সাম্যই পৃথিবীতে কাম্য। কিন্তু ক্ষুধা থেকে ক্রীড়া কোথাও সাম্যটাকে দেখা যায় না বড়। সাম্য সর্বত্রই ‘বাজে করুণ সুরে’। বাদের খাতায় নাম লিখিয়ে দিয়ে বসে আছে। আছে তো আছেই। এই যে ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে, কী হইহই-চইচই হচ্ছে, আমরা ফুটো থালা বাজিয়ে কিংবা ভুঁড়ি নাচিয়ে তা দেখছি, কিন্তু এ তো পুরুষের কীর্তি। পুরুষের পায়ের প্রাণে আপনি প্রাণনা পাচ্ছেন, কেউ-বা প্রেরণা পাচ্ছেন। আমাদের ছোটবেলায় এমন বড় খেলা চললে, বাতাবি লেবুর গাছগুলি ফাঁকা হয়ে যেত। এখন কেউ আর বাতাবিতে ফুট লাগায় না, তাকে ফুটিয়ে দেওয়া হয়েছে মাঠময়দান থেকে। কিন্তু ছেলেদের কাপ নিয়ে এত যে কাঁপাকাঁপি, মেয়েদেরও ওয়ার্ল্ডকাপ হয় জানেন তো! হ্যাঁ, জানেন তো বটেই, একশো বার হাজার বার জানেন। কিন্তু ওইটুকুই। জানা ক্রমে ‘না’ হয়ে যায়। আমরা পরম অবহেলার আনন্দে থাকি, মেয়েদের ওয়ার্ল্ডকাপ এসে খেলে চলে যায়। ঋতুবদল হয়ে যায়, চায়ের কাপে কফির মগে একটা তরঙ্গও না তুলে মেয়েদের ফুটের ড্রিবলিং, গোল, হেড, কর্নার, হোহো হাহা, আহ-হা, দারুণ ও দুরন্ত– শেষ হয়ে যায়। কেন এমন হয়? শুধু ফুটবল নয়, তাঁদের সব খেলাতেই। মানুষ কম দেখে, তাই মিডিয়াও দূরে থাকে। মানুষ ও মিডিয়া দূরে থাকে বলে পয়সাকড়িও কম আসে। তাই পুরুষ ও নারী দুই জাতীয় দু’-পেয়ের প্রাপ্তির ফারাক আকাশ-জমিনের। ছেলেরা যদি অর্থাকাশে একটি শঙ্খচিল হয়ে থাকে, মেয়েরা রাত্তিরে ভুল করে ঘরে ঢুকে পড়া বিভ্রান্ত কোনও চড়ুইপাখিটি। একই পেশা কিন্তু রোজগারে এক গাদা ফারাক। ধরুন কোনও অফিসে একজন পুরুষ ও এক জন মহিলা পাশাপাশি কাজ করছেন, কাজ একই, কিন্তু পুরুষটি যা বেতন পাচ্ছেন, মহিলাটি তার তিন ভাগের একভাগ পাচ্ছেন। অন্য কোনও প্রফেশনে এমনটা ভাবা না গেলেও, খেলায় এটাই স্বাভাবিক। এটা চলছে সেই ভোরবেলা থেকে। হ্যাঁ বিদ্রোহও হচ্ছে, তাতে কাজও হচ্ছে, তবে মুঠিখানেক।

আসুন এই ইস্যুতে একটু ঘুরে আসা যাক গ্রিসদেশ থেকে। ক্রীড়া বৈষম্যের সেই প্রাতঃকালে। গ্রিসের স্পার্টায় সিনিসকা নামে এক রাজনন্দিনী ছিলেন। খ্রিস্টের জন্মের মোটামুটি ৪৪০ বছর আগে তাঁর জন্ম। সিনিসকা ছিলেন দারুণ দক্ষ ঘোড়সওয়ার। অশ্ব তাঁর হাতে কথা বলত। সিনিসকার বাবা ছিলেন রাজা আর্কেডামাস-২, আর ভাই ছিলেন রাজা আজেসিলাস-২। এই সিনিসকার প্রবেশ ঘটল অলিম্পিকে। হাতে এল জয়ের অপরূপও। তখন গ্রিসে মেয়েরা মোটেই স্বাধীন ছিল না। দাসত্ব-শৃঙ্খল তাদের পায়ে ঘুঙুরের মতো বাজত। খেলাধুলোয় মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল না। অলিম্পিকের মতো খেলায় তো সে প্রশ্ন ওঠেই না। অলিম্পিকের খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে ঢোকার ছাড়পত্র অবশ্য ছিল মেয়েদের, কিন্তু অবিবাহিত হলে তবেই। আসলে পুরুষ খেলোয়াড়দের নগ্ন হয়ে খেলা দেখাতে হত, সেই নগ্নতা যাতে ঋতুমতীরা না দেখতে পান, সেই লক্ষ্যও ছিল মনে হয় ওই নিয়মে। কারণ প্রায় শৈশবেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত তখন ওই গ্রিসেও। তা, এ হেন কঠোর কালে, ঘোড়া যাঁর ক্রীড়নক, সেই সিনিসকা ঢুকতে পারলেন অলিম্পিকে। ভাই রাজা আজেলিয়াস-২ তাঁকে সেই ছাড়পত্র দিয়েছিলেন। তিনি তার পর তো কামাল দেখালেন। না, নিষেধ ভেঙে অলিম্পিকের মাঠে ঘোড়ায় তিনি চড়েননি। কিন্তু তাঁর চার-ঘোড়ার রথে তাঁর নিযুক্ত ঘোড়সওয়ার, অর্থাৎ কিনা তাঁর টিম ঘোড়দৌড়ে জিতে গেল। পরপর দুটি অলিম্পিয়াড, খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৬ এবং ৩৯২, জিতলেন তাঁরা। চার দিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। খেলাধুলোর জগতে মেয়েদের দুর্লঙ্ঘ্য দরজাটা খুলে দেওয়ার জোর চেষ্টা হল এই ভাবে। সে সময়ে সিনিসকার বয়স কিন্তু ৪০ বছর পেরিয়েছে। মানে প্রায় বুড়ো হাড়ে কামাল দেখানোর মতো ব্যাপার। তাঁর চেহারা, তাঁর ঘোড়া বাঁধা রথটিকে ব্রোঞ্জে খোদাই করা হয় এই জয়ের পর, যাকে ব্রোঞ্জ সম্মান বলা হয়ে থাকে। রাখা হয় জিউসের মন্দিরের প্রবেশদ্বারে। স্পার্টাতেও তাঁর নামে একটি মনুমেন্ট তৈরি করা হয়। দু’-জায়গাতেই, সিনিসকা (কিনিসকাও বলেন অনেকে)-র বয়ান খোদাই করা, ‘আমার বাবা-ভাইরা স্পার্টার রাজা, আমি সিনিসকা, ঘোড়া-দুরন্ত রথে আমি জয়ী, তাই এই সম্মান লাভ করেছি। আমি ঘোষণা করছি– গ্রিসে মহিলাদের মধ্যে একমাত্র আমিই, যে কিনা এমন জিত হাসিল করেছে।… ’

এখানে আর এক মহিলার কথা বলব, তিনিও গ্রিসদেশের। ক্রীড়াকথায় তাঁর নামও সূত্রপাতে স্মরণ করা হয়ে থাকে। তিনি– কালিপেটেরা। তার জন্ম সিনিসকার জন্মের কিছু পর। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৮-তে। তিনি ছিলেন গ্রিসের রোডসের একজন এ-ক্লাস অ্যাথলিট। কিন্তু মেয়ে বলে, স্বাভাবিক নিয়মে, তিনি অলিম্পিকে অংশ নিতে পারেননি। এই একুশে আইন তাঁকে বিদ্ধ করছে, ক্রুদ্ধও, কিন্তু কিছুই করার কোনও উপায় নেই। কালিপেটেরা (অনেকেই বলেন ফেরেনিকা) ছিলেন এক নামী অ্যাথলিট দিয়াগোরাসের মেয়ে, কম বয়সে মানে বিয়ের আগে তিনি হেরেইয়ান গেমসে অংশ নিয়েছেন, অলিম্পিকের স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখেছেন। কিন্তু বিয়ের পর পৃথিবীটা তাঁর কাছে সাদাকালো হয়ে গেছে। তবে স্বপ্ন একটা, ছেলেকে বক্সার হিসেবে তৈরি করা। তাঁর স্বামী সে কাজ করছিলেন, কিন্তু কোথাও কিছু নেই তিনি ফেরেনিকাকে অথৈ সাগরে ফেলে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। প্রয়াত স্বামীর পদাঙ্ক ধরে ছেলেকে তিনিই তৈরি করতে লাগলেন। ক্রমে অলিম্পিকের দিনগুলি চলে এল। একেবারে মিছিল করে ছেলেকে নিয়ে চললেন মা ফেরেনিকা। অলিম্পিকের ময়দানে ঢুকতেই হবে, তাই পুরুষের ছদ্মবেশ নিলেন। ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে, তাও অসীম সাহসে তাঁর এমন করে ভর। দেখা গেল, ছেলে পিরিওডস বক্সিংয়ে জয় পেলেন, আর পুরুষবেশে তাঁর মা তখন অন্য সব ট্রেনারদের সঙ্গে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন, আকাশবাতাস কেঁপে উঠছে। কিন্তু তার পর… শেষ রক্ষা হল না। ছেলের সাফল্য দেখে উত্তেজিত মা ট্রেনারদের অঞ্চলটি ছেড়ে ছোট একটি দেওয়াল লাফ দিয়ে পেরিয়ে খেলোয়াড়দের এলাকায় ঢুকে পড়লেন, কিন্তু সেই ঝটকায় তাঁর ছদ্মবেশ খসে পড়ল, ধরা পড়ে গেলেন। এবার কী হবে? কেন এভাবে এসেছেন এখানে, এই প্রশ্নে ফেরেনিকা এক আবেগমথিত বক্তব্য রাখেন। বলেন, তাঁদের পরিবারের খেলোয়াড়ি ঐতিহ্যের কথা। বলেন, এই ভাবে অলিম্পিকে ঢুকে পড়ার জন্য তিনি তথাপি ক্ষমাপ্রার্থী। ফেরেনিকাকে ছেড়ে দেওয়া হল, গ্রিসের ক্রীড়াপ্রেমিকের দল হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। ফেরেনিকাও ইতিহাসে প্রবেশ করলেন। এবার নয়া নিয়ম হল অলিম্পিকে। সমস্ত ট্রেনারদের স্টেডিয়ামে ঢুকতে হবে উলঙ্গ হয়ে। ভাবা যায় না!
আরও পড়ুন: সার্কাস, ট্রেটর ও দ্রোহকাল
এই ফাঁকে মহামতি অ্যারিস্টটলের কথাবার্তায় অল্প নজর দিই। এই গ্রিক দার্শনিক ‘পলিটিক্স’ পুস্তকে বলেছেন, ‘বন্যর তুলনায় পোষা পশুদের স্বভাব ভাল। পোষা পশুরা আরও ভাল হয়ে থাকে যখন তারা পুরুষের মাধ্যমে চালিত হয়।… পুরুষেরা স্বভাবেই উঁচুতে থাকে, মহিলারা থাকে নিচুতে। এক দল শাসন করে, আরেক দল হয় শাসিত। এই নীতিটা প্রয়োজন মানব সভ্যতার স্বার্থে।’ গ্রিস, ক্রীড়ার আঁতুড়ঘরে, মেধা-সম্রাট অ্যারিস্টটল যখন এমন বলেছেন, তখন তো বৈষম্য এখান থেকে সহজে যাওয়ার নয়। গোড়াতেই গলদ, তাই এই সত্যযুগের সংস্কৃতিটা সহজে সরবে কীভাবে!

মনে রাখবেন জীবনানন্দ দাশ ‘ক্রমমুক্তি’র কথা বলেছিলেন। মনে করুন সেই লাইনগুলো, ‘সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে— এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;/ সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ,/ এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল,–/ প্রায় তত দূর ভাল মানবসমাজ/ আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে/ গড়ে দেব আজ নয় ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।’ খেলায় অর্থে সাম্য ঢের দূরের ব্যাপার, লড়াই আর অপেক্ষা এই দুটি একটি মুদ্রার দু’দিকে চিত্রিত হয়ে আছে। আশা জাগিয়ে বিবিসি-র সমীক্ষাও তো বলছে, ৮৩ শতাংশ খেলায় নাকি মেয়েরা ছেলেদের সমান পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন এখন। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই টেনিস। মানে টেনিসই হল এ রাস্তায় পথপ্রদর্শক। ১৯৭৩ সালে আমেরিকান টেনিস তারকা বিলি কিং এই যুদ্ধে খোলা তলোয়ার নিয়ে নামে পড়েন। জেন্ডার ইক্যোয়ালিটির লড়াইয়ে তিনি ‘ব্যাটেল অফ সেক্সেস’ ম্যাচে হারিয়ে দেন ৫৫ বছর বয়সী ববি রিগসকে, তখন বিলি-র বয়স মাত্র ২৯। লিঙ্গসাম্যের লড়াই-এর তিনি মুখ হয়ে ওঠেন, মেয়েদের খেলায় স্পনসর আসে না তেমন, তাই বেতন কম, সেই দুরবস্থা কাটাতেও চেষ্টা করেন বিলি। ১৯৭০ সালে সিগারেট ব্র্যান্ড ভার্জিনিয়া স্লিমস তাঁর চেষ্টায় মহিলা টেনিস অ্যাসোসিয়েশনকে স্পনসর করে। মহিলা ক্রীড়ায় অর্থলাভের সুদিনের পায়ের শব্দ শোনা যায়।

এবার ২০০৬ সাল। আমেরিকার আরেক টেনিস স্টার ভিনাস উইলিয়ামস লন্ডন টাইমস-এ একটি খোলা চিঠি লেখেন। উইম্বলডন জয়ের বিচারে তিনি বলেন, ‘পুরুষ জয়ীর চেয়ে তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কারমূল্য অনেকটাই কম। এভাবে মেয়েদের পরিশ্রমকে ছোট করা হচ্ছে।’ ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার সেই চিঠি পড়ে মাঠে নামেন, এবং পুরস্কারমূল্যে সমতা বোনা হয়। কিন্তু ওই কবি-বাক্য, ‘অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’, টেনিস এগিয়ে থাকলেও এখনও বেশ পিছিয়ে। ২০১৭ সালে ফোর্বস ১০০ জন হায়েস্ট পেড খেলোয়াড়ের যে তালিকা বানায় তাতে মহিলা টেনিস প্লেয়ার সেরিনা উইলিয়ামস একমাত্র ছিলেন, তাও বেশ পিছনে, ৫৬ নম্বরে। ২০১৮-এ ফোর্বসের ওই ১০০ জনের তালিকায় একজনও মহিলা খেলোয়াড় ছিলেন না। আর গ্রিসে অ্যাথলিট কালিপেটেরা পুরুষের সমান হওয়ার লক্ষ্যে প্রাণের ঝুঁকি নিলেও, এখন অ্যাথলিটরাই জেন্ডার গ্যাপের সবচেয়ে বড় গ্যাপে। এক নম্বরে। একটি সমীক্ষা বলছে, গড়ে একজন মহিলা অ্যাথলিট পান ১৫,২৩২ ডলার, আর পুরুষ অ্যাথলিটরা পান তার দ্বিগুণের বেশি– ৩৮,০০৮ ডলার।
নারীপুরুষের বৈষম্য নিকেশের এই যাত্রায় শুধু ব্যক্তি-লড়াই নেই। আছে সরকারি সিলমোহরও। ‘টাইটেল নাইন’ নামে একটি আইন রয়েছে আমেরিকায়। যাতে বলা হয়েছে, কোনও লিঙ্গ-বৈষম্য চলবে না। বহু দিন হল, সেই ১৯৭২ সালে এই আইনটি পাশ হয়েছে। কিন্তু আইন করে মানবিকতা দিয়ে জ্ঞান কপচিয়ে অনেক কিছুই হয় না। যা হয়ে যায় টাকার গরমে। মেয়েদের খেলাগুলিতে তাই চাই পরিকল্পিত টাকার বান। দর্শক বাড়ানোর কৌশল করা চাই গুছিয়ে। টাকার চাপে টাকার আঁচে ‘ক্রমমুক্তি’টা হবে সহজে।
ছবি সৌজন্য: PxHere
পেশায় সাংবাদিক নীলার্ণব বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। গল্প কবিতা ও ফিচার লেখায় সমান আগ্রহ ও দক্ষতা রয়েছে। প্রকাশিত বই রাতের কাহিনী, অসংলগ্ন রিপোর্টাজ, হাওয়ার আওয়াজ।