আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২]
পরের পর্বের লিংক: [পর্ব ৪]

জীবনের প্রথম পর্বের বন্ধুরা দ্বিতীয় পর্বে থাকে না। দ্বিতীয় পর্বে থাকে অফিস কলিগরা। তারাই সব। তাদের বিয়ে, তাদের সন্তানের অন্নপ্রাশন, সেই সন্তানের বিবাহ পর্যন্ত চলে চাকরি। তারপর জীবনের সব কাজ শেষ করে অবসর নিয়ে ঘরে এসে বসা। কলিগরা ধীরে ধীরে মন থেকে মুছে যেতে থাকে। হারিয়ে যেতে থাকে। কৈশোর, প্রথম যৌবনের বন্ধুরা ফিরে আসে কিছু কিছু। আবার আসেও না। কলেজের বন্ধুরা কোথায় গেছে কে জানে? কেউ বিদেশে, কেউ অন্য রাজ্যে, কেউ উত্তর থেকে দক্ষিণে, কেউ বা বেঁচে নেই, কেউ সুইসাইড করেছিল, কেউ দুরারোগ্য অসুখে চলে গেছে, দুর্ঘটনায় চলে গেছে…। কিছু খবর আসে, কিছু আসে না। বন্ধুরা অজ্ঞাতে প্রয়াত হয়।

এই সেদিন শুনলাম, মানে ফোন করে বিজন তালুকদার শোনাল, পরিমল ভট্টাচার্য চলে গেছে। আচমকা হার্ট অ্যাটাক। পরিমল আমার ঘনিষ্ঠ ছিল। কয়েক জেলায় একসঙ্গে চাকরি করেছি। পরিমলের প্রেমের চিঠি আমিই বয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমরা মেদিনীপুর শহরে থাকি। ভুলেই গিয়েছিলাম পরিমলকে। এইরকম ভুলে যাওয়া, চিনতে না-পারার রোগ সিসিসি ওরফে চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্রর আছে কিনা জানি না। তবে জেনেই বা কী হবে, চঞ্চলচন্দ্রের সঙ্গে আমার কী? আমাদের কী? 

সে নীলমাধবের মণিমালিকা আবাসনে থাকে, তাকে নিয়ে নীলমাধবের মাথাব্যথা, আমাদের নয়।  নীলমাধব বলতে পারবে তার সম্পর্কে কিছু কিছু। হয়তো আছে, নীলমাধব বলে, তাকে চিনতেই পারে না লোকটা। অথচ তার বাড়িতে তো থাকতে এসেছে। রাস্তায় যদি মুখোমুখি হয়, একটা কথাও বলে না। অসামাজিক মানুষ। তার বাড়িতে ভাড়ায় থাকে, অথচ তাকেই চেনে না। এমন কখনও হয়? নীলমাধব গজগজ করে এই নিয়ে। কিন্তু বাড়ি কি এখন নীলমাধবের? 

আমি মনে মনে বলি, এখন তোমার বাড়ি নয়। তোমার বাবা নীলাম্বর পাল কিংবা মোল্লার বাড়িও নয়। কাকলি গানের বাড়ি বলতে পারি। তারপর তো ভেঙে দিয়ে মানে কাকলি গানের বাড়ি ভেঙে মণিমালিকা   আবাসন। হ্যাঁ, আমি মনে মনে বলি, ওটি কাকলি গানের বাড়ি। তার আগে হ্যারিয়েট মিউজিক স্কুল। ওই বাড়ি ভেঙে ফেলা মানে, সেই গানের সুর ভেঙে ভেঙে…, আমার এইরকম মনে হয়। কিন্তু এসব মনে মনেই বলা, মুখে কিছু বলি না।

তাহলে নীলমাধবের কথা বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের প্রাতর্ভ্রমণের আড্ডা ভেঙে যাবে। নীলমাধব এমন অনেক কিছু করে, যা আমাদের সাধ্য নয়। নীলমাধব সকালে ভ্রমণের শেষে একপ্রস্ত চায়ের খরচ দেয়। ও নিজেই দেয়। আমরা দিতে গেলে বারণ করে। উদার প্রকৃতির মানুষ নীলমাধব। আসলে টাকার উপর শয়ন করে যেন। শুনে একদিন জুড়ান রায় বলেছিল, যেমন ছিল ওর বাবা, পার হয়ে এসেই পাড়াটাকে লুটের টাকা দিয়ে বশ করে ফেলেছিল। ও-ও তোমাদের তাই করেছে।

নীলমাধব কিন্তু সতর্ক মানুষ। নীলমাধব বলে, জুড়ান রায়রা যশোরের লোক। চাষাভুষো ছিল ওর বাপ জেঠারা। পালোধীদের সঙ্গে মেশার যোগ্য ছিল না। কিন্তু নীলমাধব চায় তাদের সঙ্গে মিশুক। জুড়ান রায় তার সঙ্গে মেশে না কেন, যশোর জেলার পরেই তো ফরিদপুর। জুড়ান চাইলে তাদের আবাসনে সস্তায় একটা ফ্ল্যাট করে দিত নীলমাধব। হাজার হোক ওপারে কাছাকাছি বাড়ি ছিল তো। এর আবাসন তো পালোধীদেরই বাড়ি।

নীলমাধব বলে, আমাদেরই তো বাড়ি। আর আমার বাবার যা মন, ফ্রিতেই দিয়ে দিত। যশোর, ফরিদপুর, খুলনা সমিতিতে জুড়ানকে নিয়ে নিতাম। কিন্তু তার জন্য জুড়ানকে আসতে হবে আমার কাছে। বলতে হবে হাত জোড় করে। আসলে ওরা তো ছিল হেলে চাষা। এপারে এসে চায়ের দোকান করে বিপিন রায় সংসার চালায় দেখে নীলাম্বর তাকে কাজ দেবে বলেছিল কর্পোরেশনে। সরকারবাবু যাদের বলে সাফাই মজুর মহেন্দ্র, সেই কাজ। উপরিও ছিল। বিপিনের কী দেমাগ। বলল, চা ফুলুরির দোকানই ভাল। নীলাম্বর আর বলেনি। চাইলে কি নীলমাধবের বাবা পুলিশ দিয়ে সেই চা দোকান তুলে দিতে পারত না? 

 

আরও পড়ুন: সেবন্তী ঘোষের উপন্যাস: ছাড় বেদয়া পত্র

 

জুড়ান তা করেনি। তবে কিনা যশোরের লোক এমনিতেই ফরিদপুরের লোককে হিংসে করে, ফরিদপুর অনেক সমৃদ্ধ জায়গা, ফরিদপুরের লোকের হাতে টাকা বেশি, চাষবাস ভালো হয়, যশোরের লোক ফরিদপুরের বদনাম করেই থাকে, যশোরের কই মাছ বিখ্যাত, আর কী?

তুমি চিনতে ওদের? জিজ্ঞেস করেছে আমাদেরই একজন কার্তিক দত্ত।
না। চিনব কী করে? তবে চাষাই ছিল মনে হয়, আর যশোর কি কম বড়? ফরিদপুরও কম বড় নয়,  জুড়ান রায় লোকটা খ্যাপা আছে, না হলে আমাদের সঙ্গে মিশবে না কেন? মিশলে ওর ভালই হত।
কিন্তু তোমাদের অবস্থা ভাল, মধুতলার জমিদার ছিলে। জুড়ান সংকোচ বোধ করে হয়তো। আমি বলি। মাধব খুশি হয়। বলে:
– হয়তো ওরা আমাদের প্রজা ছিল। আমাদের জমি তো যশোরেও ছিল। জমিদারের জমি ছড়িয়েই থাকে। কিন্তু আমাদের এখন ওসব নেই। জমিদারি ছিল ছিল, সে আমার ঠাকুরদা নীলমোহন পাল, তার বাবা নীলগৌর পালের করা। জমিদারির জমি ছিল যেমন, বেনামে কম জমি রাখা ছিল না। যত মুনিষ কামলা, গোরু ছাগলের নামে জমি ছিল আট-দশ বিঘে করে। আসার সময় বাবা তাদের দিয়ে এসেছে, লিখিত করে দিয়ে এসেছে। 
কত জমি ছিল? একজন জিজ্ঞেস করেন।

নীলমাধব বলে, সঠিক বলতে পারবে না, তবে পাঁচ সাতশো বিঘে তো হবেই। তাদের বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের মন্দির ছিল, রাধাকৃষ্ণের নামে, মানে দেবতার নামে নিষ্কর দেবোত্তর সম্পত্তি ছিল চারশো বিঘে। কত উৎসব হত। দোলপূর্ণিমা, রাসপূর্ণিমা, জন্মাষ্টমী। হিন্দু মুসলমান সকলে পাত পেড়ে খেয়ে যেত। বাজনদার আসত গোয়ালন্দ থেকে। কৃষ্ণযাত্রা হত, সাতদিন অবিরাম কীর্তন হত। তারা আসত গোপালগঞ্জ থেকে। নীলমাধব আরও বলে, কলকাতার আর্টিস্ট যেত সেই মোচ্ছবে। আমরা কি কমলা ঝরিয়া কীর্তনিয়ার নাম শুনেছি? কমলা ঝরিয়া তাদের মধুতলার বাড়িতে গিয়ে গান গেয়ে এসেছেন, সে অবশ্য নীলমাধবের  জন্মের আগে। সে শুনেছে সেই  কথা। তাদের বাড়িতে ভিয়েন বসত। পান্তুয়া, বোঁদে, দই পাতা হত হাঁড়ি হাঁড়ি। সাতক্ষীরে থেকে কাঁচাগোল্লা সন্দেশ আসত। কিন্তু সে খরচ জমিদারের ছিল না, প্রজারাই সব ব্যবস্থা করত, তাদের খাজনা দেওয়ার সঙ্গে এসবও দিতে হত।  

আসলে ওরা তো ছিল হেলে চাষা। এপারে এসে চায়ের দোকান করে বিপিন রায় সংসার চালায় দেখে নীলাম্বর তাকে কাজ দেবে বলেছিল কর্পোরেশনে। সরকারবাবু যাদের বলে সাফাই মজুর মহেন্দ্র, সেই কাজ। উপরিও ছিল। বিপিনের কী দেমাগ। বলল, চা ফুলুরির দোকানই ভাল। 

দেবোত্তর, নিষ্কর জমি, এসব আমরা কিছুই বুঝি না। শুনেই যাই নীলমাধবের কথা। এতদিন এ পাড়ায় বাস করছি, নীলমাধবের সঙ্গে এত কথা আগে হয়নি। আমি নিজে মফসসলে ঘুরেছি, কাকলি গানের বাড়ির  শ্যামাশ্রীদের দেশের বাড়ির আশপাশে। সকলেই চাকরি আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সঞ্জয়বাবু চাকরি করতেন জমি বিভাগে, মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলেন, অত জমি রাখা তো বেআইনি, সরকার খাস করে নেয়নি? নীলমাধব বলল:
– সে ইন্ডিয়ায়, ওয়েস্ট বেঙ্গলে। পাকিস্তানে ওসব হয়নি। জমিদারি ছিল। যত খুশি রাখা যেত। ইন্ডিয়া আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যারা গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে, তারা কত জমি কিনত, হিন্দুদের বদলে তারাই জমিদার হয়ে বসেছিল।

আমরা চুপ করে থাকি। নীলমাধবের কথা সত্য না জুড়ান রায়ের কথা সত্য, তা খুঁজে বের করে কী হবে?  এসব এক একসময় গাল-গপ্পোই মনে হয়। পূর্ববঙ্গ থেকে যারাই এসেছে, তাদেরই জমিদারি ছিল। ছিল না শুধু জুড়ানচন্দ্র রায়দের আর আমাদের। আমরা দেশভাগের পরপরই চলে এসেছিলাম। আমাদের তেমন কিছুই ছিল না শুনেছি। এপারে এসে অনেক কষ্ট করে দাঁড়িয়েছি। জুড়ান রায় বলে, ও মূর্খ। তাই বলে যশোরে কিছু নেই। যশোরে আছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সাগরদাঁড়ি, যশোরের মণিহার সিনেমা হলের মতো বড় হল আর নেই এশিয়া মহাদেশে, যশোরের কই কেন, যশোর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কপোতাক্ষ, মাইকেল তাকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন…! আসলে ওরা হল চালিয়াতের বংশ, জাল দলিলে ওস্তাদ ছিল ওর বাবা, কত লোকের জমি হাতিয়েছে! ও ঘুষ ছাড়া কথাই বলত না কলকাতা কর্পোরেশনে, ও সুইপারদের টাকারও ভাগ নিত, খারাপ লোক।

 

আরও পড়ুন: তৃষ্ণা বসাকের গল্প: শেষ খেলা

 

জুড়ান জানল কী করে নীলমাধব ঘুষ নিত কি নিত না? জুড়ান যেন সমস্ত জীবন ধরে নীলমাধবের পিছনে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে। জুড়ান নিজে চাকরি করত বারাসত কালেকটরেটে। সেখানে চাকরি করে কলকাতা কর্পোরেশনের কোন এক বোরো অফিসের ক্যাশবাবুর খবর রাখত কী করে? সকালে বারাসত গিয়ে রাতে বাড়ি ফিরে জুড়ান কী করে নীলমাধবের খবর রেখে বেড়াত? জুড়ান বলে, মহেন্দরকে জিজ্ঞেস করো, কর্পোরেশনের ক্যাশবাবু মাধোবাবু কী করে? মহেন্দর হলো সুইপার। বিহারে বাড়ি। তার বাবাও কলকাতা পৌরসভার সুইপার ছিল। মহেন্দর এবং তার ভাই সুরিন্দর এখন করে। পাপ চাপা থাকে না। পাপ আবার কী? ঘুষ থাকলেই কাজ হয়। নইলে কাজ হতেও পারে, না-ও হতে পারে। 

কর্পোরেশনের সুইপার, ওভারসিয়রদের কাছে নীলমাধব সংক্ষিপ্ত হয়ে মাধোবাবু। মাধোবাবু সুইপারদের মাইনে দেওয়ার সময় পান খাওয়ার টাকা কেটে নেয়। পান মাধোবাবু খায় না, অন্তত খেতে দ্যাখেনি কেউ কোনওদিন। মাধোবাবু সিগারেট খেত, কিন্তু তা অন্যের থেকে উপহার পেলে। মহেন্দরকে কতবার বলেছে, যা এক প্যাকেট উইলস নিয়ে আয় দেখি। মহেন্দর ছুটেছে। এসব কথা জুড়ানচন্দ্র রায়  মহেন্দরের কাছেই শুনেছে।

জুড়ান গত পঞ্চাশ বছর ধরে নীলমাধব পালের দিকে নজর রেখে চলেছে।  তখন নীলমাধব ছিল পনেরো, এখন সে পঁয়ষট্টি। অবসর নিয়েছে। জীবন খুব সুন্দর কেটেছে। জুড়ান রায় নিন্দা করলেও, তার জীবন আনন্দে কেটেছে। ঘুষ, হুঁ, নিয়েছে। সে নিজেই বলে। কেন নেবে না? সুইপারদের ক’জন পাকা চাকরি করে? বাবা গিয়ে বসে আছে দেশে ক্ষেতি করতে, বাবার বদলে সে এসেছে কাজ করতে। বেআইনি। বেতন তো পাওয়ার কথাই নয়। দিয়েছে সে। বিনিময়ে পেয়েছে ভাগ। কত ফলস লোকের বিল হত, সে বেতন দিচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে, ভাগ নেবে না? বিনা কাজে উপার্জন তো করেনি! কিন্তু তা যে নজরে রেখেছে জুড়ান, তা কি নীলমাধব জানে? জুড়ান যে কোনওদিন তার অনেক গুপ্ত কথা ফাঁস করে দিতে পারে। দেবেই। জুড়ান তাইই বলে।

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *