আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১]
সেই একটা ফোন সেদিন সত্যি সত্যি গুড মর্নিং নিয়ে এসেছিল তার জীবনে। যাদবপুর থেকে এমএ করে চাকরির কথা ভাবেইনি ঝিল্লি, বিয়ে করে সংসারে জড়িয়ে গিয়েছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। নিজের কী স্কিল আছে, আদৌ আছে কিনা, সে জানতই না। অর্ণব আর বিদিতা প্রথম ওকে ওর ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করল। প্রথম প্রথম ইংরেজি বিজ্ঞাপনের বাংলা অনুবাদ, আস্তে আস্তে ও নিজেই কপি লিখতে শুরু করল। তারপর বিজ্ঞাপনের ফিল্মের সঙ্গেও জড়িয়ে গেল। লে আউট নিয়েও ক্রিয়েটিভ ইনপুট দিতে শুরু করল। আপাতত ঝিল্লি ফ্লেক্সি ওয়ার্কিং করে। অফিসে একটা ক্রেশ খোলার কথা হচ্ছে। মহিলাকর্মী বেশি তো। তখন ও ফুল টাইম কাজ করবে। তবে সেটা হতে এখনও বছরখানেক। তার মধ্যে ডিভোর্সটা পেয়ে যাবে।
ব্যালকনি থেকে ঝিল্লি বৃষ্টি দেখল কিছুক্ষণ। গাছপালাগুলো ভিজে আরও সবুজ লাগছে। এদিকটা খুব সুন্দর। সবই ভালো, কিন্তু বড্ড নিচু বলে খুব জল জমে যায়। তবে মেট্রোটা ভীষণ কাছে। পাঁচ সাত মিনিটের হাঁটা পথ। ঝিল্লি নিজেই স্কুলে দিয়ে আসে ছেলেকে, মাঝখানের সময়টুকু কাজ করে, তারপর ছেলেকে নিয়ে ফেরে। ফেরার পথে রাস্তার দু’পাশে সবজি, মাছ পরপর। আলাদা করে বাজারে যেতে হয় না। কখনও ভুট্টা, কখনও ফুচকা বা রোল কিনে ঘরে ফেরে মা-ছেলে। বাজার করার একটা আলাদা মজাও আছে। কত নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। আর একা লাগে না অতটা। কাল সবজিমসির কাছ থেকে কচুর মুখি আর কুলেখাড়া শাক নিতে নিতে জানতে পারল তার দেশের বাড়ি অবন্তীনগর। বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল অমনি।
আজ সকালের ঝমঝম বৃষ্টিতে অবন্তীনগর শব্দটাই বেজে উঠছে বারবার। কতদিন কথা হয়নি মিথিলেশের সঙ্গে, বেচারা ফোন করে করে না পেয়ে পেয়ে আর ফোন করে না। শেষবার একটা অদ্ভুত এমএমএস পাঠিয়েছিল। চুড়ি পরা কংকালের হাত। মাথাটা গেছে নাকি একেবারে? তিন চার মাস ঝিল্লি অন্য কোনওকিছু নিয়ে ভাবার সময় পায়নি। শুধু নতুন সংসারে গুছিয়ে বসা। স্বাধীন উপার্জনের চেষ্টা করা আর ছেলের দেখাশোনা। আজ এমন একটা কর্মনাশা দিন বলেই বোধহয় মনে হচ্ছে তার সব গুছনো হয়ে গেছে। এবার সে একটু আরাম করতেই পারে। এবার সে অবন্তীনগরের বাস ধরে…
ফোন বাজল নাকি ঘরে? বৃষ্টি এত জোরে পড়ছে যে এখান থেকে কিছু শোনা যায় না। অরুণাভ মাঝে মাঝে ন্যাকামি করে ফোন করে ‘ভালো মাছ পেয়েছি, দিয়ে আসব? জিদান কই মেটে খাবে?’ অরুণাভর কথা মনে হতেই ওর মনে হল ‘দূর হোক গে, ধরব না।’ ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল। ঝিল্লির অস্থির লাগল একটু। ঘরে এসে দেখল মিথিলেশের মিসড কল। টেলিপ্যাথি নাকি? কতদিন পর ফোন করল মিথিলেশ! রিং ব্যাক করবে ভাবছে, এমন সময় আবার বাজল ফোন। ঝিল্লি একটা চেয়ার টেনে ব্যালকনিতে নিয়ে যায়, জমিয়ে বসে ফোন ধরে।
– হ্যাঁ বল, বহু যুগের ওপার থেকে উদয় হলি যে…
উত্তরে একটা মেয়েলি গলা শোনে।
– আপনি কি ঝিল্লি?
– হ্যাঁ, কিন্তু এটা তো মিথিলেশের ফোন।
– হ্যাঁ, এতে আপনার নাম সেভ করা ছিল। দেখলাম সবচেয়ে বেশি ফোন করা হয়েছে আপনাকে।
বৃষ্টিতে চরাচর ভেসে যাচ্ছে, ঝিল্লিকেও বুঝি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সে খসখসে গলায় বলে,
– আপনি কে? মিথহিলেশের ফোন থেকে কেন ফোন করছেন? মিথিলেশ কোথায়?
– আমাকে চিনবেন না। আমি সীমা। মিথিলেশ আমার স্বামী ছিল।
ছিল মানে? এখন নেই? ডিভোর্স হয়ে গেছে? ছেলের কথা মাঝে মাঝে বললেও বউয়ের কথা প্রায় কিছুই বলেই মিথিলেশ। সদ্য পাওয়া চাকরি, নতুন খোলা বাস রুট, যাতায়াতের সুবিধে, অসুবিধে, আর ঝিল্লির সেখানে যাওয়া নিয়ে আকাশকুসুম স্বপ্ন বোনা– এই নিয়েই তো ওদের কথা চলত। কিন্তু সারা জীবনের হিসেবে সে আর কতদিন? মিথিলেশ আর কাউকে ফোন করেনি!
– আমি বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বলবেন? মিথিলেশের সঙ্গে কি আপনার সেপারেশন হয়ে গেছে?
সে কথার উত্তর না দিয়ে হাড় হিম করা একটা প্রশ্ন করে সীমা নামের মেয়েটি।
– আমি জানি না, আপনি ওর কীরকম বান্ধবী, কতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল আপনাদের? তবু আপনি ছাড়া আর কাকেই বা বলব এ কথা? প্লিজ বলুন না, ওকে দেখে আপনার কখনও মনে হয়েছে ও কাউকে রেপ করতে পারে? বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ঝিল্লি। চিৎকার করে বলে,
– কী বলছেন কী? মিথিলেশ রেপ করবে? কী বলছেন আবোল তাবোল?
তার উত্তরে সীমা অবিশ্রান্ত বর্ষণের মতোই কেঁদে চলে। সেই কান্নার ফাঁকে ফাঁকে শব্দগুলো বোঝার চেষ্টা করে ঝিল্লি।
– তাহলে ওরা কেন মারল ওকে, পিটিয়ে মেরে ফেলল আস্ত মানুষটাকে? ও নাকি ছাত্রের মাকে রেপ করতে গিয়েছিল। আপনি বলুন মিথিলেশ এ কাজ করতে পারে? যে লোক ছাত্র ময়ূর দেখেনি বলে নিজের ছেলেকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যায়নি…
ঝিল্লি ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে। তার শুনতে ইচ্ছে করে না অচেনা একটা মেয়ের কাছ থেকে মিথিলেশের হত্যার খবর। তবু প্রেতিনীর হাতের মতো দুর্নিবার এক কৌতূহল কাজ করে তার। সীমার কান্নার নীচ থেকে উঠে আসে ভয়ঙ্কর এক কঙ্কাল, তার সামনে দাঁড়াতে হয় তাকে, দাঁড়াতেই হয়।
অবন্তীনগরের বাস আবার বন্ধ হয়ে গেছিল। খুব অসুবিধে হচ্ছিল যাতায়াতের। ট্রেকারে, অটোয় ভেঙে ভেঙে যেতে অনেক বেশি খরচও হচ্ছিল। হেডমাস্টারমশাই শুনে বলেন, স্কুলের যে ছাত্রাবাস অর্ধেক উঠে থেমে গিয়েছে, সেখানে থাকার কথা। সীমা দেখেনি সে বাড়ি, বস্তুত সে কোনওদিন স্বামীর কর্মস্থলে যায়নি। কজনই বা যায়? কিন্তু সে শুনে আপত্তি করেছিল। নদীর ধারে ওরকম একটা আধা-ওঠা শুনশান হস্টেল, কেউ থাকে না, সেখানে কীভাবে থাকবে একটা মানুষ? তাছাড়া খাওয়া-দাওয়া করবে কোথায়? ছেলেটাও সারা সপ্তা বাবাকে পাবে না। মিথিলেশ ওকে বুঝিয়েছিল, এটা একটা সাময়িক ব্যবস্থা। অবন্তীনগরের বাস চালু হলেই সে বাড়ি থেকে আগে যেমন যাতায়াত করত, তেমনি করবে। তাছাড়া খাওয়াদাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই। দুপুরে বাজারের একটা ঝুপড়ি হোটেলে খায়, রাতে এক ছাত্রের বাড়ি থেকে রুটি তরকারি আসে। ছাত্রটিই দিয়ে যায়।
সেদিন ছাত্রটির জ্বর হয়েছিল, আসতে পারেনি। তার মা এসেছিল খাবার নিয়ে। তাকে নাকি মিথিলেশ… কান্নার তোড়ে সীমার কথা ভেসে যায়। ঝিল্লি তাকে কোনও সান্ত্বনা দ্যায় না। পাথরের মতো স্থির হয়ে অপেক্ষা করে, কখন সীমা খানিকটা সামলে নিয়ে আবার কথায় ফিরে যাবে। সেই মহিলাটি চিৎকার করে ওঠে, মিথিলেশ নাকি ওর গায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। স্কুল কম্পাউন্ডের মধ্যে খাতাপেনের দোকান চালায় একটা বেকার ছেলে। রাতের বেলা সেটাই হয়ে যায় চুল্লুর ঠেক। এরা নাকি সেক্রেটারির পোষ্য। নদীপথে বাংলাদেশের সঙ্গে চোরাপথে অনেক কারবার চলে তাঁর, সেসব রাখতে এদের পুষতে হয়।
বেশ কয়েক মাস চারদিকে শান্তি। এরা রক্তের স্বাদ পায়নি অনেকদিন। মহিলার চিৎকার শুনে এরা ছুটে এসে কিছু না শুনতে চেয়েই মিথিলেশকে বেধড়ক পিটতে শুরু করে। তারপর একসময় আশ মিটে গেলে ফেলে চলে যায়। ওইভাবেই পড়ে থাকে মিথিলেশ, রক্তের নদীর মধ্যে। পরের দিন, ঝাঁট দিতে এসে দেখতে পায় জলিলের মা। সে সবাইকে খবর দ্যায়, সীমাকে ফোন করা হয়। মিথিলেশকে নিয়ে আসা হয় বারুইপুর হসপিটালে। তখনো প্রাণটা ধুকপুক করছিল। ঘণ্টাখানেক বেঁচেছিল তারপর। সীমা থামে একটু দম নিতে। ঝিল্লি জিজ্ঞেস করে,
– তোমাকে কিছু বলতে পেরেছিল?
– বলার চেষ্টা করেছিল কী একটা। আমি তো শুধু মোবাইলে ময়ূরের ছবি…। আমি বুঝতে পারিনি ঠিক। আরও অনেক কিছু বলার চেষ্টা করছিল। সন্তু কোনওদিন ময়ূর দেখেনি। এইসব প্রলাপ। আমার তখন মাথার ঠিক ছিল না। কী শুনতে কী শুনেছি। আরও কটা দিন যদি বাঁচত! চাকরির একটা বছরও পার হল না…
মিথিলেশের শেষ কথা না সীমার এই কথাগুলো– কোনটা বেশি দুর্বোধ্য কে জানে! ঝিল্লি বুঝতে পারে না কিছু। তার কান বৃষ্টির আওয়াজে বধির। অসময়ের এই বৃষ্টি, আকাশ থেকে যেন রক্তের ধারা নেমে আসছে। সমস্ত পৃথিবী স্নান করছে রক্তে। রক্তের গন্ধে তার গা গুলিয়ে ওঠে। সে শুধু কোনওরকমে বলতে পারে
– অবন্তীনগরের বাস চলে না আর? তাহলে আমি কীভাবে যাব বলতে পারো? কীভাবে পৌঁছব আমি অবন্তীনগরে ঝিল্লি নদী পেরিয়ে?
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।