‘বুঝতে পারছি না রে অরিত্র, কুর্চির সেদিন খেলা দেখতে আসাটা তোর কেরিয়ারের পক্ষে ভালো হল, না খারাপ?’ সকালের প্র্যাকটিসের পর লেকের ধারে একটা রোয়িং ক্লাবে অরিত্রকে নিয়ে দেবদীপ এসেছে দরকারি কথা আছে বলে। সেখানেই জলের ধারে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসে দেবদীপ ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিলতারপর গুছিয়ে বোমাটা ফাটাল

অরিত্র সত্যিই অবাক দেবদীপের কথা শুনে। বলল, ‘দু’টোর মধ্যে সম্পর্কটা কী, আগে সেটা তো বলো।’ 

‘সামনের সিজনে দক্ষিণী তোকে রাখছে না।’ অরিত্রর চোখে চোখ না রেখে খানিকটা উদাসীন গলায় কথাটা ভাসিয়ে দিল দেবদীপ। 

‘দক্ষিণী মানে তো তুমি। কুর্চি একদিন খেলা দেখতে এসেছিল বলে তুমি আমাকে দক্ষিণী থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?’ অরিত্র বিশ্বাসই করতে পারছে না এক্ষুনি যা শুনল নিজের কানে!

–  আমার কথা এককালে চলত, যখন দক্ষিণী ছোট ছিল। এখন দক্ষিণী চলে স্পনসরদের টাকার জোরে তারা কী চায় না চায়, সেটাই শেষ কথা। এই সিজনে এত ইমপ্রুভ করেছে তোর খেলা। অথচ সিজনের বাকি খেলাগুলোর কটাতে যে তোকে নামাতে পারব, তাও বুঝতে পারছি না।

– তার মানে কুর্চির বাবা আমার খবর পেয়েছে, আর তোমাকে বলেছে আমাকে তাড়াতে।

প্রত্যাশা মতোই দেবদীপ এ কথার সত্যাসত্যের মধ্যে ঢুকলই না। আবার তেরছা ভাবে বলল, ‘ভাবছি, কলকাতায় তুই কি দক্ষিণীর চেয়ে ভালো ক্লাব পাবি? ভালো ক্লাব না পে্লে তোকে কলকাতাই না ছাড়তে হয়।’

– সমস্যা আসলে তোমার দেবুদা। তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো, আবার কুর্চির রিংমাস্টার বাবার কথায় ওঠো আর বসো।

এতক্ষণ বেশ শান্ত মেজাজেই ছিল দেবদীপ। কিন্তু অরিত্রর কথাটা শুনেই ধক করে জ্বলে উঠল তার চোখ। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘জানিস তো, আজকাল আমার নিজেকে ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে  সুজাতদার কথাটা তোকে বলার মতো ভুল আমি কী করে করলাম! জীবনে এরকম ভুল উঃ, উঃ, উঃ! আমি ভাবতে পারছি না! কী ছিল বল তো সেই রাত্তিরে শান্তিনিকেতনের বাতাসে! কী করে বুঝব ব্যাপারটা এত দূর গড়াবে। সুজাতদার মেয়েটার জন্যে আমার মাঝে মাঝে বেশ খারাপ লাগেসেটাই তোর সঙ্গে শেয়ার করতে গিয়েছিলাম বোকার মতো।’

কথাটা বলেই অরিত্রর থেকে চোখ সরিয়ে টেবিলে পৌঁছে যাওয়া খাবারে মন দিল দেবদীপ। টোস্টে মাখন লাগিয়ে একটা বড় কামড় বসাল। তারপর এমন গভীর মনযোগে অমলেটের ওপর ছুরি চালাতে লাগল যেন অরিত্রর অস্তিত্বই নেই সেখানে। চোখই তুলছে না খাবারের প্লেট থেকে। দেখতে দেখতে মজা পাচ্ছিল অরিত্রবোঝাই যাচ্ছে রেগে আছে দেবুদা। কিন্তু এই রাগটা তো তার ওপর নয়। সেটা অসম্ভব। মাঠের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে বলে স্পনসর বা ডোনরের ওপর রাগের সম্ভাবনাটাই বেশি। কিন্তু কুর্চি মাঠে এসেছিল বলে ওর ওপর চটে যায়নি তো আবার? কথাটা সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না। 

তাই একটু ঘুরপথ ধরল অরিত্র। বলল, ‘কুর্চির কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করাটাকে তোমার ভুল বলে ভাবছ এখন? কী জানি, হয়ত ওটাই তোমার ঠিক কাজ। হয়ত তুমিও মনে মনে চাইছ কুর্চিকে ওর বাবার দখলদারি থেকে বাঁচাতে। হয়ত ভেবেছিলে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারি। তবে একটা কথা আমি তোমাকে সত্যি বলছি দেবুদা। এখনও কিছুই গড়ায়নি এখনও আমরা কেউ কাউকে তেমন চিনিই না। কিন্তু তোমরা যা শুরু করেছ, ভাবতেই পারছি না, এরপর কী অপেক্ষা করছে।’

ন্যাপকিন দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে তার দিকে তাকাল দেবদীপ। বেশ অনেকক্ষণ পর। ভুরু তুলে তার স্বাভাবিক গলায় ফিরে বলল, ‘তোর জন্যে দক্ষিণীর লাল কার্ডই অপেক্ষা করছে, সেটা আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু আমার জন্যে যে তোর এই সব পাকা পাকা কথা অপেক্ষা করছিল, সেটা কে জানত!’

– কাল থেকে তাহলে প্র্যাকটিসে আমার ছুটি?

‘সেটা তোকে কে বলল?’ অরিত্রর প্রশ্নটা শুনেই নিমেষের মধ্যে দেবদীপের ফুটবল কর্তার চেহারাটা বেরিয়ে এল। ‘চার দিন পর গ্রাহাম স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে খেলা। প্রভু এবার ওদের কোচিং করাচ্ছে। ছ’গোল করেছে গ্রাহাম আগের চারটে খেলায়। নতুন গোলকিপার নামিয়ে আমি ওদের অ্যাটাক সামলাব? কিচ্ছু জানিস না তুই, কিচ্ছু শুনিসনি, কেউ তোকে কিচ্ছু বলেনি। যেমন প্র্যাকটিসে আসিস, তেমনি আসবি। তারপর দেখা যাক।’

না, কেউই কিছু বলেনি অরিত্রকে। শুধু দক্ষিণীর কোচ সোমু ঘোষকে দেখা গেল অনেকক্ষণ ধরে প্র্যাকটিস দিলেন রিজার্ভ গোলকিপার সুবেশ প্রধানকে। তবে সোমুদাও কিছু জানেন বলে মনে হল না। অরিত্রকে ডেকে বেশ মন দিয়ে বোঝালেন, গ্রাহামের নাইজেরিয়ান ডিফেন্ডার আনোজি আর স্ট্রাইকার মিলিন্দের মধ্যে দারুণ একটা বোঝাপড়া আছে। ফাইনাল থার্ডের সাইডলাইন থেকে আনোজির লম্বা থ্রো পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ঠিক খুঁজে নেয় দুর্দান্ত হেডার মিলিন্দের মাথা। সোমুদার লোক খবর দিয়েছে, ওরা আলাদা করে নিজেদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই প্র্যাকটিস চালাচ্ছে। বললেন, ‘জিয়ারুলকে আমি মিলিন্দের পেছনে মার্কার লাগাচ্ছি। তোর সঙ্গে জিয়ারুলের আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা তো ভালো, তুইই দেখিস, সেট পিসের সময় জিয়ারুল যেন মিলিন্দকে কিছুতেই ফাঁকা জায়গা না ছাড়ে।’

আরও অনেক কিছু বললেন সোমুদা। কিন্তু অরিত্র কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারল না, আজ হঠাৎ আপনি সুবেশকে এতক্ষণ ধরে প্র্যাকটিস দিলেন কেন? উত্তরটা তো স্পষ্ট। সুবেশ সেকেন্ড গোলকিপার, তাকে তৈরি রাখাই তো কোচের কাজ। 

মনটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ছিল অরিত্রর। রোদ উঠল হঠাৎ কুর্চির ফোন পেয়ে। ফোন ধরতেই জিজ্ঞেস করল, জানতে পারলে, দক্ষিণীর পরের খেলা কবে?

সামনের বুধবার। গ্রাহামের সঙ্গে। তুমি আসতে পারবে নাকি?

এতক্ষণ ঠিক ছিল না। কিন্তু বুধবার শুনেই ঠিক করে ফেললাম, হ্যাঁ আবার যাবো। বুধবার তো শান্তিনিকেতনে ছুটির দিন। বসন্তদারও ইচ্ছে তোমার খেলা দেখার, এবার ওকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

খুব ভালো। তবে বুধবার আমারও না ছুটির দিন হয়ে যায়। হয়ত ছুটি দিয়ে দিল, মাঠে আর নামাই হল না।

সেকি! কী হয়েছে? ইনজিউরি নাকি?

না না, শরীর দিব্যি ভালোতবে ক্লাবের, কোচের নানারকম স্ট্র্যাটেজি থাকে তো? এই খেলাতে হয়ত অন্য গোলকিপার মাঠে নামানো হল।

বাব্বা! আসল কথাটা বলো না, গোলকিপার দক্ষিণীর এলেবেলে প্লেয়ার? যাক, না খেলালে আগে থেকে জানিয়ে দিও আমাকে। মিছিমিছি কলকাতা ছুটতে যাব কেন?

কেন যে তাকে ছুটি দেওয়া হতে পারে, সেই সত্যিটা কুর্চিকে বলার জন্যে ছটফট করছিল অরিত্র। কিন্তু কী বলবে? শুরু করবে কোত্থেকে? এত কথা সে কীভাবে জেনেছে বলতে হলে তো দেবুদার কথা বলতেই হবে। সেটা কি ঠিক হবে? তাছাড়া, সবচেয়ে বড় কথা, এসব কথা ফোনে বলা যায় নাকি? কে জানে, হয়ত কুর্চির ফোন ট্যাপ করার ব্যবস্থা করে রেখেছেন ওর বাবা।

অরিত্র হঠাৎ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে আছে দেখে কুর্চি চিন্তিত গলায় বলল, ‘গোলকিপারের কথাবার্তায় স্ফূর্তি নেই কেন? মন খারাপ? অনেক ভাবনা-চিন্তা ঘুরছে মাথায়? নাকি, এখন ব্যস্ত? অসুবিধে আছে কথা বলার?’

না না, মোটেই ব্যস্ত না। অনেক কথা আছে, দেখা হলে বলব। পারলে বুধবার এসো। খেললে তো দেখতেই পাবে। আর না-ই খেলি যদি, তাহলে আড্ডা তো দেওয়া যাবে!  এখন রাখি?’ বলে, ফোনটা আচমকাই কেটে দিল অরিত্র।

কিছুক্ষণের জন্যে ঝলমল করে ওঠা অরিত্রর আকাশ আবার মেঘলা হয়ে গেল।

(পরবর্তী পর্ব আগামী সোমবার)

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *