আগের পর্ব পড়তে: 
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ১  সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ২ সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৩ সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৪ সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৫ সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৬ সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৭ সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৮ সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৯  সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ১০  সুরসম্রাজ্ঞী ১১

লতা মঙ্গেশকর নামটি তামাম বিশ্বের সঙ্গীতপ্রেমীর মনেপ্রাণে নির্মল বাতাসের মতো বয়ে নিয়ে আসে অফুরন্ত ভালোবাসার আবেশ, যা চিরকালীন। অসংখ্য গানের কলি মনে গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে ওই একটি নাম শুনলেই। গানপাগল শ্রোতাদের মনকে পৌঁছে দেয় পরিপূর্ণতার শিখরে। হৃদয়ের অন্তরে মনভ্রমরার গুনগুন শুরু হয়ে যায়, আকাশে এক লহমায় গানের ইন্দ্রধনু ফুটে ওঠে। বেশ কয়েক দশক জুড়ে হিন্দি ফিল্মসঙ্গীত তাঁর কণ্ঠের মায়াজালে আটকে পড়েছে। তাঁর গাওয়া গান এখনও একটা গোটা জাতির অনন্য সম্পদ হিসেবে রয়ে গিয়েছে। তাঁর গানে স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের শ্রোতারা, শিখেছেন ভালবাসার গভীরতা বুঝতে। আর তাই আনন্দে, বিরহে বারবার লতারই আশ্রয় খুঁজেছেন সকলে।

৭০-দশকের গোড়ায় আমরা পেলাম লতা কণ্ঠে কিছু অনন্যসাধারণ রত্ন যার সম্ভার আজও আমার মনে সঞ্চিত রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়া হিন্দি ফিচার ‘আপ আয়ে বাহার আঈ’ পরিচালনা করেছিলেন মোহনকুমার। রাজেন্দ্রকুমার, সাধনা, মুমতাজ বেগম, রাজ মেহেরা, রাজেন্দ্রনাথ, প্রেম চোপড়া অভিনীত এই ফিল্মের সম্পদ ছিল তার মনমাতানো সঙ্গীত। লতা-রফির ডুয়েট ‘মুঝে তেরি মহব্বৎ কা সাহারা মিল গ্যয়া হোতা’ (সুরকার– লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল) আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। এই ছবির কিশোর-লতার ডুয়েট ‘তুমকো ভি তো, অ্যায়সা হি কুছ হোতা হোগা ও সজনা’ এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে গণ্য হয় আজও। 

LP and LR
লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের (বাঁয়ে) সঙ্গে গানের মহড়ায় লতা-রফি

এ শমশির নির্দেশিত ছায়াছবি ‘অলবেলা’–তে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন মেহমুদ, নম্রতা, আনোয়ার আলি, আই এস জোহর, রমেশ দেও, অসিত সেন প্রমুখ। শংকর-জয়কিষণের সুরসংযোজনায় লতা কণ্ঠে নিবেদিত কাহারবা তালে বাঁধা গান ‘দেবতা মানা অউর পূজা তেরি তসবির কো’ রেডিওর অনুরোধের আসরের জনপ্রিয় গান ছিল। শক্তি সামন্ত পরিচালিত ছবি ‘অমর প্রেম’ এক যুগান্তকারী সৃষ্টি হিসেবে সিনেমাপ্রেমী মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। এই ফিল্মে লতা কণ্ঠে পরিবেশিত দুটি গান অমর হয়ে আছে বিগত কয়েক দশক ধরে। গুণী কম্পোজার রাহুল দেববর্মনের সুরসৃষ্টি এই ছবিকে নিয়ে গিয়েছিল সফলতার শীর্ষে। যশস্বী গীতিকার আনন্দ বক্সি রচিত গান ‘আ, রেয়না বিতি যায়ে শ্যাম না আয়ে, নিন্দিয়া না আয়ে’ হিন্দি ছবির গানের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। এই ছবির আরেকটি গান ‘বড়া নটখট হ্যায় রে কৃষ্ণ কনহইয়া’ ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের প্রয়োগবিধির এক উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। 

ভার্মা ফিল্মস এন্টারপ্রাইজেস প্রযোজিত ও রবি ট্যান্ডন পরিচালিত ছায়াছবি ‘বলিদান’ বক্স-অফিসে মাঝারি মাপের সফলতা পেয়েছিল। দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মনোজকুমার ও সায়রাবানু। সঙ্গে ছিলেন আনোয়ার হুসেন, দেবকুমার, অসিত সেন, হীরালাল, মনমোহন ও অন্যান্য শিল্পীরা। লতা কণ্ঠের মেলডি নির্ভর গান ‘চলে আও দিল মে বচাকে নজর’ এক অসাধারণ সংযোজন। গানটি লিখেছিলেন প্রখ্যাত গীতিকবি ভার্মা মালিক। শংকর-জয়কিষণের অনবদ্য সুরের চলন এই গানকে চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। 

১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়া, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ফিচার ‘বুডঢা মিল গ্যয়া’ এক মনোরঞ্জক ছবি হিসেবে দর্শকমহলে সমাদৃত। সেখানে লতা কণ্ঠের নিবেদন ‘জিয়া না লাগে মোরা’ এক অনন্যতার পরিচয় দিয়েছিল। রাহুল দেববর্মন সৃষ্ট অনুপম সুরের মায়াজাল এই ফিল্মের মান বাড়িয়ে দেয় অনেকখানি। জিতেন্দ্র, আশা পারেখ অভিনীত, নাসির হুসেনের ছবি ‘কারবাঁ’-ও অলটাইম হিট ফিল্মের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত মূলত গানের জন্যই। এই ছায়াছবির জন্য লতা পরিবেশন করেছিলেন তিনটি চমকপ্রদ গান যা আজও সুপারহিট। গানগুলি– ‘দিলবর দিল সে প্যারে দিলবর’, ‘চড়তি জওয়ানি মেরি চাল মস্তানি’ (মহম্মদ রফির সঙ্গে ডুয়েট), ‘কিতনা প্যারা ওয়াদা হ্যায়’ (মহম্মদ রফির সঙ্গে ডুয়েট)।

ঈগল ফিল্মস প্রযোজিত ছায়াছবি ‘এলান’ সমৃদ্ধ হয়েছিল মূলত বিনোদ মেহরা, রেখা ও বিনোদ খান্নার প্রানবন্ত অভিনয় গুণে। হসরত জয়পুরির লেখা ও শংকর-জয়কিষণের অপূর্ব সুরের ধারা ছিল এই ফিল্মের সম্পদ। লতা কণ্ঠের পরিবেশন ‘ও অঙ্গ সে অঙ্গ লগালে’ দাদরা তালে আধারিত এক নির্মল নিবেদন। গানটির অন্তরার কথাগুলো ধরিয়ে দেয় নায়িকার হৃদয়ের বেদনার সুরটি যা অতি সুচারুরূপে পরিবেশন করেছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী। কথাগুলো দেখা যাক– 

‘বিরহা কা বোঝ ভারি ক্যায়সে উঠায়ুঁ অকেলি,
আ সেজ পে নিঁদ ন আয়ে বাট তকুঁ অলবেলি,
তেরে বিনা ইয়ে জীবন প্রেম কি এক পহেলি,
তেরে হি কারণ হমনে হর বদনামি লে লি’। 

Lata-Mangeshkar-R-D-Burman
বাপ-ছেলে (শচীনদেব-রাহুলদেব) দুজনের সুরেই অসাধারণ সব গান গেয়েছেন লতা

অমরজিৎ পরিচালিত ফিচার ফিল্ম ‘গ্যাম্বলার’ প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মূলত দেবানন্দ, জাহিদা ও জাহিরার প্রানবন্ত অভিনয়ের দৌলতে। এই ছবিতে লতা কণ্ঠের দুটি ডুয়েট বয়ে নিয়ে এসেছিল রোম্যান্টিসিজম–এর অমোঘ ছোঁয়া। কিশোরকুমারের সঙ্গে পরিবেশিত পপুলার গানগুলি ছিল সুপার ডুপার হিট– ‘চুড়ি নহি ইয়ে মেরা দিল হ্যায়’ এবং ‘অপনে হোঠোঁ কি বনসি বনা লে মুঝে’। শোম্যান দেবানন্দ নির্দেশিত ফিল্ম ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণা’ তো জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল। এই ফিচারে দুর্দান্ত অভিনয়ের নিদর্শন রেখেছিলেন দেবানন্দ, জিনত আমন, মুমতাজ়, কিশোর সাহু, ইফতেখার, প্রেম চোপড়া প্রমুখ। রাহুল দেববর্মন এই ছবিতে সুরের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। লতার গলায় অসাধারণ সব মণিমুক্তো পেয়েছিল এ ছবি– ‘ফুলো কা তারো কা’ (রাহুল দেববর্মন–এর সঙ্গে ডুয়েট), ‘ঘুঙরু কা বোলে অ্যায়সা হো’, ‘কাঞ্চি রে কাঞ্চি রে’ (কিশোরকুমারের সঙ্গে ডুয়েট)। 

দাদরা তালে বাঁধা ‘সুরজ সে যো কিরণ কা নাতা’ লতা-মুকেশ এর দ্বৈত-গান হিসেবে আজও সঙ্গীতবোদ্ধাদের মনে তার জায়গা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। অনজান–এর কথা ও রাহুল দেববর্মনের অভূতপূর্ব সুরের মায়া এই মেলডিনির্ভর রচনাকে দিয়েছিল এক অসাধারণ সাংগীতিক উচ্চতা। ‘হাঙ্গামা’ ফিল্মের এই চমকপ্রদ সংযোজন হিন্দি ফিল্মি সঙ্গীতের এক বিরল অধ্যায়ের প্রতীক। প্রথিতযশা কম্পোজার জুটি শঙ্কর–জয়কিষণ সুরের ঝংকার তুলেছিলেন শক্তি সামন্ত নির্দেশিত ফিল্ম ‘জানে অনজানে’–তে। শাম্মি কাপুর, লীনা চন্দ্রভারকর, সন্ধ্যা রায়, বিনোদ খান্না, হেলেন, কে এন সিং দাপটে অভিনয় করেন এই ছবিতে। লতা কণ্ঠের দুটি গান সেইসময় ভালই এয়ার-প্লে পেয়েছিল। ‘তেরি নীলি নীলি আঁখো কে’ (মহম্মদ রফির সঙ্গে ডুয়েট) ও ‘মোহে জাল মেঁ ফসায়ে লিও’ (কোরাস-সহ)।

এবার বলতে হয়, মহল পিকচার্স–এর ব্যানারে পরিস্ফুট কমল আমরোহির যুগান্তকারী ফিল্ম ‘পাকিজা’-র কথা। মুক্তি পেয়েছিল ৭০-দশকের গোড়ায়। ছবিতে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেন মীনাকুমারী, অশোককুমার, রাজকুমার, কমল কাপুর, বীণা, নাদিরা, সাপ্রু প্রমুখ। এই ফিচারের হাত ধরে সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর পৌঁছে গেলেন প্লে-ব্যাক গায়িকা হিসেবে তাঁর কাঙ্খিত লক্ষ্যে। লতা কণ্ঠে পরিবেশিত এই ফিল্মের তিনটি গান ভারতীয় লঘুসংগীতের মার্গে মাইলফলক হিসেবে রয়ে গেল। গানগুলি হল– ‘মৌসম হ্যায় আশিকানা অ্যায় দিল’, ‘চলতে চলতে ইয়ুঁহি কোই মিল গ্যয়া থা’ এবং ‘ইনহি লোগোঁনে লে লি না দুপট্টা মেরা’। 

এরপর শচীন দেববর্মন সুরারোপিত ছবি ‘তেরে মেরে সপনে’-ও তার অসাধারণ গানের জন্য জনতার দরবারে সমাদৃত হয়েছিল। ফিল্মের চারটি গান লতা কণ্ঠের মাধুর্যে এক অনন্য স্তরে পৌঁছোয়। ‘য্যায়সে রাধা নে মালা জপি’, ‘হে ম্যায়নে কসম লি’ (কিশোরকুমারের সঙ্গে ডুয়েট), ‘মেরা অন্তর এক মন্দির হ্যায়’ এবং ‘জীবন কি বগিয়া মেহকেগি লেহকেগি চেহকেগি’ (কিশোরকুমারের সঙ্গে ডুয়েট) আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় সযত্নে সঞ্চিত রয়েছে। এবার ৭০-দশকের প্রথমার্ধে লতা মঙ্গেশকর পরিবেশিত আরও কিছু জনপ্রিয় গানের তালিকায় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক–

‘মেঘা ছায়ে আধি রাত ব্যায়রন বন গই নিন্দিয়া’ (ছবি –শর্মিলি, ১৯৭১)
‘সুনি রে নগরিয়া সুনি রে সজরিয়া’ (উপহার, ১৯৭১)
‘তেরে বিন জিয়া না লগে আজা রে’ (পর্দে কে পিছে, ১৯৭১)
‘তু চন্দা ম্যায় চাঁদনি’ (রেশমা অউর শেরা, ১৯৭১)
‘রাতোঁ কে সায়ে ঘনে’ (অন্নদাতা, ১৯৭২)
‘সুন রি পবন’ (অনুরাগ, ১৯৭২)
‘মোরে ন্যয়না বাহায়ে নীর’ (বাবুর্চি, ১৯৭২)
‘কেহতে হ্যায়ঁ সারে’ (বিশ সাল পেহলে, ১৯৭২)
‘দর্দে দিল বঢ়তা যায়ে’ (বুনিয়াদ, ১৯৭২)
‘পেয়াস লিয়ে মনওয়া’ (মেরে ভইয়া, ১৯৭২)
‘বংলে কে পিছে তেরি’ (সমাধি, ১৯৭২)
‘বাহোঁ মেঁ চলে আও’ (অনামিকা, ১৯৭৩)
‘তন মন তেরে রঙ্গ’ (অর্চনা, ১৯৭৩)
‘তুনে ছিন লিয়া’ (বন্ধে হাত, ১৯৭৩)
‘যব ভি জি চাহে নই’ (দাগ, ১৯৭৩)
‘বেতাব দিল কি তমন্না’ (হন্সঁতে জখম, ১৯৭৩)
‘তু ক্যয়া জানে ওয়ফা’ (হাত কি সফাই, ১৯৭৪)
‘রোজ শাম আতি থি’ (ইমতিহান, ১৯৭৪)
‘অব কে সজন সাবন মেঁ’ (চুপকে চুপকে, ১৯৭৫)
দো নয়নো মেঁ আসুঁ ভরে হ্যায়’ (খুশবু, ১৯৭৫)
‘ইয়ে রাতেঁ নই পুরানি’ (জুলি, ১৯৭৫)।     (চলবে) 

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৯ জুন ২০২২
ছবি ও ভিডিও সৌজন্য: Bollywoodbubble, Youtube

বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *