ছাত্রী ছিলাম ডাভটন কোরির। ইতিহাস আর ইংরেজি সাহিত্যে আমার আগ্রহটা ওঁরাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা দিতে আমাকে যেতে হয়েছিল উটির লরেন্স স্কুলে। কারণ, মাদ্রাজে তখন সিনিয়র কেম্ব্রিজ পরীক্ষার কোনও সেন্টারই ছিল না। মাসখানেক থাকতে হয়েছিল উটির ভয়ঙ্কর ঠান্ডায়। ওইখানেই আমার সিগারেট খাওয়ার শুরু। এখন যদিও অনেক দিন হল ধূমপান একদম ছেড়ে দিয়েছি। পরীক্ষার প্রায় পরপরই বাবা আবার বদলি হলেন কলকাতায়। কলকাতায় এসে আমি ইতিহাসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম লোরেটো কলেজে। আর পরপর আসতে থাকল কাজের অফার। হরিদাস ভট্টাচার্যের ‘শেষ অঙ্ক’ (১৯৬৩), তপন সিংহের ‘নির্জন সৈকতে’ (১৯৬৩), পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘ছায়াসূর্য’ (১৯৬৩)।

সত্যজিৎ রায়ের দু’টো ছবিতে তো কাজ করেছি বিনা পারিশ্রমিকে। বাবা মানিকদাকে বলে দিয়েছিলেন, টাকাপয়সা নেওয়ার প্রশ্নই নেই। ভালো কাজ করলে রাখবেন, নইলে বাদ দিয়ে দেবেন। কিন্তু ‘শেষ অঙ্ক’ থেকে আমি পেশাদার অভিনেত্রী। বোধ হয় পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলাম ‘শেষ অঙ্ক’-তে কাজ করে। তখনকার দিনে সেটা কিন্তু অনেক টাকা। আমার সেই প্রথম রোজগার থেকে একটা হার, কিছু চুড়ি, কানের দুল, মানে বেশ কয়েকটা সোনার গয়না কিনেছিলাম। অনেক পরে, আমার বোন টিঙ্কুর মেয়ের বিয়েতে সেগুলো উপহার দিয়েছিলাম। ‘শেষ অঙ্ক’-তে প্রথম কাজ করলাম উত্তমকুমারের সঙ্গে। দেখলাম লোকে ওঁকে কেমন রাজার মত সম্মান করে! পরে ওঁর সঙ্গে আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করেছি, তবে ওই প্রথম ছবি, ‘শেষ অঙ্ক’, আজও আমার দেখা হয়নি।
‘নির্জন সৈকতে’-র জন্যে আমাকে লম্বা লম্বা সংলাপ দিয়েছিলেন তপন সিংহ। খুবই শিক্ষিত মানুষ, ভাবার মত বক্তব্য ছবিতে, আর অসাধারণ দৃশ্য পরিকল্পনা। ওই দৃশ্যটা, যেখানে ছায়া দেবী আর অন্য সব মহিলারা মিলে সমুদ্রে স্নান করছেন, বা রুমা গুহঠকুরতা গাইছেন ‘দেখ দেখ শুকতারা আঁখি মেলি চায়’, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমার সঙ্গে অনিল চ্যাটার্জির অনেকক্ষণ ধরে কথা, ভোলা যায় না! ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় অভিনয় করা হয়নি, কিন্তু এখানে সুযোগ হল অনিলবাবুর সঙ্গে কাজ করার। আর, চিনলাম রবি ঘোষকে। আমি তো শিখে অভিনয় করতে আসিনি, করতে করতে শিখেছি। কিন্তু আমার মেন্টর যদি কাউকে বলতে হয়, তো রবি ঘোষ। কত কিছুই যে শিখেছি তাঁর কাছে।

মানিকদার শুরুর দিকের সহকারী নিমাই দত্ত, তপেশ্বর প্রসাদরা মিলে ‘প্রান্তিক’ নাম নিয়ে সৌমিত্র আর আমাকে নিয়ে করেছিলেন ‘শেষ প্রহর’ (১৯৬৩)। রবিদাও ছিলেন সেই ছবিতে। তার একটা দৃশ্যে, ট্রেনের মধ্যে, আমাকে অনেকক্ষণ ধরে হাসতে হাসতে শেষে একেবারে হাসিতে ফেটে পড়তে হবে। কিছুতেই সেটা পারছি না। রবিদা দেখিয়ে দিলেন কী করে করতে হবে। বললেন প্রথমে একটুখানি, এই মুচকি হাসি দিয়ে শুরু কর। তারপর হাসতে হাসতে হাসিটাকে বাড়িয়ে যাও। রবিদার কথামত হাসতে হাসতে দৃশ্যটা উতরে গেল।
কলকাতায় তখন অনেক ফিল্ম ক্লাব ছিল। তারা নিয়মিত দেখাত বিভিন্ন দেশের ছবি। এরকম বহু ছবি দেখাতে রবিদা নিয়ে গিয়েছেন আমাকে। দেখার পর আড্ডাও হত। চর্চা হত সেই সব ছবি নিয়ে। অভিনয় দেখে বোঝা যায় না, কী রকম একটা কর্পোরেট চরিত্রের মানুষ ছিলেন রবি ঘোষ। কত লোকের সঙ্গে যে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমাকে। ‘নায়ক’-এর (১৯৬৬) সময় হল কী, তখনও স্ক্রিপ্ট শোনানো হয়নি, কিন্তু মানিকদা বলে রেখেছেন, আমার চোখে একটা চশমা থাকবে। রবিদা বললেন জেনে নিতে সেটা প্লাস, না মাইনাস? কাছের, না দূরের? আমি মানিকদাকে জিজ্ঞেস করতে উনি খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘বাঃ, এরই মধ্যে চরিত্রে ঢুকে পড়েছ তুমি?’ ওঁকে আর বলিনি যে রবিদাই বলে দিয়েছিলেন প্রশ্নটা করতে। ‘ছায়াসূর্য’-র পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেও ভালো লেগেছিল খুব। ওঁর সঙ্গে পরে আরও একটা ছবি করেছি, ‘শুভা’।

অনেকে ভাবেন বিদেশের মানুষ বাংলা ছবি বলতে শুধুই বোঝেন সত্যজিৎ রায়। তা কিন্তু নয়। কয়েক বছর আগে, ২০০৯ সালে, মার্ক কাজিন্স (Mark Cousins) নামে এক ভদ্রলোক, যিনি এডিনবরা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালের অন্যতম আয়োজক এবং কিউরেটর, এখানে এলেন একদিন। বললেন, আমরা পশ্চিম বঙ্গের কিছু ক্লাসিক বাংলা ছবি নিয়ে একটা ফেস্টিভাল করছি। সেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে চাই, সরাসরি তোমার কাছ থেকে সত্যজিৎ রায়ের কথা, বাংলা ছবির কথা শুনব বলে। আমি ভেবেছিলাম, ওরা বুঝি মানিকদার ছবিই শুধু দেখাবে। মার্ক বলল, না, সত্যজিৎ রায়ের ছবি থাকবে, তার সঙ্গে ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, মৃণাল সেনের ছবিও দেখাব আমরা। মোট সাতটা বাংলা ছবি বেছেছিল ওরা, তার মধ্যে – ‘দেবী’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ আর ‘নির্জন সৈকতে’ – তিনটে ছবিতে আমি কাজ করেছি। আর ছিল, ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩), মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) আর তপন সিংহের ‘হুইল চেয়ার’ (১৯৯৪)।
চিফ গেস্ট বানিয়ে খুব খাতির করে বিশেষ ক্লাসের টিকিটে ওঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে, রেখেছিলেন ওখানকার সেরা হোটেলে। ব্যাগপাইপ-টাইপ বাজিয়ে সংবর্ধনা দিলেন ওখানকার মেয়র। শন কনোরি (Sean Connory) ওদের চিফ পেট্রন, তিনি এসেছিলেন কিল্ট পরে। আন্তর্জাতিক সিনেমার আরও অনেক বিখ্যাত মানুষও ছিলেন। একটা পুরনো চার্চ হলকে অডিটোরিয়াম বানিয়ে প্যারাডাইস সিনেমা হল নাম দিয়ে ছবি দেখানো হচ্ছিল। প্রচুর লোক এসেছিল, এক্কেবারে ফুল হাউস। কিছু বাঙালি নিশ্চয়ই ছিলেন, কিন্তু ওখানকার লোকই বেশি। খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন তাঁরা, অনেকে প্রশ্নও করলেন। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার।
তাই, বাংলা ছবির অনেক পরিচালককেই যে বিদেশের সিনেমা-উৎসাহীরা চেনেন, এটা আমি নিজে দেখেছি। ফ্রান্সে আমি যেবার কান ফিল্ম ফেস্টিভালের জুরি, ওঁরা আমাকে বলেছিলেন, মৃণাল সেনের ছবির রেট্রোস্পেকটিভ করতে চান। কিন্তু সব ছবির ভালো প্রিন্টই পাচ্ছেন না। এটা মস্ত অসুবিধে। আসলে, সিনেমা তো শুধু গল্প আর অভিনয় নয়, তার সাউন্ড, আলো, ফ্রেমের ডিটেল, সবটা নিয়েই সিনেমা। ফিল্ম এমন টেকনিকাল একটা মিডিয়াম, যে তার ঠিকমত প্রিজার্ভেশন আর রেস্টোরেশন না করলে বড় পর্দায় দেখানোর মত থাকেই না। কটা বাংলা ছবির আর সেই সৌভাগ্য হয়!

বাংলায় ছবি পরিচালনা করেনি, কিন্তু কলকাতার বাঙালি বলে বলছি, কঙ্কণা সেনশর্মার ‘ডেথ ইন দ্য গাঞ্জ’ (২০১৭) আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। অনেক অনেক দিন পরে আমরা একজন পরিচালককে পেয়েছি, যে সিনেমা বোঝে। ক্যামেরা, সাউন্ড, এডিটিং, সংলাপ, অভিনয়ের যে বোধ কঙ্কণা দেখিয়েছে, আমি তো সেটা মানিকদার সঙ্গে তুলনা করছি। অসাধারণ পরিমিতি, বারবার দেখার মত ছবি। আমি কঙ্কণাকে বলেওছি সেটা। খুব চাইব, কঙ্কণা যেন এই জায়গাটা ধরে রাখতে পারে।
***
মানিকদার সঙ্গে তুলনার কথা হলেই ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা আগে মনে আসে? না! আমার কখনও সেরকম মনে হয়নি। ঋতুপর্ণর ধরনটা ছিল আলাদা, ওর নিজস্ব। ‘শুভ মহরত’-এ (২০০৩) অভিনয় করেছি বলেই শুধু নয়, ঋতু ছিল আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যখন ‘উনিশে এপ্রিল’-এর (১৯৯৪) চিত্রনাট্য তৈরি, কিন্তু কাজ শুরু হয়নি, তখন ঋতু এসেছিল দিল্লিতে, আমার বাড়িতে। যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিল রিনা, মানে অপর্ণা সেন। তখনই ঋতুর মাথা ভর্তি আইডিয়া। সেই তখন থেকে শুরু, তারপর থেকে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। একটা সময় আমি টেলিভিশনের জন্যে তেরোটা ছোটগল্প নিয়ে তেরোটা ছোট ছবি করব ভেবেছিলাম। ঋতু তখন তার চারটে ছবির চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছিল একদিনে! কম্পিউটারে নয়, একেবারে হাতে লিখে। অবিশ্বাস্য দ্রুত কাজ করতে পারত ঋতু! ভাবতেও পারি না সেই ঋতু নেই। তবে ওর লেখা চিত্রনাট্যগুলো খুব যত্ন করে রাখা আছে আমার কাছে।

আমাকে অনেক বাংলা বই পড়িয়েছে ঋতু, অনেক। আলাপ করিয়ে দিয়েছে জয় গোস্বামী, আরও অনেকের সঙ্গে। বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু এত কিছু শিখেছি ঋতুর কাছে! একবার জয়পুর লিটারারি ফেস্টিভালে গিয়ে কী কী বলব সব যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। অগত্যা সাত সকালে ঋতুকে ফোন। এত গুছিয়ে বলতে শুরু করল ঋতু, একেবারে ছবির মতো বর্ণনা সমেত, যে আমি নোট নিতে গিয়ে হিমশিম। ঋতু বলত, রবীন্দ্রনাথ জমিদার বাড়ির ছেলে। তখনকার গ্রামের মানুষের চায়ের ওপর লোভ, বা কর্কশ কথাবার্তা – হয় তাঁর অভিজ্ঞতায় ছিল না, থাকলেও সেটা লেখায় ধরা পড়েনি। কিন্তু মানিকদা গ্রামের মানুষের কথাবার্তার সেই মার্জিত ধরনটাই রেখে দেবেন কেন? সেইজন্যে ‘অন্তরমহল’-এ (২০০৫) সোহার চরিত্রের কণ্ঠস্বর, ডাবড যদিও সেটা, বেশ কর্কশ। ঋতুর সঙ্গে এ ব্যাপারে আমি কোনওদিনই সহমত ছিলাম না। কিন্তু ঋতুর ‘তিতলি’ (২০০২) বা ‘চোখের বালি’ (২০০৩) আমার বেশ ভালো লেগেছে। শেষের দিকে ওর তো শরীর খারাপ হয়ে গেল। ‘মেমরিজ ইন মার্চ’ (২০১১), ‘চিত্রাঙ্গদা’-র (২০১২) মতো ছবি করার পর, ঋতু যখন ওর আত্মপরিচয় বা যৌনতার সংকট থেকে বেরিয়ে আসছে, তখন শরীর এতই খারাপ হয়ে গেছে যে আর আউটডোর করতে পারে না। তারপর তো চলেই গেল। অথচ তখনই আমাদের সত্যিকারের ঋতুকে পাওয়ার কথা। (চলবে)
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
Khub bhalo lagche porte..
আন্তরিক ধন্যবাদ। সঙ্গে থাকবেন।
ভালো লাগছে । এই ক্যানডিড , খোলাখুলি ভঙ্গীটাই যেন বজায় থাকে !