চলার পথে
হালে ‘Indian diaspora’ কথাটা প্রায়ই দেখি নানা নিবন্ধে। এই diaspora শব্দটির আক্ষরিক অর্থে কোনও সমার্থক বাংলা শব্দ অবশ্য আমার জানা নেই। ইংরেজি অভিধান বলছে diaspora হল কোনও বিশেষ দেশের মানুষের দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা জনগোষ্ঠী।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের পৃথিবীর নানা দেশে বাস। সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলতে পারি সংখ্যাটা আড়াই থেকে তিন কোটি। বিষয়টি নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক গবেষণা করা যেতে পারে — কোনও এক পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করব এই ভারতীয় diaspora নিয়ে।
১৯৯০ সালে যখন অস্ট্রেলিয়াতে অভিবাসী হয়ে আসি, এদেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। অন্যভাবে বললে, প্রতি ৪০০ জন অধিবাসীর মধ্যে একজন। রাস্তাঘাটে ভারতীয় চেহারার কাউকে দেখলে যেচে আলাপ করতাম।
বর্তমানে সংখ্যাটা সাড়ে সাত লক্ষ এবং ক্রমবর্ধমান। নতুন অভিবাসীদের ২০ শতাংশ ভারতীয়। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে প্রতি ৩০ জনে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। বলাই বাহুল্য, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ আর করি না। মানে করার দরকার পড়ে না । ক্যানবেরার মতো ছোট শহরেও Indian Australian-দের জমজমাট সামাজিক জীবন।

বেশ কয়েকটি দেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একটা ভিন্ন ভাষা, অপরিচিত সাংস্কৃতিক পরিবেশের নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে সমঝোতা করে নতুন জীবন শুরু করাটা প্রায়শই সহজ নয়। অবশ্য প্রত্যেক অভিবাসীর অভিজ্ঞতাই অন্যরকম। সবার কথা তো জানি না, নিজের চলার পথের বলার মতো কাহিনিগুলোই শোনাব।
আমার পরিবারের ইতিহাস যতটুকু জানি, আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। দেশভাগের সময়ে (এবং পরবর্তীকালেও) ওপার বাংলার অসংখ্য মানুষের মতো নিরুপায় হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে প্রায় সহায়সম্বলহীন অবস্থায় র্যাডক্লিফ সাহেবের টানা সীমান্তরেখা পার হয়ে নতুন জীবন শুরু করতে হয়নি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও গল্প-উপন্যাসে, পরিচিত মানুষের মুখে সেই কঠোর সংগ্রামের নানা গল্প শুনেছি।
অস্ট্রেলিয়ায় স্বেচ্ছায় অভিবাসী হয়ে আসার শুরুর দিনগুলোতে থেকে থেকে মনে একটা প্রশ্ন জাগত– উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আমার মতো স্বল্প পুঁজি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়া মানুষদের খুব একটা পার্থক্য আছে কি? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বেশ কয়েক বছর ধরে অনেক রকম লড়াই করতে হয়েছে পায়ের তলায় মাটি পেতে।
চার্লস ডিকেন্সের ‘Hard Times’ উপন্যাসে Mr Bounderby নামে একটি চরিত্র ছিল। থেকে থেকেই ভদ্রলোক বলতেন: “I am a self-made man”। কথাটা ডাহা মিথ্যে, সফল জীবনের নেপথ্যে ওঁর মায়ের অনেক ত্যাগের কথা বেমালুম চেপে যেতেন ভদ্রলোক।
আমার পরিবারের ইতিহাস যতটুকু জানি, আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। দেশভাগের সময়ে (এবং পরবর্তীকালেও) ওপার বাংলার অসংখ্য মানুষের মতো নিরুপায় হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে প্রায় সহায়সম্বলহীন অবস্থায় র্যাডক্লিফ সাহেবের টানা সীমান্তরেখা পার হয়ে নতুন জীবন শুরু করতে হয়নি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও গল্প-উপন্যাসে, পরিচিত মানুষের মুখে সেই কঠোর সংগ্রামের নানা গল্প শুনেছি।
অগ্রজ বন্ধু পার্থ ভট্টাচার্য’দার মুখে শুনেছি, ওঁর শৈশবকালে ওঁদের বৌবাজারের অপরিসর ভাড়া বাড়িতে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বহু আত্মীয়-স্বজন আশ্রয় পেতেন। পরবর্তীকালে হয়তো এঁদের অনেকেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। জানি না, এঁরাও ভট্টাচার্য পরিবারের সাহায্য অস্বীকার করে Mr Bounderby-র মত নিজেদের ‘self made man’ বলতেন কিনা!
প্রসঙ্গটার উত্থাপন করলাম, কারণ আমার অস্ট্রেলিয়াতে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে বহু মানুষের নানা ধরনের অবদান আছে। অযাচিতভাবে সাহায্য পেয়েছি অনেকের কাছ থেকেই। চেষ্টা করব আমার এই কলামের পাঠকদের এঁদের কয়েকজনের কথা শোনাতে। এবারের লেখা এমনই একজনকে নিয়ে।

অস্ট্রেলিয়াতে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চাকরি করতাম আই বি পি বলে একটি সংস্থায়। সেই সময় কর্মস্থল ছিল কলকাতায়, থাকতাম সল্টলেকে কোম্পানির দেওয়া একটা সুন্দর বাড়িতে। উল্টো দিকে থাকতেন এক জাহাজের ক্যাপ্টেন। খবর পেয়ে জানালেন অস্ট্রেলিয়াতে ওঁর এক বন্ধু থাকেন– সম্ভবত সিডনিতে, নাম সুব্রত দে। এর থেকে বেশি কোনও তথ্য উনি আমায় দিতে পারেননি।
অস্ট্রেলিয়াতে কাউকেই চিনতাম না। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের এক বিকেলে সিডনির এয়ারপোর্ট থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে উঠেছিলাম একটা ইউথ হোস্টেলে। দিন সাতেক বাদে টপ রাইড নামে এক পাড়ায় একটা দুকামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। বয়স তখন ৩৫, যৌবনের তেজ কমে এলেও, শূন্য হয়ে যায়নি। নতুন দেশে জীবন শুরু করার চেষ্টা করছি অধীত বিদ্যা, আর বছর দশেকের দেশে বিদেশে ছড়ানো-ছেটানো অভিজ্ঞতার পুঁজি সম্বল করে।
অস্ট্রেলিয়ায় সেই সময়ে বড় রকম অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। বেকারত্ব ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, জাতীয় আয় পড়তির দিকে (অর্থনীতির ভাষায় recession চলছে)। তাছাড়া এদেশে খ্রিস্টমাসের মাসখানেক আগে থেকে যে কাজেকর্মে নতুন নিয়োগ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় এ ব্যাপারটা জানা ছিল না। সবমিলিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় রীতিমতো উদ্বিগ্ন ছিলাম।
অস্ট্রেলিয়াতে কাউকেই চিনতাম না। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের এক বিকেলে সিডনির এয়ারপোর্ট থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে উঠেছিলাম একটা ইউথ হোস্টেলে। দিন সাতেক বাদে টপ রাইড নামে এক পাড়ায় একটা দুকামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। বয়স তখন ৩৫, যৌবনের তেজ কমে এলেও, শূন্য হয়ে যায়নি।
রাত নটা সেদিন। দরজায় ঠক ঠক… খুলে দেখি এক সুদর্শন ভদ্রলোক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। প্রথম দেখায় বাঙালি মনে হয় না– রীতিমতো ফর্সা রং, দেখতে অনেকটাই সাহেবদের মতো। হাত বাড়িয়ে পরিচয় দিলেন– ‘সুব্রত দে’।
সেই শুরু, পরবর্তী দু’বছর উনি ছিলেন আমার পরম বন্ধু, অনুপ্রেরণার উৎস এবং নানা বিষয়ে পরামর্শদাতা।

৯০ দশকের শুরুতে বিশাল শহর সিডনিতে কয়েকশ বাঙালি থাকতেন। এখন অবশ্য সেই সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। আলাপ হওয়া দু–এক জনকে ওঁর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেউই ঠিকমতো খবর দিতে পারেননি। কীভাবে জানি না, লতায় পাতায় ওঁর কাছে খবর পৌঁছয়– ঠিকানা জোগাড় করে সোজা বাড়িতে চলে এসেছিলেন।
তখন আমি সরকারিভাবে বেকার– আর উনি বড় চাকুরে। ঝকঝকে গাড়ি, চোখে পড়ার মতো সপ্রতিভ হাবভাব। আমার তরফ থেকে তাই প্রাথমিকভাবে একটু আড়ষ্টতা ছিল। কিন্তু ওঁর ব্যবহারের উষ্ণতায় মেঘটা অল্পক্ষণের মধ্যেই সরে গেল।
ব্যাপারটা কাকতালীয় হলেও, আশ্চর্যভাবে সুব্রতর বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটা পথে। ওঁর স্ত্রী মঞ্জুষা অত্যন্ত বিদুষী মহিলা। শুনেছি রীতিমতো ভালো ছাত্রী ছিলেন, নানা কলাতে পারদর্শিনী। মোটের ওপর ওঁরা ছিলেন তৎকালীন সিডনির বঙ্গসমাজের ‘গ্ল্যামার কাপল’। তাও আমাদের সঙ্গে কেমন যেন রসায়নটা মিলে গেল– শুরু হল নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ, আড্ডা, ওঁদের সঙ্গে সিডনির দ্রষ্টব্য জায়গায় বেড়ানো। ক্রমে ওঁদের মাধ্যমে সিডনির বেশ কিছু মানুষের সঙ্গেও আলাপ হল। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে নামল না।

সামাজিক মেলামেশার সাথে সাথে সুব্রতর চরিত্রের একটা দিকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এমন লোক-না-জানিয়ে নিঃস্বার্থ পরোপকার করতে খুব বেশি মানুষকে আমি দেখিনি। একটা নতুন দেশে স্বচ্ছন্দ হওয়া সহজ নয়, নানারকম নরম তথ্য (সফট ইনফরমেশন) জানতে হয়, নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হয়। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে সুব্রত আমাকে নানারকম কার্যকর, মূল্যবান উপদেশ দিয়ে সাহায্য করেছেন। প্রথম দিকে চাকরির দরখাস্ত করে ফল পাচ্ছিলাম না– ব্যস্ত জীবনের মধ্যে সময় করে নিজের হাতে আমার কয়েকটি দরখাস্তের খসড়া করে দিলেন। অফিস থেকে এক তাড়া রেসিউমের কপি ছেপে এনে দিলেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই– বয়সে কাছাকাছি হলেও সুব্রত আমার অস্ট্রেলিয়ার কর্মজীবনের শিক্ষাগুরু।
১৯৯২ সালে সিডনি ছেড়ে ক্যানবেরাতে এলাম সরকারি চাকরি নিয়ে। নতুন শহর, ভিন্ন পরিবেশ, অন্য সমাজ। ভৌগোলিক দূরত্ব হলে যা হয়– যোগাযোগ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল। তাছাড়া তখন ক্যানবেরা-সিডনির টেলিফোন মোটামুটি খরচসাপেক্ষ ছিল, ইমেলের ব্যবহারও সেরকমভাবে চালু হয়নি। একবার ওঁরা আমাদের কাছে এসেছিলেন সপ্তাহান্তে, আমরাও বারকয়েক গেছি সিডনিতে। তারপর যা হয় আর কি! তবে খবর পেতাম মাঝেমধ্যে– উনি যে পেশাগত জীবনে অনেক সাফল্য পেয়ে চলেছেন, দেশে বিদেশে নানা কাজে ব্যস্ত, সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলাম। অবশ্য দীর্ঘ কুড়ি বছরের ব্যবধানে দুটি পরিবারের জীবনের অনেক ভালো মন্দই অজ্ঞাত, অজানা রয়ে গেছে। আমার অস্ট্রেলিয়াজাত পুত্র কন্যার সঙ্গে ওঁদের পরিচয়ই হয়নি। ওঁদের কন্যার বিয়ের খবর ভারতীয় মুদির দোকানে একটি পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি আমরা।

শেষ যোগাযোগ টেলিফোনে– ২০১৪ সালের শেষের দিকে। আধ ঘণ্টা মতো কথা বলেছিলাম। সে সময়ে উনি ভারতে কিছু কাজ করছিলেন, দেশের নানা দুর্নীতির মধ্যে কাজ করার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। আমাদের সিডনির আর এক বন্ধু দেবী (ব্যানার্জি)দির মৃত্যু নিয়েও অল্প কথা হয়েছিল। ইচ্ছে, সুযোগ দুইই ছিল, তা সত্ত্বেও আর যোগাযোগ হয়নি। এই ফোনালাপের মাসখানেক পরেই ২০১৫-র শুরুতে ফেসবুকে ওঁর অকালপ্রয়াণের সংবাদ পেলাম।
বেশ কিছুদিন মনটা ভারাক্রান্ত ছিল। যোগাযোগ না থাকলেও ওঁর কাছে পাওয়া সাহায্যের কথা কিন্তু ভুলিনি। পরবর্তীকালে আমরা নিজেদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা করে গেছি নতুন আসা অভিবাসীদের সামাজিক জীবনের অন্তর্গত করার।
আসা যাওয়ার পথে বহু মানুষের সঙ্গে দেখা, আলাপ, বন্ধুত্ব, অন্তরঙ্গতা হয়। তবে আমার জীবন অভিজ্ঞতায় খুব অল্প সংখ্যক মানুষের সম্পর্কেই বলতে পারব ‘হি মেড আ ডিফারেন্স’। সুব্রত দে এমন–ই একজন। বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলেন অজাতশত্রু এক আপাদমস্তক ভদ্রলোক।
***
সুব্রতর চিরবিদায়ের পরের কয়েক বছর মঞ্জুষার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সামাজিক মাধ্যমে। স্বামীর মৃত্যুর পর রীতিমতো আধ্যাত্মিক হয়ে উঠেছিলেন উনি, আগের মঞ্জুষাকে সেভাবে খুঁজে পেতাম না। উনিও দীর্ঘজীবন পাননি — বছর দুয়েক আগে ক্যানসারের কাছে হার মেনে চলে গেলেন।
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৫ মে, ২০২৩
ছবি সৌজন্য: Pixabay, Goodreads.com, লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।