আগের পর্ব পড়তে: [] []

– ঝিল্লি, দিজ ইজ রায়া। রায়া দিজ ইজ ঝিল্লি। 
নার্সারির বাচ্চাদের যেভাবে বল কিংবা আপেল কিংবা বেড়ালের সঙ্গে পরিচয় করানো হয়, প্রায় সেইভাবে অরুণাভ ঝিল্লির সঙ্গে রায়ার পরিচয় করাল এবং রায়ার সঙ্গে ঝিল্লির। আজকে একটা চমৎকার দিন। ১৫ জুন পেরিয়ে গেছে। যে কোনওদিন বর্ষা এসে পড়বে। আজ তার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কোথা থেকে বৃষ্টিমাখা হাওয়া ছুটে ছুটে আসছে। রোদ কিছুতেই জমিয়ে বসতে পারছে না। এমন দিনে খুব কেজো লোকেরও কাজের হিসেব ঘেঁটে যায়।

আজ দিনটা খুব ভালো থাকতে পারত ঝিল্লি। তাকে দেখে মনেও হচ্ছে সে খুব ভালো আছে। মভ রঙের কুর্তি আর জংলা ছাপ লং স্কার্ট, সর্পিল টিপ, কানেও সর্পিল অক্সিডাইজড দুল, মভ লিপস্টিক, ব্র্যান্ডেড সানগ্লাস আর বার্গেন্ডি রঙের চুলে তাকে অলৌকিক দেখাচ্ছে। কফিশপের সামনে সে যখন ট্যাক্সি থেকে নামল, অরুণাভ অল্পক্ষণের জন্যে হলেও কথা খুঁজে পেল না। রায়া অরুণাভর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। এতক্ষণ তাকে ঠিকঠাকই লাগছিল। ক্রু-কাট চুল, জিনস পাঞ্জাবিতে ভারী চেহারাও বেশ ক্যারি করে রায়া। তার গায়ের রঙ খুব ফর্সা, এছাড়া তার চেহারায় বলার মতো জিনিসটা তার ব্যক্তিত্ব। যে কোনও লোক তার সামনে এসে কুঁকড়ে যায়। কিন্তু ঝিল্লিকে দেখে আজ সেই রায়াই একটু কুঁকড়ে গেল, পরক্ষণেই তার গম্ভীর মুখের নীচে হালকা হলেও ফুটে উঠল জয়ের তৃপ্তি। এই মেয়েটাকে, এই মেয়েটাকে সে ফেড আউট করে দিল! ওয়াও! অরুণাভ কিছুক্ষণ বিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে দু’জনের পরিচয়পর্ব সারল, তারপর বলল ‘চলো ভেতরে যাই।’

এখানে ঝিল্লি আগে কখনও আসেনি। সত্যি বলতে কি, কলকাতায় খুব কম রেস্তরাঁতেই সে খেয়েছে। অরুণাভ পছন্দ করে না বাইরে বসে খাওয়া। সে বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে ঘরে বসে শান্তিতে খাবার পক্ষপাতী। অন্তত ঝিল্লি তো তাইই জানত এতদিন। আজ রায়া আর অরুণাভর সঙ্গে বসে সে জানতে পারল, ওরা প্রায়ই এখানে খেতে আসে। শুধু এখানেই নয়, নতুন কোনও ফুড জয়েন্ট খুললে নাকি সেটা ট্রাই করা অরুণাভর হবি। রায়া হঠাৎ অরুণাভকে জিগ্যেস করল,
– অ্যাই, মার্কো পোলো-তে ইলিশ উৎসব কবে শুরু হচ্ছে গো? 
ঝিল্লির চোখ জ্বালা জ্বালা করে উঠল। অরুণাভর সঙ্গে তার আসন্ন বিচ্ছেদ তাকে তত কষ্ট দিচ্ছিল না, যতটা এই রায়া মেয়েটার নির্বাচন। ওর ধারণা, যাদের বাড়িতে রুই-কাতলা ছাড়া অন্য মাছ আসে না, তারাই এই সব ইলিশ উৎসবে গিয়ে হামলে পড়ে, তারাই বাংলা নববর্ষে হোটেলে পোস্ত, মোচার ঘন্ট খেতে যায়। বাড়িতে রাঁধা ইলিশ মাছের স্বাদ তো শুধু জিভে নয়, সে এক একাত্মতার সুখ। ছোটবেলায় বাবা সন্ধেয় ইলিশ নিয়ে ফিরলে তারা ভাইবোনেরা কেমন বাবার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ত, মনে পড়ে গেল তার। ঝিল্লি যে সব মাছ খায়, সব মাছ রাঁধতেও পারে– এই পটুতায় এত বছর ধরে মুগ্ধ ছিল অরুণাভ। সেই অরুণাভ কিনা রায়াকে… সে নিচু গলায় বলল
– আমি শুধু কফি নেব।

abstract-river-jason-folstad
আহারের মাঝখানে বসে ঝিল্লি কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছিল

ওর এই উচ্চারণে ওদের সম্বিত ফিরল। রায়া কফি উইথ ক্রিম ছাড়াও প্রচুর স্ন্যাক্স অর্ডার দিতে যাচ্ছিল। সে খানিকটা ক্ষুণ্ণভাবেই বলল
– ওকে, আমি… ঠিক আছে… চিকেন স্যান্ডউইচ, বেশ খিদে পেয়েছে আসলে।
অরুণাভ, সেও হয়তো অনেক কিছু খেত, খানিকটা স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল
– আমিও স্যান্ডউইচ, তবে চিকেনটা আজ আর খাব না, চিজ স্যান্ডউইচ নিই?
ঝিল্লি আর থাকতে না পেরে বলে উঠল
– অযথা ব্যাপারটাকে আনুষ্ঠানিক শোক পালনের চেহারা দেবার দরকার নেই। তোমরা যা খুশি খেতে পারো। অরুণাভ তো জানে আমি বাড়ি থেকে সবসময় সাপটে ভাত খেয়ে বার হইআমার সত্যি ক্ষিদে নেই।
কথাটা বলার সময় আবার বেয়াক্কেলের মতো তার চোখে জল চলে এল। অরুণাভ জানে, না জানত?

***

বহুদিন চাকরি ছেড়ে নিজস্ব আর্কিটেকচারাল ফার্ম খুলেছে অরুণাভ। তবু রোজ সকালে বাজার করাটা তার কাছে পবিত্র রিচুয়াল ছিল। ঝিল্লির রাঁধা প্রতিটা পদ খেয়ে যাবার জন্যে সে একটু বেলা করে বেরত। অনেক রাতে ফিরলেও বাড়ির খাওয়া প্রায় কোনওদিনই বাদ দিত না। বছর দুয়েক আগে ওর ফার্মের তৎপরতা এত বেড়ে গেল যে অরুণাভ প্রায়ই বাজার স্কিপ করতে লাগল। ডিনার, এমনকী লাঞ্চও স্কিপ করতে লাগল। ঠিক এক বছর ন’ মাস সতেরো দিন আগে এক মধ্যাহ্নে অরুণাভর ভাত বাড়বে কিনা জানতে বেডরুমে ঢুকেছিল ঝিল্লি। অরুণাভ তখন স্নানে গিয়েছে। ওর শার্ট, প্যান্ট, ওয়ালেট, মোবাইল সব বিছানায় ছড়ানো। হঠাৎ টুং করে একটা শব্দ হল। মেসেজ এসেছে। বসে বসে বোর হচ্ছিল বলেই আলগোছে ফোনটা তুলে নিয়ে মেসেজটা পড়ল। ‘ইউ’ নামের কোনও সেন্ডার পাঠিয়েছে। 
আজ ওশানিজ়ে লাঞ্চ, মনে আছে তো?ব্লু শার্টটা পরে এসো। 

ঝিল্লি দেখেছিল বিছানায় নীল শার্ট আর টাই রাখা। ওর সারা শরীর অজানা বিষে মুহূর্তে নীল হয়ে গেছিল। বিষ ওর চলচ্ছক্তিও কেড়ে নিয়েছিল। তবু, স্নান সেরে, কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে অরুণাভ যখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল, বরাবরের অভ্যেসে ও লাফিয়ে উঠে পড়ে বলল
– ভাত বাড়ি?
অরুণাভ ওর জলকণাখচিত শরীর দিয়ে ঝিল্লিকে জড়িয়ে ধরে বলল
– না সোনা, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আজ ক্লায়েন্ট খাওয়াবে। খুব বড় ডিলের ব্যাপার আছে।
– ক্লায়েন্ট কি জামার রংও বেছে দ্যায় আজকাল?
প্রশ্নটা উঠে এসেছিল ঠোঁটে, তবু কিছু বলেনি ঝিল্লি। এক বছর ন’ মাস সতেরো দিন আগে। ও যেন জানতই এটাই হবে, এটাই হয়।

অরুণাভর সঙ্গে তার আসন্ন বিচ্ছেদ তাকে তত কষ্ট দিচ্ছিল না, যতটা এই রায়া মেয়েটার নির্বাচন। ওর ধারণা, যাদের বাড়িতে রুই-কাতলা ছাড়া অন্য মাছ আসে না, তারাই এই সব ইলিশ উৎসবে গিয়ে হামলে পড়ে, তারাই বাংলা নববর্ষে হোটেলে পোস্ত, মোচার ঘন্ট খেতে যায়। বাড়িতে রাঁধা ইলিশ মাছের স্বাদ তো শুধু জিভে নয়, সে এক একাত্মতার সুখ। ছোটবেলায় বাবা সন্ধেয় ইলিশ নিয়ে ফিরলে তারা ভাইবোনেরা কেমন বাবার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ত, মনে পড়ে গেল তার। ঝিল্লি যে সব মাছ খায়, সব মাছ রাঁধতেও পারে– এই পটুতায় এত বছর ধরে মুগ্ধ ছিল অরুণাভ।

মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে হঠাৎ করে ওর বাবা মারা গেছিলেন। একদম সুস্থ, সাতচল্লিশ বছরের এক পূর্ণ যৌবন মানুষ। অসামান্য রূপবান। তাঁকে হারাবার পর থেকে ঝিল্লি বিশ্বাস করে যে, ওর সঙ্গে যে কোনও ঘটনাই ঘটতে পারে। মৃত্যু, বিচ্ছেদ, দুর্ঘটনা– এসব ওর জীবনে অনিবার্য। ও প্রতি মুহূর্তে নিজেকে তার জন্যে তৈরি রাখে। কিন্তু এই ঘটনাটা ওকে একটু এলোমেলো করে দিল। ছেলেকে আনা-নেওয়া, তাকে পড়ানো, তার জন্যে নিত্যনতুন টিফিন বানানো- যে কাজগুলো ও খুব ভালোবেসে করত, সেগুলো ওর কাছে বোঝা মনে হল। মনে হল অন্য কারো সংসারে সে বেগার খাটছে। তার প্রতিদিনের অভ্যস্ত কাজে ভুল হতে লাগল। তার সে ভুলগুলো অরুণাভর চোখে ধরাও পড়ছিল না, এটা আরও বেদনার ছিল। অরুণাভ নতুন  সম্পর্কে নেশাগ্রস্তের মতো ডুবে যাচ্ছিল। কখনও কখনও বাড়িতে খেলেও সে বুঝতে পারত না, ঝিল্লির রান্নায় আর আগের মতো স্বাদ নেই। আর শরীরের স্বাদ? আগের থেকেও আগ্রহে, একটু সাজিয়ে তোলা আগ্রহেই সেই শরীরের ওপর ঝাঁপাচ্ছিল অরুণাভ, কিন্তু ঝিল্লি যে আগের মতো ওকে গ্রহণ করতে পারছিল না, সেটা অনুভব করার ইচ্ছে, ক্ষমতা বা সুযোগ কিছুই তার কাছে ছিল না।

ঝিল্লি বলার পর রায়া আর অরুণাভ প্রাণ খুলে নিজেদের পছন্দের খাবার অর্ডার দিল। খাবারগুলো টেবিলে আসা পর্যন্ত অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য। তারপর দু’জনের খাবার মাঝখানে গভীর নিঃসঙ্গতায়, উপবাসে ডুবে যেতে যেতে ঝিল্লি ভাবল, আজকে একটা নষ্ট দিন। তার চেয়ে, মিথিলেশ এত করে বলে, ওর সঙ্গে অবন্তীনগর গেলে হত। অবন্তীনগরে এখন ডাইরেক্ট বাস যায়। বাস থেকে নেমে ছোট্ট একটা নদী, ওরা সেই নদীটার নাম দিয়েছে ঝিল্লি। সে কথা মনে করে, অরুণাভ আর রায়ার অমিত আহারের মাঝখানে বসে ঝিল্লি কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছিল।

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১ অগস্ট ২০২২
*ভিতরের ছবি: Pixels

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *