আগের পর্বের লিংক: []

বিষাদমাখা পথের ধারে

সন্তর্পণে মোটরওয়ে পেরিয়ে ওপারে যাওয়ার পর দেখা গেল একটা রাস্তা ভেতরের দিকে এগিয়ে গেছে। সেই পথে পাঁচ-ছশো মিটার হাঁটার পর অবশেষে পাওয়া গেল গন্তব্যের সন্ধান। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া বিশাল এক চত্বর। ভেতরে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অট্টালিকাটি রৌদ্রস্নাত  দ্বিপ্রহরেও তেমন একটা উজ্জ্বল নয়। বরং বিষাদগ্রস্ত। বাড়িটির ছাদে পতপত করে উড়ছে বেলজিয়ামের জাতীয় পতাকা। তারকাঁটার বেড়াঘেরা চত্বরের ভেতরে যাওয়ার সদর দরজার পাশে, বোর্ডের উপর ইংরেজি-সহ অন্যান্য ভাষায় পরিষ্কার লেখা আছে ‘জাতীয় স্মারক ব্রিনডংক ফোর্ট।’ আরও লেখা আছেএই স্মারককে সম্মান করুন। যন্ত্রণাদীর্ণ ৩৫০০ বন্দী এখানে বসবাস করতেন। ১৮৪ জন বন্দিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ফাঁসির দড়িতে প্রাণ হারান ২৩ জন। অত্যাচারভুল চিকিৎসায় ১০০ জন বন্দি মারা যান। 

Breendonk Fort
কাঁটাতারের বেড়ার পাশেই বোর্ডে লেখা ইতিহাস

প্রবেশ পর্বেই মন বিষণ্ণ। দরজায় কোনও রক্ষী নেই। মোরাম বিছানো পথে পায়ে পায়ে খানিকটা এগোলেই রিসেপশন। এক প্রবীণ মহিলা দফতর সামলাচ্ছেন। স্বাগত জানানোর পরই তাঁর পরামর্শএত কম সময়ে ব্রিনডংক ফোর্ট ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। তাছাড়া টিকিটের দাম বেশ বেশি। মাথাপিছু ১১ ইউরো। বাপ্পাদিত্য বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে দিলেন যে সত্যি সত্যিই দেরি হয়ে গেছে। দেরির কারণ ব্যাখ্যা না করেই বলতে লাগলেন, “তবে এসে যখন পড়েইছি তখন একবার ভেতরে গিয়ে যেটুকু ঘুরে দেখা যায় দেখে আসা যাক।” একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিকিট কেটে দু’জনের হাতে দুটো হেডফোন ধরিয়ে দিয়ে খুব বিরক্তির সঙ্গে মহিলা জানিয়ে দিলেন, যেভাবেই হোক পৌনে পাঁচটার মধ্যে ফিরে আসতেই হবে। কারণ ঠিক পাঁচটার সময় তালা লাগিয়ে দিয়ে তাঁকে বাড়ি ফিরতে হবে। 

Breendonk Fort 3
জরাজীর্ণ রেলগাড়ির ভাঙাচোরা ওয়াগন

এইসব হেডফোন আসলে চলমান যান্ত্রিক গাইড। নির্দিষ্ট ভাষা বেছে নিয়ে সুইচ অন করলেই বকবকানি শুরু করে। যন্ত্রের ভেতরে থাকা সফ্টওয়্যারের সুবাদে প্রতিটি জায়গায় পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রসঙ্গে কথা শুরু করে দেয়।  ভারতেও এখন বহু পর্যটন কেন্দ্রে এই ব্যবস্থা বহুল প্রচলিত। মেরেকেটে ঘণ্টা তিনেক। আর টিকিট কাটার আগেই বলে দেওয়া হয়েছে ভালো করে ঘুরে দেখতে হলে অন্তত চার ঘণ্টা সময় লাগে। কী আর করা! রিসেপশন থেকে বেরিয়ে আবার মোরাম বিছানো পথ। বাঁ দিকে বেশ খানিকটা দূরে একটা জরাজীর্ণ রেলগাড়ির ভাঙাচোরা ওয়াগন পড়ে আছে। হয়তো এককালে বন্দিদের আনা নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হত।

রহস্যমাখা দুর্গ

পথের চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর। গাছ নেই বললেই চলে। তবে ঘাস আছে। দেখে বোঝা যায় নিয়মিত কাট-ছাঁট করা হয়। দূর থেকে যে আপাত মলিন বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল, সেটাই আসলে ব্রিনডংক ফোর্ট। একটু দূরে ফোর্টের ভারী ফটক। কোথাও কোনও জনমনিষ্যি নেই। না দর্শক-পর্যটক, না কোনও রক্ষী। আরও একটু এগোতেই নজরে এল ফোর্টের মূল অট্টালিকার চারধার ঘিরে রেখেছে একটি প্রশস্ত পরিখা। পরিখার গড় গভীরতা প্রায় ৪ মিটার। আর প্রস্থ ৫০ মিটার। ফটকের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা একটি সেতুর উপর দিয়ে চলে গেছে। আসলে কাঁটাতার ঘেরা চত্বরের ভেতরে প্রবেশ করার পর থেকেই শুরু হয়েছে ফোর্টের প্রাঙ্গণ। মূল দুর্গ ঘিরে পরিখা নির্মাণ তো যে কোনও দুর্গেরই প্রাথমিক প্রয়োজন। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। 

Breendonk Fort 2
একটু দূরে ফোর্টের ভারী ফটক

অ্যান্টওয়ার্প প্রদেশের প্রান্তসীমায় পেটিট-ব্রাব্যান্ট এলাকায় অবস্থিত ব্রিনডংক ফোর্ট ১৯০৬ থেকে ১৯১৩ সময়সীমায় নির্মিত হয়। শত্রুর হাত থেকে অ্যান্টওয়ার্প বন্দর-শহরের সুরক্ষার জন্য গড়ে তোলা এই দুর্গ রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের অবদান। যান্ত্রিক গাই?ড এই খবর শোনানোর সঙ্গে সঙ্গেই আবার মনখারাপের পালা। এখানেও রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড! এ দেশে কি রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড ছাড়া অন্য কেউ রাজত্ব করেননি? নাকি পূর্বসূরীদের কীর্তির উপর নিজের নামাঙ্কিত ফলক বসিয়ে নিজেকে জাহির করেছিলেন

কে এই দ্বিতীয় লিওপোল্ড?

বেলজিয়ামের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের অসংখ্য কীর্তি। রয়্যাল প্যালেস থেকে শুরু করে তার উল্টোদিকের পার্ক। সরকারি ভবন, মিউজিয়াম, বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত, বোটানিক্যাল গার্ডেন, এককথায় সমস্ত বিশাল স্থাপত্য, ইমারত, উদ্যানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের নাম। ছোটবড়ো নানান আকারের নানা ভঙ্গির রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের মূর্তি বেলজিয়ামের এখানে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে। সত্যি সত্যিই তার হিসেব রাখা সহজ ব্যাপার নয়। কৌতূহল হতেই পারে। রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের আগে এবং পরে যাঁরা বেলজিয়ামের সিংহাসনে বসেছিলেন তাঁরা কি কিছুই করেননি? নিশ্চয়ই করেছিলেন। তবে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের কীর্তির তুলনায় নিতান্তই নগন্য। 

Leopold II
বেলজিয়ামের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের অসংখ্য কীর্তি

সাবেক আমলের সমস্ত প্রাসাদ ইমারত সবই এখন কোনও না কোনও মিউজিয়াম বা আদালত কিংবা প্রশাসনিক ভবন। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে নজরে আসে, প্রায় সব স্থাপত্য, উদ্যান, রাস্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের নাম। থাকবে না-ই বা কেন? এসব তো তাঁর উদ্যোগে, আর্থিক আনুকূল্যে নির্মিত। তার উপরে বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে দেশের মানুষের কাছে তিনি যথেষ্ট জনদরদী রাজা। দ্বিতীয় লিওপোল্ডের আমলে দেশে শ্রমিক অধিকার স্বীকৃতি পায়। তাঁর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিক ইউনিয়ন। দেশের মধ্যে তিনি শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করেন। এই সময়েই দেশের শ্রমিকরা দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণের অধিকার লাভ করেন এবং রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে প্রচলিত হয়। তাঁর শ্রম আইনের তিনটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল

১. বারো বছরের কমবয়সীরা কারখানায় কাজ করতে পারবে না।
২. ষোলো বছরের কমবয়সীদের জন্য রাতের কাজ নিষিদ্ধ।
৩. একুশ বছরের কমবয়সী মহিলাদের ভূগর্ভস্থ কাজে নিয়োগ করা যাবে না। 

Belgium Govt Office
বেলজিয়ামের প্রশাসনিক ভবন

বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের নামখচিত ব্রাসেলসের সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা, মিউজিয়াম, উদ্যান ইত্যাদি সফরের পর পর্যটকরা উচ্ছ্বসিত। জনকল্যাণমূলক কাজে তাঁর অবদান নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। তাহলে এত সম্পদ, এত বৈভব, এত প্রাচুর্যের সমাহার কী করে হল?

ইতিহাসের পাতার ভাঁজে

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। ১৮৮৪-৮৫ সালে বার্লিনে একটা সম্মেলন হয়েছিল। পোশাকি নাম– ‘বার্লিন ওয়েস্ট আফ্রিকা কনফারেন্স। আসলে আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের ফলে সৃষ্টি হওয়া আফ্রিকার উপনিবেশগুলি নিজেদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া। ইউরোপের তথাকথিত গ্রেট পাওয়ারস্বলে পরিচিত দেশগুলি এই সম্মেলনে আফ্রিকাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। অধিবেশনে অংশ নিয়েছিল গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল এবং বেলজিয়াম। অন্যান্যরাও অবশ্য ছিল, তবে ভাগাভাগির ফলে তাদের তেমন কোনও সুবিধা হয়নি। পরের ষাট বছর পর্যন্ত বলবৎ রইল এহেন ভাগ বাঁটোয়ারার চুক্তি।

কঙ্গোর ব্যাপারটা একটু আলাদা। কঙ্গো বেলজিয়ামের ভাগে পড়লেও দেশটা হয়ে গেল বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আফ্রিকার বাদবাকি দেশগুলো কিন্তু কোনও না কোনও ইউরোপীয় দেশের উপনিবেশ। ব্যক্তিগত সম্পত্তি হওয়ার দরুন দ্বিতীয় লিওপোল্ড নির্মমভাবে কঙ্গোকে নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহের কাজে লাগালেন। 

Congo free state
কঙ্গো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ

কঙ্গো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। খনিজ, কৃষিজ, বনজ সম্পদে সম্পৃক্ত কঙ্গোর সব থেকে লাভদায়ক উপাদান রবারগাছ। দেশের সমস্ত লোককে কার্যত ক্রীতদাস বানিয়ে, যেন তেন প্রকারেণ রবার নিষ্কাশন করা ছিল রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের নিজস্ব বর্বর বাহিনীর এক এবং একমাত্র কাজ। এই নিরাপত্তা বাহিনীর সরকারি নাম– ‘পাবলিক ফোর্স। কঙ্গোর প্রতিটি পুরুষ, মহিলা এমনকী বাচ্চাদের পর্যন্ত প্রতিদিন রবার সংগ্রহের কোটা করা ছিল, তা তারা খেতে পাক আর নাই পাক। কাজে ত্রুটি মানে অপরাধ। আর অপরাধের শাস্তি হিসেবে কঙ্গোর শ্রমিকদের হাত পা কেটে ফেলা হত। বাবা-মায়ের সামনে কত সন্তানের মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়েছে তার হিসেব কে রেখেছে! 

গ্রামের পর গ্রাম, জনপদের পর জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় লিওপোল্ডের পাবলিক ফোর্স-এর অত্যাচারে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতে পাবলিক ফোর্স-এর আক্রোশের শিকার, পঞ্চাশ লক্ষ থেকে দেড় কোটি কঙ্গোবাসী। তবে সবেচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংখ্যাটি (অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মত) এক কোটি। দ্বিতীয় লিওপোল্ড কঙ্গোর ক্ষমতা গ্রহণের সময় জনসংখ্যা ছিল সোয়া দুই কোটির মতো। ক্ষমতা ছাড়ার সময় তিনি একটি জাতির অর্ধেক জনসংখ্যা ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। এই বর্বরতার জন্য ইতিহাসের পাতায় তাঁর পরিচিতি– ‘বুচার অফ কঙ্গোঅর্থাৎ কঙ্গোর কসাই। 

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক, New Statesman, Power Engineering Int.

Amitabha Ray Author

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

One Response

  1. ব্রিনডংক দুর্গ নিয়ে আপাতত: দুটো সুলিখিত পর্ব পড়লাম। ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু গবেষকের হাত ধরে ঢুকে পড়লাম এক অজানা অধ‍্যায়ে।
    ষাটের দশকে রাজা লিওপোল্ডের নাম শুনতাম বেলজিয়ান কঙ্গোর সন্দর্ভে। এক অত‍্যাচারী ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে। কিন্তু নিজের দেশে তার রাশিয়ার পিটার দি গ্রেটের মত এক বেনেভোলেন্্ট অটোক্রাট গোছের ছবির ব‍্যাপারে আজ জানলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *