পাঁচুঠাকুরের মেলাস্থান এখন জনহীন, শুধু বাতাসে ধুলো ওড়ে। একলা পুকুর বুকে নিয়ে রিক্ত অঘ্রাণের মাঠ চোখ মেলে থাকে সারাদিন, তার একপ্রান্তের মন্দিরকে ধু ধু শূন্যতার বুকে আরও কাঙাল লাগে। মাঝে মাঝে শুকনো পাতার দল ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায়, একলা পাখি বিষণ্ণ মনে টিরটির করে ডেকে চলে। প্রান্তরের জঙ্গলের সারিকে পাঁচিলের মতো লাগে, যাকে পেরিয়ে কোনওদিনই আর সমুদ্রের সন্ধান মিলবে না। শুধু নোনা বাতাস যখন দক্ষিণ দিক থেকে বয়ে আসে, শিরশিরে স্বরে জানিয়ে দেয়, এখানে একদা মেদনমল্লের গম্বুজে ফাঁসি হত, একদা ছিল পাঁচুঠাকুরের মুখ খোদাই করা পাঁচিল, যখন রাত্রের অন্ধকারে হাওয়ার মধ্যে হাওয়া হয়ে মিশে জ্বরাসুর টহল দিয়ে বেড়াত চরাচর, আর সুসময় এলে মাংসাশী চিলের চোখের মণির ভেতর ঢুকে গুটিসুটি ঘুমিয়ে থাকত, পরবর্তী মহামারীর অপেক্ষায়। 

দিদা, বিশ্বমামা, রীণামামিমা আর টুনু হাঁটছে সেই মাঠ দিয়ে। রীণামামীমা আলুথালু, দেখে বোঝাই যায় না যে একদা তার হাসিতে সন্ধ্যা ঝলসে উঠত। গাল বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা শুকিয়ে দাগ, ময়লা কপালের ওপর নেমে আসা এলোমেলো শণের মতো চুল এখন ধূসর,  উদ্ভ্রান্ত চোখের দৃষ্টি, যেন বুঝছেও না কী ঘটছে তার চারপাশে। বিশ্বমামা টুনুকে আনতে চায়নি, কিন্তু টুনু জেদ ধরল, আর দিদা বলল, ‘আসুক গে। অত বড় বাড়িতে ওকে বুড়ো মানুষটার ভরসায় ছেড়ে আসতেও বুক কাঁপে’। এখন টুনুর মনে হচ্ছে, আর হাঁটতে পারবে না। মৃদু জ্বর আঠার মতো লেপটে আছে সর্বাঙ্গে, সেই সঙ্গে পায়ের ব্যথা। তার ওপর সারারাত পিঁপড়ের জ্বালায় অস্থির, চুলকে লাল করে ফেলেছে। যাতে কেউ দেখতে না পায় ঘা, তাই ফুলপ্যান্ট পরে এসেছে। তবুও বারেবারেই পিছিয়ে পড়ছে, হাঁ মুখে বড় নিঃশ্বাস টেনে এগিয়ে চলেছে হাঁফাতে হাঁফাতে। 

মন্দিরের সামনে এখন ফাঁকা। একজন লোক জায়গাটা ঝাঁট দিচ্ছে, একটু দূরে বসে ঝিমোচ্ছে সেদিনকার দেখা সেই মধু ডাকাত, যার লেজ আছে। ঝাঁট দেওয়া লোকটা উঠে দাঁড়াল। আধবুড়ো, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পাকানো চেহারা, গলায় একটা কণ্ঠির মালা। ‘মানত দেবেন?’ 

‘হ্যাঁ গো বাবা, এই যে, এই বউ।’ বলল দিদা। 

লোকটা ভুরু কুঁচকে তাকাল, ‘বাগালির বউ না?’ তারপর চুকচুক করে নিজের মনেই মাথা নাড়ল, ‘আর কী করবেন মা! সবই অদেষ্ট! দেখুন গে, যদি ঠাকুর কিছু পথ দেখাতে পারেন।’ 

বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রীণামামিমা, দিদা প্রাণপণ চেষ্টায় স্বাভাবিক করছিল নিজেকে। এবার এগিয়ে এসে বিশ্বমামাকে ধরল, ‘ছি ছি, কাকে কী বলছিস। বাড়ি চল বাবা!’

মন্দিরের ভেতর সবকিছুই কী নিরীহ ! পাঁচুঠাকুর আর জ্বরাসুরকে পুতুল বাদে কিছুই মনে হল না টুনুর। পাঁচি-ঠাকরাণি যেন মিষ্টি এক বুড়ি, যার কোলের ভেতর লুকনো আছে রাজ্যের ছমছমে ঘুমপাড়ানি গল্প। টুনু এগিয়ে গিয়ে ছুঁতে গেল, এবং অবধারিত ধমক খেল দিদার, ‘হাত দিস নি! ঠাকুরকে ছুঁতে আছে?’ 

তবু আজ একটু কথা বলছে, কাল পর্যন্ত তো পাথরের মতো মুখে বসে ছিল দিদা! তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। যদিও গম্ভীর মুখ, ভারাক্রান্ত ভুরু, আষাঢ়ের মেঘের মতো টেপা ঠোঁট, তবু এই দিদাকে সে চেনে। বুকের ভেতর থেকে গভীর শ্বাস বেরিয়ে এল দিদার, ‘নাও গো, চান করে এসে দণ্ডি কাটো এবার। আমি ততক্ষণে পুজোর থালা গুছুই গে।’ 

ঝাঁট দিচ্ছিল যে, সে-ই আসলে পুরুতঠাকুর। কোথা থেকে একটা নামাবলী জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। এক এক করে পুজোর উপচার, দণ্ডি, ছলনে ফুলচন্দন দেওয়া, লাড্ডু, বাতাসা, পাটালি দিয়ে প্রসাদ সাজানো, টুনুও সাহায্য করছিল টুকটাক। সে অবাক হয়ে দেখল, এই পুজোর কোনও মন্ত্র নেই। পুরুতমশায় প্রসাদের থালা রীণামামিমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নাও গো বউমা, এবার থালাটা একহাতে এগিয়ে ধরে চোখ বুজে মনে মনে বলো–ঠাকুর, হারানো মাণিক ফিরিয়ে দাও। আহা, কতটুকুই বা বয়েস তোমার! এই বয়েসেই এমন কাঁদলে কী করে চলে বলো দিকিনি !’

বিভ্রান্তের মত হাত বাড়িয়ে ধরল রীণামামিমা, দু’চোখে শূন্য দৃষ্টি। পুরুতমশায় বিশ্বমামার কানে কানে বলল, ‘মধু ডাকাতের কাছে একবার হাতটা দেখিয়ে আসো। বড় নামকরা গুণিন।’ 

মন্দির থেকে বেরিয়ে তারা মধু ডাকাতের কাছে গেল। মধু ঝিমুনি ভেঙে লাল চোখে টুনুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল একবার, তখন তার সামনের পেতে রাখা আসনে গাছের ছায়া পড়ল। লেজটাকে বোঝা যাচ্ছে না, এমনভাবে ঠেস দিয়ে বসেছে গাছের বাঁধানো গায়ে। ‘বাগালির বাচ্চা? কী হয়েছিল, বলো তো বাবারা !’ 

বিশ্ব বলল সব। মধু চোখ বুজে শোনবার পর বিশ্বর হাত ধরল, কিন্তু জ্যোতিষীদের মতো করে নয়। মুঠোর মধ্যে হাত নিয়ে যেন বা কিছু বুঝতে চায়, কিছুটা যেমনভাবে নাড়ি দেখে  ডাক্তার। একটু পর মাথা নেড়ে শ্বাস ফেলল, ‘কাল আসলেও কিছু করা যেত। এখন বড় দেরি হয়ে গেছে।’ 

‘মানে?’ ফ্যাসফ্যাস স্বরে জিজ্ঞাসা করল বিশ্ব। 

‘বাড়ি যাও বাবা। সাবধানে থাকো। আর কিছু জানতে চেও না।’ 

‘তুমি খুঁজে দেবে না?’ 

‘আমার হাতে নেই।’  মাথা নাড়ল মধু, তখন তার চোখে পড়ল দিদাকে। বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকে উঠল মধুর। ‘মা, আপনার ছেলেই সেই সেবার–‘ 

টুনু দেখল, দিদার লাল হয়ে উঠেছে মুখ। চাপাস্বরে বলল, ‘তোমার কাছেই এসেছিলাম তখন।’ 

মধু স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। এরপর বড় নিশ্বাস ফেলে চোখ তুলল, ‘আপনার ছেলে এখনও সেখানেই আছে।’ 

দিদার সারা শরীর কাঁপছে, মুখের চেহারা পালটে বিকৃত হয়ে উঠেছে, দুই চোখে লেজ আছড়াচ্ছে ক্ষুধিত অজগর, ‘ওখানেই? ডাকলে সাড়া দেবে? ঠিক বলছ?’ 

‘সেভাবে ডাকতে হবে’। মধু ধীরে ধীরে টুনুর ওপর দৃষ্টি নামিয়ে এনে নিবদ্ধ করল, মুখে হালকা ক্রূর হাসির আভাস। 

টুনু পিছিয়ে গেল দুই পা। এরপর কী হত কেউ জানে না, কিন্তু বিশ্বমামা তীব্রস্বরে বলল, ‘আর আমি? আমার ছেলের কী হবে?’ 

মধুও সামলে নিল নিজেকে, আবার ফিরে আসল সৌম্যভাব। নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাড়ি যাও বাবা। বউটাকে সাবধানে রেখো’। 

চাপা গর্জন করে উঠল বিশ্বমামা, ‘বাগালির বাচ্চার জীবনের দাম নেই, না?’ 

টুনু হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে ছিল, আঁকিবুঁকি কাটছিল মাটির গায়ে। নাকে বারবার এসে ধাক্কা মারছে সেই পচা গন্ধটা, ছোটমামার ঘর পেরিয়ে এসে বাড়ি বাগান ও মাঠের দখল নিতে চাইছে। 

বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রীণামামিমা, দিদা প্রাণপণ চেষ্টায় স্বাভাবিক করছিল নিজেকে। এবার এগিয়ে এসে বিশ্বমামাকে ধরল, ‘ছি ছি, কাকে কী বলছিস। বাড়ি চল বাবা!’ ফিরে যেতে যেতে ঘুরে তাকাল, মধুর সঙ্গে চোখে চোখে কী ইঙ্গিত বিনিময় হল টুনু দেখতে পেল না, শুধু বুঝল, দিদার সারা শরীর বেয়ে এক বিদ্যুৎতরঙ্গ পাক খেয়ে উঠছে। 

ঘন রাত যখন গাঁজানো তালরসের মত থিতিয়ে বসেছে মাঠ বাগান আর বাড়ির ছাদে, আর হিম কুয়াশার পাতলা সর আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে, টুনুরা সবাই মিলে তখন বসে ছিল বিশ্বমামার দাওয়াতে। রীণামামিমার মাথা হেলান দিয়ে রাখা বাঁশের গায়ে, দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে বিশ্বমামা, দিদা চুপচাপ নিজের ভাবনায় মগ্ন, দাদু উশখুশ করছে থেকে থেকেই। আছে পাশের বাড়ির হালদার দিদা, বারু ঘোষ বলে কে একটা বুড়ো, আরও একজন যাকে টুনু চেনে না। সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল, আর জঙ্গল ঝোপঝাড় ছাতামাথা ভাঙা পাঁচিল বেলগাছ আমডাল সবকিছুই স্তব্ধ, পাতাটাও নড়ছে না। টুনু হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে ছিল, আঁকিবুঁকি কাটছিল মাটির গায়ে। নাকে বারবার এসে ধাক্কা মারছে সেই পচা গন্ধটা, ছোটমামার ঘর পেরিয়ে এসে বাড়ি বাগান ও মাঠের দখল নিতে চাইছে। 

বিশ্বমামা মাথা তুলল, সারা মুখ ভেঙ্গেচুরে শীতের ফাটা মাটি। বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘সব শেষ’। 

‘চুপ, এমন বলতে নেই। যতক্ষণ শ্বাস–‘ ফিসফিসিয়ে তার কাঁধে চাপ দিল বারু ঘোষ। টুনু বুঝছে না, তারা ফিসফিস করছে কেন। 

আবার অনেকক্ষণ সবাই চুপ। রাত জাঁকিয়ে বসল, গাঢ় জ্বাল দেওয়া কুয়াশা তাদের মাথার ওপর ঘুরপাক খেল, আর তখন একটা খুব অস্ফুটে কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। 

থরথর করে কেঁপে উঠল রীণামামিমা, ‘গুবলু!’ 

‘রাতপাখি গো!’ দাদুর হতাশ স্বর ভেসেই থাকত কিছুক্ষণ, যদি না কান্নাটা আরেকবার শোনা যেত, আরেকটু স্পষ্ট। যেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কেউ কাতরাচ্ছে। সকলে চমকে উঠল, ভূতগ্রস্তের মত এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

 ধপ করে একটা শব্দ হল বেলগাছের নীচে। 

সবাই ছুটে গেল, টর্চগুলো মনে হচ্ছে বিঁধে বিঁধে রক্তপাত করে ছাড়বে অন্ধকারের, যদিও অত আলো দরকার ছিল না। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে কাছে গেলে। 

একটা রক্তাক্ত কাঁথায় মোড়া গুবলুর নিষ্প্রাণ দেহ। বেলগাছের ডাল থেকে নীচে পড়েছে। 

আর্ত চিৎকারটা কানে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে টুনু দেখেছিল, গুবলুর একটা কান নেই, শুধু ডেলা ডেলা রক্তপিণ্ড।

ছবি সৌজন্য: সুজয় বাগ 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৩ মার্চ ২০২১ 

আগের পর্বের লিঙ্ক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮]

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *