সন্ধে এখন| বৃষ্টি নেমেছে খুব| অনেকক্ষণ| প্রথমে বুঝতে পারিনি| জানলার বাইরে ভরপেট ময়াল সাপের মতো রাস্তা বিছিয়েছিল চুপচাপ| আচমকা কালো পিচের পথ কেমন ধূসর ধুলোট হয়ে গেল| কাঁচা ঘুম-ভাঙা, জেদি বাচ্চা যেন ! অবাধ্য হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঝড়ো বাতাসে ঝুমুরঝামর চুল উড়িয়ে ছুটতে লাগল| তার উড়ন্ত পায়ের পাতা আঁকড়ে ছুটে যাচ্ছিল হলুদ পাতা, শুকনো ফুল যত| আমার মুখ সাজিয়ে রেখেছিলাম গ্রিলের ফ্রেমে| চোখ জুড়ে নেমে এল ঘন স্বচ্ছ জলরং বৃষ্টির পর্দা| তাতে ছোট ছোট সাদা ঝুটো মুক্তো বসানো| হিম হিম বরফ|

রেইন শেডে টুংটাং বেজে যায় পিয়ানো| জলের শব্দ| বৃষ্টির ঝালর| ঢেউ বয়ে যায় রাস্তা জুড়ে| চেনা পথ, বাঁধানো পথ কেমন অচেনা নদী হয়ে যায় ধীরে ধীরে| অন্ধকারের নদী| বেলা ফুরোনোর আগেই বেলা ফুরিয়েছিল আজ|

আলো চলে গেল| ঘরে বাইরে|

সামনের নিকষ অন্ধকারে জেগে থাকে মিছরিদানা বৃষ্টি| নিখুঁত নিটোল|

এমনভাবে আজ তুমি হেঁটে যেও মন ..ওই বৃষ্টিদানা ছুঁয়ে…আলতো পায়ে… এমনভাবে, যেন একটি জলের বিন্দুও ভেঙে নষ্ট হয়ে না যায়|

যত নিজস্ব অনুভব আর অনন্ত ভাঙচুর শুধু কোনও নিভৃতির অবকাশে ফিরে দেখার জন্যই না হয় …তোলা থাক!

এখন সেই নিভৃতি লালনের সময় এসেছে আমার।

বাইরে যদিও বৃষ্টি, জীবনের মুখে কিন্তু আড়াআড়িভাবে পড়ন্ত রোদ্দুরের তাপ । বুঝতে পারি, এতদিনের যাপন ছিল এক অলৌকিক বাগানে লুকোচুরি খেলার মতোই|

বয়স যখন কম ছিল, তখন ছটফটানি ছিল বেশি| পাওয়ার হিসেব করিনি তেমন| দেওয়ার হিসেব করেছি আর ‘হায় হায়’  করে মরেছি  আমার নিজের ঝুলি শূন্য হয়ে গেল ভেবে! স্বার্থপরতার গন্ধে ঢাকা পড়ে গিয়েছে অনামা ফুলের গন্ধ;  যে ফুল আমি দেখিইনি, চিনিইনি, পাশ কাটিয়ে চলে গেছি শুধু | তখন প্রতিদিন ভোরের নরম আলো দেখে ভাবিনি, আবার নতুন একটি দিন এল| ভাবিনি আবার আকাশ দেখার সুযোগ পাচ্ছি, আবার হয়ত বিকেলে বৃষ্টি পড়লে রামধনুও| সারাদিনে না জানি কত আনন্দের টুকিটাকি অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য | তখন তেতো মুখে ভেবেছি, ‘উফ, এই শুরু হল দিনগত পাপক্ষয়| আর পারি না !’

ভাবিইনি আদৌ, যে সেদিনটাতেই হয়ত আচমকা অন্যরকম আলো এসে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে আমাকে! অথচ এমন তো হয়েওছে কত কতবার ! কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই অজানা গন্তব্যে পৌঁছে দেখেছি বৃষ্টিধোয়া আকাশের আবছা নীল ফ্রেমে ছবির মতো আগুনফুলের  কৃষ্ণচূড়া| ডানাভাঙা চড়ুইপাখির গায়ে হাত বুলিয়ে আবিষ্কার করেছি…পালকের নীচে ভয়ে ছোট্ট বুকটা কেমন ধুকপুক ধুকপুক করে! এ সব না হয় কাব্যকথা| কিন্তু রোজের জীবনেও  তো  এমন কত কিছুই ঘটে|

যেদিন কাজের মেয়েটিকে খুব সামান্য দামের কিছু কিনে দিয়েছি, হয়ত একজোড়া ঝুটো পাথরের দুল আর সঙ্গে  সঙ্গে সেটি কানে পরে ঝলমলে  মুখে আমাকে বলেছে, ‘দিদি, কী সুন্দর গো! আমায় ভালো দেখাচ্ছে?’   অথবা, ভিক্ষে  চেয়েছে কেউ.. তার হাতে ভাবলেশহীন মুখে তুলে দিয়েছি নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর দু’টি মুদ্রা…আমাকে সেই বুড়ো ফোকলা ভিখারী হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বলেছে, ‘রানী হও|’

সামনের বস্তির মেয়েটা রাত জেগে হ্যারিকেনের আলোয় পড়ে| দু’দিন অঙ্ক দেখিয়ে দিয়েছিলাম, বকাঝকাও কম করিনি| কে জানে, পয়সাকড়ি নিয়ে  কাউকে পড়ালে একটু সমঝে থাকতাম হয়ত! কিন্তু একমাথা উকুন, বোতামছেঁড়া ফ্রক আর হাতে হাতে মলিন হয়ে যাওয়া কর্পোরেশন স্কুলের রিপোর্ট কার্ড নিয়ে এসে যখন আমাকে বলেছে, ‘দিদি গো , আমি অঙ্কে একশ’তে বিরাশি পেয়েছি…’ তখন ঠিক কেমন লেগেছে আমার?

প্রথমবার মা হয়েছি| চোখ মেলেছি | সে কী ভয় আমার! আমার সন্তান সুস্থ, স্বাভাবিক তো? আবার কেঁপে উঠে  চোখ বন্ধ করেছি, ‘দূর , আমার যত ছাই পাঁশ কুচিন্তা!’ আর পরক্ষণেই ভয়ের অন্ধকার কেটে গেছে যেই, সে কী অমল আলোর উদ্ভাস|

সন্তানদের বকাবকি করেছি তুচ্ছ কারণে| পরীক্ষায়  কয়েকটা নম্বর কম পেলে, সময়ে পড়তে বসছে না, নিজেরা খুনসুটি করছে… কেন যে এক মুহূর্ত এরা আমাকে তিষ্ঠোতে দেয় না! আবার যখন দেখেছি আলোর উল্টো পিঠের অন্ধকার? আমার ছেলেদের মতো আমারই কোনও বন্ধুর ছেলে.. নিরুদ্দেশ, আত্মঘাতী, মারণ নেশা করে! শিউরে উঠে বলেছি মনে মনে, ‘ অধৈর্য হয়ে যা ভেবেছি, যা করেছি, যা বলেছি … সব ভুল|’

ব্যস্ত থেকেছি সংসারে না-পাওয়ার সালতামামিতে| বিরক্তি আর আত্মশ্লাঘা পরম বন্ধুতায় হাত ধরাধরি করে চলেছে কত সময়| ভেবে দেখিনি, কিছু পেতে গেলে তো কিছু দিতেও জানতে হয়! আমি দিতে শিখেছি কি সেভাবে? এখন মনে হয় কই, শিখিনি তো! যা পেয়েছি, তার পুরোটা তো হিসেবমতো আমার প্রাপ্যও ছিল না! আমার ঝুলি শূন্য ভেবে দীর্ণ হয়েছি..দেখিইনি শূন্যতাও পূর্ণ হয় আলোয়!

প্রিয়জনবিয়োগে কষ্ট পাই, পেয়েছি| অন্তহীন ভয় এখনও অনুক্ষণ আমাকে কোণঠাসা করে রাখে… প্রিয় মানুষগুলো চলে যাবে একে একে? আমি আর দেখতে পাব না ওদের? এখন আবার ভয়ের পাশে পাশে ভাবি, এসব ভাবছি কেন এখন থেকেই? আজ যা আছে সেটুকুই নিংড়ে নিই! আমার মুঠি ভ’রে উঠুক|

চলার পথে এমন তো কত কিছু, কত জন, কত অভ্রকুচি ভালোলাগা রং বিছিয়েছে নানা ভাবে| মাঝে মাঝে অসতর্কতায় অবহেলায় আমার  হৃদয়ের চোখ  অন্ধ হয়ে যায় হয়ত, আলোও  নিভে যায়| তখনই এই সব তুচ্ছ অথচ সত্য কিছু অনুভব স্মৃতির চকমকি পাথরটি হয়ে আগুনের ফুলকি জ্বালিয়ে দেয় আচমকা| আমার দৃষ্টিহীন হৃদয়, আমার বিবর্ণ চিন্তা, আমারএকমুখী অনর্গল অযৌক্তিক কথা বলতে থাকা মন অশেষ প্রাপ্তিসুখে আর অপার কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয়|

ইলেকট্রনিক্সের ছাত্রী ঈশানী রায়চৌধুরী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত। নিজস্ব লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে পছন্দ রম্য গদ্য আর ছোট গল্প | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ফ্রিডা কাহলো, খলিল জিব্রান, আর কে নারায়ণ প্রমুখ লেখকদের কাজ ভাষান্তর করেছেন। 'কৃষ্ণচূড়া আর পুটুস ফুল', 'আবছা অ্য়ালবাম', 'বাবু-টাবুর মা', ওঁর কয়েকটি প্রকাশিত বই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *