আমার জন্ম ১৯৪৪ সালের ৮ ডিসেম্বর। বাবাকে ফোন করে মানিকদা যখন প্রথম তাঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন, তখন আমার বয়স তেরো। আমার বোন টিঙ্কু তার আগেই তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা’-তে (১৯৫৭) মিনির চরিত্রে অভিনয় করেছে। সেটা তো দেখেইছি, ‘পথের পাঁচালি’-ও মা-বাবা আমাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে এনেছেন। খুব ভালো লেগেছে সবার। বাড়িতে অনেক কথাবার্তাও হয়েছে। এখন যেমন ছোটরা সব ছবিই দেখে, তখন তো সে রকম ছিল না। সিনেমা দেখতে যাওয়া তখন ছিল একটা উৎসবের মতো।

সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে আমাকে খোঁপা বেঁধে, গ্রামের মেয়ের মতো শাড়ি পরিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায়। মানিকদা বললেন, ডানদিকে তাকাও, বাঁ-দিকে তাকাও। অনেক ছবিটবি তুললেন সে দিন। আমার কিন্তু বিশেষ কিছুই মনে হয়নি। অভিনেত্রী হব, এরকম ভাবনাই মনের মধ্যে ছিল না কোথাও। যা করতে বলা হচ্ছে, করছি। তারপর শ্যুটিং শুরু হল। টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওতে প্রথম দিনের শ্যুটিংয়ে একটা বন্ধ দরজার ওপারে ক্যামেরা নিয়ে সুব্রত মিত্র। সেখানে মানিকদা আর অন্যরাও, আর এপারে আমি আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

sharmila Tagore
একা ঘরে ছেঁড়া পর্দার ফাঁকে অপর্ণার জলেভেজা চোখের সেই আইকনিক দৃশ্য। ছবি সৌজন্য – লেখক

শট নেওয়ার আগের মুহূর্তে সৌমিত্র জিজ্ঞেস করেছিল, নার্ভাস লাগছে? বললাম, না তো! ঠিক তখনই মানিকদার গলা ভেসে এল, স্টার্ট সাউন্ড, ক্যামেরা, অ্যাকশন। সঙ্গে সঙ্গে হাতে স্যুটকেস আর হাতপাখা নিয়ে সৌমিত্র দরজাটা খুলল, আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এসো। হাতে টোপর নিয়ে কনের সাজে আমি ভেতরে ঢুকলাম। এই ছিল আমার প্রথম দিনের শট। একা হয়ে যেতেই ছেঁড়া-পর্দা-টাঙানো জানলার পাশে বসে কান্না ছিল স্টুডিওতে আমার প্রথম দিনের শ্যুটিংয়ের শেষ দৃশ্য। ততক্ষণে অবশ্য বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। টালার বাড়িতে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার যে সব দৃশ্য, সেগুলো নেওয়া হয়েছিল পরে। আগে স্টুডিওতে তুলে নেওয়া হয়েছিল ঘরে ঢোকার পরের দৃশ্য। কিন্তু বারবার দেখেও যে দু’য়ের মধ্যে কোনও তফাৎ করা যায় না, সেটাই মানিকদার পরিকল্পনা আর বংশী চন্দ্রগুপ্তর অসামান্য দক্ষতার বৈশিষ্ট্য।

sharmila Tagore
অপু-অপর্ণার সুখি সংসারের দৃশ্য। ছবি সৌজন্য – লেখক

তখন আসলে এসব কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু এখন ভাবতে বসলে অনেক কথাই মনে হয়। তেরো বছর বয়সের একটা আদ্যন্ত শহুরে মেয়ের পক্ষে সাদাসিধে গ্রামের মেয়ে অপর্ণা হয়ে ওঠার কাজটা তো খুব অনায়াস ছিল না! করেছিলাম কী করে? আসলে, মানিকদা কাজটা সহজ করে দিতেন অল্প কয়েকটা কথায়। অভিনয়ের ওয়র্কশপ বা লম্বা লম্বা রিহার্সাল এসব কিচ্ছুর দরকার হত না। মনে আছে, আমাকে শুধু বলেছিলেন, অনেক দূরে একটা নতুন জায়গায় এসেছ তুমি। মা-বাবা কেউ নেই তোমার কাছে। এখন থেকে এইখানেই থাকতে হবে তোমাকে। এইটুকু বলার সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু এমনভাবে সাজিয়ে রাখতেন আর চিত্রনাট্যটা এমন ভাবে পড়ে শোনাতেন যে, মন দিয়ে একবার শুনলেই সমস্ত ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যেত। বোঝা যেত, আমাকে ঠিক কী করতে হবে, কোথায় দাঁড়াতে হবে, কী ভাবে তাকাতে হবে, কোন কথাটা ঠিক কী ভাবে বলতে হবে। অনেক লম্বা তো আমার চেয়ে, একটু নিচু হয়ে, একেবারে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখিয়ে দিতেন কী চান। বেশির ভাগ শট একটা টেকেই ওকে হয়ে যেত। কখনও কোনও কিছু পছন্দ না হলে আলাদা করে ডেকে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলতেন, এরকম করে বলে দেখ না! তাতে কাজ হয়েছিল। এখন মনে হয়, তেরো বছর বয়সেই নির্দেশ পালন করাটা আমি ভালো শিখে নিয়েছিলাম।

অপুর সংসার’-এ (১৯৫৯) আমার কাজ দশ দিনের মধ্যেই শেষ হয়েছিল। তার মধ্যে আবার আমার হল মামস। সেরে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন মানিকদা। বাবা আগেই বলে রেখেছিলেন ছবিতে অভিনয়ের জন্যে রিঙ্কুকে কোনও টাকাপয়সা দেওয়া চলবে না। মানিকদা তাই অনেক উপহার দিয়েছিলেন। শাড়ি, ঘড়ি, আরও অনেক কিছু। 

***

সৌমিত্রর ওপর চমৎকার একটা ডকুমেন্টারি করেছেন ক্যাথারিন বার্জ (Catherine Berger) নামে যে ফরাসি মহিলা, তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন টালার সেই বাড়িতে, যেখানে অপুর সংসার’-এর শ্যুটিং হয়েছিল। বাড়িটা দেখলাম এত বছরেও বিশেষ পাল্টায়নি। জায়গাটাও। কোনরকম প্রিভেসি নেই, ঘিঞ্জি, প্রায় দম বন্ধ করা একটা পরিবেশে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে যেই চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে পৌঁছলাম, হঠাৎ যেন আকাশ খুলে গেল। চোখের সামনে শুধু মুক্তি। সব মলিনতা যেন পড়ে রইল দূরে, অনেক নিচে। আর রইল রেল লাইন, দূর থেকে আসা ট্রেনের আওয়াজ। অপুর জগতটা চিনিয়ে দেওয়ার জন্যে এর চেয়ে ভালো কোনও জায়গা হতে পারে? কী করে মানিকদা আবিষ্কার করতেন এরকম অসাধারণ লোকেশন? কী চাই সেটা কতটা ভালো জানলে এটা সম্ভব? যখন অভিনয় করেছি, তখন এসব কিছুই বুঝিনি। পরিণত বয়সে ছবিটা দেখতে দেখতে ভেবে অবাক হয়েছি।

sharmila Tagore
টালার বাড়িটার মতো এমন আশ্চর্য লোকেশন খুঁজে বের করা মানিকদার পক্ষেই সম্ভব ছিল। ছবি সৌজন্য – লেখক

দেবী’ (১৯৬০) করতে গিয়ে আবার আর এক রকমের অভিজ্ঞতা। অপুর সংসারকরার সময় সবাই আমার সঙ্গে কত গল্প করতেন, মজা করতেন। দেবীকরার সময় দেখি কেউ কথাই বলে না। মানিকদার বোধ হয় সেরকমই নির্দেশ ছিল। আমাকে মানসিকভাবে চাপে রাখার, কুণ্ঠিত করে রাখার, যাতে দয়াময়ীর চরিত্রে ঢুকতে আমার সুবিধে হয়। সেটের আলো তৈরি করতে প্রচুর সময় নিতেন সুব্রতদা। আমি একটা খাটের ওপর শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়েই পড়তাম মাঝে মাঝে। তারই মধ্যে একদিন তো একজন বয়স্ক মানুষ এসে আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে গেলেন। পরে বুঝেছি, ইচ্ছে করেই মানিকদা আমাকে এই গভীর অস্বস্তি, এই ভয়ঙ্কর বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে রাখতেন। সারাক্ষণ সিঁটিয়ে আছি। কে আমি? নিজের মনেই সন্দেহ তৈরি হত মাঝে মাঝে। আর মানিকদা সেটাই ছবি বিশ্বাসের মত ওইরকম প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বশালী অভিনেতার সঙ্গে আমার তাল মেলানোর কাজে লাগাতেন।

sharmila Tagore
দেবী ছবিতে দয়াময়ীর চরিত্রে। ছবি সৌজন্য – লেখক

এদিকে, ‘দেবী’-র কাজ শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বাবা বদলি হলেন আসানসোল থেকে মাদ্রাজ। আমিও মা-বাবার সঙ্গে সঙ্গে গেলাম সেখানে। ভর্তি হলাম ডাভটন কোরি (Doveton Corrie) স্কুলে। সেখানকার ব্রিটিশ প্রিন্সিপাল দায়িত্ব নিলেন আমার সিনিয়র কেম্ব্রিজ পরীক্ষার প্রস্তুতির। ডিসেম্বরে সেই পরীক্ষা, তার ঠিক মুখে, নভেম্বরে বোধ হয়, বাবার কাছে মানিকদার চিঠি এল কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় অভিনয়ের জন্যে আমাকে চেয়ে। সামনে পরীক্ষা তো ছিলই, কিন্তু মানিকদা একটা গণ্ডগোলও করে ফেলেছিলেন। চিঠিতে বাবার নাম জি এন টেগোরের বদলে লিখেছিলেন এন টেগোর। বাবা খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “হতেই পারেন উনি সত্যজিৎ রায়, খুব নামকরা মানুষ, তা বলে আমার নাম ভুল করবেন কেন! কেন মনে রাখবেন না যে আমি জি এন টেগোর?” পত্রপাঠ না বলে দিলেন বাবা। ফলে মানিকদার ডাক পেয়েও আমার আর কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় অভিনয় করা হল না!

আমি নিজে কি অন্যরকম কিছু চেয়েছিলাম তখন? কী জানি, এখন আর মনে করে বলতে পারব না। যে পরিবেশে, যে মূল্যবোধে বড় হয়েছি, সেখানে উদারতা যথেষ্টই ছিল। ফলে অভিভাবকদের সঙ্গে বিরোধের, জেদ ধরে নিজের মত প্রতিষ্ঠার তেমন দরকারই হয়নি কোনও দিন। (চলবে)

মনে, রেখে দেব (পর্ব ১)

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

2 Responses

  1. আবার বলতে হচ্ছে; অনবদ্ধ লেখনি তোমার। ঠিক মনে হয় সামনে বসে চা খেতে খেতে গল্প শুনছি। এই মুহুর্তে কি সুধু বিনোদন জগতের অজানা গল্প কথাই শোনবে. নাকি বিষয় বস্তু পরিবর্ত করার চিন্তা ভাবনা আছে? তবে লেখা যেন না থামে। চারধারে এত কষ্ট, দুঃখ্যের মধ্যে কিছুক্ষনের জন্য ভুলে থাকতে সাহায্য করে তোমর লেখনী। ভালো থেকোও।

    1. অনেক ধন্যবাদ, সুবিনদা। ঠিকই ধরেছেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে উত্তর সম্পাদকীয় লেখা আপাতত বন্ধ রেখেছি। মাথায় গিজগিজ করছে গল্পের আইডিয়া। তবে রুপোলি পর্দার ইতিহাস বা নেহাত গল্প-উপন্যাস, যা-ই লিখি, শেষ পর্যন্ত দেখবেন ভুলে থাকার জন্যে নয়, মনে রাখার জন্যেই লিখেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *