লতা মঙ্গেশকরের গান যেন আকাশে ইন্দ্রধনুর ছটা, একাধারে রঙিন, মায়াময়, অন্যদিকে অতুলনীয়, অননুকরণীয়। আর সেই প্রাণচঞ্চলতায় ভর করে আপাত শান্ত, সমাহিত মানুষটি গেয়ে ফেলেছেন কয়েক হাজার গান। যে বিপুল বৈচিত্র তিনি তাঁর গায়নে ধরে রেখেছেন, তাঁর সাধনা ছুঁয়ে ফেলল সুরের আকাশের সমস্তটা। লতা মঙ্গেশকর তাই মহারাষ্ট্রে জন্মেও, আসলে ভারতবর্ষ নামক দেশটিরই এক উজ্জ্বল রত্ন। এই দেশের সামগ্রিক সংগীতের ইতিহাসই সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁকে পেয়ে, তাঁর কণ্ঠ-ঐশ্বর্য লাভ করে। তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত গানের অবিরাম ধারা সঙ্গীতপিপাসু মনকে আজীবন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সুখের সাগরে। যে গানে নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তেও সেই গান ছিল তাঁর এক মাত্র আশ্রয়।
লতা মঙ্গেশকরের মিউজিকাল কেরিয়ারে ১৯৪৯ সালটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি মনে করতেন ওই বছরটি তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ভারতবিখ্যাত সুরস্রষ্টা নৌশাদ আলি, মেহেবুব প্রোডাকসন্স –এর ফিচার ফিল্ম ‘আন্দাজ’-এর জন্য ব্যবহার করলেন লতাকণ্ঠ নিঃসৃত সাতটি চমৎকার মেলোডিনির্ভর গান। তৎকালীন যুগের হার্টথ্রব নার্গিস–এর লিপ-সিংকে অমর হয়ে ওঠা ‘উঠায়ে যা উনকে সিতম’ (রেকর্ড নং – N 35771) সমগ্র দেশের প্রাণের সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল। দাদরা তালে আধারিত এই গানে বিরহ যন্ত্রণার প্রত্যক্ষ ছবি ফুটিয়ে তুলেছিল নৌশাদ সাহেবের অনুপম সুরমূর্ছনা। কবিবর মজরুহ সুলতানপুরীর কলমে জীবন্ত হয়ে ওঠে অন-স্ক্রিন নায়িকার নিদারুণ মর্মব্যাথা। গানটি এরকম:
‘উঠায়ে যা উনকে সিতম অউর জিয়ে যা,
ইঁয়ুহি মুস্কুরায়ে যা, আসুঁ পিয়ে যা।
ইয়েহি হ্যায় মহব্বত কা দস্তুর অ্যয় দিল,
উয়ো গম দে তুঝে তু দুয়ায়েঁ দিয়ে যা।
কভি উয়ো নজর যো সমাই থি দিল মেঁ,
উসি এক নজর কা সাহারা লিয়ে যা।
সতায়ে জমানা সিতম ঢায়ে দুনিয়া,
মগর তু কিসি কি তমন্না কিয়ে যা।’
ফিল্মে, মহম্মদ রফির সঙ্গে লতার ডুয়েট, ‘ইয়ুঁ তো আপস মেঁ বিগড়তে হ্যাঁয় খফা হোতে হ্যাঁয়’ দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। লতা-কণ্ঠের চমকপ্রদ পরিবেশন, ‘তোড় দিয়া দিল মেরা তুনে অরে বেওয়াফা, মুঝকো মেরে পেয়ার কা খুব ইয়ে বদলা দিয়া’ আজও সঙ্গীতবোদ্ধাদের হৃদয়ে এক ভালোলাগার আবেশ বয়ে নিয়ে আসে। মজার ব্যাপার, এই ছবিতে মুকেশ তাঁর কণ্ঠটি ধার দিয়েছিলেন দিলীপকুমারকে ও রফি গেয়েছিলেন রাজ কাপুরের জন্য, যা পরবর্তীকালে উল্টে গিয়েছিল। মুকেশ হয়ে উঠেছিলেন রাজ কাপুরের এক্সক্লুসিভ ভয়েস।

নৌশাদের সুরের পারফেকশনের জাদুতে মজে গিয়েছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। সুরকার হিসেবে তিনি সর্বদাই চাইতেন প্রতিটি গানের নিখুঁত রেকর্ডিং। ‘আন্দাজ’ ছবির পর সেই বছরই নৌশাদের সুরে লতাকণ্ঠ শোনা যায় কারদার প্রোডাকশন্স–এর হিট ফিল্ম ‘দুলারি’-তে। এই ছবিতে বিভিন্ন ভূমিকায় ছিলেন সুরেশ, মধুবালা, গীতাবালী, জয়ন্ত, প্রতিমা দেবী, শ্যামকুমার প্রমুখ। শাকিল বদায়ুনীর কথায় এই ফিচারে আমরা পাই লতাকণ্ঠে বিরচিত নয়টি অনন্যসাধারণ গান, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘তকদির জগাকর আয়ি হুঁ’, ‘কৌন শুনে ফরিয়াদ হমারি’, ‘মুহব্বত হমারি জমানা হামারা’, ‘না ও হমসে জুদা হোঙ্গে’, ‘অ্যায় দিল তুঝে কসম হ্যায়’, ‘মিল-মিল কে গায়েঙ্গে হো হো দো দিল ইয়াহাঁ, এক তেরা এক মেরা’ (মহম্মদ রফির সঙ্গে), ‘আঁখো মেঁ আ যা দিল মেঁ সমা যা, মেরি কাহানি সুন যা অপনি সুনা যা’, ‘রাত রঙ্গিলি মস্ত নজারে, গীত সুনায়ে চাদঁ-সিতারে’ (মহম্মদ রফির সঙ্গে)। এই ফিচারের জনপ্রিয় গানের ভাণ্ডার সমগ্র দেশবাসীর হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। নৌশাদ হয়ে উঠলেন সকল সুররসিক মানুষের নয়নের মণি। তাঁর সুরের সহজভাব, অনবদ্য চলন প্রক্রিয়া আপামর সঙ্গীতপ্রেমী জনতার মনের চাহিদা মিটিয়েছিল নিপুণভাবে।

হিন্দি ছবির জগতে সেই সময় হুসনলাল-ভগতরাম এক ট্রেন্ডসেটার জুটি। রাম নারায়ণ দভে পরিচালিত ছায়াছবি ‘বাঁসুরিয়া’ ছিল বড় বাজেটের ভেঞ্চার। ফিল্মে অনবদ্য অভিনয়ের সাক্ষর রেখেছিলেন গীতা বালি, রণধীর, ওমপ্রকাশ, কুলদীপ, উমা দত্ত ও আরও অনেকে। এই ছবির তিনটি গান লতাকণ্ঠে এক অনন্যসাধারণ উচ্চতা স্পর্শ করে। মুল্করাজ ভাখড়ির লেখা গান তার উৎকর্ষের চরম সীমায় পৌঁছেছিল। তার মধ্যে একটি:
‘ইয়ে দুনিয়া কেহতি হ্যায়
কোই ফরিয়াদ না করে,
কিসি কো ইয়াদ না করে।
কোই সুনতা নহি অপনি
সুনায়ে কিসকো ইয়ে দুখড়ে,
দিখায়ে কিসকো যা কর
ইস দিল-এ-বরবাদ কে টুকড়ে’
গুণী কম্পোজার শ্যামসুন্দরের সঙ্গে লতার প্রথম পরিচয়ের ঘটনা খুব সুখের হয়নি। মাস্টার বিনায়কের কোম্পানিতে কাজ করার সময় কোনও একদিন নবীন গায়িকা লতার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় শ্যামসুন্দরের সঙ্গে। অহঙ্কারী মানুষ শ্যামসুন্দর তেমন পাত্তাই দেননি সেই দিন ভবিষ্যতের সুরসম্রাজ্ঞীকে। লতাকে গান-বাজনা জগতের মানুষ বলে মনে করেননি ওই সুরকার। পরে শ্যামসুন্দরের সু্রসৃষ্টি লতার অসাধারণ কণ্ঠমাধুর্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল জইমিনি দিওয়ান প্রোডাকসন্স –এর ‘লাহোর’ ছায়াছবিতে। ফিল্মটি জনসমক্ষে সাড়া ফেলেছিল মূলত করণ দেওয়ান ও নার্গিসের প্রাণবন্ত অভিনয়ের দৌলতে। অন্যান্য অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন প্রতিমা দেবী, কুলদীপ, ওম প্রকাশ, রণধীর, বালকরাম, রাম অবতার।

ওই ছবিতে লতা–করণ দেওয়ান পরিবেশন করেছিলেন দুটি মধুর দ্বৈতসঙ্গীত যা আজও মানুষের মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত রয়েছে। ‘সুন লো সজন মেরি বাত’, ‘দুনিয়া হমারে পেয়ার কি ইয়ুঁহি জওয়াঁ রহে’… কিংবদন্তী গীতিকার রাজেন্দ্রকৃষ্ণের লেখা এইসব গানগুলির কথা ছবির গরিমা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ব্যক্তিগত স্তরে লতার গাওয়া এই ফিল্মের চারটি সোলো আমার বিশেষ পছন্দের। সেগুলি হল: ১) ‘নজর সে দূর জানেওয়ালে দিল সে দূর না করনা’, ২) ‘উস দিল কি কিস্মত কেয়া কহিয়ে জিস দিল কা সাহারা কোই নহি’, ৩) ‘এক আস বধাঁয়ে জাতি হ্যায় এক আস মিটায়ে যাতি হ্যায়’ ৪) ‘টুটে হুয়ে অরমানোঁ কি ইক দুনিয়া বসায়ে’।
হিন্দি ফিল্ম সংগীতের ইতিহাসে শোম্যান রাজ কাপুর পরিচালিত ছবি ‘বরসাত’–এর গান একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে শ্রোতাদের দরবারে। আর কে ফিল্মসের ব্যানারে পরিস্ফুট এই ফিল্ম ও তার সঙ্গীত আজও জনপ্রিয়তার শিখরে রয়েছে। তরুণ তুর্কি শঙ্কর-জয়কিষণের সুরসৃষ্টি, শৈলেন্দ্র ও হসরত জয়পুরির লেখা গানের কথা; রাজ কাপুর, নার্গিস, প্রেমনাথ, বি এম ব্যাস, কে এন সিং, সুশীলা দেবীর অনবদ্য অভিনয়ের ছটা এই ফিচারকে সাফ্যলের উচ্চাসনে বসিয়েছিল বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের গোড়া থেকেই। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া গান এই ছবির সম্পদ হিসেবে গণ্য হয় আজও। ‘জিয়া বেকারার হ্যায় ছাই বাহার হ্যায়, আ যা মোরে বালমা তেরা ইন্তেজার হ্যায়’ এই ফিল্মের সিগনেচার টিউন হিসেবে গানপাগল মানুষের মননে জায়গা পাকা করে নিয়েছে। গানের অন্তরার সুর ও কথা, নায়িকার মানসিক অস্থিরতা এবং সারল্যের এক অসাধারণ সংমিশ্রণ হয়ে সামনে দেখা দিয়েছিল। কথাগুলি হল:
‘ও সুরজ দেখে চন্দা দেখে সব দেখে হম তরসে হো,
য্যায়সে বরসে কোই বদরিয়া অ্যায়সে অখিয়াঁ বরষে
ও ন্যায়নোঁ সে এক তারা টুটে মিট্টি মেঁ মিল যায় হো,
আসুঁ কি বরসাত বলমওয়া দিল মেঁ আগ লগায়ে
ও তুঝকো নজরেঁ ঢুঢঁ রহি হ্যায় মুখড়া তো দিখলা যা হো,
রস্তে পর হুঁ আস লগায়ে আনেওয়ালে আজা’
‘বরসাত’ ফিল্মে লতার গাওয়া আরেকটি বহুশ্রুত গান ‘হাওয়া মেঁ উড়তা যায়ে মোরা লাল দুপট্টা মলমল কা” (লিখেছিলেন রমেশ শাস্ত্রী) পপুলারিটি চার্টের নিরিখে আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান অধিকার করে রেখেছে। এই ছবিতে লতার অন্যান্য গান বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের মন মাতিয়েছে। গানগুলি হল– ‘পতলি কমর হ্যায় তিরছি নজর হ্যায়’(মুকেশের সঙ্গে ডুয়েট), ‘ও মুঝে কিসি সে পেয়ার হো গ্যয়া’, ‘ছোড় গয়ে বালম মুঝে হায় অকেলা ছোড় গয়ে’ (মুকেশের সঙ্গে ডুয়েট), ‘মেরি আখোঁ মেঁ বস গ্যয়া কোই রে’ ইত্যাদি। (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৬ এপ্রিল ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Facebook, Hindustan Times, The Bihar Post, IMDB, News 18
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।