আগের পর্ব পড়তে: [১]
যত দিন যায়, তত নিখিলেশের কাছে বড় হয়ে ওঠে একটাই সমস্যা– ঝিল্লি কীভাবে আটটা চব্বিশের বাসটা ধরবে? তবে এ বিষয়ে তার কোনও সন্দেহই নেই যে ঝিল্লিকে অবন্তীনগরে যেতে হলে তার সঙ্গেই যেতে হবে। রবিবার বা অন্য ছুটির দিন গেলে তো চলবে না। মিথিলেশের বৌ অবাক হয়ে যাবে ছুটির দিনে মিথিলেশ স্কুলে ছুটছে দেখে। রোজই তো সে বিষণ্ণ মুখে বাড়ি থেকে বাড়ি থেকে বেরয়, আর ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। সে তো খালি ছুটির লিস্ট খোঁজে বসে বসে। সেই লোক ছুটির দিন ইস্কুল ছুটলে যে কেউ অবাক হবে। গ্রামের লোকেরা, এমনকী বাসের ড্রাইভার, খেয়ার মাঝি, সবাই ভাববে ছুটির দিন মিথিলেশ মাস্টার কী করতে একটা ঝিনচ্যাক মেয়েছেলে নিয়ে এসে হাজির হয়েছে!
কিন্তু স্কুলের দিন গেলে অনেক অসুবিধে। অতখানি সময় ঝিল্লি কী করে কাটাবে, কোথায় বসবে, বাথরুম টাথরুম পেলেই বা কী হবে? মিথিলেশের তো লাস্ট পিরিয়ড পর্যন্ত ক্লাস। অবন্তীনগরে স্কুলবাড়ি ছাড়া একটিমাত্র পাকা বাড়ি আছে। সে বাড়ি কাঁড়ারদের। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কাঁড়ারবাড়ির ছেলে এবার ভোটে দাঁড়িয়েছে, ফলে সে বাড়ি একেবারেই হট্টমেলা। সারাদিনই বাইক আর গাড়ির লাইন বাড়ির সামনে। হুমদো হুমদো চেহারার লোকজন অনবরত ঢুকছে আর বেরচ্ছে। ওর মধ্যে ঝিল্লি থাকবে ভাবতেও আতঙ্ক হয়– যেন একদল বুনো কুকুরের মধ্যে একটা হরিণ ছানা।
এক দুপুরে টিফিনের ঘণ্টা পড়লে মিথিলেশ সমস্যাটা নিয়ে ঝিল্লির সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করল। ওর ধারণা ছিল এ ব্যাপারে ও চিন্তাভাবনায় যতটা অগ্রসর হয়েছে, ঝিল্লিও বুঝি ততটাই। তাই মিথিলেশ শুরুই করল এই বলে
– আমি ভাবছি তুই থাকবি কোথায়?
শুনেই ঝিল্লির বুক ধড়াস করে ওঠে। ব্যাপারটা সে যতদূর সম্ভব গোপন রেখেছে। তাহলে মিথিলেশ জানল কী করে? রেগে উঠতে গিয়েও তার মন পরক্ষণেই কোমল হয়ে এল। মিথিলেশের সরল মুখ, এলোমেলো চুল, মালিন্যহীন হাসি- চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এমন হাসি জগতের কোনও পুরুষকে হাসতে দেখেনি ঝিল্লি। সে সিদ্ধান্ত নেয়, মিথিলেশকে ও কনফিডেন্সে নেবে। এই কঠিন সময়ে, যখন নিজের মা-ও ওর পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা করছে, তখন ওর তো একটা অবলম্বন দরকার। একজন বন্ধু। আর ঝিল্লি নিশ্চিত, মিথিলেশ এখনো ওকে ভালবাসে।
– আমিও তো তাই ভাবছি, কোথায় থাকব…
– তুইও ভাবছিস, না? আমি জানতাম! আমি জানতাম!

ঝিল্লি ভেবেই পায় না মিথিলেশের এত উল্লসিত হবার কারণ কী। ওর ঘর ভাঙছে বলে এত আনন্দ! যতই ভালোবাসুক, ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। ওরও, মিথিলেশেরও। ঝিল্লি এবার বেশ নিস্পৃহ গলায় বলে
– ভাবব না? এটা আমার সারাজীবনের ব্যাপার। জিদানকে এত দামি স্কুলে ভর্তি করিয়েছি, ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে তো থাকতে পারি না..
এই প্রথম মিথিলেশের আত্মবিশ্বাস টাল খায়। সারাজীবনের ব্যাপার মানে কী? ঝিল্লি কি অবন্তীনগরে সারাজীবন থাকার কথা ভাবছে নাকি? তাছাড়া ওর ছেলের স্কুলের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক মাথায় ঢোকে না মিথিলেশের। অবশ্য এরকম হতে পারে যে ঝিল্লির বর একজন নেচার লাভার। তার হয়তো মাথায় ঢুকেছে কলকাতা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে আসবে ফ্রেশ এয়ার আর নেচারের মধ্যে থাকবে বলে। সে উত্তেজিত ভাবে বলে:
– না না, এদিকে তোরা থাকতে পারবি না। সে তোর বর একটা ফার্ম হাউস বানাল, মাঝে মধ্যে উইকএন্ডে এলি, সে আলাদা কথা। তাছাড়া সত্যি কথা, ছেলের স্কুলের কথাটাও ভাবতে হবে। ওটাই টপ প্রায়োরিটি। এখানে এসে থাকলে তোর ছেলেকে তো আমার স্কুলেই ভর্তি করাতে হবে রে। অবন্তীনগর শৈলেন্দ্র বাসনাবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে, এমন ভাব করে গলা ফাটিয়ে হাসে মিথিলেশ। তারপর সে ঝিল্লিকে নিরুত্তর দেখে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বলতে থাকে
– হ্যালো হ্যালো হ্যালো, ঝিল্লি, এই ঝিল্লি, কেটে গেল নাকি?
তার কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কাছেই ফিরে আসে। ঝিল্লি ফোন ছেড়ে দিয়েছে।
***
সেদিনের পর থেকে মিথিলেশ আর ঝিল্লিকে ফোনে পাচ্ছে না। ফোন ধরছেই না ঝিল্লি। কী হল কে জানে। ও নিজেই তো যেচে আসতে চেয়েছিল। এখন ফোন তো করেই না, মিথিলেশ ফোন করলেও ধরে না। আরও একটা বড় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার ছিল। সেটা হচ্ছে, রত্নেশ্বরপুর থেকে আটটা চব্বিশের বাসটা ও ধরবে কী করে? শক্ত, খুবই শক্ত কাজ। প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। মিথিলেশ হিসেব করে দেখেছে তার জন্যে প্রায় ভোর চারটেয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে বারুইপুর নামতে হবে। সেটা কি ও পারবে? অবশ্য ইচ্ছের জোর থাকলে কঠিন কিছু নয়। কিন্তু, হ্যাঁ এর মধ্যে একটা বড় কিন্তু আছে। ঝিল্লি এতটা কষ্ট কেন করবে? যে কোনও মানুষই এই অভিযানের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। অবন্তীনগর কাশ্মীর কিংবা আরাকু ভ্যালি নয়, যে যার জন্যে ঝিল্লি এতটা কষ্ট স্বীকার করবে।
ঝিল্লির বুক ধড়াস করে ওঠে। ব্যাপারটা সে যতদূর সম্ভব গোপন রেখেছে। তাহলে মিথিলেশ জানল কী করে? রেগে উঠতে গিয়েও তার মন পরক্ষণেই কোমল হয়ে এল। মিথিলেশের সরল মুখ, এলোমেলো চুল, মালিন্যহীন হাসি- চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এমন হাসি জগতের কোনও পুরুষকে হাসতে দেখেনি ঝিল্লি। সে সিদ্ধান্ত নেয়, মিথিলেশকে ও কনফিডেন্সে নেবে। এই কঠিন সময়ে, যখন নিজের মা-ও ওর পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা করছে, তখন ওর তো একটা অবলম্বন দরকার। একজন বন্ধু। আর ঝিল্লি নিশ্চিত, মিথিলেশ এখনো ওকে ভালবাসে।
এই জায়গাটায় এসে মিথিলেশ একটু দমে যায়। সত্যি বলতে কি, চাকরি পাবার পর থেকেই সে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। সেই কলেজ ছাড়ার পর থেকে প্রায় পনেরো বছরের অনিশ্চিত উপার্জনের জীবনে সে তো কত কিছু করেছে। টিউশনি, বন্ধুদের সঙ্গে সার্জিকাল গুডসের ব্যবসা,জমি বাড়ির দালালি,এমনকী ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট পর্যন্ত। যদিও শেষ পেশাটি একটিমাত্র ইভেন্টকে ঘিরে এবং সেটি তাদের রত্নেশ্বরপুর হাইস্কুলের প্লাটিনাম জুবিলি। এর জন্যে তিনদিন ব্যাপী যে উৎসব হয়েছে সেখানে সে কলকাতা থেকে আর্টিস্ট সরবরাহ করে দালালি বাবদ কিছু কামিয়েছে। আর সেটা হেডমাস্টার নিরুপম মাইতির জ্ঞাতসারেই। এখনও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলে মিথিলেশ কেমন চুপসে যায়। যাই হোক, এইসব বহুবিধ ধান্দার খাতিরে গত পনেরো বছর ধরে সে কলকাতা এবং তার সন্নিহিত এলাকার কত মফসসল শহরেই না গেছে। তবু, সে কোনওদিন ঝিল্লির বাড়ি যাবার কথা ভাবেনি, ফোন করেনি।
তবে তার মানে এই নয় যে ঝিল্লির সঙ্গে তার দেখা হয়নি। কলকাতা যেতে আসতে মাঝে মাঝেই স্টেশনে তার সঙ্গে ঝিল্লির দেখা হয়ে গেছে। লালচে চুল, জিনস কুর্তি আর ব্র্যান্ডেড রোদচশমায় প্রথমে চিনতে না পারলেও ঝিল্লির কলস্বর তাকে আবার নিশ্চয়তা দিয়েছে। হ্যাঁ, এই তো সেই মেয়েটা, স্কুলে যাবার পথে সাইকেল থেকে যাকে অনেক চোরা চাউনি দিয়েছে সে। ইউনিভার্সিটিতে ওর বাংলা আর ঝিল্লির ফিলজফি খানিকটা কাছাকাছি এনে দিয়েছিল তাদের। খানিকটাই। কারণ ফিলজফির মেয়েদের হৃদয় কেবলমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেদের জন্য সংরক্ষিত। সেখানে বাংলা পড়া মুখচোরা মিথিলেশের কোনও চান্সই ছিল না। তবু দেশের ছেলে হিসেবে ঝিল্লির মিথিলেশের ওপর খানিকটা ভরসা ছিল। ট্রেন বন্ধ থাকলে বাসে বা অটোতে কীভাবে বাড়ি ফেরা যায়, সে ব্যাপারে ঝিল্লির সহায় ছিল মিথিলেশ।
মনে আছে, সেদিন ট্রেন বন্ধ। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। কোনওরকমে ২১৮ নম্বর বাসে উঠেছে তারা। প্রচণ্ড ভিড়। লেডিসের সামনে দাঁড়িয়েছিল ওরা। তার জন্যে মিথিলেশকে নানান কটূক্তি শুনতে হচ্ছিল। তবু ঝিল্লি তার হাত ছাড়তে চায়নি। কামালগাজিতে দৈবাৎ একটা বসার জায়গা পেয়ে যাওয়ার পরেও ঝিল্লি তার হাত ছুঁয়ে ছিল। হরিনাভির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় সে সোৎসাহে ঝিল্লিকে জানলা দিয়ে দেখাতে গেল ‘এইখানে আমার দাদুরা থাকত একসময়’। ঝিল্লি জানলা দিয়ে তাকিয়ে বৃষ্টিস্নাত দোকানপাট ছাড়া কিচ্ছু দেখতে পায়নি, তবু সে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টে, আর মিথিলেশ শরীরে বিদ্যুৎস্পর্শ নিয়ে স্থানুর মতো। তার আঙুল অনিচ্ছাকৃত ভুলে ঝিল্লির স্তন ছুঁয়ে ফেলেছিল যে।
বহুদিন সে স্পর্শ হারিয়ে ফেলেছিল তার হাত। কিন্তু স্মৃতি? আজ ঝিল্লি ফোন কেটে দেওয়ার পর স্মৃতির সেই সঞ্চয় তার শরীর ফিরে পেল সহসা। মিথিলেশ, নদীরে দাঁড়ানো মিথিলেশ, নিজের আঙুল চুম্বন করল। নদীতীরে কি কেউ ছিল না? ছিল। নদী কত পরিষেবা দেয় মানুষকে। স্নান, গরু চরানো, নৌকা সারাই ইত্যাদি কাজে ব্যপৃত মানুষজন দেখল অবন্তীনগর শৈলেন্দ্র বাসনাবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নতুন মাস্টার মিথিলেশ প্রসাদ ঝা নিজের আঙুলে চুমু দিচ্ছে। তারা এর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারল না। এই দৃশ্যের সৌন্দর্য ও বেদনা তাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। তারা শুধু ভাবতে পারল মাস্টারটি ছিটেল, হয়তো বা বদ্ধ পাগল, তারা নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত হয়ে উঠল স্বাভাবিকভাবেই। তাদের চিন্তাভাবনা বিষয়ে সম্পূর্ণ অসচেতন মিথিলেশ তখন ভাবছিল, সত্যিই তো আমি ঝিল্লির কেই বা। কেনই বা ঝিল্লি খামোখা অবন্তীনগরে আসবে? (ক্রমশ)
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৫ জুলাই ২০২২
*ভিতরের ছবি: Coastside-Artists
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।