আলু আলু আর আলু। বিরিয়ানিতে আলু ছাড়া চলেই না, রোববারের মাংসের ঝোল আলু ছাড়া? ইমপসিবল! আলুপোস্ত, আলুর টক, আলুভাজা আলুকাবলি, বাঙালিরা আলুকে এমনভাবে নিজের করে নিয়েছে, আর হাবভাব এমন যে আলুর জন্মই যেন বাংলায়…

তা কিন্তু মোটেই নয়! আলুর জন্ম কোথায়? কোথায় তবে? 

কোন সুদূর পেরুতে নাকি হাজার হাজার বছর আগে, কোন খ্রিস্টপূর্বে… পুরাতত্ত্ববিদরা পারেনও বাবা, খুঁড়ে বের করতে পেরেছিলেন পুরনো আলুর টিউবর, আর আলুর আকারের সেরামিকের বাটি। 

আমার অবশ্য পেটপুজো নিয়েই মূল উৎসাহ। কাজেই প্রশ্ন হল, আলুর উৎস যে দেশে, সেখানে কীভাবে আলু রান্না হয়? ভীষন কুঁড়ে তো, তাই বই বা লেখা না ঘেঁটে, সোজা জিজ্ঞেস করলাম আমার দিদিকে। আমার দিদি হল ইন্দিরা দেবীর মতন, নানান দেশ ঘুরে রেসিপি জোগাড় করেন, কিন্তু বানান না।

কজ়া লিমেনা (Causa limeña)

– Peruvian আলু সেদ্ধ? তাহলে  Causa limeña বানা। দিদির জবাব। 

বানাব তো, কিন্তু অত্ত সুন্দর হলুদ আভা-সমেত শার্লট আলু (Charlotte), কোথায় পাব? কাজেই আমাদের দিশি চন্দ্রমুখীই সই। তাতে না হয় হালকা হলুদ রঙ মেশাব… ইয়েলো পেপার দিয়ে। 

অতএব আলুসেদ্ধ খোসা ছাড়িয়ে নুন, হালকা লাল লঙ্কার পেস্ট, লেবুর রস আর অলিভ অয়েল দিয়ে মাখা হল। অলিভ অয়েল? আমি না ভুল করে মাখন দিয়েই মেখেছিলাম! কী করি, আজন্মের অভ্যাস যে! আলুসেদ্ধ হলেই ঘি-মাখন চাই!!

এরপর অ্যাভোকাডো কুচি করার ছিল। আমার কাছে সেটা ছিল না। সবুজ রঙের শশা ছিল। কুচি করে লেবু, নুন আর মরিচ দিয়ে মাখলাম। 

আর চিকেন জলে পোচ করে রাখা ছিল নুন মরিচ দিয়ে। সেটা ছোট্ট ছোট্ট টুকরো করে গোলমরিচ, নুন, মেয়োনিজ়, চিলি ফ্লেকস দিয়ে মাখলাম। ব্যাস সব রেডি!

এবার ফুড রিং চাই। কোথায় পাই! এই পর্বটা বাড়িতে ছেলেমেয়ে থাকলে সানন্দে একটা পিচবোর্ড দিয়ে বানিয়ে ফেলা যেতেই পারে। ছবিতে দিলাম বাড়িতে বানানো ফুড রিং।

প্লেটে সাজানোটাও বেশ মজার। রিংয়ের ভিতরে প্রথমে গেল আলুর লেয়ার, তারপর অ্যাভোকাডো/ বা শশার লেয়ার। তারপর চিকেন। তারপর আবার শশা আর শেষে আবার আলু সেদ্ধ। আস্তে আস্তে কায়দা করে রিংটা তুলে ফেলে ওপরে ডিম সেদ্ধ লেটুস পাতা বা ইচ্ছেমতন সাজানো… 

Causa Limena
প্লেটে সাজানো কজ়া লিমেনা

বাড়িতে ছেলেমেয়েদের জন্যে বেশ মজার, ওরা চেখে দেখার আগে চোখে দেখে কিনা! টেবিলে সাজিয়ে রাখছি, অমনি ঘাড়ের পাশ দিয়ে উঁকি মেরে মা বলল, “কী বানালি? অ, এ তো আমাদের আলু সেদ্ধ! নতুন জামায়!”

[কী কী লাগবে তাহলে? রিভিশন করি? মাপ আর লিখছি না, স্বাদ আর দৃষ্টি নিজের নিজের]

আলু, লেবুর রস, মাখন, নুন, শশা বা অ্যাভোকাডো, নুন, গোলমরিচ, চিকেন, মেয়োনিজ়। সাজানোর জন্যে ডিমসেদ্ধ, লেটুস আর যা খুশি…

শেপার্ডস পাই (Shepherd’s pie)

দিদি বলল, “তারপর ষোড়শ শতক নাগাদ জাহাজে চেপে আলু গেল ইউরোপে। সবাই আপন করে নিল, আর আলু হয়ে গেল গরিব মধ্যবিত্তের প্রধান খাবার। গরিব কৃষক পরিবার, যে হাতে ফসল ফলায়, সেই কঠিন হাতে অর্জন করা খাদ্য। ‘আলু’ খাওয়ার সেই বিখ্যাত ছবি, ‘দ্য পোট্যাটো ইটার্স’, ভিনসেন্ট ভ্যান গখ, মনে পড়ছে? সেই রকমই কোনও কৃষক পরিবারের গৃহিণীদের উদ্ভাবন হয়তো শেপার্ডস পাই (Shepherd’s pie) বানিয়ে ফেলতেই পারিস…”

Boiled Potato and Keema Ready
বেক করার আগে আলুসেদ্ধ আর কিমা সাজানো শেষ

চমৎকার! তেমন কঠিন তো নয়! পেঁয়াজ-রসুনকুচি তেলে নেড়ে, তাতে পরিষ্কার মাংসের কিমা দিয়ে দাও। স্বাদমতো নুন আর মিক্সড হার্বস দাও। খানিক সেদ্ধ হয়ে এলে পছন্দমতো সবজি, এই ধর গাজর, টমেটো, মটরশুঁটি, কর্ন, সব দিয়ে নাড়তে নাড়তে সেদ্ধ হলে, একটু কর্নফ্লাওয়ার দিয়ে শুকনো শুকনো নামিয়ে নাও। 

ওদিকে নরম আলুসেদ্ধ, মাখন, চিজ়, রসুনগুঁড়ো, মরিচগুঁড়ো, ক্রিম, স্বাদমতো নুন দিয়ে মেখে নাও। 

একটা বেকিং ট্রে-তে, ধর এক ইঞ্চি কিমা লেয়ার, তারপরে এক ইঞ্চি আলুর লেয়ার দিয়ে দাও। ওপরে চিজ় গ্রেট করে দিয়ে সুন্দর কোনও ডিজাইন করে, ওভেন ২০০°সেলশিয়াসে প্রি-হিট করে, বেকিং ট্রে বসিয়ে দিলেই হল। বেরিয়ে এল আধঘণ্টা পর, গরম গরম।

ওপর থেকে দেখে এবারও মা বলল, “অ, এটাও তো আমাদের আলুসেদ্ধই…”

Oven Hot Shepherd's Pie
ওভেন থেকে বের করা গরমাগরম শেপার্ডস পাই

আবার রিভিশন। তাহলে শেপার্ডস পাই করতে লাগছে:

২৫০ গ্রাম কিমা
তিন চারটে ছোট পেঁয়াজকুচি
৬-৭ টা রসুনকুচি
কিছুটা গাজর ছোট্ট কুচি। ধর এক মুঠো।
ততটাই মটরশুঁটি, কর্ন, একটু পার্সলে বা ধনেপাতা কুচি,
মিক্সড হার্বস দু’ চামচ
নুন মরিচ

Shepherd's Pie Served on the table
পাতে পড়ল শেপার্ডস পাই

আলুর জন্যে

৩০০-৩৫০ গ্রাম আলু
মাখন দু’ চামচ
ক্রিম ১/৪ কাপ
রসুনগুঁড়ো এক চামচ
গ্রেট করা চিজ় এক কিউব
নুনমরিচ স্বাদমতো
আর সাজানোর জন্যে চিজ় কিউব গ্রেট করা
ব্যাস…

এরপর পর্তুগিজদের হাত ধরে বাটাটা বা আলু এল আমাদের দেশে। পর্তুগিজ আলুসেদ্ধ বাটাটা আও মারো (batata ao murro) গোয়াতে দিদির বাড়িতে বসে হবে, তোলা রইল। বাকিটা হয়ে গেল ইতিহাস, যেই না ইংরেজদের হাত ধরে আলু এল বাংলায়! 

Best is mothers recipe
কিন্তু সবার চাইতে ভাল… মায়ের হাতেৃর ফ্যানভাত আর আলুসেদ্ধ

তারপর আলুসেদ্ধ যেদিকেই যাক না, আসামের আলু পিটিকা হয়ে ইন্দোনেশিয়ার কেনটাং হয়ে, আমি আটকে রইলাম মায়ের বানানো ফ্যানভাত আর আলুসেদ্ধতে।
“কাল হবে নাকি মা? আমাদের আলু সেদ্ধ ফ্যান ভাত?”

*ছবি এবং রান্না সৌজন্য: লেখক

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

5 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *