লতা মঙ্গেশকরের বহুমুখী সঙ্গীত আহরণ, তাঁকে যেমন সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত গায়কী দিয়েছিল, তেমনই করে তুলেছিল সঙ্গীত পরিচালকদের ভরসাস্থল। কিন্তু ধাপে ধাপে ঘটে এই উত্থান এবং হিন্দি গানের সম্রাজ্ঞীর আসনটি অর্জন করতে প্রথম রেকর্ড থেকে তাঁকে বেশ কয়েকবছর প্রতীক্ষা করতে হয়েছে। তবে এই পর্বে লতা ছিলেন সতত সক্রিয় এবং ক্রমিক উৎকর্ষের দিশারি। গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে লতা মঙ্গেশকরের যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছয় এবং সাতের দশকেও অব্যাহত ও ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ১৯৫১ সালে দুই নতুন সুরের কান্ডারির সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের দীর্ঘমেয়াদি যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটে। তাঁরা হলেন রোশনলাল ও খৈয়াম।
রঞ্জিত মুভিটোন–এর জিয়া সারহাদি পরিচালিত ‘হামলোগ’–এ লতার কণ্ঠে পাচঁটি অনবদ্য গানের মধ্যে জনপ্রিয় হয় উদ্ধবকুমার রচিত, রোশন সুরারোপিত ‘বহুত বুরা হ্যায় হাল তেরে মজবুর কা’, ‘বহেঁ অখিয়োঁ সে ধার জিয়া মেরা বেকারার’, ‘চলি যা চলি যা চলি যা, ছোড় কে দুনিয়া’। ওই বছর ডার্লিং ফিল্মস–এর ছবি ‘মলহার’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই ছবিতে বিভিন্ন ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছিলেন মতি সাগর, শাম্মি, অর্জুন, উমা দত্ত, ইন্দিরা বনসল, জনি ওয়াকার, শেখর প্রমুখ। ফিল্মে, লতা-মুকেশের গাওয়া দ্বৈত-গান আজও সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের মুখে মুখে ফেরে। রোশন–এর অপূর্ব সৃষ্টি ‘বড়ে অরমানোঁ সে রখা হ্যায় বলম তেরি কসম’, ‘ইক বার অগর তু কেহ দে তু হ্যায় মেরি’, ‘কাহাঁ হো তুম জ়রা আওয়াজ দো’, লতা-মুকেশের সেরা ডুয়েটগুলির মধ্যে অন্যতম। কাহারবা তালে আধারিত লতা কণ্ঠের সোলো ‘মহব্বত কি কিসমৎ বনানে সে পেহলে’ (লিখেছিলেন ক্যইফ ইরফানি) এই ফিল্মের এক দুর্লভ রত্ন হিসেবে গণ্য করা হয়।

অশোককুমার, নলিনী জয়ন্ত, জগদীশ শেঠী, কুলদীপ কৌর, রণধীর, বদ্রিপ্রসাদ, শিবরাজ প্রমুখ শিল্পীদের অসাধারণ অভিনয়ের সাক্ষী হিসেবে রয়ে গিয়েছে ‘নৌবাহার’ ফিল্মটি। ১৯৫২ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে লতাকণ্ঠের অনন্যসাধারণ ব্যবহার দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, রোশনের সুরে। নকসব জারচবি রচিত ‘ভটকে হুয়ে মুসাফির মঞ্জিল কো ঢুঢঁতে হ্যাঁয়’ লতাকণ্ঠের এক অনুপম নিবেদন। লতার গাওয়া এই ফিচারের অন্যান্য নগমাগুলি যেমন ‘উনকে বুলাওয়ে পে ডোলে মেরা দিল’, ‘আ কাঁহা হ্যায় তু কাঁহা হ্যায়’, ‘দেখোজি, মেরা জিয়া চুরায়ে লিয়ে যায়ে’, ‘না ম্যাঁয় জানু আরতি বন্দন’ আজও সঙ্গীতপিপাসুদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে সঞ্চিত রয়েছে।
আখতার হুসেন পরিচালিত, নার্গিস আর্ট কনসার্নের ছবি ‘প্যায়ার কি বাঁতে’ জনসমক্ষে সাড়া ফেলেছিল। এই ছবিতে প্রাণবন্ত অভিনয়ের নিদর্শন রাখেন নার্গিস, ত্রিলোক কাপুর, রশিদ খান, মারুতি, কুক্কু, প্রাণ ও আরো অনেকে। ছবিতে খাবর জঁমার অনুপম বাণী লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে এমন এক সাংগীতিক উচ্চতা লাভ করেছিল, যা এখনও মনে রেখেছেন উর্দু সাহিত্যের অনুরাগীরা। নবীন কম্পোজার খৈয়ামের সুরে এই গান দুটি লতারও নিজের পছন্দের তালিকায় ছিল। নজম দুটি – ‘হুয়ে হ্যাঁয় মজবুর হো কে অপনোঁ সে দূর’ ও ‘অব কাঁহা যাঁয়ে কি অপনা মেহেরবাঁ কোই নঁহি’।
ফলি মিস্ত্রি নির্দেশিত ফিল্ম ‘সাজ়া’–তে অনবদ্য অভিনয়ের নিদর্শন রেখেছিলেন দেব আনন্দ, নিম্মি, ললিতা পাওয়ার, কে এন সিং, শ্যামা ও দুর্গা খোটে। এই ছবিতে সুরের যাদুকর শচীন দেববর্মন তাঁর সুরের জাদুতে মাতোয়ারা করে তুললেন দেশবাসীকে। ছবিতে, লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠলালিত্যের উদাহরণস্বরূপ চারটি সোলো গান ছিল। চূড়ান্ত জনপ্রিয় হয় দাদরা তালে আধারিত, ‘তুম না জানে কিস যাঁহা মেঁ খো গ্যয়ে, হাম ভরি দুনিয়া মেঁ তনহা হো গ্যয়ে’। এছাড়া, ‘হাম পেয়ার কি বাজি হারে’, ‘ধক ধক ধক জিয়া করে ধক’, আহাহা হো গই রে তেরি হো গই’ তখন রেডিওতে তুমুল জনপ্রিয় হয়। তালাত মেহমুদের সঙ্গে ডুয়েট ‘ও আজা আজা তেরা ইন্তজার হ্যায়’ চমৎকার লিখেছিলেন প্রতিভাবান গীতিকার রাজেন্দ্রকৃষ্ণ। এই ফিল্মের আর একটি ডুয়েট লতা পরিবেশন করেছিলেন প্রমোদিনী দেশাইয়ের সঙ্গে।

রাম দরিয়ানি পরিচালিত ছবি ‘তরানা’ বেশ বড় বাজেটের ভেঞ্চার ছিল। এই ছবিতে মনপ্রাণ ঢেলে অভিনয় করেন দিলীপকুমার, মধুবালা, শ্যামা, জীবন, গোপ, বিক্রম কাপুর প্রমুখ। অসাধারণ সাংগীতিক মেধার পরিবেশনায় অনিল বিশ্বাস হয়ে ওঠেন সুরের জগতের এক মুকুটহীন সম্রাট। ফিল্মে, লতার গাওয়া আটটি গানই প্রশংসার দাবি রাখে। তালাত মেহমুদের সঙ্গে দুটি ডুয়েট– ‘সিনে মেঁ সুলগতে হ্যায়ঁ অরমাঁ’ এবং ‘নয়ন মিলে নয়ন হুয়ে বাওরে’ আজও লতা –তালাত ডুয়েটের টপ চার্টে রয়েছে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মাইক্রোফোন ভাগ করে নিয়েছিলেন এই ফিল্মে লতা মঙ্গেশকর। ‘বোল পপিহে বোল রে, হ্যায় কৌন মেরা চিতচোর’–এর ৭৮ পাক শেল্যাক এখনও সন্ধান করেন সঙ্গিতপিপাসু রেকর্ড কালেক্টারেরা। এই ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া একক গানগুলি সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। গানগুলি হল– ‘ওয়াপস লে লে ইয়ে জওয়ানি ও জওয়ানি দেনেওয়ালে’, ‘ক্যায়া খবর থি কি মহব্বত মেঁ ইয়ে দিন আতে হ্যাঁয়’, ‘মোসে রুঠ গয়ো মোরা সাঁওয়ারিয়া’, ‘বেইমান তোরে নয়নওয়া নিন্দিঁয়া না আয়ে’, ‘ইঁয়ু ছুপ ছুপ কে চুপকে চুপকে মেরা আনা’।

ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের সুরে লতা কণ্ঠে একটি উৎকৃষ্ট নজম জনপ্রিয় হয় ১৯৫২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আধিঁয়া’ ছবির হাত ধরে। নরেন্দ্র শর্মা রচিত এই দর্দভরা নগমার সাংগীতিক পরিবেশনের মাধ্যমে লতা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, যে এই ধরনের প্রয়োগে তিনি কতখানি স্বচ্ছন্দ। গানটি ছিল– ‘হ্যায় কহিঁ পর শাদমানি অউর কহিঁ নাশাঁদিয়া’। হিন্দি শায়েরির মুখ্য অঙ্গ হিসেবে অলঙ্কারের বিশেষ প্রয়োগ ও অসাধারণ ব্যবহার এই গানকে করে তুলেছিল চমকপ্রদ। অন্তরার কথাগুলি প্রমাণ করে নায়িকার চিত্তচাঞ্চল্য ও বিরহের করুণ ব্যথার অনুভব। কথাগুলি পাঠককে শোনাই–
‘আয়ি অ্যায়সি আধিঁয়া বুঝ গ্যয়া ঘর কা চিরাগ,
ধুল নঁহি সকতা কভি জো পড় গ্যয়া আঁচল মেঁ দাগ
থে কাঁহা অরমান উস দিল কো মিলি বরবাদিঁয়া
জিন্দেগি কে সবজ্ দামন মেঁ কভি ফুলোঁ কে বাগ,
জিন্দেগি কে সুরখ্ দামন মেঁ কভি কাটোঁ কে দাগ,
ফুল কাটোঁ সে ভরি হ্যাঁয় জিন্দেগি কি ওয়াদিঁয়া।’
গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের প্রথম ভাগে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া অতুলনীয় গানের ভাণ্ডার যেসব হিন্দি ছবিকে সমৃদ্ধ করেছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির তালিকা নীচে দেওয়া হল–
‘আলবেলা’ (১৯৫১, সুরকার– সি রামচন্দ্র)
‘আওয়ারা’ (১৯৫১, শংকর জয়কিষণ)
‘বিখরে মোতি’ (১৯৫১, গুলাম মহম্মদ)
‘বুজ়দিল’ (১৯৫১, শচীন দেববর্মন)
‘দিদার’ (১৯৫১, নৌশাদ),
‘ঢোলক’ (১৯৫১, শ্যামসুন্দর),
‘এক নজর’ (১৯৫১, শচীন দেববর্মন),
‘গজব’ (১৯৫১, নাশাদ),
‘কালি ঘটা’ (১৯৫১, শংকর জয়কিষণ),
‘খাজানা’ (১৯৫১, সি রামচন্দ্র),
‘লচক’ (১৯৫১, মোতিরাম),
‘মুরলীওয়ালা’ (১৯৫১, সুধীর ফাড়কে),
‘মালতী মাধব’ (১৯৫১, সুধীর ফাড়কে),
‘মধহোশ’ (১৯৫১, মদনমোহন),
‘নাগিনা’ (১৯৫১, শংকর জয়কিষণ),
‘শোখিঁয়া’ (১৯৫১, জামাল সেন),
‘উস্তাদ পেড্রো’ (১৯৫১, সি রামচন্দ্র)
‘আনন্দমঠ’ (১৯৫২, হেমন্তকুমার)
‘অন্নদাতা’ (১৯৫২, মহম্মদ শফি)
‘বদনাম’ (১৯৫২, বসন্ত প্রকাশ)
‘বৈজু বাওরা’ (১৯৫২, নৌশাদ)
‘চমকি’ (১৯৫২, মান্না দে)
‘দিওয়ানা’ (১৯৫২, নৌশাদ)
‘হাঙ্গামা’ (১৯৫২, সি রামচন্দ্র),
‘জাল’ (১৯৫২, শচীন দেববর্মন)
‘নজরিয়া’ (১৯৫২, ভোলা শ্রেষ্ঠ)
‘পরছাঁই’ (১৯৫২, সি রামচন্দ্র)
‘আগোশ’ (১৯৫৩, রোশন),
‘আহ্’ (১৯৫৩, শংকর জয়কিষণ)
‘আনারকলি’ (১৯৫৩, বসন্ত প্রকাশ ও সি রামচন্দ্র)
‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩, সলিল চৌধুরী)
‘ফরেব’ (১৯৫৩, অনিল বিশ্বাস),
‘ফরমাইশ’ (১৯৫৩, হুসনলাল ভগতরাম)
(চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, NDTV, Indiannation, Rediff
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।
সন্জু, খুব ভাল লাগল পড়ে