ঝিল্লি দ্রুত হাতে চোখে কাজল লাগায়। এই কাজলটা নতুন বাজারে এসেছে। বেশ একটা নাটকীয়তা আছে এর মধ্যে। রহস্যময়তাও। প’রে এলে মনে হবে এই কাজলটানা চোখদুটোর পেছনে অনেক কথা লুকিয়ে আছে। পৃথিবীর সব মানুষের আড়ালেই আর একটা মানুষ লুকিয়ে থাকে বলে ঝিল্লির মনে হয়। খুব সাদামাটা চেহারার ড্যাবড্যাবে অভিব্যক্তিহীন চোখের তলায়ও অনেক কথা থাকতে পারে, থাকেও। কিন্তু রায়া, ওর ব্যক্তিত্বময়ী চেহারার আড়ালে যেন কিছুই লুকনো নেই! ওর জীবন যেন খুব গোছানো সংসারের মতো। চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় জিরের কৌটোটা কোথায়, লন্ড্রি থেকে কাচিয়ে আনা শালটা আলমারির কোথায় আছে কিংবা নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পমালার চতুর্থ খণ্ডটা কোন তাকের কোন জায়গায় রাখা আছে। সেখানে কিছুই হারিয়ে যায় না, সবকিছু ঠিক ঠিক জায়গায় হাতের কাছে রাখা। এরকম একটা মেয়ের সঙ্গে কাজ করা যায়, সিনেমা দেখা যায়, রেস্তরায় খাওয়া যায়, কিন্তু প্রেমে পড়া? ঝিল্লির কাছে এ বড় আশ্চর্য ঘটনা।
যাক গে, মরুক গে। এসব অরুণাভর ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঝিল্লির সেখানে নাক গলানোর দরকার নেই। ও তো চলেই যাচ্ছে এখান থেকে। ওর হাত আরও দ্রুত চলতে লাগল। এখন বারোটা বাজে। সওয়া একটায় সময় দেওয়া আছে। সাদার্ন অ্যাভিনিউ থেকে নিউ গড়িয়া এক ঘণ্টায় পৌঁছে যেতে পারবে না? মেট্রো ধরবে তো। আর দেরি হলেই বা কি? অরুণাভ একটু দাঁড়াবে, এই তো? ও ঝিল্লির যতখানি ক্ষতি করেছে, তার তুলনায় এইটুকু অপেক্ষা কিছুই নয়।
ভাবল বটে, কিন্তু সাজতে বেশি সময় নিল না ঝিল্লি। এ বাড়িতে স্নান, খাওয়া, সাজগোজ, সবই যেন হাওয়ার ওপর ভেসে ভেসে চলেছে, ভেতরে কিছুই ঢুকছে না। ঝিল্লি যেন একটা ভরহীন, ভারহীন পাখির পালক। এমনকী তার যন্ত্রণার কোনও ভর, ভার নেই। সে আর তার যন্ত্রণা– দু’জনে নিরালম্ব শূন্যে দু’জনের সমান্তরালে ফ্ল্যামেংকো নেচে যাচ্ছে, কেউ কাউকে ছুঁতে পারছে না। মাঝে মাঝে কান্না পায়, সেই কান্নাটাও মাটি ছোঁয়ার আগে উড়ে উড়ে কোথায় চলে যায়! ঝিল্লি যেন হঠাৎ একটা অতি-হাওয়ার দেশে চলে এসেছে। কাচ বসানো রাজস্থানী ঝোলা কাঁধে ঝুলিয়ে বাইরে এসে সে খেয়াল করল, আজও সে সেই মভ কুর্তি আর লং স্কার্টটা পরে এসেছে, যেটা পরে ওদের সঙ্গে খেতে গিয়েছিল, বলা ভালো, ওদের খাওয়া দেখতে গেছিল। আসলে ও এখন যেখানেই যাচ্ছে, এটাই পরে যাচ্ছে। কেউ ভাবতে পারে তার আর কোনও পোশাক নেই। যা ইচ্ছে ভাবুক। সমস্ত জামাকাপড় প্যাক করে ফেলেছে তো, তার, ছেলের। দু-চারটেই যা বাইরে আছে।

বেশ লাগছে, মনে হচ্ছে কোনও হোটেলে আছে। দিব্যি দায়দায়িত্বহীন ফুরফুরে জীবন। এক একদিন ইচ্ছে করে দরজা জানলা খোলা রেখে বেরিয়ে যেতে। এ বাড়ির কিছু চুরি হলে তার কিছু এসে যায় না। যে জানলার কাচগুলো সে নিয়মিত মুছেছে, দরজার কোণ, ফ্রিজের পেছন, খাটের তলা– কাজের লোক মুছে যাবার পরেও আবার নিজে মুছেছে, দামি কাচের বাসন কাজের লোককে মাজতে দেয়নি কোনওদিন, নিজে মেজে মুছে তুলে রেখেছে অতিথি চলে যাবার পর– সেই সংসারের কোনও ক্ষতি বা বিপদের আশংকা তার মনে রেখাপাত করে না। তবু, বাইরে বেরবার সময় সে জানলা বন্ধ করতে, দরজায় তালা লাগাতে ভোলে না। এ কি নিছকই বছরের পর বছর ধরে একভাবে বাঁচার অভ্যেস? না কি অন্য কোনও অজানা অনুভব? অরুণাভ বলেছিল, ঝিল্লি আর ছেলে এই ফ্ল্যাটেই থাকুক। অভ্যস্ত পরিবেশ থেকে ওদের সরাতে চায় না সে। এখান থেকে ছেলের স্কুল খুব কাছে, বাজার-দোকান চেনা। পার্লার বাড়ির নিচেই, সামনে দিয়ে হাজারটা বাস, খুব কাছে মেট্রো। কিন্তু তাদের বারো বছরের দাম্পত্যের প্রতিটা মুহূর্তের সাক্ষী এই বাড়িতে ঝিল্লি মেয়াদের একদিন বেশি থাকতে রাজি নয়।
রায়াকে নিয়ে সে একটি কথাও বলেনি, কিন্তু নিজের নতুন ফ্ল্যাট পাবার জন্যে সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছে। যে অরুণাভর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তার গা ঘিনঘিন করে, তার সঙ্গে সে তর্ক করেছে, গলার শির খিঁচিয়ে ঝগড়া করেছে। অশান্তির কোনও সুযোগই সে নষ্ট করেনি। যখনই সে শুনেছে নতুন ফ্ল্যাটটা বাইপাসের ধারে, নতুন মেট্রো স্টেশনের লাগোয়া, সেখান দিয়ে সে বারুইপুরে সহজে যাতায়াত করতে পারবে, ফ্ল্যাটটা পাবার জন্যে সে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে। এই ফ্ল্যাট থেকে অবন্তীনগরে যাওয়াও কি সহজ হবে না? অবন্তীনগর, মিথিলেশ। একটা জায়গা, একটা মানুষ। জায়গাটায় সে কখনও যায়নি আর মানুষটাকে সে দেখেছে কত বছর আগে। মাঝেমধ্যে এক আধবার দু’তিন মিনিটের জন্যে দেখা হয়েছে। সেটাও তো বছর চারেক হয়ে গেছে। তাছাড়া সেই মিথিলেশ আর এই মিথিলেশ তো এক নয়। ঝিল্লির কেন জানি মনে হচ্ছে মিথিলেশ অনেক বদলে গেছে, এখন সে নিজের জীবনে অনেক স্বচ্ছন্দ। আগে মনে হত, অন্যের জুতো পরে ঘোরার মতো সে অন্য কারো জীবনে ঢুকে পড়েছে। ঝিল্লিও কি এতদিন অন্য কারও জীবন পায়ে গলিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল? সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না এটা তার মাপের চেয়ে অনেক ছোট। লাগছে, ফোসকা পড়ছে, তবু সে জুতোটার সঙ্গে ক্রমাগত মানাবার চেষ্টা করে গেছে। এবার নতুন ফ্ল্যাটে গিয়ে সে ঠিকঠাক মাপটা খুঁজে পাবে কি?

ট্যাক্সি থেকে নামলেই কালীঘাট মেট্রোর সামনের ফুটপাথে অনেকগুলো খেলনার দোকান। খেলনা আর জাংক জুয়েলারি দেখলে সে নিজেকে সামলাতে পারে না। একটা ছোট্ট টেডি বিয়ারে তার চোখ আটকে গেছে। নীল রঙের টেডি নেই তার ছেলের, এই সাইজটা তো নয়ই। টেডিটা থেকে চোখ সরাতে পারছিল না ঝিল্লি। দামও খুব কম। কিন্তু নিতে গিয়েও নিল না সে। তার এখন কার্যত কোনও বাড়ি নেই। একটা অস্থায়ী আস্তানা। যাই কিনবে, সেগুলোকে প্যাক করে গুছিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া সব অভ্যাসের মতো, খরচের অভ্যাসেরও বদল দরকার তার। সে তো শুধু নতুন ঠিকানায় যাচ্ছে না, উপার্জনহীন মানুষ হিসেবে সংসারের দায়িত্ব নেবার এক বিপজ্জনক ও অদ্ভুত ভূমিকাও নিতে চলেছে। ফ্ল্যাটটা নিশ্চয় অনেক দাম দিয়ে অরুণাভ তাদের কিনে দিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ছেলের পড়াশোনার খরচও সে এখন দেবে। কিন্তু সংসার চালানোর কোনও টাকা তার কাছ থেকে ঝিল্লি নেবে না। তার নামে কিছু টাকা আছে, বাবা রেখে গেছিল, সেটা বেড়ে যা দাঁড়িয়েছে, তার সুদে প্রথম ছ’মাস হয়তো চলে যাবে। কিন্তু তারপর? নতুন সংসার পাতার একটা বিরাট খরচ আছে। এখান থেকে মায়ের দেওয়া খাট ও অন্যান্য আসবাব এবং নিজেদের জামাকাপড় ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছু নেবে না সে। ফলে হাঁড়ি, কড়া, ছাঁকনি, মগ, বালতি সবই তাকে কিনতে হবে। হয়তো এটার কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু এই সংসারের প্রাত্যহিকতার স্পর্শ লাগা কিছুই সে নতুন সংসারে নিয়ে যেতে পারবে না।
মেট্রোর গেটে ঢুকছে, হঠাৎ কে ডাকল ‘অ্যাই ঝিল্লি…’ বিদিতা! বিদিতার পাশে একজন পুরুষ। বিদিতা আলাপ করিয়ে দিল
– অর্ণব মুখার্জি, আমার কলিগ। আর এ হচ্ছে ঝিল্লি, যাদবপুরে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
অর্ণব মুখার্জি বললেন
– আমরা সবাই তাহলে যদুবংশ? আমিও যাদবপুর, কমপ্যারাটিভ লিটারেচার।
বিদিতার কলিগ? তার মানে বিদিতা চাকরি করে? ঝিল্লি চট করে মোবাইল বের করে বলল
– অ্যাই ৯৪৩২২৫৬৫৩২ নম্বরে চট করে একটা মিসড কল দে তো।
বিদিতা চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল টাওয়ার নেই।
– বি এস এন এল নিশ্চয়। তুই আর পালটাবি না!
ঝিল্লি বলল
– পালটেছি তো। যাদবপুরে যখন পড়তাম তখন তো মোবাইলই ছিল না।
অর্ণব মুখার্জি পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে পেছনে বিদিতার নম্বর লিখে দিয়ে বললেন
– এতে দুজনের নম্বরই রইল।
ঝিল্লি কার্ডটা নিয়ে বলল
– আসি রে, আমার ট্রেন এসে গেছে।
মেট্রোয় উঠে ঝিল্লি দেখল ওরা দু’জন স্মিত মুখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৬ অগস্ট ২০২২
*ভেতরের ছবি: Pinterest, Shutterstock
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।
besh lagche…..choritrota bsh jhor-jhore,phur-phure jhillir….golper bhasar matoi
dekha jaak ki hoy ….