আগের পর্বের লিংক: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪]
আমার পাড়ায় হরতাল চলবে না৷ যারা হরতালের কথা বলবে, তাদের মাথা ভেঙে দেব৷ হাত-পা ভেঙে করপরেশনের ময়লার লরিতে তুলে দেব৷ কোনও বাপ হাসপাতালে নিয়ে যাবে না৷ আমার পাড়ায় আমিই শেষকথা৷ কাল যে-দোকান বন্ধ থাকবে, জ্বালিয়ে দেব৷ কোনও বাপ নেই দমকল ডাকার৷ আমার পাড়ায় আমিই শেষকথা৷ হরতাল হবে না৷ আমার পাড়ায় হরতাল হয় না৷ এটা শান্তির জায়গা৷ এখানে যে গোলমাল পাকাতে আসবে, তাকে বাড়ি ফিরতে হবে না৷
মণীশ ঘোষ হয়তো আরও লম্বা হুমকি দিয়েছিল৷ হয়তো আরও কড়া ভাষায়৷ লোকটা এমনিতে তোতলায়৷ ভাষণ দেবার সময় টানা বলে৷ ওর ভাষণ মানে হুমকি৷ কংগ্রেস ছাড়া অন্য রাজনীতি এখানে করতে গেলে পস্তাতে হবে— এটাই মোদ্দা কথা৷ গলার এত জোর যে মাইক লাগে না৷ পরনে ধুতি, ফুলহাতা জামা৷ হাতা গুটোনো৷ ব্যাকব্রাশ চুল৷ সঙ্গে সবসময় দু-চার পিস মস্তান টাইপের চ্যালা৷
মণীশ ঘোষ সম্পর্কে বালক আর যা যা মনে করতে পারে তা হল, গোবরায় তার টালিখোলার বাড়ি৷ গোটা দশেক গোরু আছে৷ দুধ বিক্রি জীবিকা৷ দেখভাল করে তার বাবা৷ মণীশ সাইকেলে ক্যান ঝুলিয়ে মাসকাবারি খদ্দেরদের ঘরে ঘরে দুধ দিত৷ মাথাগরম ছেলে৷ কথা নেই বার্তা নেই হাত চালিয়ে দেয়৷ ঝঞ্ঝাট বাধাত প্রায়ই৷ ‘আমার লগে তেরিবেরি করিস না, মাথা ফাটাইয়া দিমু’। সামলাতো ওর বাবা৷ সেই মণীশ কংগ্রেসের ডাকাবুকো নেতা ভান্তু ঘোষের নজরে পড়ে খুচরো নেতা হল৷ ভান্তু ঘোষ মানে আশুতোষ ঘোষ৷ বিধান রায়ের সরকারে মন্ত্রী ছিলেন৷ কয়েক লাখ ত্রাণের কম্বল হাপিশ করে দেন বলে জনশ্রুতি৷ সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউয়ের ওপর নিজের বাড়ির গায়ের জমির ওপর আটতলা বা দশতলা অট্টালিকা বানান৷ লোকে বলে, এ সবই রাজনীতির কামাই, স্বাধীনতার মুনাফা৷ কমিউনিস্টরা বলত, ঝুটা আজাদির লুটের মাল৷
ওইখানে, লিন্টন স্ট্রিট স্টপ থেকে বালক বহুবছর বাসে উঠেছে, গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার স্টপে বাস থেকে নেমেছে, কখনও গুনে দেখবার ইচ্ছে হয়নি অট্টালিকাটি আটতলা না দশতলা৷ ঘাড়ে ব্যথা হয়৷ বরং তার মনে পড়ে, ওই অট্টালিকা তখনও হয়নি, পাশেই কলকাতা করপোরেশনের লালবাড়ি ছিল, দোতলা, ভেতরে অনেক ঘর, ছায়া ছায়া টেবিল চেয়ার আলমারি মানুষ ফাইল সাইকেল, দেওয়ালে পোস্টার আর ময়লা দাগ আর কালো মেঘের মতো ঝুল। বসন্তরোগের ও কলেরারোগের প্রতিষেধক টিকা ও ইনজেকশন দেওয়া হত, অন্যান্য কাজও হত৷ বালক টিকা নিতে সেই বাড়িতে গেছে কতবার৷ বাড়ির বাইরে মাটিতে চাকা বসে-যাওয়া ভাঙাচোরা রঙচটা একটা মোটরগাড়ি ছিল৷ তার ছাদ ছিল না, দরজা বা সিট ছিল না৷ ছিল স্টিয়ারিং৷ সেই গাড়িতে উঠে বালকের দল সারা দুপুর স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গড়ের মাঠ, মনুমেন্ট, হাওড়া ব্রিজ, দমদম, চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়াত৷ বালক তখন একটু বড় শিশু, এক ছুটে লিন্টন স্ট্রিট পোস্ট অফিস থেকে পোস্টকার্ড ইনল্যান্ডলেটার খাম কিনে নিয়ে যায়, বস্তির বড়দের অর্ডারমাফিক৷ চিঠি লেখা হলে ডাকবাক্সে ফেলে যায়৷

মণীশ ঘোষ যখন ভাষণ তথা হুমকি দিচ্ছে, তখন সে আর বালকটি নেই৷ রিফিউজি-জাতক এবং বস্তিঘরের ছেলে বেশিদিন বালক থাকতে পারে না, লোক হয়ে যায়৷ সেই লোক আমি এবার আমার বয়ানে বাকিটা বলব৷
মণীশের ভাষণের সময়টা খুব সম্ভব ১৯৬৬ সালের মার্চ বা এপ্রিল হবে৷ আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা এগিয়ে আসছে৷ টেস্ট হয়ে গেছে৷ এদিকে খাদ্য সঙ্কটে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আগুনদামে উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলা৷ বসিরহাটে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে নুরুল ইসলাম৷ কৃষ্ণনগরে মৃত্যু হয়েছে আনন্দ হাইতের৷ রাজ্য জুড়ে আন্দোলন, অবরোধ, মিছিল৷ ক্ষুধার দাবি বুলেট দিয়ে মোকাবিলা করতে গিয়ে অস্থির সময় ডেকে এনেছে প্রফুল্লচন্দ্র সেনের সরকার৷ হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ কোথাও কোথাও জ্বলে উঠছে৷ রাষ্ট্রের হত্যার প্রতিবাদে মিছিলে হাঁটছেন সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, শোভা সেন৷ সভা ডাকছেন উত্তমকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ সভায় বলছেন বিকাশ রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপ মুখোপাধ্যায়৷ আর আমাদের বস্তিতে দিলীপ দে-র রেশনের দোকানে, গালভরা নাম ফেয়ার প্রাইস শপ, ভোর থেকে লম্বা লাইন, অশথতলার কলপাড় ছেড়ে এঁকেবেঁকে তিন-চার রকম ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, চাল-গম-চিনি-ডাল যা মেলে৷ গতরে-খাটা, কলমপেশা লাইনে একাকার৷ পাশে ছিদামবাবুর গমভাঙানোর কল ভোর থেকে ঘঙরঘঙর৷ রাত একটু গভীর হলে রেশনের মাল ঠেলাগাড়িতে পাচার হয় হোটেলে, বড় মুদিখানায়৷ ঠেলা পাহারা দেয় মণীশের মস্তানরা৷ আমাদের ঘরে গমের খিচুড়ি হয় দু-বেলা৷ বাবা চাল জোগাড় করতে পারে না৷ এপাড়ার ওপাড়ার মুদিদোকানে ঘুরে ঘুরে দু-এক সের মোটা দানার চালের খোঁজ পেলেও যা দাম তাতে কেনা যায় না৷ দিনের পর দিন গমের খিচুড়ি খেতে হয়৷ পেটে সহ্য হয়নি৷ ফাইনালের ইংরেজি পরীক্ষার আগের রাতে পেটগরম হয়ে শয্যাশায়ী আমি৷ মাথা তুলতে পারিনি৷ পরদিন ওষুধ খেয়ে কোনওক্রমে মধ্য কলকাতার শ্রীবিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয়ে পৌঁছে সিক বেডে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল৷

আমার জীবনে দেখা এটাই প্রথম খাদ্যসঙ্কট৷ আমার জীবনে এটাই প্রথম বুঝতে পারা খাদ্যাভাব কী জিনিস৷ পরে পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জেনেছি না খেতে পেয়ে দু-বছরে মারা গেছে পঞ্চাশ লক্ষ বাঙালি৷ উজাড় হয়েছে গ্রাম-কে-গ্রাম৷ ধ্বংস হয়েছে বাঙালির আবহমান জীবন৷
আশুতোষ ঘোষ ওরফে ভান্তু ঘোষ আমার দেখা প্রথম মন্ত্রী ও অতি-ধনী ব্যক্তি৷ মণীশ ঘোষ আমার দেখা প্রথম রাজনৈতিক গুণ্ডাসর্দার৷ অবশ্য আমি তাকে ভয় দেখাতেই বেশি দেখেছি৷ কারও হাত-পা ভেঙে দিতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না৷ সেদিন সে যে ‘হরতাল করলে আগুন লাগিয়ে দেব’ বলে বিস্তর হাত-পা নেড়েছিল, তাতে লোকজন তেমন ভয় খায়নি৷ ডিহি শ্রীরামপুর রোড আর ডাক্তার সুরেশ সরকার রোডের ক্রসিংয়ে, শিবাজি হিন্দু হোটেল থেকে ম্যানেজারের টেবিল বের করে ফুটপাতে রাখে চ্যালারা৷ টেবিলে উঠে দাঁড়িয়ে মণীশ ভাষণ দেয়৷ ওই মোড়টার আধা-বাজার চেহারা ছিল৷ মাতৃভাণ্ডার, গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডার, ঢাকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, হাওড়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, বড়ুয়া বেকারি, ভাগবতের পানের দোকান, রামযতন ভুজিয়াওলার দোকান, বিজলি হেয়ার কাটিং সেলুন, অমল টেলার্স, কচুরি-পেঁয়াজি-ফুলুরির দোকান, যাদবের সবজির দোকান, মুন্নার মাংসের দোকান ইত্যাদি মিলে সকাল সাতটা-আটটা থেকেই মোটামুটি ভিড়৷ মণীশ দু-চারবার শান্তিপ্রিয় মানবদরদি গান্ধীবাদী নেতা আশুতোষ ঘোষের কথা বলেছিল তার ভাষণে৷ উপস্থিত সবাই শুনেছে৷ পাত্তা যে দেয়নি বোঝা গেল পরদিন। তল্লাট জুড়ে হরতাল, সব দোকান বন্ধ৷ কয়েকটা রোগা লোক লাল ঝান্ডা হাতে মিছিল করেছিল সকালের দিকে, মনে আছে৷ পুলিনদা ছিলেন মিছিলে, যিনি পরে নকশালবাড়ির রাজনীতি করবেন। দেড়-দু বছরের মধ্যে মিছিলটাও আড়াআড়ি ভেঙে যাবে, একদল হাঁটবে কৃষিবিপ্লবের পথে৷

হরতালের দু-চারদিন পর অবাক-করা ঘটনা ঘটল আমাদের পাড়ায়৷ ‘অবাক-করা’ এইজন্য বলা যে, এমন ঘটনা ঘটতে পারে এটা পাড়ার কেউ অনুমান করতে পারেনি৷ অথচ যখন ঘটল, পাড়ার লোকজন তাতে সামিল হল তেজের সঙ্গে৷ দুপুর দুটো নাগাদ, রেশনের দোকানে ভিড় পাতলা হয়ে গেছে, পুলিনদারা রেশন দোকানের মালিক দিলীপ দে-র গুদাম ঘিরে ফেললেন৷ দাবি, গুদামের দরজা খুলুন৷ দেখব চালের বস্তা আছে কি না৷ রেশনে চাল পাচ্ছে না মানুষ৷ অথচ রাতে পাচার হচ্ছে৷ গুদাম খুলুন৷ আমরা দেখব চাল লুকোনো আছে কি না৷ কথা দিচ্ছি, গুদাম থেকে এক ছটাক মালও কেউ সরাবে না৷ দিলীপ দে গুদাম খুলবে না৷ প্রথমে হাসিমুখে পুলিনদাদের শান্ত করতে চাইল৷ পরে পুলিশের ভয় দেখাল৷ সরকারের মাল লুট করতে গুন্ডার দল এসেছে বলে অভিযোগ করল৷ ইতিমধ্যে বস্তির ঘর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে শয়ে শয়ে মানুষ৷ তাদেরও দাবি, গুদাম খোলো৷ দেখব চালের বস্তা আছে কি না৷ চাল না থাকলে দরজা খুলতে ভয় কীসের? মানুষের চিৎকার ক্রমে গর্জন হয়ে ওঠে৷ খবর চলে যায় মণীশের কাছে৷ চ্যালাচামুণ্ডা নিয়ে মণীশ আসে৷ ভিড় দেখে আর ভিড়ের গর্জন শুনে কাছে আসার সাহস পায়নি৷ পুলিশ আসে৷ বিশাল ভ্যানে লোহালাগানো বুট আর বন্দুক আর লাঠির বাহিনী নিয়ে৷ জনতাকে গুদাম থেকে সরে যেতে বলে৷ জনতা পুলিশের হুকুম শুনতে নারাজ, তারা চালের গন্ধ পেয়েছে৷ ভাতের গন্ধ পেয়েছে৷ কতদিন ভাত খায়নি৷ গম মাইলো ভুট্টা কি বাঙালির পেটে সয়? পুলিশ গুলি চালাবার ভয় দেখায়৷ জনতা ভয় পায়নি৷ বরং গর্জে ওঠে, চালাও গুলি৷ পুলিনদারা লালঝান্ডা হাতে পুলিশ আর জনতার মাঝখানে দাঁড়ায়৷
অবশেষে গুদাম খুলতে বাধ্য হয় দিলীপ দে৷ গম আর চিনির বস্তার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে চালের গন্ধ৷ এবার জনতাকে সামলে রাখা কঠিন হয়৷ বহু কষ্টে পুলিনদারা বোঝায়৷ গুদামের সামনে পুলিশ বসে৷ পরদিন রেশনে চাল বিলি হয় পুলিশের পাহারায়৷ দিলীপ দে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে বেঁচে গিয়েছিল৷ শোনা যায়, পুলিশ আর মণীশকে মাসোহারা দিত দিলীপ৷ সত্যি মিথ্যে জানি না৷ আমার জীবনে দেখা এটাই প্রথম গণবিক্ষোভ৷
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২০ ডিসেম্বর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Picryl, Wikimedia Commons, লেখক
মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন্যাস। বই আখ্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।