জগদীশ বোস বলতে আমরা কী বুঝি? মানে, সাধারণত কোন ছবিটা আমাদের মনে ভেসে আসে? এক, বিজ্ঞানী। দুই, ‘গাছের প্রাণ আছে’ তত্ত্বের প্রবক্তা। তিন, রেডিওর আবিষ্কর্তা (যদিও তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই, কোথাকার কোন মার্কোনি তাঁর আবিষ্কার ঝেড়ে নিজের নামে করে নিয়েছেন)। কেউ কেউ গলা বাড়িয়ে বলতে পারেন, লোয়ার সার্কুলার রোডের নাম বদলে এজেসি বোস রোড করে দেওয়া হয়েছে কবে! এজেসি মানে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস। তাই তো! কেউ আরও জুড়ে দিতে পারেন, ‘ওই যে, ইশকুলে থাকতে থাকতে সায়েন্স ট্যালেন্ট সার্চ এগজামিন দিতুম, সেটাও তো ওঁর নামে! দেখেননি, রাসবিহারী কানেক্টরে একটা বাড়ি আছে, সেটার গায়ে মোজাইক করে তো ওঁরই ছবি আঁকা!’ গেরামভারী গোছের কোনও গড়পার-বাসী এ তল্লাটে থাকলে কলার তুলে বলতে পারেন, ‘আহ, বসু বিজ্ঞান মন্দির দেকোনি বুঝি! রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের পাশে। ভেতরে ঢুকতে পারবে কিনা বলতে পারি না!’ 

এভাবে কথা চালিয়ে যাওয়া যায়। জুড়ে যেতে পারে ছোটোবেলায় পড়া ‘অমর চিত্র কথা’র মলাটে ধ্যানমগ্ন এক বিজ্ঞানসাধকের ছবি কিংবা মাধ্যমিকের বাংলা বইয়ে ‘স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনাপ্রবাহ’ নামের এক গদ্যাংশ পাঠের স্মৃতি। থাক। আমরা আর ওদিকে যাব না। এই ধরতাই এইজন্যই যে জগদীশচন্দ্র বসু সম্বন্ধে গড়পড়তা বাঙালির ধারণা খুবই কম। ‘দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান’ ইশকুলের রচনা বইয়ে সেঁধিয়ে যাওয়ায় সমস্যা আরও প্রকট। অবিশ্যি বিজ্ঞান নিয়ে যারা লেখাপড়া করেছেন, বোস ইন্সটিটউটের মতো গবেষণাকেন্দ্রে কাজ করেছেন, তাদের ব্যাপার আলাদা। 

আরও পড়ুন: ছ’ঘণ্টার অবাক যাপন ‘ঊরুভঙ্গম’ 

এহেন জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে আস্ত একটা নাটক লিখে ফেলেছেন সুদীপ্ত ভৌমিক। নাম দিয়েছেন ‘আমি জগদীশ’। মার্কিন মুলুকের শহর নিউ জার্সির নাটকের দল ইসিটিএ (ECTA) এই নাটকটাকে মঞ্চে এনেছেন, সৌমেন্দু ভট্টাচার্যের নির্দেশনায়। গেল অগাস্টে ওই নিউ জার্সিতেই এই নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়। ডিসেম্বরের শেষ হপ্তায় পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি বানিয়ে লাগাতার শো করে গেলেন পরিযায়ী এই নাট্যদল। একে একে বহরমপুর, শান্তিপুর, গোবরডাঙা, কলকাতা, নিউ টাউন, উত্তরপাড়ায়। ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ‘আমি জগদীশ’ দেখা গেল অনীকের গঙ্গা-যমুনা নাট্য উৎসবের মঞ্চে। একাডেমির অডিটোরিয়াম ভর্তি করে লোক এল সে নাটক দেখতে। সচরাচর যারা একাডেমিতে আসেন, তারা হাতে গোনা। রবাহূত সিংহভাগ। এই লোকজনের মধ্যে ইসিটিএ-র এদেশি আত্ম-স্বজন যেমন ছিলেন, তেমন বিজ্ঞানীকুলের কেউ কেউ ছিলেন – এটুকু হলফ করেই বলা যায়। বিরতি সমেত দু ঘণ্টা ১০ মিনিটের নাটক। সবাই মন দিয়ে দেখলেন। উঠে গেলেন না। শেষটায় স্ট্যান্ডিং ওভেশন হল। বাংলাদেশের কৃতবিদ্য নট ও নাট্যকার মামুনুর রশীদের হাত থেকে উৎসব স্মারক পেলেন সুদীপ্ত-সৌমেন্দু। মধুরেণ সমাপয়েৎ যাকে বলে আরকি!

Bengali play Aami Jagadish
জগদীশের ভূমিকায় ছিলেন তুষারমৌলি মুখোপাধ্যায়।

তা ‘আমি জগদীশ’ ব্যাপারটা কী? জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে বায়োড্রামা? না। কলকাতায় পোড়খাওয়া নাটকের দল রঙরূপ সেটা করেছেন বছর সাতেক আগে, ‘অব্যক্ত’ নামে (নাটককার সৌনাভ বসু, নির্দেশক সীমা মুখোপাধ্যায়)। এখনও হয়। ‘আমি জগদীশ’ চেয়েছে সেকাল-একালকে পাশাপাশি এনে টাইট-রোপ-ওয়াকিং করাতে। সেকালের মজ্জাগত মূল্যবোধের সঙ্গে একালকে লড়িয়ে দিতে। বৈজ্ঞানিক নীতিবোধ বা সায়েন্টিফিক এথিকসকে এপিঠ-ওপিঠ দেখিয়ে আমাদের সজাগ করতে চেয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্র যা চাইছে আর বৈজ্ঞানিক যা চাইছেন তার মধ্যে দিয়ে পথ কাটতে কাটতে এগিয়েছে ‘আমি জগদীশ’। এই টানাপোড়েন অবিশ্যি আনকোরা কিছু নয়। আর্যভট্ট থেকে শুরু করে গ্যালিলেও, লিওনার্দো থেকে আইনস্টাইন – সবাইকে এই ক্ষুরস্য ধারায় চলতে হয়েছে। ঔপনিবেশিক ভারতের বুকে বেড়ে ওঠা জগদীশচন্দ্রকে এই গ্যাঁড়াকলে পড়তে হয়নি ঠিকই, তাঁর উত্তরসাধকদের হচ্ছে। অহরহ। এটাই সুদীপ্তর নাটকের ভরকেন্দ্র। 

এমনিতে ইতিহাস থেকে সুতো নিয়ে নাটক লেখায় পাকা হাত সুদীপ্তর। বিশেষ করে স্বদেশী আন্দোলনের পঞ্জাব অধ্যায় নিয়ে ওঁর অধ্যয়ন ও অভিযোজন আমাদের সাবাসি পেয়েছে। যে আকাশেই ঘুড়ি উড়ুক বাংলার একটা সুতো টেনে রাখেন সুদীপ্ত। তথাকথিত বেঙ্গল রেনেসাঁর মাপকাঠিতে আমাদের সমকালকে রাঙিয়ে নেন। ‘আমি জগদীশে’ তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

মার্কিন মুলুকের শহর নিউ জার্সির নাটকের দল ইসিটিএ (ECTA) এই নাটকটাকে মঞ্চে এনেছেন, সৌমেন্দু ভট্টাচার্যের নির্দেশনায়। গেল অগাস্টে ওই নিউ জার্সিতেই এই নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়। ডিসেম্বরের শেষ হপ্তায় পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি বানিয়ে লাগাতার শো করে গেলেন পরিযায়ী এই নাট্যদল। একে একে বহরমপুর, শান্তিপুর, গোবরডাঙা, কলকাতা, নিউ টাউন, উত্তরপাড়ায়। ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ‘আমি জগদীশ’ দেখা গেল অনীকের গঙ্গা-যমুনা নাট্য উৎসবের মঞ্চে।

সেদিন নাটক শুরুই হল ফ্রন্ট লেফটে – অর্থাৎ প্রসেনিয়াম স্টেজের সবচাইতে নজরকাড়া এলাকায় – জগদীশচন্দ্র বসুকে (তুষারমৌলী মুখোপাধ্যায়) দেখিয়ে। শুধু দেখিয়ে নয়, তাঁর অভিভাষণ দিয়ে। ইট ওয়জ ম্যাজিক্যাল! তুষারমৌলী এমনিতে দীর্ঘদেহী দীর্ঘনাসা। দৃষ্টি তাঁর গাঢ়, ভঙ্গি তাঁর নম্র। সামান্য রূপটান নিয়ে, জগদীশসুলভ জামাকাপড় পরে যেই তিনি স্পটলাইটের সামনে এলেন, আমাদের চোখ সেদিকে ঘুরে গেল। আর ফিরল না। পরিশীলিত বচনে আমাদের ভালো-লাগায় ভরিয়ে দিলেন তিনি। বাস্তব-বিভ্রমের ল্যাঠা চুকে গেল। মনে হতে থাকল বুঝি কাশিমবাজার কি ইলাহাবাদে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের মঞ্চে বদলে গেছে লেডি রানু মুখার্জি মঞ্চ। এও মনে হতে লাগল, বুঝি গুছিয়ে একটি পিরিয়ড পিস বানিয়ে এনেছেন ইসিটিএ। 

ব্ল্যাক আউট হতেই বোঝা গেল যে পিরিয়ড পিস নয়। সেন্টারস্টেজ জুড়ে একেলে এক বিজ্ঞান গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছেন ইসিটিএ-র দলবল (পরে শুনলাম শ্যামবাজারের সায়ক নাট্যদল তাদের সহযোগী)। এটা জীববিজ্ঞানী নিরূপ বিশ্বাসের (সৌমেন্দু ভট্টাচার্য) ঘাঁটি। ঈষৎ খাপছাড়া মেজাজের এই দুঁদে বিজ্ঞানীর সহকারী হয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন এক ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার (অন্তরা মুখোপাধ্যায়)। ক্রমে মালুম হল যে দিল্লির পয়সায় চলা এই বিজ্ঞানসত্র এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রকের নেকনজরে আছে। খোদ মন্ত্রী (অনির্বাণ বিশ্বাস) এখানে যাতায়াত করেন। পাশে থাকেন ফার্মা কোম্পানির মালিক (রানা রায়)। এই বিজ্ঞানসত্রের সর্বময়ী কর্ত্রী (অপর্ণা ভট্টাচার্য) পড়েছেন ফাঁপরে। মন্ত্রীর মন জুগিয়ে, দিল্লির স্বাস্থ্যনীতির মর্জি মাফিক এটাসেটা প্রকল্প জুটিয়ে তাঁকে চালাতে হয়। বন্ধু তথা সহকর্মী নিরূপ যদি একটু সহযোগিতা করেন তাহলে সোনায় সোহাগা হয়। কিন্তু নিরূপ বেঁকে বসেছেন। কৃষিবিপ্লবের সাত দশক আগেকার মডেলকে সামনে রেখে কৃষিজমির উৎপাদন আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে নেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন মন্ত্রী। এই গবেষণায় চোদ্দ আনা এগিয়ে যাওয়া নিরূপ সেটা চাইছেন না। প্রকৃতির ওপর খবরদারি করাতে মোটে সায় নেই তাঁর। বরং কী করে গাছের ভাষা পড়ে নেওয়া যায়, কীভাবে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি টিম তৈরি করে উদ্ভিদকুলের আঁতের কথা বুঝে নেওয়া যায়, সেদিকে মন ঘুরে গেছে তাঁর। এবং তাঁর জাগ্রত তন্দ্রায় দেখা দিচ্ছেন খোদ জগদীশচন্দ্র। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে, নিজের বোধবুদ্ধি দিয়ে পুত্রপ্রতিম নিরূপকে প্রণোদনা জুগিয়ে চলেছেন। 

still from Bengali play Aami Jagadish
নাটকের এক দৃশ্যে তুষারমৌলি এবং অন্তরা।

বিজ্ঞানের নাটকে ভূতের ক্যার্দানি? না, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। তবে এর চেয়ে বেশি বলা যাবে না। হিস্ট্রি অফ সায়েন্স ভালো করেই পড়েছেন সুদীপ্ত। উচ্চফলনশীল বীজের প্রচলন কীভাবে জমির উৎপাদনশীতলতার বারোটা বাজিয়েছে, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বীজের রমরমা কীভাবে আরও বড়ো বিপদের মুখে দাঁড় করিয়েছে আমাদের, এসব ব্যাপারেও তাঁর জ্ঞান টনটনে। তবু কোনও কিছু না-দাগিয়ে বিজ্ঞানীর বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠার চোরাবালির ফাঁদ চিনিয়ে দিয়েছেন ‘আমি জগদীশে’। উকিল ঠাউরেছেন জগদীশচন্দ্রকে, যাঁকে ঘিরে আজও অতিকথা ও কিংবদন্তীর জন্ম হয়। 

নিপাট নিটোল প্রযোজনা। ভারী মঞ্চসজ্জা। গাছগাছালিতে বোঝাই। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আলোকসম্পাত বড়োই ভালো হওয়ায় তেলেজলেমিশ খেয়ে যায়। এমনকি লজ্জাবতী-পতঙ্গভুকের (‘পোকাখেকো’ নামটি আশু বর্জনীয়) ভাব-পাতানোর খেলাটিও মন দিয়ে দেখি আমরা। পিনাকী দত্তর আবহ সংগীতে সেকাল-একালের সেতুবন্ধন কতক অনায়াসেই ঘটে। 

বাকি রইল অভিনয়। সাদা চোখে ‘তারকাটা’ বৈজ্ঞানিকের চরিত্রে সৌমেন্দুর ছটফটানি খুব কাজে এসেছে। বিশেষ করে তুষারমৌলীর গড়া দুঃখেষ্বনুবিগ্নমনা জগদীশচন্দ্রের একেবারে উল্টোমুখে চলায় দুটো অভিনয়ই দাঁড়িয়ে গেছে। বাকিরা সামাল দিয়েছেন বলে রয়েসয়ে গেছে সব। 

জগদীশচন্দ্রের খুব কাছের মানুষ রবীন্দ্রনাথের একটা গানের প্রথম কালিতে আছে ‘তারো তারো, হরি, দীনজনে’। এই মুহূর্তে ভারত জুড়ে দেবদ্বিজে ভক্তির যে ভরা মরসুম, পুরাণকে বেদবাক্য মানার পন্থাই যেখানে নান্যঃ হয়ে উঠছে, সেখানে এমন নাটক কেমন করে বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে সেটাই বিলিয়ন ডলায় কোয়েশ্চেন। 

ছবি সৌজন্য: কৌশিক ভাওয়াল।

anshuman bhowmick

অংশুমান ভৌমিকের জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। ছেলেবেলা কাটিয়েছেন মামারবাড়ি নবদ্বীপে। গত চার দশক কলকাতার বাসিন্দা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজির এমএ হলেও বাবার 'দেশ' বরিশাল আর মায়ের 'দেশ' নদিয়ার মধ্যে দোদুল্যমান তাঁর অস্তিত্ব। পেশায় শিক্ষক, নেশায় কালচারাল কমেন্টেটর। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি করছেন দু'দশকের বেশি। দেশবিদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বারো। 'দ্য টেলিগ্রাফ' ও কৃত্তিবাস-এর নাট্যসমালোচক হিসেবে ইদানীং থিতু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *