গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও শোভাবাজার রাজবাড়ির জামাইষষ্ঠীতে ধুমধাম ছিল দেখার মতো, যাকে বলে টক অফ দ্য টাউন! প্রতিবছর জামাইষষ্ঠীর আগের দিন বা দি দুই আগে রাজবাড়ি থেকে জামাইবাড়িতে তত্ত্ব যেত। সেই তত্ত্বে মেয়ে-জামাইয়ের পোশাক তো যেতই, কাপড়জামা উপহার দেওয়া হত কুটুমবাড়ির প্রত্যেককে। এমনকী ঝি-চাকরেরাও বাদ যেত না। রাজবাড়ি থেকে তত্ত্ব নিয়ে কুটুমবাড়ি যেতেন অন্তত জনা পঞ্চাশের একটি দল। রঙিন সেলোফেনে মোড়া সুগন্ধি ছড়ানো সেই তত্ত্ব হার মানাতো বিয়ের তত্ত্বকেও। সারা বাড়িতে ভুরভুর করত আতরের সুগন্ধ। জামাইয়ের জন্য তত্ত্বে যেত বাড়িতে গিলে করা, কোঁচানো ধুতি, কাজ করা পাঞ্জাবি আর সাদা সোয়েটের পাম শু!
তবে শুধু কি আর জামাকাপড়? তত্ত্বে যেত সাজগোজের হরেক জিনিস। আলতা-সিঁদুর তো বটেই। আর হরেক রকমের খাবার জিনিসও। নোনতা এবং মিষ্টি। ফলের ঝুড়ি, খই-মুড়কি, বড় বড় ফেনি বাতাসা আর খাস মুর্শিদাবাদ থেকে আনা চিনির মতো মিষ্টি আম। জামাইয়ের বাড়িতে তত্ত্ব পাঠানোর পর থেকেই শুরু হয়ে যেত জামাই খাওয়াবার তোড়জোড়। রাজপরিবারের প্রথা অনুযায়ী জামাই-ভোজন হত রাতে।
শাশুড়ি-দিদিশাশুড়িদের মুখে শুনেছি জামাইরা নাকি সঙ্গে করে পেশাদার খাইয়ে নিয়ে আসতেন। তাঁরা হয়তো জামাইবাড়িরই জ্ঞাতিকুটুম্ব কেউ। কিন্তু তাঁদের খাওয়া দেখলে মাথা ঘুরে যাবার দাখিল হত। এক একজন একটা গোটা একটা পাঁঠার মাংস খেয়ে দিব্যি হজম করতে পারতেন। আর শুধু কি খাওয়া? বিনোদন বাদ যাবে কেন? কুটুমবাড়ির অতিথিদের তুষ্ট করতে যাত্রার আসর ছিল বাঁধাধরা। আমাদের মাঠেই নামকরা যাত্রার দল আসত। পালা চলত রাতভোর। তবে একটা আফশোসের ব্যাপার ছিল। ষষ্ঠীর দিন বলে বাড়ির মেয়ে-বৌরা সেদিন আমিষ খেতে পারতেন না। পুজোর জন্য সারাদিন ফল খেয়ে থাকতে হত তাঁদের। তবে খাওয়াটা মার যেত না। তোলা থাকত অন্য একদিনের জন্য। সেদিন মেয়ে-বউরা পাত পেড়ে ভোজ খেতেন।

আমার এক পিসিশাশুড়ির মুখে শুনেছি, জামাইষষ্ঠীর দিন সকাল থেকেই গোয়ালঘরের পাশে ভিয়েন বসে যেত| বাইরে থেকে বামুনঠাকুররা এসে সেদিন বাড়ির তিন তিনটি রান্নাঘরের দখল নিত| কারণ বাড়ির নিয়মিত সদস্য ছাড়াও দশ-বারোজন মেয়ে, তাঁদের ছেলেমেয়েরা ও সর্বোপরি জামাইরা‚ অত লোককে রেঁধে খাওয়ানো তো চাট্টিখানি কথা নয়! ফলে সাহায্যের হাত লাগতই। মূল ভোজ হত রাত্তিরে। তাও দিনের বেলা থেকেই তার প্রস্তুতি শুরু হত, কারণ বাড়ির মেয়েরা সকাল সকালই পুত্রকন্যা সমেত বাপের বাড়ি চলে আসতেন| মেয়ে-বউরা ষষ্ঠী পালন করতেন বলে তাদের জন্য আবার রকমারি নিরামিষ রান্নারও ব্যবস্থা থাকত।
সন্ধে গড়াতেই জামাইবাড়ির গাড়ি এসে থামত বাড়ির সামনে। কোনও মেয়ের বিয়ের পর প্রথম জামাইষষ্ঠী হলে সেই মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সকলেরই সেদিন নিমন্ত্রণ থাকত। সমবয়সী শ্যালকেরা সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে সদর দরজায় জামাইবাবুদের জন্য অপেক্ষা করতেন। তাঁরা ঢুকলে তাঁদের হাতে ছোট ছোট জুঁই ফুলের মালা দেওয়া হত। সেটা কেউ হাতে জড়াতেন, কেউ পকেটে রাখতেন| তত্ত্বে পাঠানো ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদরে সেজে জামাইবাবাজি বাড়িতে পা দিতেই শুরু হয়ে যেত আপ্যায়নের তোড়জোড়।
ঠাকুরদালানের পাশের হলঘরে জামাইদের জন্যে আসন পাতা হত। বাজারের কেনা আসন নয় কিন্তু! সুতির শাড়ির পাড়ের রঙিন সুতো দিয়ে শাশুড়িমায়ের স্বহস্তে নকশা করা আসন সব। এক একজনের জন্য এক এক রকমের নকশা তোলা। জামাইরা মাটিতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসলে শাশুড়ি মা একগলা ঘোমটা দিয়ে এসে বসবেন তাঁদের সামনে রাখা মেহগনি কাঠের বড় পিঁড়েতে। হাতে তালপাতার পাখা। বৌমারা সব ঘোমটা টেনে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। পরিবেশনের কাজ কিন্তু মূলত করত ছেলেরাই। আর বাচ্চাদের তো সে ঘরে প্রবেশ নিষেধ। ওরা কেবল এ দরজা ও দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে মেরে দেখত। তবে ওদের খাওয়াদাওয়াতে ফাঁক পড়ত না। বাড়িতে তো আর দিদি-মাসি কম ছিল না! ওঁরাই বাচ্চা সামলাতেন।

রাজবাড়িতে বরাবরই ফল দিয়ে জামাইবরণের প্রথা। আর সেটা ফল কেটে রেকাবে সাজিয়ে দেওয়া নয়। ফল সাজানোর প্রথা ছিল একেবারে আলাদা। গরমে ফলের তো অভাব নেই। আম-কাঁঠাল ছাড়াও লিচু, কালোজাম, জামরুল, গোলাপজাম, আনারস তো ছিলই। কিন্তু টুকরো টুকরো করে কেটে দিলে হবে না। সব ফল কায়দা করে কাটতে হত, কোনওটা পদ্মফুলের আকারে, কোনওটা ময়ূরের মতো। ওই আজকালকার কেটারিংয়ের লোকেরা যেমন সব করে টেবিল সাজায়, সেগুলো তখন করা হত বাড়িতে জামাইয়ের জন্যে। যেমন ধরো, লিচুর বিচিটা বের করে সাদা ধবধবে ফলের দুদিকে দুটো লবঙ্গ গুঁজে দেওয়া হত চোখের মতো। দেখতে লাগত ছোট্ট গিনিপিগ বা সাদা ইঁদুরের মতো। এমন প্রতিটি ফলে কাঠি দিয়ে, মশলা দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হত। এর সঙ্গে থাকত শুকনো ফলের পশরাও– কাজু, কিশমিশ, আখরোট, মনাক্কা সবরকম।
এবার আসা যাক জামাইষষ্ঠার মেন কোর্সে। প্রথমেই আসত ভাজার প্লেট। তাতে থাকত আলুভাজা‚ পটলভাজা‚ লম্বা বোঁটাঅলা বেগুনভাজা। সঙ্গে লুচি, নারকোল দিয়ে ছোলার ডাল, মুখে দিলেই ঘিয়ের গন্ধ আর টকমিষ্টি কিশমিশ। তারপরে আসত মাছের পুর ভরা পটলের দোরমা। আর জামাইষষ্ঠীর মেনুতে একটা পদ তো মাস্ট মাস্ট মাস্ট। তোপসে মাছের ফ্রাই। তারপরে ভাতের পালা। সেটা শুরু হবে পোলাও দিয়ে। তারপর আসবে ভাত। সঙ্গী পাকা পোনার কালিয়া, দই ভেটকি, চিংড়ির মালাইকারি, কই মাছের কোর্মা আর চাটনি হতে হবে আলুবখরার। অনেক সময়ই আলাদা করে না দিয়ে, এই ভোজের সঙ্গেই সাজিয়ে দেওয়া হত ফল। রুপোর রেকাবের ওপর কলাপাতা পদ্মের মতো আকারে কেটে বসিয়ে তার ওপর ফল সাজানো হত।

কখনও আবার জামাই খেতেন ঘি-ভাত। সেই ঘি কি আজকালকার মতো শিশি থেকে চামচে করে ঢেলে দেওয়া ঘি? মোটেই না। খাঁটি দুধের ঘি ছোট্ট রুপোর বাটিতে ভাতের আগপাতে বসিয়ে দিতেন শাশুড়ি। জামাই নিজে ঢেলে নিতেন। তবে তার সঙ্গে হতেই হবে বড় কাতলার মাথা দিয়ে মুগের ডাল। এই ভোজ রাত্তিরেও হত, আগেই বলেছি। আসলে আগেকার দিনে তো এখনকার মতো পেটরোগা অম্বলে-ভোগা জামাই ছিলেন না। তাঁরা দুপুর-রাত যে কোনও সময়েই ভোজ খেতে সদাপ্রস্তুত থাকতেন।
এবার আসি মিষ্টির কথায়। গোল চন্দ্রপুলি দিতেই হবে। ওটা তত্ত্বতেও যেত। কারণ চন্দ্রপুলিকে শুভ বলে মানা হত। ফলে জামাইষষ্ঠী চন্দ্রপুলি ছাড়া ভাবা যেত না। তারপর রুপোর বাটিতে ক্ষীর-আম। রাজভোগ আর জলভরা তালশাঁস সন্দেশ। পান্তুয়া‚ দরবেশ‚ বোঁদে‚ পায়েস, আম-সন্দেশ, দই, রাবড়ি সব ঘরে বানানো হত। আর সবশেষে আসত পান আর মশলার ট্রে। বাড়ির মেয়েদের তৈরি নানারকম ঝাল মিষ্টি মশলার বাহার থাকত তাতে। পরিবেশন করত বাড়ির মেয়ে বউরা আর তত্বাবধানে থাকতেন শাশুড়িরা। বাড়ির কর্তারাও খাবার সময় উপস্থিত থাকতেন। বলা তো যায় না, জামাই আদরে পাছে কোনও ত্রুটি হয়!
আর একটা দারুণ মজার ব্যাপার কী ছিল জানো? তাকে বলত জামাই ঠকানো। ধরো বিকেলের চায়ের সঙ্গে জামাইকে দেওয়া হল ঘরে করা সিঙাড়া। তার একটার মধ্যে পুরের বদলে ভরে দেওয়া হল সবজির খোসা, ডগা এইসব হাবিজাবি। জামাই কামড় বসাতেই এপ্রিল ফুল! কিম্বা মাটির সন্দেশ তৈরি করে সুন্দর রং করে (খাবার রং) জামাইয়ের পাতে দেওয়া হল।
আরও একটা খাবার দেওয়া হত জামাই ঠকাতে বলি শোনো। আগেকার দিনে এখনকার মতো ছোট ছোট লুচি তো হত না। রুটির মতো বড় গোল লুচি হত। সেই লেচি খুব পাতলা করে বেলে দুটো লেচির মাঝখানে ভরে দেওয়া হত পাতলা ফিনফিনে মিলের কাপড়ের টুকরো। তারপর লেচি জোড়া করে ভেজে সোজা জামাইয়ের পাতে। জামাই ফুলকো লুচিতে যতই টান দেন, লুচি আর ছেঁড়ে না! ঘরজুড়ে হাসির রোল! তবে এসব কিন্তু শাশুড়ি বা বড় শ্যালিকারা করতে পারতেন না। এসবের মূল হোতা থাকত বাড়ির ছোটরা, অর্থাৎ যাদের থেকে জামাইবাবু বয়সে বড়। কিন্তু তারা তো আর খাবার বানাতে পারত না, তাই ঠকাবার বন্দোবস্তটা বড়দেরই করে দিতে হত!

আমার বাপের বাড়ির জামাইবরণও কিন্তু খুব ঘটা করে হত, জানো তো। আমি হলাম গড়পার মাহিনগরের বিখ্যাত বসু পরিবারের মেয়ে। আমার মা প্রমীলাদেবী জামাইদের খাওয়াতেন সন্তানস্নেহে। আমার স্বামী অলককৃষ্ণ দেব, অন্যান্য জামাইদের মতো কাঁটা বেছে মাছ খেতে পারতেন না। একটু কাবু হয়ে পড়তেন। কিন্তু সকলে একসঙ্গে খেতে বসেছেন, আমার সাত ভাই সেখানে রয়েছে, তাই উনি মুখে কিছু বলতে পারতেন না, বাটিগুলো সাবধানে এদিক ওদিক সরিয়ে রাখতেন। মা কিন্তু সেটা লক্ষ করেছিলেন। তাই তারপর থেকে নিজের হাতে ইলিশ মাছ বেছে ওঁকে ভাতের সঙ্গে মেখে দিতেন।
শোভাবাজার রাজবাড়িতে বৌ হয়ে আসার পর অনেক রান্নাই শিখেছি। তবে জামাইষষ্ঠী স্পেশাল দুটো রান্না বলতে বললে আম-ক্ষীর আর দই ভেটকির কথাই বলতে হয়। তোমাদের পাঠকদের জন্য সেই দুটো রেসিপিই দিলাম।
দই ভেটকি
ভেটকি মাছ সরষের তেলে খুব হালকা করে ভেজে তুলে নিতে হবে। ওই তেলেই তেজপাতা, গরমমশলা, পেঁয়াজবাটা আর আদাবাটা দিয়ে ভাল করে নাড়াচাড়া করতে হবে। মনে রাখতে হবে এ রান্নায় কিন্তু হলুদ পড়বে না এক ফোঁটাও। স্বাদমতো কাঁচালঙ্কাবাটা আর নুন মিষ্টি দিয়ে আরও খানিকক্ষণ কষাতে হবে। অতঃপর দইটা ভাল করে ফেটিয়ে নিয়ে খানিকটা কষানো মশলার মধ্যে দিয়ে আঁচ কমিয়ে দিতে হবে।

মিশ্রণটা তেল ছেড়ে এলে মাছগুলো দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে বাকি দইটা ওপর থেকে ঢেলে দিয়ে গ্যাসটা বন্ধ করে দিতে হবে। এরপরে আর ফোটানো যাবে না। তাহলে গ্রেভিটা পাতলা হয়ে যাবে। ঢাকা দিয়ে রেখে দিতে হবে। খানিক বাদে গরম গরম পরিবেশন কর ভেটকি মাছের ধবধবে সাদা পদ, দই ভেটকি।

আম-ক্ষীর
দুধটাকে প্রথমে নেড়ে নেড়ে ঘন করতে হবে। তলায় যেন ধরে না যায়। এতে পড়বে চিনি আর লাল বাতাসা। দুধ ফুটে ফুটে পরিমাণে অর্ধেক হয়ে আসবে প্রায়, ক্ষীরটা ভাল মতো তৈরি হলে মিষ্টি পাকা হিমসাগর আম খুব ছোট্ট ছোট্ট করে কেটে ওর মধ্যে দিয়ে দিতে হবে। তারপর নেড়ে নেড়ে মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। তবে ঢাকা দেওয়ার পর আর একটুও আঁচে রাখা যাবে না। আর একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, আমের মধ্যে একটুও টকভাব থাকলে কিন্তু ক্ষীর হবে না। দুধ কেটে ছানা হয়ে যাবে। ফলে খুব মিষ্টি আম হলে তবেই জমবে জামাইষষ্ঠীর আমক্ষীর।
*কারিগরী সহায়তা: তীর্থঙ্কর দেব
*অনুলিখন: পল্লবী মজুমদার
* চিত্রঋণ: News18bangla, youtube, cookpad, facebook
নন্দিনী দেব বউরানি শোভাবাজার রাজবাড়ির বউ। এবং তিনি রন্ধনশিল্পী। রাজবাড়িতে বিয়ে হয়ে এসে পর্যন্ত তিনি শিখেছেন এ বাড়ির বনেদি প্রচলিত রান্নাসমূহ। তার পাশাপাশি নিজেও রান্না নিয়ে করে চলেছেন নিরন্তর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তাঁর রন্ধনপ্রণালীর কৌশল হাতেকলমে শিখতে বহুবার এসেছেন নামীদামি রেস্তরাঁর শেফেরা। বহু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রান্না ও খাওয়াদাওয়া সংক্রান্ত বহু লেখা।