দূরে বাগানের প্রান্ত বরাবর সার দিয়ে নিচু নিচু আলো জ্বলছে। খাওয়ার পর অন্ধকার বারান্দায় দু’জনে বসল পাশাপাশি দু’টো চেয়ারে। সদ্য ব্যাঙ্কে চাকরি পাওয়া চব্বিশ বছরের অরিত্র মিত্র আর কলকাতা ফুটবল লিগের প্রিমিয়ার ডিভিশনে যে দলটির সে গোলরক্ষক, সেই দক্ষিণী সম্মিলনীর প্রাণভোমরা চল্লিশ ছুঁইছুঁই দেবদীপ গুহ বিশ্বাস। দেবদীপ পেশায় উকিল, ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বারে গুঁতোগুঁতি করে ওকালতিও করেছে কয়েক বছর। বাবার মক্কেলদের মামলা সামলেছে। কিন্তু বছর আষ্টেক আগে অলোকেশ গুহ বিশ্বাস যেদিন রাসবিহারীর কাছে ল’ ফার্ম খুলে ছোট ছেলে দেবদীপের জন্যে আলাদা চেম্বার করে দিলেন, ঠিক সেই দিন থেকেই তার যেন ডানা গজাল। বাবা যখন মাইনে দিয়ে ক্রিমিনাল প্র্যাকটিসেরই অন্য উকিল পুষছেন, তখন সে আর খেটে মরবে কেন? বাবার ফার্ম থেকে তার নিজের মাইনে বন্ধ হয়ে গেলে, তখন না হয় ভাবনা চিন্তা করা যাবে!
দেবদীপ লেগে পড়ল যেখানে ফুটবল পিটিয়ে সে বড় হয়েছে, সেই দক্ষিণী সম্মিলনী নিয়ে। টাকাপয়সা জোগানোর ব্যবস্থা করতে পারলে আর ক্লাব-কূটনীতির কিছু প্যাঁচ পয়জার জানা থাকলে ফুটবল-কর্তা হয়ে ওঠা কলকাতায় এখনও আহামরি কিছু কঠিন নয়। ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কয়েক বছরের ওকালতির সুবাদে ক্রিমিনাল আর পুলিশ মহলে তার যা যোগাযোগ, তাতে খুব একটা অসুবিধে হল না দেবদীপের। টাকাও আসতে শুরু করল তার অধ্যবসায়ের ফলে। তার সঙ্গে সঙ্গে উন্নতিও করল বটে দক্ষিণী! সেদিনকার সেকেন্ড ডিভিশনের ক্লাব এই ক’বছরে ফার্স্ট ডিভিশন হয়ে প্রিমিয়ার ডিভিশনে পৌঁছে তো গেছেই, স্বপ্ন দেখছে আই-লিগ খেলারও!
দক্ষিণী সম্মিলনী নিয়ে দেবদীপের মাতামাতির সব খবরই রাখতেন তার বাবা অলোকেশ গুহ বিশ্বাস। তিনি নিজে অবশ্য উকিল নন, ব্যবসায়ী। সেই সত্তরের দশকে ইনসাইট ডিটেকটিভ এজেন্সি দিয়ে শুরু; তারপর একে একে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি কেন্দ্র উইজডম টিউটোরিয়াল, এক চিলতে বাগান সমেত তিনতলা বিয়েবাড়ি সাদার্ন ব্যাঙ্কোয়েট, ল’ ফার্ম গুহ বিশ্বাস অ্যান্ড পার্টনার্স, ব্যবসা বেড়েই চলেছে তাঁর। সত্তর পার করেও তিনি নিজেই এখনও সব ব্যবসার চালকের আসনে গ্যাঁট হয়ে বসে। ছোট ছেলে দেবদীপকে আজও বিয়েতে রাজি করাতে পারেননি বটে, কিন্তু বড় ছেলে শুভদীপের বেলায় সে অসুবিধে ছিল না। বিয়ে দিয়েছেন একমাত্র মেয়ে অনিন্দিতারও। ছেলে, ছেলের বৌ, মেয়ে, জামাই, সকলেই এখন সোমনাথের ব্যবসাতে নানা দায়িত্ব পালন করে।
এক দেবদীপেরই শুধু ওকালতি বা পারিবারিক ব্যবসা কোনওটাতেই মন নেই। ফুটবল আর ক্লাবই তার সর্বক্ষণের ধ্যান-জ্ঞান। দেবদীপের এই মাতামাতিতে অলোকেশ কোনও বাধা তো দেনইনি, বরং খুঁটিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে গেছেন গত ক’বছরে দক্ষিণীর পুরো যাত্রাপথের। বিপদে-আপদে দক্ষিণীকে বেশ কয়েকবার টাকা দিয়ে সাহায্যও করেছেন তিনি। দেবদীপ আইএফএ-র গভর্নিং বডিতে পৌঁছনোর পর তার বন্ধু এবং শত্রুরা একমত হয়ে বলেছিল, ব্যবসাটা অলোকেশ গুহ বিশ্বাস সত্যিই ভালো বোঝেন।
ছ’ফুট ছুঁইছুঁই উচ্চতার অরিত্রকে দেবদীপ প্রথম দেখে অফিস লিগের একটা খেলায়। তখনও ব্যাঙ্কে ঢোকেনি অরিত্র, অস্থায়ী চাকরির সুবাদে খেলছিল একটা রেল ক্লাবের হয়ে। গোলের মুখে পৌঁছে গেছে বিপক্ষের আগুয়ান স্ট্রাইকার, অরিত্র তার পা লক্ষ্য করে ডাইভ দিল। কিন্তু অরিত্র ঝাঁপিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে প্রখর অনুমান শক্তির স্ট্রাইকার বলটা ঠেলে দিল পেছনে। বক্সের ঠিক মাথায় সেই বল পেয়েই চকিতে গোলে লব করল তার সতীর্থ। ডাইভ দেওয়া অরিত্রর শরীর হাতের ওপর ভর দিয়েই টানটান হয়ে উঠল, দুই পা শূন্যে। ডান পা ছুঁইয়ে অরিত্র বারের ওপর দিয়ে পাঠিয়ে দিল গোলমুখী বল। হাইকোর্ট ক্লাবের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা সে খেলার জনা চল্লিশ দর্শক উচ্ছ্বসিত হাততালিতে বাহবা দিয়েছিলেন। আর দেবদীপ নিশ্চিত করে নিয়েছিল তার লক্ষ্য।
কিন্তু অরিত্রকে টিমে এনে দেবদীপের অশান্তি যেন বেড়ে গেল। ছেলেটার দুর্দান্ত স্কিল, ফাটাফাটি অ্যান্টিসিপেশন, অদ্ভুত রিফ্লেক্স, কিন্তু কোনও মোটিভেশন নেই। এই প্রস্তরীভূত লাভা কুঁদে হিরে বের করে আনার একটা রোখ চেপে বসল দেবদীপের মাথায়। তুই যাদবপুরে ইকনমিক্স পড়লি, ভালো রেজাল্টও করলি। কিন্তু এমএটা পড়লি না কেন রে? অরিত্রকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া গেল, “ধ্যুর, পড়াশোনা করতে আর ভাল লাগছিল না।” বেশ, তাহলে খেলায় মন দে পুরোপুরি। সেখানেও গা-ছাড়া ভাব, প্র্যাকটিসে টুকটাক ডুব দিস, তারপর সিগারেট খাস! চেপে ধরেছিল দেবদীপ, “একদম ঠিক করে বল, কবে ছাড়বি?” হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিল অরিত্র, “ঠিকঠাক একটা প্রেমে পড়ি দেবুদা, তারপরেই ছেড়ে দেব।”
– কেন, সিগারেট ছাড়ার সঙ্গে প্রেমের কী সম্পর্ক?
– আরে দেবুদা, সেই মেয়েটাও তো বলবে, সিগারেট ছাড়ো, সিগারেট ছাড়ো। তখন বলা যাবে, তোমার জন্যে সিগারেট ছাড়লাম। দেখ, কত্ত বড় স্যাক্রিফাইস!
– হুঁ, তোর আবার প্রেম! তিন বছর যাদবপুরে কাটিয়ে কাউকে পেলি না, এখন হা পিত্যেশ করে কী হবে?
– উফ, তোমরা ভাবো কী বল তো? প্রেম ফ্রেম নয়, ওখানে কলরব হয়, কলরব।
এই ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ থেকে অরিত্রকে বার করতে হবে। ফোকাস আনতে হবে। গোলকিপার হিসেবে অরিত্রর সম্ভাবনা যে কী বিপুল, সেটা বোঝাতে হবে। মাথায় ঢোকাতে হবে, যে ও কলকাতার সেরা গোলকিপারদের একজন। সেইজন্যেই দেবদীপ এবার ওকে সঙ্গে করে শান্তিনিকেতনের বাড়িতে এনেছে। তার মধ্যে কুকুরের কামড়ে এ কী বিপত্তি!
(পরবর্তী পর্ব আগামী সোমবার)
আগের পর্ব পড়তে হলে – https://banglalive.today/goalkeeper-an-episodic-novel-on-relationships-and-social-norms-2/
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
ভালো লাগছে। গল্প বেশ তরতর করে এগুচ্ছে।ফুটবল নিয়ে আজকাল সেরকম উপন্যাস চোখে পড়ে না। বেশ টানটান গল্প।