পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা শেষ। ফেলুদা আর টিনটিন গোটা পুজোর ছুটি জুড়ে তার মামার  বাড়ির ঘরে ডানা মেলে উড়ে বেরিয়ে আপাতত মলাটমুড়ি দিয়ে শীতঘুমে। সারা দুপুর এই বিশাল বাড়ি ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কোনও অন্য আকাশ নেই, উপদ্রবও নেই। দিদা ভাঁড়ার ঘরে খুটখাট, দাদু ঘুমোচ্ছে। মোটা মোটা কড়িবরগা, উঁচু ছাদ, খড়খড়ির বড় জানালা, তালাবন্ধ ঘরে মোষের শিং, ধারালো ছুরির দল তার দিকে নিশ্চুপে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে একটা শুকনো হাওয়া দেয় মাঠের থেকে, হাড়ের ভেতর ঢুকে বাঁকানো নখে আঁচড়ায়। অনেক ঘর আছে, টুনু ঢুকতে চেয়েও পারেনি। দাদু বলেছে, ‘এসব ঘরে কেউ যায় না। তালাবন্ধ পড়ে থাকে।’ একটা ঘর মনে হয় লাইব্রেরি ছিল, পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া বইয়ে ঠাসা। দাদুর কাছে আর্জি জানিয়েছিল ওখানে ঢুকে বই পড়বে। আঁতকে উঠে দাদু বলেছে, ‘ওরে বাপ রে, অত ধুলো, টিকটিকি সাপ খোপ কী নেই ওখানে ! আমিই ঢুকতে ভয় পাই।’ লাইব্রেরি ঘরের সামনে থমকে দাঁড়াল টুনু। একদিন খোলা পেলে দৌড়ে গিয়ে কয়েকটা বই বেছে আনা যেত। 

দোতলা এই বাড়ির  এল-এর মতো আকার। একপ্রান্ত মাটির। ঠাকুর ঘর, রান্না ঘর, ভাঁড়ার ঘর, মুড়ি ভাজার ঘর, সারি সারি শোয়া বসার ঘর, সব মিলিয়ে তেরো -চোদ্দটা তো হবেই। দাদু দিদা, আর বাগানের ঘরে বিশ্বমামা আর তার বউ। নিঃঝিম বাড়িতে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা ধরে যায়, বাইরের বাগান থেকে শুকনো পাতার দল উড়ে আসে, একটেরে একটি পাখি একঘেয়ে ডেকেই চলেছে। বাগান, তার সামনের খোলা বিশাল মাঠ, অনেক দূরে মাঠটা ছুটতে ছুটতে  গিয়ে যেখানে আচমকা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গিয়েছে, সবাই চুপচাপ। সেই জঙ্গলের মধ্যে একটা গম্বুজ আছে, রাজা মেদনমল্ল বানিয়েছিল নাকি। ওখানে ফাঁসি দেওয়া হত। ফাঁসুড়ে গম্বুজের ঘুলঘুলিগুলোর মধ্যে হাওয়া ঢুকে বাঁশির মতো শিস দেয় রাত্রিবেলা। একানড়েও ডাকে সেভাবেই, তালগাছ থেকে, সে আওয়াজ পায় মাত্র একজনই, নিশির ঘোর থেকে উঠে যার হেঁটে যাবার কথা থাকে মাঠবরাবর। 

টুনুর চোখ চলে গেল দোতলার একদম কোনার ঘরটার দিকে। 

একটা খাতা টেনে নিল। মলাট উল্টোতেই, ‘শুভদীপ ঘোষ। ক্লাস সেভেন’। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। অঙ্কের টাস্ক পাতার পর পাতা জুড়ে। মাঝে মাঝে মার্জিনে বেখেয়ালে আঁকা ছবি। টুনুর কী মনে হল, যন্ত্রের মতো তার হাত চলে গেল টেবিলের বাঁ পাশে, এবং ধাক্কা খেল পেন রাখার বাক্সটিতে। আশ্চর্য, এখানে পেন আছে খেয়ালও করেনি তো!

দরজা খোলা, যেটা এসে থেকে তালাবন্ধ দেখেছে। আজ সকালবেলা ঘরগুলোর ঝুল ঝাড়বার জন্য দরজা খুলেছিল দাদু, তারপর ভুলে গেছে হয়ত। ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল টুনু। ঢুকলে যদি দিদা বিরক্ত হয় আবার? এমনিতেই তার বিছানায় হিসু করে ফেলা নিয়ে রেগে আছে, কিন্তু দিদা তো এখন নীচে। সারা দুপুর আর ওপরে আসবে না, এই রুটিন এতদিনে টুনুর জানা। দরজা আলতো ফাঁক, ঠিক ততটুকু, নয় বছরের একটা ছেলে যার মধ্যে দিয়ে বিনা আয়াসে এবং ক্যাঁচ শব্দ না করেই ঢুকে যেতে পারে। 

টুনু ভেতরে পা দিল। পরিপাটি সাজানো গোছানো ঘর। একটা টেবিল, দুটো চেয়ার, খাট, একটা আলমারি। দরজার উল্টোদিকেই বড় জানালা মাঠ মুখে নিয়ে বসে আছে সারাদিন। এখান থেকে জঙ্গলটা যেন কাছে অনেক, এমনকি পেছনের হিম হিম বাগানের গন্ধও তীব্র। একটা চেয়ার তার দিকেই মুখ করে তাকিয়ে। উল্টোদিকের দেওয়ালে ওয়াসিম আক্রামের পোস্টার। এক পা এক পা করে চেয়ারের কাছে এগিয়ে এল টুনু। ঘুম পাচ্ছে কি হাল্কা? যেন চেয়ারটায় বসলেই ঘুমিয়ে পড়বে, পুরনো সেগুনকাঠের পালিশ থেকে এমনই আরামদায়ক একটা ভাপ ছাড়ছিল। 

চেয়ারে বসল টুনু। ঘরটাকে এখন চেনা লাগছে যেন। হাতের ডানপাশে টেবিল, খাতা বই যত্নে সাজানো। যদিও পাতা হলুদ হয়ে গেছে। একটা খাতা টেনে নিল। মলাট উল্টোতেই, ‘শুভদীপ ঘোষ। ক্লাস সেভেন’। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। অঙ্কের টাস্ক পাতার পর পাতা জুড়ে। মাঝে মাঝে মার্জিনে বেখেয়ালে আঁকা ছবি। টুনুর কী মনে হল, যন্ত্রের মতো তার হাত চলে গেল টেবিলের বাঁ পাশে, এবং ধাক্কা খেল পেন রাখার বাক্সটিতে। আশ্চর্য, এখানে পেন আছে খেয়ালও করেনি তো! একটা ডট পেন টেনে নিল। নাহ, লেখা পড়ছে না। অনেকদিনের পুরনো, বোঝা যাচ্ছে দেখেই। কিন্তু পাশের পেনসিলটা চকচকে, যেন সবেমাত্র কাটা হয়েছে। পেনসিল হাতে নিয়ে টুনু নামের জায়গাটা ঘষে ঘষে কেটে দিল। তার ওপর লিখল, ‘সৌভিক সিংহ। ক্লাস ফোর’। 

সঙ্গে সঙ্গে কে যেন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ছাড়ল। 

চমকে পেছনে ফিরল টুনু। ফাঁকা ঘর নিশ্চুপে, কিন্তু মনে হল তার ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে কেউ রুদ্ধ্বশ্বাসে দেখছিল টুনু কী করে, শ্বাস ফেলল তারপর। এখনো তার ঘাড়ের রোমে শিরশিরানি–হাওয়া? কিন্তু জানালার ধারের নারকোল গাছের পাতা তো স্তব্ধ! দৌড়ে দরজার বাইরে গিয়ে দেখল, খাঁ খাঁ করছে টানা বারান্দা। কেউ কোথাও নেই, শুধু কলঘরে জল পড়বার একঘেয়ে টপ টপ আওয়াজ।  

পা টিপে টিপে ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসল, স্থির। যদি কিছু বোঝা যায়। পেছনে তাকাতে প্রবল ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে ঘাড় ঘোরায়, যাকে সংযত রেখেই দাঁতে দাঁত চিপে সামনে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। 

কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল, চুপচাপ। 

জোরে নিশ্বাস ফেলল টুনু। নিজের মনেই হাসল একবার, তারপর ভূগোলের বই, স্পোকেন ইংলিশ, হাউ টু রাইট লেটারসের ওপর দিয়ে হাত বোলাল আলতো। বইগুলো একটু এলোমেলো করল, গুছিয়ে দিল আবার। পিছু ফিরল, এবং এবার দেখতে পেল খাটের পাশের দেওয়ালের গায়ে বড় ছোপটাকে। 

হলদেটে ছোপ, বেশ বড়। ড্যাম্প ধরছে হয়ত। অদ্ভুত আকৃতির, চারটে হাত পা বেরিয়েছে যেন। বর্ষার মেঘ দেখে টুনু নানা রকম আকৃতি, মানুষজন, ঘরবাড়ির কল্পনা করে। কিন্তু ছোপটা ঠিক মেঘের মতো নয়, যেন হড়হড়ে, হলুদ আর হাল্কা সবুজ মিলে, একটা খুব হালকা পচা গন্ধও ভেসে আসছে, ফাঙ্গাস ধরলে এমন হয়, তাদের আসানসোলের বাড়িতে হয়েছিল, বাবার মুখে শুনেছে। খাটের ধারে দাঁড়িয়ে টুনু আঙুল বাড়াল; জায়গাটা নরম, যেন লেদার ব্যাগ বহুদিন ধরে জলে ভিজে ফাঁপা, কিছুটা পিচ্ছিল, আর কী গরম ! কীসের মতো লাগছে যেন। চেনা কিছুর স্পর্শ এরকম হয়। স্কুলব্যাগ? না না, অন্যরকম। শ্যাওলা হতে পারে–তার স্কুলবাড়ির ছাদে এরকম শ্যাওলা ধরা পাঁচিলে বসতে গিয়েই স্লিপ খেয়ে উলটে পড়ে গিয়েছিল ক্লাস ফাইভের সুতনু সরকার। তিনতলা থেকে সোজা, মাথা নীচে পা ওপরে–সেই থেকে ছাদের দরজা বন্ধ রাখা হয়। সুতনু দারুণ ফুটবল খেলত, যখন বল নিয়ে দৌড়ত মাঠের ধারে বসে হাঁ করে দেখত টুনু, ছিপছিপে লম্বা চেহারাটা মনে হত হাওয়ার মধ্যে দিয়ে পিছলে যাচ্ছে। টুনুকে চকলেট খাওয়াত মাঝেমাঝে, পাজি ছেলেরা পেছন থেকে এসে টুনুর প্যান্ট খুলে দিলে রুখে দাঁড়াত, ওর ভয়ে অনেকেই টুনুকে ঘাঁটাত না। আজ এই জায়গাটায় হাত রেখে ওর সুতনুর কথা মনে পড়ছে বেশি করে, কিন্তু তবুও–ঠিক শ্যাওলা নয় যেন, অন্য কিছুর স্পর্শ–হাত রাখতে ভাল লাগছে, মনে হচ্ছে এভাবেই রেখে দেয়, কত আরাম! 

অনেক দূরে মাঠটা ছুটতে ছুটতে  গিয়ে যেখানে আচমকা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গিয়েছে, সবাই চুপচাপ। সেই জঙ্গলের মধ্যে একটা গম্বুজ আছে, রাজা মেদনমল্ল বানিয়েছিল নাকি। ওখানে ফাঁসি দেওয়া হত। ফাঁসুড়ে গম্বুজের ঘুলঘুলিগুলোর মধ্যে হাওয়া ঢুকে বাঁশির মতো শিস দেয় রাত্রিবেলা। একানড়েও ডাকে সেভাবেই, তালগাছ থেকে, সে আওয়াজ পায় মাত্র একজনই, নিশির ঘোর থেকে উঠে যার হেঁটে যাবার কথা থাকে মাঠবরাবর। 

ঘেয়ো চামড়া! 

একটা বোবা চিৎকার পেটের ভেতর থেকে উঠে এসে টুঁটি টিপে ধরতে চাইছিল টুনুর, বিস্ফারিত চোখে হাত সরিয়ে ছিটকে এল। 

তাদের বাড়ির সামনে যে নেড়িটা থাকত, টুনু যার নাম দিয়েছিল প্রফেসর ক্যালকুলাস, শেষদিকে তার লোম উঠে যাচ্ছিল, পচে যাচ্ছিল পেট। সারা গা থেকে বিশ্রী দুর্গন্ধ ছাড়ছিল। সে লুকিয়ে প্রফেসর ক্যালকুলাসের গায়ে হাত বুলিয়ে দিত মাঝে মাঝে, তখন এই পচা গন্ধ, অবিকল এরকম স্পর্শ, তলতলে, আঠালো, পচা। কিন্তু সেটুকুই সব নয়। কেন এই স্পর্শ চামড়ার ব্যাগের হতে পারে না, আর কেনই বা ক্যালকুলাস, তার সবথেকে বড় কারণ অন্য। 

ধকধক করছিল জায়গাটা, যেন ক্যালকুলাসের হার্ট। 

অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকল টুনু। সাধারণ দেওয়াল একটা, কী করে হতে পারে এরকম ! চুপচাপ হাত পা ছড়িয়ে ছোপটা এখন শুয়ে আছে, নিরীহ নির্বিকার।  একটা শুকনো হাওয়া দিল, ফরফর করে উলটে গেল বইয়ের পাতা। হাতে কিছুই লেগে নেই, চটচটও করছে না। এতটা ভুল? টুনু জায়গাটায় আরেকবার হাত রাখল। না কিছু মনেই হচ্ছে না, অন্য জায়গার মতোই, একটু হয়ত বেশি স্যাঁতস্যাঁতে। 

পরবর্তী পর্ব : ৮ ডিসেম্বর ২০২০, সন্ধে ছটা। 

একনড়ে পর্ব ৩

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *