আগের পর্বের লিংক: [১] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১]

উকিলবাবুর নাম মনে নেই৷ পাড়ার লোকে বলত, নাটা উকিল৷ বেবিআন্টি বলতেন, ছোটা উকিল৷ পাতি পাবলিক চেহারা৷ ক্ষয়াটে চোখমুখ৷ টাকের ওপর গুটিকয় রুগণ চুল নেতিয়ে আছে৷ পোশাক বলে দেয় পসার ভালো নয়৷ কবেকার কালো কোট কাগজ-পোড়া ছাইরঙা হয়ে গেছে৷ ব্যাগের চামড়া ছাল-চটা লতপতে৷ ভিড়বাসে কোনওক্রমে শরীর গুঁজে শিয়ালদা কোর্টে যান৷ ফেরার পথে বউবাজারের ফুটপাথে সস্তার বাজার করেন৷ উকিলবাবুর বাড়ি বেবিআন্টির ঘরের দেয়ালে৷ দরজা উল্টোদিকে হলেও আন্টিকে উকিলবাবুর কাছে যেতে হয় মাঝেমাঝেই৷ কারণ, বালক শুনেছে, থানা থেকে আসামীকে ছাড়িয়ে আনতে এবং কোর্টে জামিন করাতে উকিল লাগে৷ ছোটা উকিলকে দিয়ে কম পয়সায় হয়ে যায়৷ শুধু বেবিআন্টি নয়, আরও যত বান্টি-মান্টি আছে সবার ঘরে থানার ডাকবাবু আসে৷ তখনই উকিলবাবুর ডাক পড়ে৷ বড়ো হয়ে বালক ভেবেছে, এত অপরাধ ছিল ওই আধখানা ইট আর আধখানা কাঠের অদ্ভুত বাড়িটাতে? অপরাধ আর উকিলের এমন সহবাস সে ছেলেবেলায়ই দেখার সুযোগ পেয়েছে৷ আরও ভেবেছে, এই ‘মে গাড ব্লেস ইউ’ কমিউনিটি আশৈশব বঞ্চনার মধ্যে বড়ো হয়, যা তাদের অপরাধের পথে ঠেলে দেয়৷ 

flag
রাত জেগে তোমরা, বাচ্চা ছেলেরা স্বাধীনতাদিবসের কাজ করেছ।

এহেন উকিলবাবুর ছেলে এক ১৫ আগস্টের প্রভাতে আবির্ভূত হল৷ পাড়ার ছেলেপুলেরা তখন তেমাথায় চুন-সুরকি দিয়ে ভারতের মানচিত্র আঁকার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল৷ তখনও জানা যায়নি ইনি উকিলবাবুর ছেলে৷ রাজপুত্রের মতো৷ ছ-ফুটের ওপর লম্বা৷ সুঠাম গড়ন৷ পরনে সাদা-নীল পোশাক৷ পরে জানা যায়, ওটা ভারতীয় নৌবাহিনীর উর্দি৷ পিচরাস্তায় জুতো খটখটিয়ে এ-মাথা ও-মাথা প্রায় কুচকাওয়াজ করলেন তিনি৷ ছেলেপুলেরা অনেক কিছুই দেখেছে, সিনেমার হিরোর মতো জ্যান্ত মানুষ এপাড়ায় দেখেনি৷ হিরো মানচিত্রের কাছে দাঁড়িয়ে বালকদের জিজ্ঞাসা করলেন,
– পতাকা কে তুলবে? আমি নেভিম্যান৷ সমুদ্রে ভারতের সৈনিক৷ দেশকে তোমরা ভালোবাসো দেখে আমার গর্ব হচ্ছে৷ রাত জেগে তোমরা, বাচ্চা ছেলেরা স্বাধীনতাদিবস পালনের কাজ করেছ৷ দেশের প্রতি এই ভক্তি তোমাদের অটুট রাখতে হবে৷ আমি সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে দেশের সীমানা পাহারা দিই৷ শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করি৷ তোমরা যদি চাও তো আমি পতাকা তুলতে পারি৷ আমার বাবা তোমাদের পাড়ার বিখ্যাত উকিল৷ তিনি অপরাধীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেন৷ আমি বিদেশি শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করি৷ যদি বলো, আমি ও আমার বাবা দুজনেই পতাকা তুলব৷ 

এতক্ষণে বোঝা গেল হিরোর মতো যুবক উকিলবাবুর ছেলে৷ তিনি সেই ভোরে হুবহু এই ভাষায় হয়তো নয়, এভাবেই বলেছিলেন৷ কথার শেষে বলেছিলেন ‘বন্দেমাতরম’ এবং বালকদের হাতে হাতে লজেন্স দিয়েছিলেন৷ একটা সমস্যা দেখা দেয় তখনই৷ ইমারতি মালপত্রের দোকানের মালিক গৌরাঙ্গ রায়কে বলা হয়েছে পতাকা তুলতে৷ গত সন্ধেয় ছেলেরা ইট-চুন-সুরকি চাইতে দোকানে গিয়েছিল৷ গৌরাঙ্গ রায় বরাবরই দেন৷ বলেন, ইটগুলো ফেরত দিয়ে যাস, বাপু৷ পাঁচটা টাকা রাখ৷ ফুলমালা কিনে আনিস৷ যদি কাউকে না পাস, বলিস, দোকান খোলার আগে পতাকা তুলে দেব৷ পাঁচ বছরের মধ্যে একবার ক্ষীরোদমাস্টার তুলেছিলেন৷ বাকি চারবার গৌরাঙ্গ রায়৷ গতকাল তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছে, কাকাবাবু, কাল দশটায় আসবেন৷ এবার হাতে মুখে লজেন্স নিয়ে ছেলেরা কী বলা যায় ভাবতে থাকে৷ ফট করে সমস্যা সমাধান করে দেয় বিমল৷ বলে, কাকু, আমাদের পতাকা তোলেন গৌরাঙ্গকাকু৷ উনি ইট-চুন-সুরকি দেন৷ আমাদের ভালোবাসেন৷ আজ দশটায় উনিই আসবেন৷ আসছে বছর আপনি তুলবেন৷
– ঠিক আছে৷ অনুষ্ঠান ভালোভাবে হলেই হল৷ দেশ একটা বড়ো ব্যাপার৷ আমরা যারা দিন নেই রাত নেই দেশের মাটি পাহারা দিই, তাদের মতো স্বাধীনতার মর্ম আর কে বুঝবে? তাই বলছিলাম৷ ঠিক আছে৷ আমি বাবাকে নিয়ে দশটায় চলে আসব৷ আর-একটা কথা, তোমরা আমাকে কাকু বলবে না৷ আমি স্বরাজ ঘোষ৷ আমাকে দাদা বা স্বরাজদা বলবে৷
বলে হিরোর মতো যুবক খটখটিয়ে উকিলবাড়ির দিকে হেঁটে যান৷

আমি সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে দেশের সীমানা পাহারা দিই…

মনে আছে, নেভিম্যান স্বরাজ ঘোষের আবির্ভাব পাড়ার ছবি কিছুটা পালটে দিল৷ হরিপদদার ইস্ট ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্ট ছিল খোলামেলা তর্কের জায়গা৷ সেখানে স্বরাজ ঘোষ ঢুকলেই সবাই কথা গুটিয়ে নিতে থাকল৷ যেমন, অক্ষয়দা ছিলেন কংগ্রেসের সমর্থক৷ তিনি বললেন,
– কংগ্রেস আমাগো স্বাধীনতা দিছে, সংবিধান দিছে৷ গণতান্ত্রিক দেশ দিছে৷ আমাগো উচিত কংগ্রেস সরকাররে ঠিক মতো কাজ করার সুযোগ দেওয়া৷ কমিউনিস্টরা খালি অশান্তি বাধায়৷ স্বাধীনতা সম্পর্কে অগো নীতি আইজও ঠিক করতে পারে নাই৷
চিৎকার করে উঠলেন বিপুলদা।
– থামো৷ দালালি কইরা স্বাধীনতা পাইলা, আবার বড়ো বড়ো কথা! কংগ্রেস মানে আত্মসমর্পণ আর বিশ্বাসঘাতকতা৷ আগে ইংরেজের কাছে আত্মসমর্পণ করছে৷ এখন টাটা-বিড়লা আর কালোবাজারিদের কাছে৷ দেশটারে টুকরা কইরা স্বাধীনতা আনছে৷ রিফিউজিগো লগে বিশ্বাসঘাতকতা করছো৷
ঠিক এই সময় স্বরাজ ঘোষ দোকানে ঢুকলেন৷ সব্বাই চুপ৷ এইভাবে কিছুক্ষণ৷ কেটলিতে গরম জলের শোঁ শোঁ৷ চায়ের গ্লাসে চামচের টুং টাং৷ স্বরাজ ঘোষ বললেন,
– আপনাদের আলোচনা থেমে গেল কেন? আমি বলি কী, আমরা এমন মন্তব্য যেন না করি যা দেশের বিরুদ্ধে যায়৷ দেশকে ভালোবাসা আমাদের প্রথম কাজ৷ এটা যারা না মানে তারা দেশদ্রোহী৷ দেশের ভেতরকার শত্রু৷ আমরা বাইরের শত্রুকে পরাজিত করব৷ আপনারা ভেতরের শত্রুকে৷ এটা আপনাদের দায়িত্ব৷
এরপর কে আর কথা বলে৷ স্বরাজ ঘোষ উঠে গেলে বিপুলদা বলেছিলেন,
– আমরা কি মীনাকুমারী-মালা সিনহা-সায়রা বানু নিয়ে শুধু কথা বলব? হরিপদর রেস্টুরেন্টে জাতীয়তাবাদ ঢুকে গেছে৷ 

বালক তখনও জানে না ‘জাতীয়তাবাদ’ কী? চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় শব্দটা সে শুনেছে৷ কিন্তু তখন সে নিতান্ত বালক৷ পাড়ায় অচিরেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, স্বরাজ ঘোষটা কে? স্বরাজ নামে উকিলবাবুর কোনো ছেলেকে আগে কেউ দেখেনি, নামও শোনেনি৷ যদি থেকেও থাকে, এতদিন ছিল কোথায়? কোথায় পড়াশোনা করেছে? নেভিতে গেল কবে? উকিলবাবু কি আগে অন্য কোথাও থাকতেন? তাঁর কি আর কোনও সংসার আছে? উকিলবাবুর স্ত্রীর আগের পক্ষের ছেলে? চেহারায় তো এতটুক মিল নেই৷ কে জানে কোথায় কী হচ্ছে৷ এই পাড়ায় কে যে কার, আর কে যে কার না, ভাবতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায়৷ স্বরাজ ঘোষ চায়ের দোকানে আসেন কম৷ তবে একটা অস্বস্তি সেই খোলামেলা মুখরতা অনেকটাই চাপা দিয়েছে যেন৷ তাঁকে বেশি দেখা যৈায় সেই আধখানা ইট আর আধখানা কাঠের রহস্যময় বাড়িতে৷ আর দেখা যায় এ পাড়ার সে পাড়ার ছোটবড়ো ক্লাবে৷ পার্কসার্কাস মাঠে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যান৷ নিছক দেখতে যাওয়া নয়৷ কোনো ক্লাবের সাপোর্টে মারকুটে দল নিয়ে যাওয়া৷ প্রতিপক্ষের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করা৷

ছবিটা আরও পালটে গেল খাদ্যসংকটের সময়৷ সাল ১৯৬৫৷ বাজারে চালের দাম হু হু করে বাড়ছে৷ যেসব মুদিদোকানে এতদিন চাল পাওয়া যেত, সেখানে চাল অমিল৷ যেখানে পাওয়া যায়, দাম দুগুণ-তিনগুণ বেশি৷ রেশনে লম্বা লাইন৷ মাঝে মাঝে সেখানেও স্টক নেই৷ কোনওদিন গম নেই, চিনিও নেই৷ অথচ সবই আছে৷ দিলীপ দে-র ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে রাতের অন্ধকারে রিকশা করে সাইকেল ভ্যানে করে বস্তা বস্তা চাল-চিনি যায় এ পাড়ার ও পাড়ার হোটেলে, মিষ্টির দোকানে, উঁচু উঁচু বাড়ির বড়লোক-ঘরে৷ পাহারা দেয় স্বরাজ ঘোষ৷ লম্বা লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে খালিব্যাগে ফিরে যেতে যেতে লোকজন গজগজ করে বটে, চিৎকার করে একটা শব্দও বলে না৷ স্বরাজ ঘোষকে ভয়৷ বিনিময়ে স্বরাজ মাসোহারা পান দিলীপ দে-র কাছ থেকে৷ বালকের দেখা প্রথম ভাড়াটে গুন্ডার নাম স্বরাজ ঘোষ৷ ছবিটা আরও পালটাতে থাকে৷ পাড়ার সব দোকান থেকে তোলা আদায় করতে শুরু করে স্বরাজবাহিনী৷ সবাই মুখ বুজে দিয়ে দেয়৷ তোলাবাজির আদিযুগের যুবরাজ স্বরাজ৷

Food Crisis
কোনওদিন গম নেই, চিনিও নেই৷ অথচ সবই আছে।

একটা ক্ষুদ্র প্রতিবাদ জমা হচ্ছিল৷ দিলীপ দে-র ন্যায্যমূল্যের দোকানে দু’নম্বরি রেশন কার্ডের মেমো লেখেন কার্তিকদার বাবা৷ রাতে গুদামের বন্ধ ঘরে বসে৷ শয়ে শয়ে অবৈধ মেমো৷ বুড়ো মানুষ৷ গরিব মানুষ৷ সামান্য কিছু পয়সার জন্য নিদারুণ খাটনির কাজ মেনে নিয়েছেন৷ এক রাতে তাঁর পায়ে কামড় বসায় ধেড়ে ইঁদুর৷ গুদাম ইঁদুরে ভরতি৷ বিষাক্ত তরল স্প্রে করলে কিছুদিন কম থাকে৷ তারপর আবার৷ অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে কার্তিকদার বাবা ঘরে ফেরেন৷ রাতে ধুম জ্বর৷ সকালে চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে৷ দু’দিন বাদে মারা গেলেন রুগণ মানুষটি৷ কার্তিকদা বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী করলেন দিলীপ দে-কে৷ চেঁচামেচি করতে থাকলেন দিলীপের অবৈধ কাজকর্ম নিয়ে৷ কালোবাজারে কোথায় কীভাবে চাল-চিনি যায় এসব বলতে লাগলেন এবং আক্রমণ করা হল স্বরাজ ঘোষকে৷ পালের গোদা দিলীপ আর তার ভাড়াটে সাকরেদ স্বরাজ৷ খবর পেয়ে স্বরাজ এলেন, কার্তিককে শান্ত করতে চাইলেন, তারপর তুলে নিয়ে বেধড়ক পেটালেন৷ তাতেও থামানো যায়নি পিতৃহারা যুবককে, প্রতিবাদী মানুষটিকে৷ তাঁকে সমর্থন করতে চেয়েছে কেউ কেউ, দূর থেকে, নিজেদের বাঁচিয়ে৷

এই ঘটনার মাসখানেক পরই আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটে গেল যা আজও বোঝার অতীত৷ এক গাড়ি পুলিশ অফিসার এসে তুলে নিয়ে গেল স্বরাজ ঘোষকে৷ কেন নিয়ে গেল? কেউ বলে, ও নেভি থেকে পালিয়ে এসেছিল৷ ওর নামে পরোয়ানা ছিল৷ কেউ বলে, ও নেভির কেউ নয়৷ পোশাক জাল করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ক্রাইম করত৷ কেউ বলে, ওর বিরুদ্ধে খুনখারাবির অভিযোগ আছে বিভিন্ন থানায়৷ এখানে লুকিয়ে ছিল৷ জানা যায়, উকিলবাবু স্থানীয় থানায় যান৷ সেখান থেকে বলে দেওয়া হয়, আমাদের কিছু করার নেই৷ হেডকোয়ার্টারের কর্তারা তুলে নিয়ে গেছে৷ বালকদের বস্তি অধ্যুষিত গরিব-গুর্বো পাড়ায় এত বড়ো অপরাধী, বেশ কিছুদিন তপ্ত চর্চার মধ্যে ছিল৷ (চলবে)

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৬ অক্টোবর ২০২২
ছবি সৌজন্য: India.com, Pinterest

Madhumoy Paul

মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক‍্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন‍্যাস। বই আখ‍্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *