আমার দক্ষিণ খোলা জানলায়
মাঘের এই অন্তরঙ্গ দুপুর বেলায়
না শোনা গল্প পুরনো
মনে পড়ে যায়
এক দমকা হাওয়ায়…

হ্যাঁ, রূপকথা ও মহুলের জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় যেখানে শুরু হয়েছে সেই ছোট্ট ৮৫০ বর্গক্ষেত্রের ফ্ল্যাটের সাজানো-গোছানো বৈঠকখানায় একখানি দক্ষিণ-খোলা জানলা আছে। বলতে নেই, রূপকথার এই জানলাটিকে নিয়ে বেশ একটা গর্ববোধও আছে। কংক্রিটের জঙ্গলে থেকে এক টুকরো ফ্ল্যাটবাড়িতে আজকাল দক্ষিণের আলো-হাওয়ার আশা কেউ করে নাকি!

রূপকথা সেই দক্ষিণের জানলায় একটা পাখি-ছাপ সাদা পর্দা ঝুলিয়েছে, যাতে পর্দা দিয়ে জানলা ঢাকা থাকলেও ও যেন আকাশটাকে দেখতে পায়।

bird curtain
গরমকালে জানালায় মানানসই পাখি-ছাপ সাদা পর্দা

 — রূপ, দখিনা বাতাস তোমায় মিষ্টি সুরে গান শোনাবে, চাও কি!
— কেন মহুল? কী এনেছ, বল… বল… আমার যে আর তর সইছে না।
— তাহলে চোখ বন্ধ কর।
— করলাম। 

মহুল আজ অফিস-ফেরত গড়িয়াহাটের ফুটপাথ থেকে খুব সুন্দর সুন্দর তিনটে রঙবেরঙের উইন্ড চাইম কিনে এনেছে রূপকথাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে। ও জানে দক্ষিণের এই জানলা নিয়ে রূপকথার কী ভীষণ আদিখ্যেতা! মহুলও চায় বাড়িটা যেন রূপে-রঙে ‘রূপকথার বাড়ি’ হয়ে ওঠে।

— এবার চোখ খোলো।

রূপকথা দেখে টেবিলের উপর কী সুন্দর তিনটে উইন্ড চাইম রাখা আছে! ঘর সাজানোর ছলে ওরা ওদের জীবনটাকেই তো সাজাচ্ছে আসলে।

শহরের বুকে তীব্র দাবদাহ, তাই ছোট্ট নীড়টিকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যেন ঘরে ফিরলেই নিমেষে উবে যায় সারাদিনের ক্লান্তি। সেই জন্যই রূপ সাদা-হলুদ-কমলায় বাড়িটাকে রাঙাতে চায় এই গ্রীষ্মে। সব ঋতুরই একটা রং থাকে। আমাদের দেশে বোশেখের রং উষ্ণ। কিছু সোফা রানার এনেছে ঐ রঙে। রোজকার সোফাকে কিছুটা অন্যভাবে পাওয়া। এই ঋতু ধরে ঘর সাজানো রূপের অন্যতম শখ। দেওয়ালটা একটা নিউট্রাল মুক্তোর রঙে রেখেছে। এতে সুবিধা হল সব রঙের অ্যাক্সেসরিস চলে যায়। দেওয়াল সাজিয়েছে নিজেরই অবসরে এঁকে চলা কিছু ছবি দিয়ে। তাতে সাদা কালো যেমন আছে, তেমনই আছে নানা রঙের দাপট।

yellow white sofa interior

ঘরের কোণে মাটির পটে এঁকে যে দুটো ফুলদানি তৈরি করেছে রূপ, সে দুটোকে ভেবেছে লাল হলুদ সাদা ফুলে সাজিয়ে রাখবে গোটা গরমকাল। সেন্টার টেবিলটাকেও বেশ কটা ছোটবড় হাতে আঁকা রঙিন ট্রে দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে, যাতে রঙের ছোঁয়া সেখানেও পায়। রূপ জানে রঙের কী আশ্চর্য প্রভাব তার মনে পড়ে। কিছু মানিপ্ল্যান্টও রেখেছে ও ছোট ছোট মাটির ভাঁড়ে। মেয়েটা যে খুব মাটির কাছে থাকতে ভালোবাসে।

আরও পড়ুন: ডালিয়ার সহজপাঠ

রূপ ছোট থেকে যেখানে যেখানে গেছে সেখান থেকেই ও নানা ধরনের গণেশের মূর্তি সংগ্রহ করেছে। ওর এতদিনের সঞ্চয় দিয়ে চেস্টের ওপরটাকে ভরিয়ে তুলেছে, পাশেই কিছু সবুজের ছোঁয়া। ঘরের একপাশে সেট করা পর পর কাঠের তাকগুলোতে রেখেছে নিজের পছন্দের লেখকদের বই— ওর জীবনের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। সঙ্গে আছে কিছু  আর্টিফ্যাক্টসও। যেমন অপূর্ব সব ডোকরার সংগ্রহ আছে, তার সঙ্গে বর্ধমানের নতুন গ্রাম থেকে আনা খোদাই করে রং করা কাঠের একজোড়া পেঁচা, যেটা  ও প্রাণে ধরে কোনওদিন কাউকে দিতে পারবে না। পুরুলিয়া থেকে যত্ন করে নিয়ে আসা ছৌ নাচের মুখোশ দুটো দিয়ে ও দরজার ওপরের ফাঁকা দেওয়ালটা সাজিয়েছে। সেবার ওর প্রিয় বন্ধু উৎসা পিংলার শিল্পীদের হাতে আঁকা পটচিত্র ওকে উপহার দিয়েছিল। সেটা ও রেখেই দিয়েছিল এতদিন,ওর নতুন আস্তানাতে বাঁধিয়ে রাখবে বলে।

এইভাবে ছোট বড় নানারঙের মায়ায় সে ভরিয়ে রেখেছে নিজের বৈঠকখানা, যেখানে অতিথিদের সঙ্গে সে তার নিজের পরিচয় করিয়ে দেয়। নিজেকে চেনায়।

Dokra
ডোকরার আর্টিফ্যাক্টস

আপনার গৃহকোণকেও যদি রূপকথা ও মহুলের মতো করে সাজিয়ে তুলতে চান, তাহলে বৈঠকখানার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় টিপস 

১ ) দেওয়ালের রং নিউট্রাল রাখুন, যাতে বাকি জিনিসগুলো যেকোনও কালার স্কিমে কিনতে পারেন। নিউট্রাল মানে সাদার যে কোনও শেড, বা গ্রের যেকোনও শেড।

২) সোফা কেনার সময় সেটা কতটা কোজি, খেয়াল রেখে কিনবেন। খুব বড় এল (L) শেপ না নেওয়াই ভালো। একটা থ্রি সিটারের পাশে বরং ছোট ছোট নানারকম সিঙ্গেল সিটার রাখতে পারেন, তাতে একঘেয়েমিও কাটবে ও গৃহসজ্জায় বৈচিত্র্যও আসবে। 

৩) অবশ্যই পর্দার বা ব্লাইন্ড একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। রং নির্বাচনটা বিশেষভাবে ঘরের সৌন্দর্যের উপর প্রভাব ফেলে। 

৪) বৈঠকখানা বলেই সেখানে আপনি আপনার সৌন্দর্যবোধ প্রকাশের সুযোগ পাবেন। তাই সুন্দর সুন্দর আর্টিফ্যাক্টসগুলো প্লেস করার মতো সাইড টেবিল বা র‍্যাক বা ড্রয়ার-চেস্ট দিয়ে ঘরকে ভরবেন। 

৫) সোফার উপর মাঝে মাঝে কিছু কালারফুল রানার ও তার সঙ্গে রং মিলিয়ে বা কনট্রাস্টে কুশন কভার  দিয়ে সাজালে পুরনো ঘরটাই নতুন হয়ে ওঠে। 

৬) আর একটা জিনিস, শীত ও গ্রীষ্মে ফ্লোরম্যাটের অদলবদল করেও ঘরের রূপ বদলে দেওয়া যায়।

 

 

ছবি সৌজন্য: Wallpaper Flare, Needpix

Susmita Dutta

সুস্মিতা (চৌধুরী) দত্ত পেশাগত পরিচয়ে পোশাক পরিকল্পক। ভালবাসেন ছবি আঁকতে, চিত্রকলা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সিনেমা ও গ্রুপ থিয়েটার নিয়েও আগ্রহ রয়েছে। যুক্ত রয়েছেন নানা সামাজিক কল্যাণমূলক কাজকর্মের সঙ্গে। আর অবসর সময় কাটে সাহিত্যচর্চা ও বাগান করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *