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা ফিরে পেলাম।
দ্বিতীয়ত, শুধু অভিনয়ক্ষমতা দিয়ে সম্ভবত কেউ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠতে পারেন না। ওরকম উপস্থিতি, ব্যক্তিত্ব, পড়াশোনা, প্রজ্ঞা এবং সর্বোপরি চলচ্চিত্র ও মঞ্চ দুটি মাধ্যমের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে অমন সুস্পষ্ট জ্ঞান ছাড়া সেই শিখরটিতে পৌঁছনো দূরে থাক, সেই যাত্রাপথে পা বাড়ানোই অসম্ভব। ‘মন্দার’ বুঝিয়ে দিল, সেই যাত্রাপথে পা বাড়ানোর ক্ষমতা আপাতত অনির্বাণ ভট্টাচার্য ছাড়া বাংলা অভিনয়জগতে খুব একটা কারও নেই।
যাই হোক, আসা যাক মন্দারের কথায়। এখানে দুটো আঙ্গিক অবধারিতভাবেই এসে যায়। এক, ম্যাকবেথের অভিযোজন হিসেবে মন্দারের সার্থকতা, আর দুই, মৌলিক ওয়েবসিরিজ় হিসাবে মন্দার।
প্রথমটা স্বভাবতই দুরূহ। ম্যাকবেথের যত পরিবেশনা দেখেছি, তাতে এখনও, মানে ‘মন্দার’ দেখার পরেও আমার প্রিয়তম স্থানে থাকবে বিশাল ভরদ্বাজ পরিচালিত ‘মকবুল।’ ‘থ্রোন অফ ব্লাড’ এ বিষয়ে ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ ধরা হলেও আমি সে ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করি। মন্দারের শেক্সপিয়ার ব্যাখ্যা আমার সব জায়গায় ভালো লেগেছে তা বলব না, কিন্তু পরিচালক তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির অনন্যতাকে যেরকম অসাধারণভাবে পরিবেশন করেছেন, সেটাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। এক এক করে ধরা যাক।

প্রথম যেটা বলতে হয়, সেটা হল, সিরিজের মূল আমেজ। ম্যাকবেথের গল্পে উচ্চাশার পাশাপাশি যৌনতার একটা চোরাস্রোত আছেই। তবে অন্যান্য জায়গায় যেটা লেডি ম্যাকবেথের চরিত্রেই মূলত সীমাবদ্ধ, সেটা এখানে কিন্তু অনেক বেশি প্রত্যক্ষ, দৃষ্টিগ্রাহ্য, প্রকাশ্য এবং সর্বাঙ্গীন। প্রায় সমস্ত চরিত্রের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন যৌনবৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। এমনকী, এই সিরিজে উচ্চাশার পিছনে মূল অনুঘটক ক্ষমতা বা ভাগ্যের থেকেও বেশি যৌনতা। অথচ, এ ব্যাপারটা সিরিজে আসে অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে- যেমন বারবনিতার সঙ্গে মুকাদ্দার মুখার্জির (অনির্বাণ ভট্টাচার্যের) সংলাপে, মাংস কাটার দৃশ্যে, কিছু খাওয়ার দৃশ্যে জিভের ক্লোজ়আপে, বা দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে খাটে ঝুলন্ত ময়লা অন্তর্বাসের মাধ্যমে। তবে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা লাগে দুটো ক্ষেত্রে। অভাবনীয়রকম লাগসই জায়গায় জাম্প কাট করে শুকনো গাছের ডালের খাঁজের অ্যাক্সিয়াল শটে বন্ধ্যা যোনির মোটিফ আর এক জায়গায় ড্রোনের মাধ্যমে নেওয়া এরিয়াল শটে ডিঙিনৌকোর উপর লাল শাড়িতে ঋতুস্রাবী যোনির মোটিফ।
এ প্রসঙ্গে বলি, এরিয়াল বা ড্রোন শটের আধিক্য সিরিজে একটু বেশি। কিছু জায়গায় সেটা একঘেয়ে লাগলেও কিছু কিছু শট সত্যিই অনবদ্যভাবে প্রাসঙ্গিক ও সিনেম্যাটিক।

ম্যাকবেথের যে কোনও পরিবেশনায় আর একটা যে জিনিস আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করে, সেটা হল ‘থ্রি উইচেস’-এর রূপায়ন। মন্দারে বরং সেই দৃশ্যগুলো আমার কিছুটা অতিনাটকীয় মনে হয়েছে। আসলে, মূল নাটকে দৃশ্যগুলো বেশি নাটকীয় বলেই হয়তো আশা করেছিলাম, এখানে রূপায়নটা আরও অনেক সূক্ষ্ম হবে। এর পিছনে কোনও যুক্তি নেই যদিও, এবং এটা সম্পূর্ণভাবেই পরিচালকের স্বাধীনতা। হয়তো, মকবুলে নাসিরুদ্দিন শাহ এবং ওম পুরির অনবদ্য চরিত্রচিত্রণ এই প্রত্যাশাটা আমার মনে বসিয়ে দিয়েছে। সবাই এরকম না-ই ভাবতে পারেন। আর একথা অনস্বীকার্য, যে মঞ্জুবুড়ি (সজল মন্ডল) আর তাঁর নাতি (সুদীপ ধাড়া) দু’জনেই নিজেদের ভূমিকার প্রতি অত্যন্ত সুবিচার করেছেন। দৃশ্যগুলোয় যে পরাবাস্তব আবহাওয়া অনির্বাণ তৈরি করতে চেয়েছেন, এঁদের ছাড়া সেটা সম্ভব হত না। বুড়ির চরিত্রে সজল মন্ডলের কাস্টিং এবং তাঁর গলায় সংলাপও চমকপ্রদ।
এই সিরিজে ম্যাকবেথের মূল গল্প ও চরিত্রায়ণ বেশকিছু জায়গায় পরিবর্তন করেছেন পরিচালক। কিন্তু, মূল টেক্সটের অভিযোজন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সেগুলির অবতারণা করতে হলে সেটা আমি সমালোচকের দীনতা বলেই মনে করি। তাই এর সমস্ত খুঁটিনাটিতে ঢুকব না। তবে সিরিজের দুটি প্রধান চরিত্রের কথা এখানে বলা দরকার। মুকাদ্দার মুখার্জির চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য এবং মদন হালদারের চরিত্রে লোকনাথ দে। দু’জনেরই অভিনয় অনবদ্য। অনির্বাণের অভিনয় নিয়ে বেশি কিছু বলাটা বাহুল্যই হবে। আর লোকনাথ দে রেপার্টরির সময় থেকে তাঁর সঙ্গী। দেবী সর্পমস্তায় আদিবাসী নেতা ডাহুকের চরিত্রে তাঁর অভিনয় আজও চোখে লেগে আছে। এখানেও তিনি অসামান্য অভিনয় করেছেন।

কিন্তু ব্যাপার হল, মূল নাটকে এই চরিত্রগুলি নেই। এবং শেষপর্যন্ত আমার কাছে পরিষ্কার হল না, যে ম্যাকবেথের ইন্টারপ্রিটেশন হিসেবে দেখলে এই সিরিজে তাঁদের ভূমিকাটা ঠিক কী। মানে চরিত্রগুলো খুবই যত্ন করে নির্মিত, কিন্তু এঁরা না থাকলেও মূল গল্পের স্রোতে খুব হেরফের হত বলে মনে হয় না। আর আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এঁরা হবেন ওই বুড়ি ছাড়া আর দুজন ডাইনি। সেটা হয়নি, তবে হলে আমার মনে হয়, চরিত্রদুটো সত্যিই একটা অসাধারণ স্তর পেত।
তবে অভিযোজনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্বল লেগেছে গতির বিবর্তন। সিরিজের প্রথম পর্ব যতটা সময় ও যত্ন নিয়ে দেখানো হয়েছে, শেষের দিকটায় যেন খানিকটা তাড়াহুড়োর ভাব। লাইলির ক্ষেত্রে তাও চরিত্রের পুরো যাত্রাটা সুষম। কিন্তু মন্দারের ক্ষেত্রে উত্থানটা যত যত্ন ও সময় নিয়ে বানানো, পতনের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো ততটাই চোখে লাগে। সত্যি বলতে কী, মন্দারের নিরাপত্তাহীনতা দর্শকমনে কায়েম হবার অতটা সময়ই পায় না।
সিরিজের ক্লাইম্যাক্সটাও ম্যাকবেথের থেকে একটু আলাদা। হয়তো যেভাবে সিরিজটা সাজিয়েছেন পরিচালক, তাতে অন্যরকম সমাপ্তি বেমানানই লাগত। যাই হোক, একদম সিরিজ শেষের দৃশ্যকল্প বা মোটিফটি আমার অনবদ্য লেগেছে। না দেখলে তার অভিনবত্ব বোঝানো মুশকিল।
এবার আসি নির্মাণে। অবশ্য তার অনেকটাই উপরে আলোচনা হয়েছে। তবে এ ছাড়াও লক্ষণীয় একটা বৈশিষ্ট্য আছে নির্মাণে। সিরিজের কিছু কিছু দৃশ্য অনির্বাণ প্রায় মঞ্চের মতো উপস্থাপনা করেছেন। যেমন, সিরিজের একটি জায়গায় অল্প আলোকিত ঘরে, কোনও সংলাপ ছাড়া ডাবলুভাই (দেবেশ রায়চৌধুরী) বসে, আর তাঁর স্ত্রীর (সুমনা চক্রবর্তী) সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবার একটি দৃশ্য। এবং এইরকম দৃশ্যগুলির অভিঘাত এত যথাযথ, যে তাতেই বোঝা যায় মঞ্চ ও চলচ্চিত্র, দু’টি মাধ্যমেই পরিচালকের যাতায়াত কতখানি অনায়াস। বিভিন্ন জায়গায় এই সিনেম্যাটিক ও ড্রামাটিক ট্রিটমেন্টের বৈপরীত্য সিরিজের অন্যতম শক্তিশালী বিষয় আমার মনে হয়েছে।
পরিচালক ছাড়াও উপরোক্ত অধিকাংশ বিষয়গুলিতে তাঁর কৃতিত্বের অনেকটা ভাগীদার কিন্তু চিত্রগ্রাহক সৌমিক হালদার এবং সম্পাদক সংলাপ ভৌমিক। সিরিজের কিছু কিছু জায়গায়, যেখানে দৃশ্য দুটো আলাদা পরিবেশে বারবার আনাগোনা করে, তার মসৃণ যাতায়াতটা এই তিনজনের বোঝাপড়া ছাড়া সম্ভব হত না। মন্দারের প্রতিটি দৃশ্যই যে ভিস্যুয়ালের দিক থেকে অত্যন্ত জোরালো এবং অভিঘাতপ্রবণ, সেটা এই তিনজনেরই যুগ্ম প্রয়াস। সিরিজের দ্বিতীয় বড় সম্পদ আবহ। এফেক্ট সাউন্ড বা মিউজ়িক ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে সঙ্গীতকার শুভদীপ গুহ ব্যবহার করেছেন মফসসলে হিট নতুন ও পুরনো বাংলা ছবির কমার্শিয়াল গান। গেইলপুরি ডায়লেকটের কথায় একটু পরে আসব, কিন্তু তার সঙ্গে এই আবহের যুগলবন্দিটা দুর্দান্ত লেগেছে।

গল্প ও চিত্রনাট্যের কৃতিত্ব শেক্সপিয়ারকেই দিয়েছেন অনির্বাণ, হয়তো যেটুকু পরিবর্তন, তা তাঁর নিজের করা বলেই। তবে যে-ই করে থাকুন, গেইলপুর ডায়লেক্টের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। এটা সম্ভবত মেদিনীপুরের মৎস্যজীবীদের থেকে অনুপ্রাণিত আর সেইটে সত্যিই চরিত্রগুলোর আদিমতায়, এমনকী যৌনতার উচ্চকিত প্রকাশেও একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
অভিনয়ের ব্যাপারে কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? একটু আন্ডারপ্লেড চরিত্রে দেবেশ রায়চৌধুরী বরাবরই আমার প্রিয়তম অভিনেতাদের একজন। তাঁর ডাবলুভাই (ডানকান) চরিত্রটিকে মূল নাটকের চেয়ে অনেক আলাদা ও সুস্পষ্টভাবে গড়েছেন অনির্বাণ। সেটা বেশি বিশ্লেষণ করতে গেলে গল্পে ঢুকতে হয়। তাই ওপর ওপর বলি, এই ডাবলুভাই কিন্তু ডানকানের মতো ‘প্রজাহিতৈষী’ নন, যথেষ্ট শোষক প্রকৃতির। তবে সে একাধারে বিচক্ষণ, লম্পট, প্রভাবশালী এবং ধূর্ত। দেবেশবাবুর মতো হাতে গোনা কিছু শক্তিশালী অভিনেতা ছাড়া এই চরিত্র ফোটানো খুব মুশকিল ছিল।

অন্যদিকে লাইলির (লেডি ম্যাকবেথ) চরিত্রে সোহিনী সরকার দাপিয়ে অভিনয় করেছেন তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সিরিজের প্রথমদিকে প্রধান ‘সেক্স সিম্বল’, আর শেষদিকে আস্তে আস্তে উন্মাদ হয়ে যাওয়া, দু’জায়গাতেই জাত অভিনেত্রীর ছাপ রেখেছেন তিনি। মন্দারের (ম্যাকবেথ) ভূমিকায় দেবাশিস মন্ডলকে প্রথমদিকে, মানে ম্যাকবেথের উত্থানের সময়টায় খুবই ভাল লেগেছে। ম্যাকবেথ প্রবাদপ্রতিম যোদ্ধা, কিন্তু হাজার উচ্চাশা সত্ত্বেও রাজা হবার গুণ যে তার মধ্যে নেই, এই ব্যাপারটা খুবই ভালো ফুটিয়েছেন তিনি। সমস্যা হল, পরের দিকে, মানে পতনের সময়ে, তাঁর অভিনয়টা একটু উচ্চকিত আর একমাত্রিক হয়ে যায়। সেটা চিত্রনাট্যের সমস্যা, না অভিনয়ের, বলা মুশকিল। কিন্তু অন্যদের পাশে সেটা বেশ বিসদৃশ লেগেছে।
বঙ্কার (ব্যাঙ্কো) চরিত্রে শঙ্কর দেবনাথ বেশ ভাল। চরিত্রটা ফুটিয়েছেনও অত্যন্ত সফলভাবে। অবধারিতভাবেই মকবুলে পীযুষ মিশ্রের সঙ্গে এখানে একটা তুলনা চলেই আসে, তবে সেটা করাটা সুবিচার হবে না বোধহয়। অনির্বাণ ও লোকনাথের কথা আগেই বলেছি।
বাকি চরিত্রদের মধ্যে লাকুমণির চরিত্রে নবাগতা দোয়েল রায়নন্দী বেশ ভাল অভিনয় করেছেন। আধা-মফসসলি, স্বাধীনচেতা মেয়ের চরিত্র বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়েছেন দোয়েল। শুধু তাই নয়, সিরিজে একটা পুনরাবৃত্তির সুর আছে, যেখানে মঞ্চা (ম্যালকম), ফন্টুস (ম্যাকডাফ) আর তার প্রেমিকা লাকুমণির হাত ধরে যেন আবার ডানকান, ম্যাকবেথ আর লেডি ম্যাকবেথের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা দেখা যায় শেষে। চরিত্রের সেই বিবর্তনটা তিনজনের মধ্যে দোয়েলই সবচেয়ে সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। তবে ফন্টুসের (ম্যাকডাফ) চরিত্রে কোরক সামন্তকে একেবারেই মানায়নি। অভিব্যক্তিহীন মুখ, কথা বললে শোনা যায় না, চলাফেরায় ব্যক্তিত্বের অভাব- একরম অভিনেতাকে ভাবী রাজার চরিত্রে ভাবাই যায় না। মঞ্চার (ম্যালকম) চরিত্রে দিগন্ত সাহার নিষ্ফল রাগ আর গোঁয়ার্তুমি দেখানো ছাড়া করার বিশেষ কিছু ছিল না। সেটুকু বেশ ভালই করেছেন তিনি।
তবে অভিযোজনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্বল লেগেছে গতির বিবর্তন। সিরিজের প্রথম পর্ব যতটা সময় ও যত্ন নিয়ে দেখানো হয়েছে, শেষের দিকটায় যেন খানিকটা তাড়াহুড়োর ভাব। লাইলির ক্ষেত্রে তাও চরিত্রের পুরো যাত্রাটা সুষম। কিন্তু মন্দারের ক্ষেত্রে উত্থানটা যত যত্ন ও সময় নিয়ে বানানো, পতনের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো ততটাই চোখে লাগে। সত্যি বলতে কী, মন্দারের নিরাপত্তাহীনতা দর্শকমনে কায়েম হবার অতটা সময়ই পায় না।
পোশাক-আশাকের ব্যাপারে একটু বলি। এটা মোটামুটি যথাযথ, তবে সামান্য হতাশ করল একটা ব্যাপার। নির্দেশনার খুঁটিনাটিতে যেখানে পরিচালকের অত নজর, সেখানে গ্রামের গরিব জেলে-বৌ সোহিনীর অমন পরিষ্কার করে কাটা নখ, বা অমন ফিটিংয়ের স্লিভলেস ব্লাউজ- বেশ চোখে লাগে। সেটা মেক আপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুন্ডু বা কস্টিউম ডিজাইনার সঞ্চিতা ভট্টাচার্যের দুর্বলতা, নাকি প্রধান সেক্স সিম্বলকে এরচেয়ে কম আকর্ষক করলে শহুরে দর্শককে খুশি করা যাবে না ভেবে ঝুঁকি নেননি পরিচালক- তা অবশ্য বলা মুশকিল।
তবে যে কোনও সৃজনেই খুঁত তো কিছু থাকবেই। এবং ম্যাকবেথের মতো ক্লাসিক নিয়ে কাজ করলে দর্শকদের তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হবার আশা করা অধুনা বাংলা বিজ্ঞাপনে শুদ্ধ ভাষা দেখতে চাওয়ার মতোই দুরাশা। কিন্তু, নির্মাণের পিছনে যে চিন্তা, নিষ্ঠা, শিক্ষা ও সততা অনির্বাণ দেখিয়েছেন, তা আধুনিক বাংলায় আরও বিরল। সব শেষে, অনির্বাণ ভট্টাচার্যের কাছে দর্শক হিসেবে একটাই বিনীত অনুরোধ, আপনি আরও পরিচালনা করুন। চারিদিকে মধ্যমেধার এই ইতর উদযাপনের মধ্যে আপনার মতো একটা নির্মম, শানিত, ঝকঝকে তলোয়ার নিয়তি না হোক, অন্ততঃ আয়না হিসেবে বড্ড জরুরি।
*ছবি সৌজন্য: anirbanactor.com, wikiwiki.in, imdb.com, youtube
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিতিবিরক্ত হতে হতেও আইটি শিল্পতালুকে মজদুরি করতে বাধ্য হন। কিন্তু সবচেয়ে পছন্দের কাজ হাতে মোবাইলটি নিয়ে আলসেমি করে শুয়ে থাকা। চেহারাছবি নিরীহ হলেও হেব্বি ভালোবাসেন অ্যাকশন ফিলিম, সুপারহিরো আর সাই ফাই। সঙ্গে চাই সুরেশের রাবড়ি, চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা-পান্তুয়া, কেষ্টনগরের সরভাজা ইত্যাদি নানাবিধ মিষ্টান্ন।
সহমত। প্রচুর সাড়া জাগিয়ে নতুন চিত্রভাষা, প্রয়োগে পরিচালক অনির্বাণকে অনন্য মাত্রায় প্রতিষ্ঠা করে। অতিরিক্ত অলঙ্কার যেমন প্রকৃত সৌন্দর্যকে ক্ষুণ্ণ করে, তেমন এই সিরিজের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করলাম। চারটে এপিসোড দেখে, বাকিটা দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। মুখ্য চরিত্রটি যে কে বোঝা যায় না, আর তার কষ্টে দর্শক একাত্ম হওয়ার সুযোগ পায় না।
নতুন লোকেশন, বেশ কিছু নতুন মুখ এক নতুন আশা জাগিয়ে রাখে। অনির্বাণের পরের কাজের দিকে তাকিয়ে।