শান্ত ও ভুতুড়ে বাড়িটার চেহারা এক লহমায় উধাও হয়ে গিয়ে ঝন ঝন উত্তেজনা আধিপত্য বিস্তার করেছে, লোকসমাগমে চেনাই দায় হয়ে উঠেছে একদিন আগেকার নির্জনকে। এত লোক থাকত এই বিজন প্রান্তরে, মাঠের আশেপাশে? এত এত প্রতিবেশী ছিল তাদের? ঘোষপাড়া, যুগীপাড়া, চাটুজ্জেহাট, মোল্লাগঞ্জ, কত না অজানা জায়গা থেকে নানা লোক চলে আসছে, কারণ এখন বাতাসে এক খবর, জয়রামপুরের  এক বাগালির খোকা হারিয়ে গেছে। 

পাথরের মতো বসে আছে দিদা, কারোর সঙ্গে কথা বলছে না, তাকাচ্ছে না, এমনকি জানালার ধারেও দাঁড়িয়ে নেই। রীণামামিমাকে আর দেখতে পায়নি টুনু, তাকে ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে দরজা দেওয়া হয়েছে, তবে টুকরো টুকরো কথায় বুঝেছে যে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে বারবার। বিশ্বমামা বাড়িতে নেই, আজ ভোর হতেই বেরিয়ে গিয়েছে। এখান ওখান থেকে ভুয়ো খবর আসছে, কোথায় একটা বাচ্চাকে নাকি দেখা গেছে পুকুরপাড়ে বসে থাকতে একা একা, বা রাস্তার ধারে কাঁদতে কাঁদতে হামাগুড়ি দিচ্ছে, আর বিশ্ব উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। কাল থেকে এই নিয়ে তিনবার হল। ভালমানুষ দাদু বিভ্রান্তের মতো পায়চারি করছে আর বিড়বিড় করছে মাঝেমাঝেই, ‘এ কী—কী হল—‘। গতকাল সন্ধেবেলাতেই পুলিশ এসেছিল। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, এমনকি টুনুকেও। পুলিশের লোকটা মোটাসোটা, টাকমাথা, ভালমানুষ ধরনের দেখতে। কপালের মাঝখানে একটা গোল আঁচিল, দেখে মনে হয় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। 

অফিসার একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন টুনুর দিকে। তারপর বললেন, ‘তোমার ছোটমামাকে একানড়ে ধরে নিয়ে গেছে, এই গল্প কে করেছিল?’

‘তোমার নাম তো সৌভিক? তা সৌভিক, তুমি কি কিছু দেখেছ?’ টুনুর ঘরে বসেই প্রশ্ন করেছিলেন অফিসার।

টুনু মাথা নাড়ল। এত এত লোক দেখে সে নিজেও হকচকিয়ে, তার ওপর দুর্বল মাথা কাজ করছে না ভাল করে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল জানালা দিয়ে বাইরে।

‘আচ্ছা, গুবলুকে তুমি শেষ কখন দেখেছিলে?’

‘বারোটার সময়ে। তখন দিদা গুবলুকে তেল মাখায়, আর রোদে শুইয়ে রাখে। দিদা বলে, রোদ খাওয়ালে হাড় শক্ত হবে। আমি তখন হিসু করতে গিয়েছিলাম। দিদা নীচ থেকে ডাকল, দুধ খেতে হবে বলে। আমি নেমে দেখি, গুবলু শুয়ে আছে।’

‘তারপর থেকে আর দেখোনি?’

‘না। তারপর ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দুপুরবেলা দাদু ডাকল, খেতে গেলাম।’

পাশে বসে আরেকজন পুলিশ নোট নিচ্ছিল, অফিসার তার দিকে ফিরে চাপা গলায় বললেন, ‘চাকর বাকরের বাচ্চাকে তেল মাখাচ্ছে, যত্নআত্তি করছে, একটু খোঁজখবর লাগাও হে! কেমন যেন ঠেকছে ব্যাপারটা।’ তারপর টুনুর দিকে ফিরে হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার বাড়ি আসানসোলে? আমি গিয়েছি, খুব সুন্দর জায়গা। তা, তোমার বাবা মা আসেননি?’

টুনু মাথা নিচু করল। একটু সময় অপেক্ষা করে অফিসার নরম গলায় বললেন, ‘একটা কথা বলবে আমাকে? তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?’

‘সন্দেহ?’ বোবা দৃষ্টিতে তাকাল টুনু।

‘সন্দেহ মানে, তোমার কি মনে হয় গুবলুকে কেউ চুরি করতে পারে? চেনা কেউ? মানে, দেখো, গুবলু তো খুব বাচ্চা। তুমিও বাচ্চা, কিন্তু গুবলু আরো ছোট। ও তো নিজে থেকে কোথাও যেতে পারে না, তাই না?’

‘একানড়ে’, অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এল টুনুর।

‘কী?’ অফিসারের ভুরু কুঁচকে গেল।

‘ওই তালগাছে থাকে। এর আগেও অনেক বাচ্চাকে নিয়ে গেছে। আমার ছোটমামাকে নিয়ে গেছে। আমাকেও নিয়ে যাবে। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। কিন্তু গুবলু–‘ টুনুর গলা ভেঙে গেল, আভাস পেল চোখজ্বালার। আবার বলল, ‘আমাকে নিয়ে যাবে ভেবেছিলাম।’

অফিসার একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন টুনুর দিকে। তারপর বললেন, ‘তোমার ছোটমামাকে একানড়ে ধরে নিয়ে গেছে, এই গল্প কে করেছিল?’

‘বিশ্বমামা।’

পাশের লোকটার দিকে তাকালেন অফিসার, ‘এই ফাইল আছে? সাসপিসাস কিছু ঘটেছিল কি? আমি নতুন, এতকিছু জানার কথা নয়। আপনারা জানবেন।’

টুনুর দিকে আড়চোখে তাকাল লোকটা, তারপর নিচু গলায় বলল, ‘সাসপিসাস কিছু নয় স্যার। পিওর অ্যাকসিডেন্ট। এখানে অনেকেই জানে। বাচ্চা বলে একে হয়তো সত্যিটা জানায়নি–‘

‘তবুও, একটু পারস্যু করুন। বলা যায় না, কোথা থেকে লিঙ্ক বেরিয়ে আসে।’ অফিসার উঠে পড়লেন, ‘আমি আজ আসি সৌভিক। যদি গুবলুকে নিয়ে কিছু তোমার মনে পড়ে, হয়তো এখন ভুলে গেছ কিন্তু পরে তো মনে পড়তেও পারে, তোমার দাদুকে জানিও। তিনি আমাকে ফোন করে দেবেন। আর দরকার পড়লে আমি আবার আসব, কেমন?’ একটু এগিয়ে গিয়ে ফিরে তাকালেন, ‘তোমার কি জ্বর? দেখে মনে হচ্ছে কাঁপছ।’

আবার চিঠি লিখতে হবে। একানড়ে চায় সেটাই, একটা করে চিঠি পাবে, আর একটা করে সঙ্কেত দেবে টুনুকে। প্রথম চিঠির পর গম্বুজের ছবি দেখাল, টুনু বুঝল যে ওখানে যেতে হবে।

‘ন্না, না তো !’ টুনু অস্বস্তির সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল। বেরিয়ে গেলেন অফিসার। তখন ঘন রাত জমা হচ্ছিল। নিচের বাগানে বসে ইতিউতি গুজগুজ জটলায় দুই তিনজন প্রতিবেশী। নানারকম টুকরো কথা সেখান থেকে ছিটকে কানে আসছিল তার,
–‘এতদিন পর আবার শুরু হল!’ ‘এ অভিশপ্ত গ্রাম !’
–‘পাঁচুঠাকুরের কাছে হত্যে দিয়ে দেখো, যদি হিল্লে হয় কিছু।’
একজন বয়স্ক দিদা মতো মহিলা থেকেও গেল রাত্রে। সে নাকি হালদারদের বাড়ির বউ, বেশ ফর্সা মোটাসোটা হাসিমুখ, ঠোঁটদুটো পান খেয়ে লাল। টুনুকে আদর করে বলল,
–‘এ কী বাবা! গায়ে তো জ্বর লাগছে !’
আরেকজন ফুট কাটল,
–‘ভয় পেয়েছে তো! বাচ্চাদের হয় এরকম!’
টুনু সরে গিয়ে ঘরের এককোণায় গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল, যাতে কেউ তার দিকে না তাকায়। হালদারদিদা আবার ব্যস্ত হয়ে গেলেন নিজেদের কথাবার্তায়, মূলত দিদার গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা,
–‘ভাববেন না দিদি। ঠাকুরের ওপর ভরসা হারাবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো আছি সবাই।’

টুনুর চোখ গেল পাশের ঘরের জানালায়, যেখান দিয়ে রীণামামিমাকে দেখা যাচ্ছে। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখল, দুজন মহিলা মিলে রীণামামিমার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে, আর বিস্রস্ত বিবশ রীণার তখন শূন্য দৃষ্টি। টুনু দেখল, ঝুমঝুমির মতো একজোড়া খোলা বুক বেয়ে জলের ধারা নেমে আসছে, যেখানে বিশ্বমামা মুখ গুঁজে দিয়েছিল। টুনুর বুকে রেলগাড়ি চলল, তখন এক মহিলার নজর পড়ল তার ওপর। তিনি এগিয়ে এসে জানালার পাল্লা ভেজিয়ে দিতে দিতে বললেন– ‘এখান থেকে যাও বাবা, এসব দেখতে নেই’।

কান গরম হয়ে উঠল টুনুর। সে যে আসলে খুব বাজে, বাজে এবং নোংরা, সেটুকুও জেনে গেল বাইরের লোক। যদি দিদাকে বলে দেয়?

আস্তে আস্তে ভিড় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল, বিশ্বমামা শুকনো মুখে ফিরে এসে ধপ করে বসে পড়ল দরজার সামনে। কেউ তাকে দেখছে না এখন, টুনু উঠে নিজের ঘরে গিয়ে শুল। ঝাঁ ঝাঁ করছে কান মাথা। সে খুব নোংরা, রীণামামিমাকে দেখলে বুঝতে পারে, আর রাগ হয় নিজের ওপর। নষ্ট লাগে, বাসী লাগে নিজেকে।

কিন্তু তবুও, আবার চিঠি লিখতে হবে। একানড়ে চায় সেটাই, একটা করে চিঠি পাবে, আর একটা করে সঙ্কেত দেবে টুনুকে। প্রথম চিঠির পর গম্বুজের ছবি দেখাল, টুনু বুঝল যে ওখানে যেতে হবে। দ্বিতীয় চিঠির পর গম্বুজে নিয়ে গেল রাস্তা চিনিয়ে, আবার নামগুলোও দেখাল। তার মানে গম্বুজেই লুকিয়ে রয়েছে এমন কিছু রহস্য, যাকে বারবার দেখাতে চায়, কারণ এ কথা তো স্পষ্টই যে টুনুকে ধরে নিয়ে যাবে না, অন্তত এখনই নয়, বরং সে স্থানে গুবলু। টুনুকে যে নিয়ে গেল না, তার কারণ একমাত্র এটাই যে একানড়ে টুনুর সঙ্গে কথা বলছে, তার সামনে খুলে দিচ্ছে রহস্যের আদি-দ্বার। সেক্ষেত্রে, যে খেলা শুরু হয়েছে, সেটা মেনেই এগিয়ে যেতে হবে টুনুকে।

সকালবেলা উঠে জানালা দিয়ে নীচের লোকসমাগম দেখতে দেখতে টুনুর চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল তালগাছের দিকে। আকাশ ফুঁড়ে দিতে চাইছে বল্লমের ফলার মতো, কিন্তু তবুও মাথার ওপরটা ধোঁয়া ধোঁয়া। অত উঁচুতে একজন উঠতে পারেই বা কীভাবে, ছোটমামা? ঘুমোতে গিয়ে যদি পাশ ফেরে তাহলেই তো পড়ে যাবে। আর গুবলু? টুনুর বুকের ভেতর হঠাৎ এক ভরসাহীন বেদনায় টনটন করে উঠল। না দেখা ছোটমামার কথা ভেবে, দিদার কথা ভেবে, গুবলুর কথা ভেবে। সব কিছুর জন্য মনখারাপ করে। প্রফেসর ক্যালকুলাসের জন্য, সুতনু সরকারের জন্য, গম্বুজের ছাদে লুটনো জ্যোৎস্না পান করা মৃত মাছেদের জন্য। দিদা যেমন ছোটমামার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, রীণামামিমাও কি এমনই দাঁড়িয়ে থাকবে গুবলুর আসার পথ চেয়ে?

জঙ্গল থেকে বার হয়ে কেউ একটা হেঁটে আসছে। হাঁটার ভঙ্গীটা অদ্ভুত রকম। টুনু জানালার গরাদে মুখ চেপে চোখ কুঁচকাল, আর মুহূর্তের মধ্যে হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল তার। মেলায় দেখা সেই পাগলটা, এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হেঁটে আসছে। তালগাছের কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর বসে পড়ল গাছেরই গা ঘেঁষে। নিজের মনেই মাথা ঝাঁকাচ্ছে, হয়তো অস্পষ্ট বিড়বিড়ও, এতদূর থেকে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু টুনু সেসব দেখছিল না। শুধু মনে হল, এত বড় একটা জিনিস তার চোখ এড়িয়ে গেল কী করে!

মেলাতেও দেখেছিল, কিন্তু খেয়াল করেনি। পাগলটার একটা পা নেই, উরুর নীচ থেকে কাটা।

ছবি সৌজন্যে: সুজয় বাগ 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২ মার্চ ২০২১ 

আগের পর্বের লিঙ্ক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *