কলামের অন্যান্য পর্ব:  [] [] [] [] [] [] []

 

প্রবাসী বাঙালি যুগ যুগ ধরে যে দেশেই বসবাস করুক— দেশাচার, লোকাচার তথা কালচারের ধারক ও বাহক হয়ে ওঠার তাগিদে কিছু ‘অলিখিত’ দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নেয়। সেই সূত্রে আমেরিকাতেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। চলছে বারো মাসে তেরো পার্বণ। যার অন্যতম হল বার্ষিক রবীন্দ্র জন্মোৎসব, সত্তর দশকে নিউইয়র্কে ‘টেগোর সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা দিয়ে যার সূচনা হয়েছিল। আজ সারা আমেরিকার বাঙালি সংগঠনগুলি এপ্রিল-মে মাস জুড়ে নববর্ষ আর কবিজয়ন্তী উদযাপন করে চলেছে। 

বাঙালি পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার উৎসাহে একসময় দীর্ঘদিন আমাদের নিউজার্সির ‘কল্লোল’ ক্লাবে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ছোটদের প্রতিভা বিকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এবছর মে মাসে নিউইয়র্ক-নিউজার্সির কয়েকটি উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়ে, পুরনো অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছিল। সে প্রসঙ্গেই এবারের লেখা।

তখন আমাদের প্রথম সমস্যা হত তারিখ নিয়ে। ২৫শে বৈশাখ যদি ৮ মে হয়, তো ওইদিনই ‘মাদার্স ডে’ পড়বে। মায়ের দাবি অগ্রগণ্য বলে কয়েকবারই পরের উইক-এন্ডে রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়েছে। ইদানীং “এসো হে বৈশাখ” দিয়ে একই দিনে নববর্ষ আর রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব হচ্ছে। আর সেই উপলক্ষ্যেই শিশুর প্রতিভা প্রদর্শন বা ট্যালেন্ট শো।

শিশুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক যে কত মধুর ছিল, সে কথা তো তাঁর আজীবনের সাহিত্যকর্মেই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আমার লেখার নামকরণে প্রকাশ পাচ্ছে কি? ‘বনাম’ আবার কী কথা? শিশু ভোলানাথদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কি প্রতিযোগিতায় নেমেছেন? না ক্রিকেট খেলেছেন? এরকম কষ্টকল্পনা করা উচিতও নয়। সব কথা খোলসা করে বলি আগে। তবেই নামকরণের কারণ অনুধাবন করতে পারবেন। 

Rabindranath Tagore

ক্লাবের গোড়াপত্তনের (১৯৭৫ সাল) পর থেকেই দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিভার স্ফূরণের দিকে কড়া নজর দেওয়া হত। রবীন্দ্রনাথকে তাদের চেনা দরকার। ক্লাব থেকে একটা ঢালাও চিঠি দেওয়া হত। যাঁরা ছোটদের বাংলা শেখাতে আগ্রহী, তাঁরা যেন অমুক তারিখে রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সালে সসন্তানে উপস্থিত থাকেন। গুটগুট করে যে ক’টি বাচ্চা আসত, কি পাঁচ-সাতজন টিনএজার ছেলেমেয়ে, তাদের অপূর্ব অনুবাদ সহযোগে নাচ, গান শিখিয়ে বেশ সুন্দর অনুষ্ঠান করানো হত। নাচ শেখানোর সময় বাংলা গানের মানে বোঝাতে সচিত্র শিক্ষাও দিয়েছি। ‘বৎসরের আবর্জনা’ মানে সারা বছরের গারবেজ যে নয়, সে কথা তারা সম্যক বুঝেছে, এই আত্মপ্রসাদে অনুপ্রাণিত হয়েছি।

রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রথম পর্বে ছোটরা নেচে, গেয়ে, হাততালি পেয়ে স্টেজ ছেড়ে দেওয়ার পর কদমছাঁট দেওয়া গোলগাল ছেলেগুলো আমাদের হাতে আঁকা চোখ, ভুরু, গোঁফ, লিপস্টিক মুছে ফেলে দৌড় দিত। ঝুঁটিবাঁধা মেয়েগুলো আইশ্যাডো মুছতে দিত না। একবার কার যেন ছোট্ট মেয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে আনমনে গান ধরেছিল—পেমেরো যোগাড়ে ভাসাবো ডোয়ারে…

মাঝে অনেক বছর চলে গেছে। যথাকালে তার প্রেমের যোগাড় হয়ে বিয়েও হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে তদ্ভব বাণী নিয়ে অত আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। দেশে এক নাচের মাস্টারমশাই ‘শ্যামা’র রিহার্সালে বজ্রসেনকে “জেনো প্রেম চিরঋণী” নাচটি শেখাতে গিয়ে “কালিমার পরশে”র সময় দুহাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে মা কালীকে স্মরণ করতে বলেছিলেন। 

রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রথম পর্বে ছোটরা নেচে, গেয়ে, হাততালি পেয়ে স্টেজ ছেড়ে দেওয়ার পর কদমছাঁট দেওয়া গোলগাল ছেলেগুলো আমাদের হাতে আঁকা চোখ, ভুরু, গোঁফ, লিপস্টিক মুছে ফেলে দৌড় দিত। ঝুঁটিবাঁধা মেয়েগুলো আইশ্যাডো মুছতে দিত না। 

আর এরা তো শিশু। আহা! এদের মুখে আরও কত তদ্ভব শব্দ শুনেছি। একবার বঙ্গ সম্মেলনের সময় ছোটদের সংগীত প্রতিযোগিতা আর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। পরীক্ষা চলার মধ্যেই উদ্যোক্তারা দূর থেকে আসা বিচারকদের চা আর স্ন্যাক্স-এর প্লেট ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। স্বকর্ণে শুনেছিলাম বছর পাঁচেকের একটা মেয়ে “সোনার হরিণ চাই” গাইতে বসে অন্তরায় বড় উদাস সুরে গেয়েছিল—“তোরা খাবার জিনিস হাতে কিনিস, রাকিস ঘরে ভরে”… আমরা জলখাবার নিয়ে অপ্রস্তুত! পরে আবার অন্য এক বিচারক বললেন, তিনি নাকি শুনেছেন মেয়েটা গাইছিল—“তোরা বাবার জিনিস হাতে কিনিস”। শিশুদের কী সংযম! বিচারকদের বলতে চাইছে— হয় তোরা নিজে হাতে কিনে খা, নয় বাবার জন্যে কিনে আন্। তদ্ভব বাণীর এইভাবেই উদ্ভব হয়।

Dancing girl
ঝুঁটিবাঁধা মেয়েগুলো আইশ্যাডো মুছতে দিত না

হ্যাঁ, আবার রবীন্দ্রনাথেই ফিরে যাই। ওই যে বছর বছর ছোটদের নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল, ক্রমাগত তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকল। ক্লাবে সদস্যসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘণ্টাখানেকের নৃত্যনাট্য না করালে সবাইকে স্টেজে তোলা যায় না। উৎসাহী বাবা-মায়েরা ছোটদের নিয়ে উইক-এন্ডের রিহার্সালে আসছে। “আজ দখিন দুয়ার খোলা”-তে জগাই মাধাইরা এসো হে, এসো হে করে পেন্সিলে আঁকা গোঁফ নাচিয়ে হাসতে হাসতে স্টেজে ঢুকছে। কচি কচি কণ্ঠের আবৃত্তি, গান বেশ লাগছে সকলের। 

কিন্তু, বেশিদিন এ ধারা বজায় রাখা গেল না। একটু বড় হলে ছেলেরা মোটেই নাচতে রাজি হয় না। গিটার হাতে ইংরিজি গান গাইতে চায়। মেরেধরে তো আর রবীন্দ্রচর্চা হয় না। কিছু বাবা-মায়েরও তাই অভিমত। ‘তোতাকাহিনী’র পাঠকরা পাখির ছানার গলায় বাংলা কালচার ঠুসে দেওয়া পছন্দ করেন না।

ভেবেচিন্তে অন্য উপায় স্থির হল। ইচ্ছুক ছেলেমেয়েরা সবাই বড়দের শেখানো রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য বা গীতিনাট্যে অংশ নেবে। বাকিরা পাঁচ মিনিট করে সময় পাবে। যে যা কিছু অন্যত্র শিখেছে, তাই করে দেখাবে। ‘ট্যালেন্ট শো’ আর রবীন্দ্রজয়ন্তী একদিনে।

Rabindranath

বিচিত্রানুষ্ঠান কাকে বলে দেখলাম। শিব্রাম চক্রবর্তীর ‘আবার হাঁসের ডাক’ কিংবা ‘হারমোনিয়ামের কালো রিডগুলিও বাজাইতে জানে’র বিশেষ ক্ষমতা সহযোগে ‘আকাশে চাঁদ ছিল রে’র মতো গানের জলসার মতোই বৈচিত্র্যের ছড়াছড়ি। 

দুপুর বারোটার মধ্যে নির্ধারিত শিল্পীরা এসে উপস্থিত। রবীন্দ্রনাথের শিশুপ্রীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আবেগমথিত ভূমিকা দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা। খেরো খাতা খুলে মাইকে নাম ডাকা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীর মঞ্চে আবির্ভাব। বাজনাবাদ্যি, নয়তো মিউজিকের আবহসংগীতের ট্র্যাক নিয়ে ঝড়ের বেগে বাবা-মা ছুটে যাচ্ছেন। নয়তো এক মিনিট নষ্ট হয়ে যাবে। সময়ের ব্যাপারে নির্মম হওয়া ছাড়া উদ্যোক্তাদের উপায় নেই। তারপর কয়েক ঘণ্টা ধরে স্বতঃস্ফূর্ত নিনাদ। নৃত্য, গীত, আবৃত্তি, বাদ্যবৃন্দ পরিবেশন। কেউ ট্রামপেট বাজাচ্ছে। কেউ স্যাকসোফোন, কেউ টুঁই টুঁই করে হাওয়াইয়ান গিটারের সঙ্গে গাইছে। একদল জোর মহড়া দিয়ে ব্যান্ড তৈরি করেছে। দমাদ্দম ড্রামের সঙ্গে শমের মাথায় ঝাঁই করে কাঁসির বাড়ি। তাদের লিড সিংগার দুর্দান্ত রক মিউজিক গাইছে। মাইকের তার টানতে টানতে স্টেজের এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো সতত-সঞ্চরমান। অথচ এই ছেলেটাকে আগের বছর “আমার মা না হয়ে তুমি, আর কারো মা হলে” আবৃত্তি শেখাতে গিয়ে ওর মা নাস্তানাবুদ। তবে কি, ব্যান্ডের দল ‘একলা চলো রে’ বাজিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তীর মান রেখেছে।

রবীন্দ্রজয়ন্তী আর বিচিত্রানুষ্ঠানে ছোট মেয়েরাই দলে দলে যোগ দেয়। যারা নৃত্যনাট্যে ঢুকে পড়ে, তারা ছাড়া অন্য মেয়েরা ট্যাপ ড্যান্স, ব্যালে, বেহালা, বাঁশি, পিয়ানো আর গানে সুরের সুরধ্বনি বইয়ে দেয়।

কেউ ট্রামপেট বাজাচ্ছে। কেউ স্যাকসোফোন, কেউ টুঁই টুঁই করে হাওয়াইয়ান গিটারের সঙ্গে গাইছে। একদল জোর মহড়া দিয়ে ব্যান্ড তৈরি করেছে। দমাদ্দম ড্রামের সঙ্গে শমের মাথায় ঝাঁই করে কাঁসির বাড়ি। তাদের লিড সিংগার দুর্দান্ত রক মিউজিক গাইছে। মাইকের তার টানতে টানতে স্টেজের এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো সতত-সঞ্চরমান। অথচ এই ছেলেটাকে আগের বছর “আমার মা না হয়ে তুমি, আর কারো মা হলে” আবৃত্তি শেখাতে গিয়ে ওর মা নাস্তানাবুদ। তবে কি, ব্যান্ডের দল ‘একলা চলো রে’ বাজিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তীর মান রেখেছে। 

কিন্তু একটানা কোনও ধারা বেশিদিন বজায় থাকে না। ব্রেক ড্যান্সের মহিমাও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এল। দিকে দিকে ভারতীয় নাচ, গানের স্কুল খুলে গেছে। সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা চমৎকার সব রাবীন্দ্রিক অনুষ্ঠান করতে লাগল। একক ও সম্মেলক রবীন্দ্রসংগীত, বেহালা, বাঁশি, ক্ল্যারিনেটে রবীন্দ্রসংগীতের সুর বাজিয়ে, গানের সঙ্গে তবলায় দাদরা, কাহারবা, ঝাঁপতাল বাজিয়ে ছোটরাই আসর জমিয়ে তুলল। তাদের অনুষ্ঠান শুধু ক্লাবের রবীন্দ্রজয়ন্তীতেই সীমাবদ্ধ থাকল না। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও শিক্ষিকা বনানী ঘোষের গানের স্কুল ‘অন্তরা’র উদ্যোগে নিউজার্সিতে যখন পর পর দু’বছর “রবীন্দ্রমেলা” আয়োজিত হয়েছিল, তখন নাচ, গান ছাড়া ও বাঙালি কিশোর-কিশোরীরা নিজেরা স্ক্রিপ্ট লিখে রবীন্দ্র-বিষয়ক গীতিআলেখ্য মঞ্চস্থ করেছিল। নিউইয়র্কে রবীন্দ্রনাথের একশো পঁচিশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ‘টেগোর সোসাইটি অফ নিউইয়র্ক’ আর ‘বঙ্গ সংস্কৃতি সংঘ’ যৌথভাবে যে উৎসব করেছিল, সেখানে আমাদের ‘কল্লোল ক্লাব অফ নিউজার্সি’ থেকে মেয়েরা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ করেছিল। অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত ওদের নিজে হাতে পুরস্কার দিয়েছিলেন। বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন। 

boy playing guiter
কেউ টুঁই টুঁই করে হাওয়াইয়ান গিটারের সঙ্গে গাইছে

আজও রবীন্দ্রজয়ন্তীর বিচিত্রানুষ্ঠান হয়ে চলেছে। একদল স্কুল শেষ করে কলেজে চলে যাচ্ছে। অন্য দল ক্লাবে ভর্তি হচ্ছে। শিশু-শিল্পীদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক অনুষ্ঠানের কথা প্রসঙ্গেই একটি অভিনব অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে। 

বছর কয়েক আগের কথা। ফোনে এক ভদ্রলোক যোগাযোগ করলেন। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে তাঁর পাঁচ বছরের ছেলে কবিতা বলবে। নাম, ধাম, জেনে নিলাম। আবৃত্তির জন্যে বরাদ্দ পাঁচ মিনিট সময়ের কথাও জানিয়ে দিলাম। প্রোগ্রাম পরিচালিকা শুনে বলল—ওদের সময়মতো আসতে হবে। ঠিক আছে, আমি যোগাযোগ করে নিচ্ছি। 

রবীন্দ্রজয়ন্তীর দুপুরে তার সঙ্গে দেখা হল। রোগা, শ্যামলাবরণ ছেলে। চোখ দুটি ভাবালু। নাম—মহারাজ পাল। কবিতার নাম ‘সোনার তরী’। সর্বনাশ! মে মাসের দুপুরে হাতে পাঁচ মিনিট সময় পেয়েছে। ধান কাটিতে কাটিতে তো বর্ষা পার করে দেবে। মহারাজের বাবাকে বললাম—“অত বড় কবিতা বেছে দিলেন! এত সময় তো দেওয়া মুশকিল!”

অভয় দিয়ে তিনি বললেন—“সবটা বলবে না। দেখুন না, এক্ষুনি ভুলে যাবে।”

কী অপূর্ব আশ্বাস! আমরাও সেই ভরসায় ছোট্ট চোস্ত্ আর কারুকার্য করা পাঞ্জাবি গায়ে বালক মহারাজকে সভায় বসিয়ে দিলাম। সে প্রথমেই স্টেজের পাশে সাজানো রবীন্দ্রনাথের ছবিকে ভক্তিভরে নমস্কার করল। তারপর কচি কণ্ঠে “গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা…। নাহি ভরসা”—পর্যন্ত বলে কিয়ৎক্ষণ নীরবতা। আবার রবীন্দ্রনাথের ছবিকে নমস্কার এবং “গগনে গরজে মেঘ…।” নাহি ভরসার পর তার মৌনব্রত দেখে তার বাবার প্রমট “রাশি রাশি ভারা ভারা”। তখন মহারাজা কলকণ্ঠে “ধান কাতা হোলো সারা” এবং সুদীর্ঘ নীরবতা। বাবার তাড়না, দর্শকদের নির্মল হাসি এবং সহযোগিতা। সে রবীন্দ্রজয়ন্তী ভুলব না। মহারাজের উতোর আর দর্শকদের চাপান। মহারাজ বলছে—“এককানি ছোতো খেত আমি একেলা”। বলেই দর্শকদের সুযোগ দিতে চুপ করে যাচ্ছে। তাঁরা সমস্বরে ক্যাচ লুফে নিয়ে—“চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।” হঠাৎ মহারাজ আপন মনে—“বাকা জল, আঁকা জল কইছে খেলা…। গান গেয়ে গান গেয়ে কইছে খেলা…।” বড় করতালি সহযোগে মহারাজ মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। বাবা সগর্বে বললেন—“বলেছিলাম না, সবটা বলতে পারবে না?”

Little Boy reading
আবার রবীন্দ্রনাথের ছবিকে নমস্কার এবং “গগনে গরজে মেঘ...।”

এই সব শিশু আর শিশু ভোলানাথদের নিয়েই আমাদের রবীন্দ্র জন্মোৎসবের আয়োজন। ট্যালেন্ট শো-তে কয়েকজন অন্য গান, কবিতাও শোনায়। কিন্তু প্রথম পুরস্কার পাওয়া দু’বছরের মেয়েটি “কল্লোলের” দুর্গাপুজোর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নির্ভুল বাংলা উচ্চারণে ‘পূজার সাজ’ আবৃত্তি করে আমাদের নস্ট্যালজিয়া ফিরিয়ে দেয়। হাজার বারোশো বাঙালি দর্শক ফিরে যায় সেই ক্লাস থ্রি-ফোর-এর বাংলা টিচারের ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের ‘মধু, বিধু দুই ভাই’-এর কবিতায়। এখানে যথাসাধ্য অভিব্যক্তি সহ ছোট মেয়েটি আবৃত্তি করে যায়—

“মা শুনি কহেন আসি, লাজে অশ্রুজলে ভাসি
কপালে করিয়া করাঘাত,
হই দুঃখী হই দীন, কাহারো রাখি না ঋণ
কারো কাছে পাতি নাই হাত। 
তুমি আমাদেরই ছেলে, ভিক্ষা লয়ে অবহেলে
অহংকার করো ধেয়ে ধেয়ে!
ছেঁড়া ধুতি আপনার ঢের বেশী দাম তার
ভিক্ষা করা সাটিনের চেয়ে। 
আয় বিধু, আয় বুকে
চুমো খাই চাঁদ মুখে
তোর সাজ সবচেয়ে ভালো।
দরিদ্র ছেলের দেহে, দরিদ্র বাপের স্নেহে
ছিটের জামাটি করে আলো।”

দ্বিতীয় প্রজন্মের সঙ্গে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির সাধ্যমতো পরিচয় ঘটাতে আমেরিকার নানা শহরে এভাবেই অনুষ্ঠানসূচীর আয়োজন করা হয়। আমাদের নিউজার্সির ‘কল্লোল’ ক্লাবের বহু পুরনো ও সাম্প্রতিক রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে, এমন তিনজনের ছবি; লেখার সঙ্গে পাঠালাম। ১৯৭৬ সালের “বসন্ত উৎসবে” শ্রীময়ী মুখার্জি। এ বছরের অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছে রূপকথা দত্ত। “পাগলা হাওয়া বাদল দিনে” গেয়ে শুনিয়েছে অহর্ষি হালদার। 

শিশুদের আবৃত্তির জন্য অধিকাংশ মানুষ রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’ আর ‘শিশু ভোলানাথ’-এর শরণ নিয়েছেন। কিন্তু মহারাজ পাল? বাল্যকালে তার রাশি রাশি ভারা ভারা, ধান কাটা সারা হয়ে গেল। আক্ষেপ হয়, তার একটা ছবি তুলে রাখা হয়নি। পাঁচ বছরের শিশুর সেই একই লাইনের আবৃত্তি, পুনরাবৃত্তি সহ অসমাপ্ত ‘সোনার তরী’ আর দর্শকদের সহর্ষ হাততালি আজও মনে পড়ে।

ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Facebook, Pixabay, Clipart library

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *