আগের পর্বের লিঙ্ক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১]

বাবানরা তালগাছের নীচ থেকে নড়ছিল না, সে যতই অন্ধকার নেমে আসুক। মা দুবার ডাক দিয়ে গেছে, তারপর দেবুকে বলেছে তাড়াতাড়ি বাবানকে নিয়ে আসতে, কিন্তু বাবান জানে তার আপাতত কোথাও যাওয়া চলবে না। হিমেল সন্ধ্যেকে যতই নম্র ও নির্ভার লাগুক, মেঘের মতো তাকে ঘিরে ধরেছে ছোটনের দল। 

‘এরপর থেকে মাঠে খেলতে আসবে না তুমি! আসলে মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেব!’ আঙুল উঁচিয়ে ছোটন বলল। 

‘কে-কেন? তোর বাব-বাবার মাঠ?’ 

‘নিজের ব্যাট দিয়ে খেলবে, আউট হলে ব্যাট নিয়ে বাড়ি চলে যাবে, এদিকে আমাদের খেলায় নেবে না, নিলেও খালি ফিল্ডিং করাবে, কেন?’ ক্রুদ্ধ ছোটন মাথার গামছায় পাক দিল, ‘আমরা ছোটলোকের ছেলেপিলে বলে যা ইচ্ছে তাই করাবে? দেবুর মতো?’ 

‘আমাকে টানবি না। তোদের ঝগড়া নিজেরা সামলা !’ দেবু উত্তর দিল। 

‘কেন টানব না শালা? ও তোকে চাকরের মতো খাটায় না? কাল গম্বুজে সিগারেট নিয়ে কী করল দেখিসনি? তোর মান অপমান নেই, ওদের পা চেটে চলিস, তা বলে আমাদের নেই নাকি?’ 

‘তার ওপর ক্যালানে! যে টিমে নেওয়া হয় সেই টিম হারে!’ বলে উঠল গণেশ। 

‘আমি কাল থেকে আর আসছি না। রোজ রোজ তোদের বাওয়ালি হবে, ওসব তোরা কর, আমি মোল্লারহাটে খেলতে যাব এর পর থেকে।’ দল থেকে দূরে একটা ঝোপের পাশে বসে ছিল বাপ্পা, বিরক্তমুখে বলে উঠল এবার। 

‘তুই চুপ কর তো ! দেবুর চামচা শালা!’ 

‘দেবু চাকর, আমি চামচা, আর তুই গব্বর সিং?’ 

বাবান ততক্ষণে ব্যাট দিয়ে ধাঁই করে গণেশের পায়ে বসিয়ে দিয়েছে, ‘আর বল-বলবি আমাকে ক্যাল-লানে?’ 

গণেশ পায়ে হাত বুলিয়ে ফুঁসে উঠে ঘুসি চালাল, ধপ করে শব্দ হল একটা, ঠিকমত লাগলে কী হত বলা যায় না তবে পিছলে গেল, চোয়াল ঘেঁষে বেরিয়ে গেল মার, ‘শুওরের বাচ্চা! আজ তোকে খুন করব।’ 

উপস্থিত চার পাঁচজন হো হো করে গণেশকে সমর্থন জানাচ্ছিল, বাবান হাত বোলাল গলায়, তারপর প্রচণ্ড রাগে অন্ধের মতো ব্যাট চালাল চারপাশে, সকলে ছিটকে গেল এদিক ওদিক লাগার ভয়ে, ‘কে, ক্কে আসব-বি, আয়! ভিখিরির দল সব! আমার প-প-পয়সায় খে-খেলবে, আম-আমার ব্যাটে, আব্বার আম-মাকে মারবে!’ 

‘এই বাবান, আস্তে, হচ্ছেটা কী?’ বাপ্পা চেঁচাল। 

দেবু স্থিরচোখে তাকিয়েছিল একটু দূরে দাঁড়িয়ে। ছোটন ব্যাটের থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেবুর দিকে তাকিয়ে খিশখিশে হাসল, ‘ক্যালানে খেপেছে’।

বাকি ছেলেপুলের দল ততক্ষণে বাবানকে ঘিরে ধরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ‘ক্যালানে ‘ ‘ক্যালানে’ বলে আওয়াজ তুলেছে। কেউ পেছন থেকে এসে বাবানের চুল ধরে টেনে পালিয়ে যাচ্ছে, বাবান তার দিকে ব্যাট হাতে তেড়ে গেলেই অন্যদিক থেকে আরেকজন এসে খুলে দিচ্ছে তার প্যান্ট। একসময়ে দেখা গেল, বাবানের প্যান্ট তার পায়ের কাছে, আর সবাই তার দিকে আঙ্গুল তুলে ‘ক্যালানের লাল লঙ্কা’ বলে চেঁচাচ্ছে। বাবানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। সে ব্যাট রেখে নিচু হয়ে প্যান্ট তুলতে গেল, কেউ একমুঠো ধুলো ছুঁড়ে দিল তার দিকে। ‘আহ !’ যন্ত্রণায় কাতরে উঠল বাবান, ‘দেবু, তু- তুই, তুই…,’ শ্বাস আটকে যাচ্ছিল, শেষ করতে পারছিল না কথা। 

বাপ্পা উঠে এসে বাবানকে ধরতে যাচ্ছিল, দেবু তার হাত চেপে ধরল। বাপ্পা অবাক হয়ে তাকাল দেবুর দিকে। 

‘বাড়ি চলো বাবান। তুমি পারবে না এদের সঙ্গে।’ দেবু হাঁক দিল। 

বাবানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। সে ব্যাট রেখে নিচু হয়ে প্যান্ট তুলতে গেল, কেউ একমুঠো ধুলো ছুঁড়ে দিল তার দিকে। ‘আহ !’ যন্ত্রণায় কাতরে উঠল বাবান, ‘দেবু, তু- তুই, তুই…,’ শ্বাস আটকে যাচ্ছিল, শেষ করতে পারছিল না কথা।

‘কে, ক্কে বলল আমি পা-পারব না? আম-আমি ভয় পা-পাই নাকি?’ রুখে এল বাবান যন্ত্রণার মধ্যেও। 

‘না, তুমি বিশাল সাহসী’। থুতু ছিটকানো গলায় হেসে উঠল ছোটন। 

‘তো-তোদের থেক-থেকে বেশি, শাল-লা !’ 

‘এদিকে একানড়ের ভয়ে বিছানায় মুতে দাও।’ 

‘আমি ভ-ভয় পাই না !’ চিৎকার করল বাবান। 

‘এই তালগাছে থাকে। জানো না? ভয় না পেলে দেখাও দেখি !’ 

‘ক্কী, কী কর-করতে হবে?’ বাবান হাঁফাচ্ছিল। 

‘তালগাছে ওঠো। তাহলে বুঝব ভয় পাও না।’ কুটিল গলায় চোখ সরু করে ছোটন বলল। 

‘তুই কি পাগল হলি, ছোটন?’ বাপ্পা চেঁচাল। ‘কী করে উঠবে?’ দেবুর দিকে তাকাল, কিন্তু দেবু অন্যদিকে দেখছিল। 

‘না উঠলে বুঝব, ক্যালানে।’ হিশহিশ করে বলল ছোটন। 

আচমকা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সব কোলাহল। সকলেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাবানের দিকে তাকিয়ে থাকল। বাবান অনিশ্চিতভাবে এদিক ওদিক দেখল, একবার গলা খাঁকড়াল, ‘দ্দে-দেবু?’ কোনও সাড়া না পেয়ে অসহায় দৃষ্টি ফেলল বাপ্পার দিকে। বাপ্পা বলল, ‘বাড়ি চলে যাও, এক্ষুণি।’ 

‘হ্যাঁ হ্যাঁ যাও, আর এসো না। ছোটলোকদের ছেলের সঙ্গে মিশো না আর, বুঝলে?’ বলে উঠল কেউ একজন। 

বাবান সকলের মুখের দিকে তাকাল, তারপর এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল তালগাছের দিকে। বাপ্পা তার হাত ধরল, ‘পাগল হলে নাকি? কোমরে দড়ি বেঁধে উঠতে হয়, তুমি পারবে না ওসব। বাড়ি যাও।’ 

বাপ্পার হাত ছাড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁটল বাবান। গাছের তলায় এসে শুধু বলল, ‘উঠ-উঠতে পারলে ক্যাল-লানে বল-বলবি না তো আর? ভীভ-ভীতু বলবি না?’ 

‘না।’ 

বাবান গাছের গায়ে একটা পা দিয়ে বেড় দিল। তারপর অন্য পায়ে ব্যালেন্স করতে না করতেই পড়ে গেল চিত হয়ে। হেসে উঠল সবাই। মরীয়া হয়ে উঠে বাবান আবার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল গুঁড়ি, তারপর অমানুষিক শক্তিতে একটু একটু করে ওপরে উঠতে লাগল। 

‘হো’ ‘হো’ করে ছেলের দল চিৎকার করে উঠল, আর বাপ্পা অবাক হয়ে দেখল বাবানের রোগা শরীরটা কীভাবে ঘষটাতে ঘষটাতে ওপরে উঠে যায়। ঠিক সেই সময়েই প্রথম ঢিলটা ছুটে গেল। গিয়ে লাগল বাবানের পিঠে, বাবান চিৎকার করে উঠল, ‘আ!’ 

বাপ্পা ছোটনের হাত ধরে ঝাঁকাল, ‘কী করছিস কি?’ 

আরেকটা ইট ছুঁড়ল ছোটন, ‘দেখ না শালা! হেভি মজা !’ 

সবাই মিলে ইট ছুঁড়তে লাগল, আর চেঁচাতে লাগল, ‘ আরও ওপরে, আরও’। বাবান উন্মত্তের মত আরও কিছুটা উঠে গেল। তার চারপাশে তখন বৃষ্টির মত ইটের টুকরো ছুটে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। ওপরে উঠলে রেহাই পাবে এই আশায় বাবান হেঁচড়ে হেঁচড়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করল, একটা ঢিল তার মাথায় গিয়ে লাগল ঠকাং করে, আবার আর্তনাদ করে উঠল বাবান। 

বাপ্পা গিয়ে দেবুকে ঝাঁকানি দিল, ‘তুই নামা। মরে যাবে ও !’ 

দেবু সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার বাপ্পাকে দেখল, তারপর ছুটে গিয়ে একটা ঢিল ছুঁড়ে দিল বাবানের দিকে। শাঁ করে বাবানের কান ঘেঁসে বেরিয়ে গেল। তারপর, বাপ্পা অবাক হয়ে দেখল, দেবু উল্টোদিকে ঘুরে পরপর কয়েকটা ঢিল ছুঁড়ছে পরম আক্রোশে, বাবানদের বড় বাড়িটাকে লক্ষ্য করে। একটা ঢিল বাবানের ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকেও গেল ভেতরে। দেবুর লক্ষ্যই নেই বাবানের দিকে, সে যেন চাইছে বাড়িটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে। 

বাপ্পা উন্মত্তের মতো চেঁচাল, ‘তোরা পাগল হয়ে যাচ্ছিস দেবু, পাগল !’ তখন পর পর দুটো ঢিল বাবানের কাঁধে গিয়ে লাগল, এবং বাবান এতক্ষণে পড়ল। মাথা নিচু করে সটান শক্ত মাটিতে, ফলত বেঁকে গেল ঘাড়টা। একটা মট করে আওয়াজ উঠল শুধু, তারপর পা দুটো কয়েকবার খিঁচিয়ে উঠল। 

এতই আচমকা ঘটল যে প্রথমে কেউই কেউই বুঝতে পারেনি। সম্বিত ফিরে পেতে ছুটল সকলে। বাবানের ঘাড়টা মাথার সঙ্গে অস্বাভাবিক কোণ করে আছে। বেরিয়ে এসেছে জিভ। চোখ দুটো খোলা, শুধু মুখ থেকে একটা সরু রক্তের ধারা আস্তে আস্তে পথ করে নিচ্ছে। 

কেঁপে উঠল গণেশ, ‘মরে গেছে !’ 

ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল ছোটনের মুখ। শুকনো জিভে ঠোঁট বুলিয়ে হাসার চেষ্টা করল সবার দিকে তাকিয়ে, ‘আমরা বলেছি গাছে চড়তে? নিজেই তো চড়ল। শালা ক্যালানে !’ 

বাপ্পা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল বাবানের দিকে। শুকনো গলায় বলল, ‘এবার কী হবে?’ তখন কেঁদে উঠল দাসপাড়ার বাবাই, ‘মরে গেল রে! চোখের সামনে!’ 

‘চুপ ক-কর’, তোতলাল ছোটন, ‘আমরা ঢিল ছুঁড়েছি জানলে আস্ত রাখবে না কেউ। কী হবে জানিস না।’ 

‘কী হবে?’ 

‘জেল হবে।’ খেঁকিয়ে উঠল ছোটন, ‘শোন, সবাই বলব ও গাছে চড়তে গিয়ে পড়ে গেছে। আমরা বারণ করেছিলাম তবু শোনেনি।’ 

‘আমি সত্যিই বারণ করেছিলাম’, অস্ফুটে বলল বাপ্পা, এবং দেখল, দেবু চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে, থরথর করে কাঁপছে দুই ঠোঁট। বাপ্পা দেবুকে ধাক্কা দিল। চোখ বুজেই দেবু বলল, ‘আমার রাগ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, আমি চাইনি, চাইনি !’ তারপর ভেঙে পড়ল মাটিতে। 

‘তোরা কেউ বলিস না! বাবা খুন করে ফেলবে আমাকে।’ অসহায়ের মতো সবার দিকে তাকাল ছোটন। তখন অন্ধকার জমাট হয়ে বসল মাঠের বুকে, বাপ্পার ঠাণ্ডা লাগল। 

বাবানের বাড়িতে তখন সান্ধ্য টিউবলাইট জ্বলে উঠেছে। এই সময়ে ওদের চায়ের জল চাপানো হয়, সন্ধ্যের বাতাস সুগন্ধী তরলের ঊষ্ণ গন্ধে আচ্ছন্ন থাকে।

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *