আগের পর্বের লিঙ্ক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০]

পরেশ টুনুর ওপর ঝুঁকল, ‘তোমার তো ভালই জ্বর এসেছে! শরীর খারাপ লাগছে খুব?’ 

টুনু মাথা নাড়ল। বোধহীন ভয় তার সারা শরীর বেয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথার কুয়াশা অধিকার করে নিতে চাইছে, সে বিমূঢ় চোখে পরেশের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠল, ‘এসব কী হচ্ছে আমার সঙ্গে?’ 

‘তুমি ওঠো। বিছানায় এসে শোও একটু। আমি তোমার খবর নিতেই এলাম। দেখলাম দরজা খোলা, তোমার দাদু দিদাকে আর বিরক্ত করিনি। এসো, আমার কাঁধের ওপর দিয়ে হাতটা ফেলে দাও’।

বিছানায় নিয়ে এসে টুনুকে শুইয়ে পরেশ জল দিল। তারপর চাবি আর চিঠিগুলো তুলে নিয়ে টেবিলে রেখে ফিরে আসল তার কাছে, ‘মা ফোন করেছিল? তোমাকে এখানে আর একদিনও রাখা উচিত নয়। তুমি মা-কে বলো যেন এসে নিয়ে যায়।’ তারপর কিছু যেন শুঁকল, দুর্গন্ধ আসছে এমনভাবে কোঁচকাল নাকটা। টুনুর মুখের গন্ধ পাচ্ছে মনে হয়। 

বালিশে মুখ গুঁজে টুনু নিজেকে সামলাল। পরেশ যেন বুঝতে না পারে। তার পাশেই ভুরু কুঁচকে বসে আছে, দৃষ্টি জানালার দিকে। টুনু সেদিকে তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘ওই পাগলটাই তাহলে একানড়ে ছিল!’ 

পরেশ টুনুর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর মৃদুস্বরে বলল, ‘আমার ভয় লাগছে তোমাকে নিয়ে’। 

‘কী ভয়?’ 

‘ভয়, যে চোখের সামনে এসব দেখে তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে।’ 

‘তোমার একানড়েকে ভয় লাগে না?’ আচমকা টুনু প্রশ্নটা কেন করল, নিজেও জানে না। 

অল্প হাসল পরেশ, ‘ছোটবেলায় লাগত। বড় হয়ে বুঝেছি যে ওসব কিছু নেই।’ 

‘নেই?’ উত্তেজনায় টুনু উঠে বসল, ‘তুমিই তো বলেছিলে কিছু একটা আছে, এই গ্রামে, এই মাঠে–‘ 

‘কিন্তু সেটা আমরা যেরকম ভাবি, কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কেউ, তালগাছে থাকে এমন কেউ–সেরকম নয়। ওগুলো বাচ্চাদের ভয় দেখাবার জন্য বানানো। যদিও সত্যিটা আমরা বলি না।’ 

‘সত্যিটা কী?’ 

পরেশ কিছুটা সময় চুপ করে থাকল। তারপর খসখসে গলায় বলল, ‘আমরা বলি, ছোট বাচ্চাদের বলি, ‘বদমাইশি করলে একানড়ে ধরে নিয়ে যাবে’। ভুল। বদমাইশি করা বা ভাল হয়ে থাকা, কিছুতেই কিছু এসে যায় না। যদি ধরবার হয়, এমনিই ধরবে। ধরবেই।’ 

বেলা আস্তে আস্তে পড়ে আসছিল। একটা পাখি একঘেয়ে টি টি করে ডেকেই যাচ্ছে। টুনু দেখল, তালগাছের ছায়া লম্বা হচ্ছে। 

‘তাহলে, ওই গাছের মাথায় কে থাকে? তুমি দেখেছ?’ 

‘জানি না, কে থাকে। এক সময়ে ভাবতাম, আমার দাদা থাকে। আমি যখন ছোট ছিলাম, এই তোমারই বয়েসি, আমার দাদাকে একটা ট্রাক ধাক্কা মেরে চলে গিয়েছিল। মুখের একদিকটা ছিল না–যাক বাদ দাও ওসব কথা। কিন্তু তারপর থেকে বহুদিন আমার মনে হয়েছে, দাদা আমার পাশে পাশে হাঁটছে। তালগাছের মাথায়, বাড়ির ছাতে কি পুকুরের নীচে লুকিয়ে আছে। আমার কাছাকাছি। আজকাল আর দাদাকে বুঝতে পারি না, আছে কি না। কিন্তু কিছু তো আছে! তার ছায়া দেখি সারাক্ষণ।’ 

টুনু চুপ করে থাকল, সে পরেশের দুঃখী মুখটা মনের ভেতর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। ঘসঘস করে পা চুলকাল, পিঁপড়ে মারল একটা, এবং দেখল পরেশের নাক আবার কুঁচকে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল মুখ। একটু পর বলল, ‘আমার একটা বন্ধুও মরে গেছিল। স্কুলের পাঁচিল থেকে নীচে পড়ে।’ 

পরেশ অবাক হয়ে তাকাল, ‘কবে? তখন তুমি কত ছোট?’ 

টুনু অন্যমনস্কভাবে তালগাছ দেখল, ‘রোহণ আর ও খুব বন্ধু ছিল। দুজনে সারাক্ষণ গলায় হাত রেখে ঘুরত। টিফিন ভাগ করে খেত। তারপর একদিন মরে গেল। সুতনু।’ 

পরেশ আবার চুপ করে গেল। পোড়ো জঙ্গলের কঙ্কালগুলোকে একটা কালচে ছায়া কিছু পরেই ঢেকে দেবে। ম্লান ধোঁয়ার গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে বাগান জুড়ে। 

কিছুক্ষণ পর পরেশ যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘আমার একটাই কথা মনে হয় শুধু। আমি কেন বেঁচে থাকলাম ! কেন অন্যদের মতো হল না আমার!’ 

‘মানে?’ 

‘সবাই মরে গেল, নাহলে পাগল হয়ে গেল, নাহলে হারিয়ে গেল, নাহলে অন্য কিছু–শুধু আমার কিছু হল না। কেন!’ 

আমরা শুধু জানতাম, সত্যিটা পুরোপুরি কাউকে বলা যাবে না। আজকাল কী মনে হয় জানো? আমাদের বয়স আর সেদিন থেকেই বাড়েনি। ওই তালগাছের নীচেই আমরা আটকে আছি, আজও।

টুনু কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকল। উল্টোদিক থেকে আবার নীরবতা দেখে কিছুক্ষণ পর বলল, ‘তুমি বললে একানড়ে বলে কেউ নেই। তাহলে ওই পাগলটা? ওর তো একটা পা ছিল না!’ 

‘তাতেই তোমার মনে হল, ও একানড়ে?’ 

‘কিন্তু ও তো গুবলুকে–‘ 

‘ছোটবেলায় ও বন্ধু ছিল আমাদের। ওর বাবা কানের ওপর গরম ইস্তিরি চেপে ধরেছিল বলে কানটা গলে যায়।’ পরেশ মাথা নাড়ল, ‘অনেক বছর আগে হাইওয়ের ওপর পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল ওকে। মাথার পেছনে ভারী কিছু দিয়ে মারা। একটা পা কাটা, মনে হয় লরি ফরি হবে। তখন ওর কতই বা বয়েস, তেরো চোদ্দো! সেই থেকে ও পাগলের মতো ঘুরে বেড়াত। বাড়ির লোক ঢুকতে দিত না। ভিক্ষে করে খেত।’ 

‘ওর পাপে এতকিছু।’ 

‘এসব আবার কে বলল তোমাকে?’ অবাক হল পরেশ। 

‘বিশ্বমামা।’ 

পরেশ উঠে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। টুনু আড়চোখে দেখল, টেবিলের ওপর চিঠিগুলো অনাদরে পড়ে আছে। পরেশ হোক বা অন্য কেউ, দেখলেও বুঝবে না। 

‘পরেশমামা?’ 

‘হুঁ?’ 

‘ছোটমামার কী হয়েছিল? যদি একানড়ে বলে কিছু না-ই থাকে, তাহলে কে ধরে নিয়ে গেল?’ 

পরেশ মুখ ফেরাল, ক্লান্তির সর পড়েছে সেখানে। ‘তুমি এত জানতে চাও কেন?’ 

‘কেউ বলে না, তাই। সুতনু এসেছিল একদিন, সেও কথা বলল না আমার সঙ্গে। আমার ওপর খুব রেগে আছে।’ টুনু মাথা নিচু করল। 

‘রেগে আছে? কেন?’ ভুরু কুঁচকে গেল পরেশের। 

টুনু বুঝল তার হৃৎস্পন্দন বাড়ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মাথা তুলল, ‘কেউ কিছু বলে না আমাকে, কী হচ্ছে। তাই ভয় লাগে আরও বেশি।’ 

‘তুমি জানো না, কী হয়েছিল বাবানের?’ 

‘বাবান?’ চমকে উঠল টুনু। 

‘হ্যাঁ, তোমার ছোটমামার ডাকনাম। বাবান। তুমি জানতে না?’ 

‘না !’ টুনুর গলা শুকনো লাগছে, কেউ কি তাকে বলেছিল, বাবান  আসলে কে? সেদিন রাত্রে গম্বুজের ছাতে ফিসফিসিয়ে, অথবা ছোটমামার ঘরে? ছায়া ছায়া মতো সবই, তবু কেন মনে পড়ে না? আর তা সত্ত্বেও, কেন পুরোপুরি অচেনাও লাগে না কোনও কিছুই? 

‘বাবান ওই তালগাছে থাকে না টুনু। তুমি ছোট বলে তোমাকে সত্যিটা বলেনি কেউ। তবে এখন আর–সে যাই হোক, আমি, ওই পাগলটা, তোমার বিশ্বমামা, বাবান, সবাই বন্ধু ছিলাম। আরও অনেকে ছিল। তাদের কেউ মরে গেছে, কেউ পাগল হয়ে গেছে, গণেশকে যখ টেনে নিয়ে গিয়েছিল পুকুরের তলায়, রাত্রে বডি ভেসে ওঠে, কৃষ্ণ বাস চাপা পড়ে মরেছে, বাবাইকে ছাদের ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে–বেঁচে ছিলাম শুধু আমি আর দেবু। অক্ষত ছিলাম এতদিন।’ 

‘দেবু?’ উত্তরটা দরকার ছিল না যদিও। 

‘তারও আজ গোটা পরিবার শেষ হয়ে গেল। থানা থেকে ছাড়া পাবে বলে মনে হচ্ছে না। দেবু জন্ম থেকেই এ বাড়িতে, জানো তো? ও তোমার ছোটমামার সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল, আবার ফাইফরমাশও খাটত।’ 

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে পরেশ বলে উঠল, ‘হয় এবার আমার পালা, আর নয়ত আমি বেঁচে গেলাম এ জন্মের মতো। কিন্তু কেন! সেটাই কোনওদিনও বুঝব না !’ গলাটা ক্যালকুলাসের ঘেয়ো চামড়ার মত লাগছিল, মৃত। 

টুনু উঠে পরেশের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তালগাছকে আগের থেকে লম্বা লাগছে। শীর্ষে উড়ছে আশ্চর্য শকুন। 

‘কতদিনের পুরনো এই গাছ, আমারও জন্মের কত আগে!’ আত্মগতভাবে বলে উঠল পরেশ, ‘এখানেই সবকিছুর শুরু।’ 

‘কীসের?’  

‘আমাদের সবার, খেলাধুলো, বন্ধুত্ব, মারামারি।’ ম্লান হাসল পরেশ। ‘দেবু যেমন তোমাকে বলেছে, পাপের’। 

‘পাগলটাকে ওরা যেদিন মারল সবাই মিলে, তুমিও ছিলে, না?’ 

‘না !’ তীব্রস্বরে ছিটকে গেল পরেশ, অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকাল, ‘আমি কোনওদিনও কোথাও ছিলাম না টুনু। বিশ্বাস করো! আমি থাকলে বাধা দিতাম ওদের। যেরকম সেবারেও দিয়েছিলাম। কোনওদিন চাইনি–‘ 

‘সেবার মানে? কবে?’ 

পরেশ দূরের জঙ্গলের দিকে তাকাল। ‘সেসবই অনেক অনেক দিন আগে ঘটে গেছে। কে আর পুরনো কথা তুলতে ভালবাসে! দেবু বারণ করেছিল আমাকে, সেদিন যখন তোমাকে দেখতে এলাম। কিন্তু আমি রাতের পর রাত ঘুমোতে পারিনি, আমরা যা করেছি–দেবুও পারত না, আমি জানতাম রাতের পর রাত ও চোখ মেলে বসে থাকে, খায় না ঘুমোয় না। আমাদের বন্ধুত্ব ভেঙে গিয়েছিল তারপর থেকেই। আমরা শুধু জানতাম, সত্যিটা পুরোপুরি কাউকে বলা যাবে না। আজকাল কী মনে হয় জানো? আমাদের বয়েস আর সেদিন থেকেই বাড়েনি। ওই তালগাছের নীচেই আমরা আটকে আছি, আজও।’ 

টুনু নীরব ছিল। দুপুরটা ধুঁকতে ধুঁকতে ক্লান্ত বিকেলের দিকে এগনোর তোড়জোড় করছিল, কিন্তু তাকে সাজাবার জন্য কোনও আলো আর বেঁচে ছিল না।

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *