আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] []

মানুষের প্রতিদিনের ঘরকন্নায় রান্নাঘর কেমন করে জানি আলোছায়ায় মিশে থাকে। তার খানিক আলোয় ঢাকা, খানিক আঁধার মাখা। সেই আঁধারে বসে বসে যারা দিনের পর দিন ইচ্ছেয় অথবা অনিচ্ছেয় থোড় বড়ি খাড়া রেঁধে থাকেন তাদের জন্য খানিক সহানুভূতি না হয় সঞ্চিত থাক। কেউ তো তাঁদের জন্য আলাদা করে ভাবেনি কিছু! অথচ তাঁরাই সময়ের উজান ঠেলে জাতির স্বাদকোরকটিকে টিকিয়ে রেখেছেন সন্ধ্যাদীপের শিখায়। জাতি সত্তা বা নেশনের অহং সেসব রান্নাকে বার বার জাতীয় চেতনার ধারক বলে দাবি করতে চেয়েছে। রাজনৈতিক গল্প না হয় মুলতুবি থাক এখন। বরং এভাবে ভাবা যাক, রান্নাঘরে কত না ইতিহাস গড়ে উঠছে প্রতিদিন অথচ সেই সংগ্রামী শ্রমিকদের গল্প হারিয়ে যাচ্ছে রোজ। রান্না তো কেবল আনাজপাতি আর মশল্লার গল্পে ভরে থাকে না! আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা শিখিয়েছিলেন কেমন করে আত্মনির্ভর হতে হয়। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী লিখেছিলেন কেমন করে উনুন পাততে হয়, মাপের একক চিনতে হয়। মাছ কাটার খুটিনাটি নিয়ে আস্ত এক পাতা না লিখলেও পারতেন তিনি! ইলিশ মাছ ‘বানানো’র (কাটার) পদ্ধতি আজ না জানলেও চলে। কেই না ওসব ভেবে মাছ কাটে! কিন্তু কাটতে জানলে অজীর্ণকারক উপাদান গুলো সরিয়ে ফেলা যায়। খাবার তো কেবল পেটভরানোর বস্তু নয়! খাবারে মিশে থাকে স্বাস্থ্য আর সেবার ইচ্ছে। পৃথিবীর তাবড় তাবড়  রান্নার ইস্কুলে সেসব শেখায় নিশ্চয়ই। কিন্তু সবাই তো আর সেসব ইস্কুলে যায় না, যেতে পারেও না। তাদের জন্য মা-ঠাকুমাদের ইস্কুল একটা বড়সড় জানলা খুলে দিতে পারে। আমার কথায় প্রত্যয় না হলে আপনারা নাদিয়াকে দেখুন! নাদিয়া সান্তিনি (Nadia Santini)। তিনি একজন রাঁধুনি। এবং বিশ্বসেরা রাঁধুনিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। 

সে অনেক বছর আগের কথা, নাদিয়া পড়তে গিয়েছিলেন মিলানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওঁর স্বামী আন্তোনিও’র সঙ্গে সেখানেই আলাপ, ক্রমে বিয়ে এবং সংসার। প্রতিটি সংসারের গল্পই আসলে নিজের নিজের মতো! তেমনই আন্তোনিওদেরও। ওঁর ঠাকুরদা যুদ্ধ ফেরত একখানা হোটেল খুলেছিলেন ঠাকুমা টেরেসার সঙ্গে। তখন ১৯২৫ সাল। সেই হোটেলখানা ক্রমে রেস্তোরাঁ হয়ে ওঠে আন্তোনিও’র বাবা-মায়ের আমলে। বিয়ের পর নাদিয়া আর আন্তোনিও বেড়াতে গেল ফ্রান্সে। সেখানে খুব বড় মাপের কিছু রাঁধুনির বা বলা ভালো শ্যেফের সঙ্গে ওঁদের দেখা হলো। নাদিয়া ভাবল এমন সুন্দর করে যদি রেস্তোরাঁটাই একটু অন্যরকম করে তোলা যায়! 

Nadia and Antonio Santini

নাদিয়া ফুড কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়েছিল বটে কিন্তু কালিনারি ইস্কুলের ডিগ্রি ওঁর ছিল না। দিদিশাশুড়ি টেরেসার কাছে রান্না শেখা নাদিয়ার। সেই যে, যিনি যুদ্ধ বিদ্ধস্ত একটা দেশে খাবারের দোকান খুলে বসেছিলেন বরের হাত ধরে! টেরেসা, নাদিয়াকে রান্নার কত না প্রকৌশল শিখিয়েছেন। রান্না তো কেবল খুন্তি নাড়া নয়, রান্না একটা দর্শন। টেরেসার জীবন দর্শন নাদিয়াকে ভাবিয়েছে বরাবর। যাঁরা অর্থনীতি নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা ভালো করে বলতে পারবেন, বৃদ্ধি আর বিকাশ তো ঠিক এক জিনিস নয়! নাদিয়ার রান্নাঘরে সেই ভাবনার চর্চা হয় প্রতিদিন। দিদিশাশুড়ি ওঁকে বলেছিলেন, – ‘ …I think it is impossible for a woman to run a kitchen that serves 100 people. I can’t give my heart to a dish if I am cooking for more than 30. …’ (আমার মনে হয় কোনও মহিলার পক্ষে এমন কোনও রান্নাঘর পরিচালনা করা সম্ভব নয়, যেখানে একশো জনের পাত পড়ে। তিরিশ জনের বেশি অতিথির জন্য কোনও পদ রাঁধতে হলে আমার মনোযোগ হারিয়ে যায়)। 

রান্নায় কেবল শারীরিক সক্ষমতা লাগে না, মন প্রাণের একাত্মতা লাগে, একথা বিশ্বাস করতেন টেরেসা। নাদিয়াও করেন। ওঁদের পারিবারিক রেস্তোরাঁই এখন নাদিয়ার রান্নাঘর। সেখানে আ-বিশ্বের মানুষ ওঁর রান্না খেতে আসেন। পারিবারিক আবহে আতিথ্য উপভোগ করতে আসেন। মানুষেরা ভাবেন, আহা! কারও বাড়িতেই এসেছি বুঝি! কী আন্তরিক, কী মায়া দিয়ে সাজানো! খুব বিরাট চকমিলানো রেস্তোরাঁ তো নয়,অথচ কী সুন্দর। এই রান্নাঘর থেকেই নাদিয়ার হাতযশ ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। Dal Pescatore (দাল পেস্কাতোর) ১৯৯৬’এ তিনটি মিশেলিন স্টার পেয়েছে। রান্নার দুনিয়ায় সে যে বিরাট ব্যপার সে তো সবাই জানে। তাজা শাক সবজি, হাতে বানানো চিজ আর বিবিধ উপকরণে মানুষ টের পায়, এই রান্নাঘরে বাড়ির মতো যত্ন করে রান্না হয়। ফাইন ডাইনিং মানে তো কেবল মাত্র চোখ জুড়ানো প্লেটিং না! রান্নার বিন্যাসে, রাঁধুনির যাপনে সেই সত্যটুকু থাকতে হয়। নাদিয়ার শেখাটুকুর মধ্যে সেই সত্যতা আছে। বৃদ্ধির চেয়েও ওর কাছে তাই বিকাশ অনেক বেশি দামি। নাদিয়ার এই যাপনে যাঁর কথা আলাদা করে বলতেই হয় তিনি আন্তোনিও। রান্নাঘরে কখনও যান বটে তিনি কিন্তু মূলত রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপনায় তিনিই মুখ্য। বাপ-ঠাকুর্দার পারিবারিক ব্যবসায় বাড়ির বউ এমন করে অগ্রণী হয়ে উঠবে একথা আমাদের দেশে এখনও যারা ভাবতে পারেন না, তারা নাদিয়া-আন্তোনিও’র জীবনের দিকে একবার ফিরে দেখতে পারেন। 

নাদিয়া কেবল মাত্র মিশেলিন স্টারই পাননি, এক্ষেত্রে মহিলা শ্যেফদের মধ্যে ইতালিতে তিনিই প্রথম। আমি তো কখনও নাদিয়ার হাতের রান্না খাইনি! তবে, যাঁরা খেয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ সে সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন। এঁদের বেশিরভাগই লিখতে চেয়েছেন, ওঁদের আন্তরিকতার কথা। বলেছেন, নাদিয়ার রন্নাঘরটি যেন একটা মন্দির। কোরিয়ান বৌদ্ধ শ্যেফ থেকে নাদিয়া, পৃথিবীর রান্নাঘরে বার বার একটা সাধন মার্গের ছবি ফুটে উঠছে প্রতিদিন। অন্যকে আনন্দ দেওয়ার ইচ্ছে এবং নিজের কাজের আনন্দকে আত্মস্থ করার ইচ্ছে প্রতিদিন জন্ম নেয় যে রান্নাঘরে তাকে কি একটেরে অন্ধকারেই ফেলে রাখব আমরা! আমাদের দেশে যাঁরা বাড়ির  নকশা বানান, যারা জানলা দরজার কারিগর তারা কি একবারও ভাববেন না, রান্নাঘরের নকশা বদলের সময় এসেছে। খানিক আলো ঢুকুক না হয়। 

টেরেসা থেকে নাদিয়া হয়ে এই বাংলার কত না মা-ঠাকুমা মন প্রাণ দিয়ে রান্না করেন প্রতিদিন। মিশেলিন স্টার না হয় নাই পেলেন, পারিবারিক স্বীকৃতিটুকু পেলেই চলবে। এই দেখুন, গল্পে গল্পে কী কথায় এসে পড়লাম। নাদিয়া’র  ‘দাল পেস্কাতোর’এর দরজাখানা দেখলেই আমার মনে হয় ওপারে একখানা সাধনক্ষেত্র। যাঁরা একবার নাদিয়ার হাতের রান্না খেয়েছেন, তাঁরা ওই দরজা পেরিয়ে আলোর ঠিকানা জেনেছেন। রান্নায় ওই আলোটুকুই তো সব। নাদিয়ার ছেলেরাও রান্নায় আগ্রহী। কী সুন্দর বলুন! আর দু’বছর পরে একশো বছর হবে একটা রেস্তোরাঁর। যুদ্ধ ফেরত দুজন মানুষ কি আদৌ ভেবেছিলেন এমন হতে পারে! যা আমরা ভাবতে পারি না অথচ ঘটে যায়, সেই তো অলৌকিক! এই ধরুন নাদিয়ার মতো!

ছবি সৈজন্য: Tripadvisor

Amrita Bhattacharya

অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্‌জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *