আগের পর্বের লিংক: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬]
ভান্তু ঘোষকে প্রথম দেখি, তখন আমি ক্লাস সেভেন কি এইট-এর ছাত্র৷ সেটা মনে রাখবার মতো ঘটনা বটে!
বন্ধুরা বলল, ভান্তু ঘোষের বাড়ি যেতে হবে৷ কারণ? খোকন বলল, সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারলে ভালো চাঁদা পাওয়া যাবে৷ তুই কথা বলবি৷ আমরা সঙ্গে আছি৷ আমরাও বলব৷ খোকন আমাকে বলে দিয়েছিল, ওঁর ভালো নাম আশুতোষ ঘোষ৷ মনে রাখবি, আশুতোষ ঘোষ৷ মণীশ ঘোষ বলেছে ও স্যারকে বলে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবে৷ ভালো নামটা মণীশই বলল৷
ভান্তু ঘোষ নামেই তাঁকে এলাকা চেনে৷ পোশাকি নাম ঘনিষ্ঠদের বাইরে কেউ জানত বলে মনে হয় না৷ নেতা হলেও তাঁর সঙ্গে এলাকার সরাসরি যোগ ছিল না৷ বিশেষ করে, আমাদের, রিফিউজি পাড়ার বাসিন্দাদের কখনও কোনও উপকার করেছেন বলে মনে পড়ে না৷ বাড়ির পোর্টিকোয় গাড়িতে চেপে জানালার কাঁচ তুলে বেরিয়ে গেলে লোকে চেনে কীভাবে? বস্তির লোকজন দুটো কারণে ওঁর নাম করত৷ এক, তিনি মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের স্নেহের মন্ত্রী৷ পাড়ায় যাঁরা কংগ্রেস রাজনীতি করতেন, মূলত তাঁরাই ওঁর কথা বলতেন অবরে সবরে৷ দুই, প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সপ্তাহদুয়েকের মধ্যে ফাটাফাটি একটা বিজয়া সম্মিলন করতেন৷ ফুটপাতের ওপর তাঁর বাড়ির খোলা ঝুলবারান্দায় হত জলসা৷ বাংলার সেসময়ের প্রায় সব গায়ক-গায়িকা আসতেন৷ বস্তির বাসিন্দারা সুন্দরীমোহন অ্যাভেনিউ-এর (সাবেক সিআইটি রোড) চওড়া ডিভাইডারে কাগজ বা কাপড় পেতে বসে গান শুনত অনেক রাত পর্যন্ত৷ শিল্পীদের দেখার সুযোগ ছিল না৷ তাতে কী, মাগনার জলসায় টাটকা গান শোনা ভাগ্যের ব্যাপার!

ওইরকম মন্ত্রীমানুষ, ওইরকম বড়লোক, বাড়ির গেটে ডাবল দারোয়ান, কয়েক পা এগোলে ডাবল অ্যালসেশিয়ান বা ডোবারম্যান, চারদিক টিপটপ, বেজায় বড়লোকি গন্ধমাখা, বন্ধুরা আমাকে সামনে ঠেলে দিয়েছিল৷ সরস্বতী পুজোর চাঁদা নিতে গিয়েছি৷ আমাদের ক্লাব ‘পূর্ব কলিকাতা ছাত্র সংসদ’৷ সত্যি বলছি, ‘সংসদ’-এর মানে আমরা কেউ তখন জানি না৷ কোনও দাদা হয়তো শব্দটা বলেছিল, আমাদের মনে ধরেছিল৷ কত না-জানা, না-বোঝা নিয়ে জীবনটা চালিয়ে দিয়েছি৷ ছোটবেলাটা সেই অজ্ঞতা-চর্চার হাতেখড়িবেলা৷ ঢিপঢিপ বুকে তাঁর ঘরে ঢুকেছিলাম৷ ঘর মানে বিশাল হলঘর৷ বিরাট টেবিল ঘিরে চকচকে সব লোকজন৷ তাঁরা কেউ আমাদের চেনা নন৷ মণীশকে কাছেপিঠে দেখা গেল না৷ এই টেবিলকে যে সেক্রেটারিয়েট টেবিল বলে তা আমাদের জানবার কথা নয়৷ দরজা থেকে দূরে টেবিলের পুবদিকের মাথায় দেয়াল ঘেঁষে সিংহাসনের মতো রাশভারি চেয়ারে বসে ছিলেন তিনি৷ বললেন, এদিকে এস৷ তোমরা পূর্ব কলিকাতা ছাত্র সংসদ? মণীশ আমাকে বলেছে তোমাদের কথা৷ সরস্বতী পুজো কর তোমরা? স্কুলে পড়ো? সেখানে পুজো হয়? বাড়িতে? আবার একটা? তিনি মিটিমিটি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করছিলেন৷ ঘাড় নেড়ে জবাব দিচ্ছিলাম৷ শেষ প্রশ্নের জবাব ছিল না৷ এবার জিজ্ঞেস করলেন, পূর্ব কলিকাতা ছাত্র সংসদ৷ ‘সংসদ’ মানে কী? আমরা বোবা৷ তিনি হাসলেন নিঃশব্দে৷ বললেন, তোমাদের চাঁদা কত? আমি বলি, আপনি যা দেবেন৷ তিনি বলেন, তোমরা কিছু চাইবে না? খোকন বলে ওঠে, দশ টাকা৷ বড় ঠাকুর হবে৷ তিনি খোকনকে দেখলেন৷ বললেন, তাহলে তো প্যান্ডেলও বড় করতে হবে৷ বেশি আলো লাগাতে হবে৷ অনেক মানুষ আসবে৷ তাদের প্রসাদ দিতে হবে৷ খরচও বড় হবে৷ তাই তো? বলতে বলতে তিনি সিল্কের পাঞ্জাবির বুকপকেট থেকে কিছু টাকা বের করে ডানহাতের দু আঙুলে একটা দু-টাকার নোট ধরে বলেন, চাঁদার বিল এনেছ? লেখো৷ দু টাকা৷ টেবিলের ওপর নোটটা চাপা দিয়ে রাখলেন তিনি৷ এখানে বলে রাখি, এখনকার দু-টাকার মতো ফেকলু ছিল না তখনকার দু-টাকা৷ তবু! এত ধনীমানুষ! এত কথা বলার পর দু-টাকা! আমরা কিছু বলিনি৷ বিলের পাতায় আমি লিখলাম BHANTU GHOSH৷ ছিঁড়ে তাঁর হাতে দিলাম৷ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ বললেন, আমার নাম আশুতোষ ঘোষ৷ কখন ভুলে গেছি৷ আবার লিখি৷ ASHUTOSH GOSH৷ বিল হাতে নিয়ে দেখে গম্ভীর মুখে বললেন, আমি গোস না, ঘোষ৷ স্কুলে যাও? পড়তে বসো? অ্যাই কে আছ! ওদের বের করে দাও৷ রেডগার্ড এখন ছাড়া আছে৷ চ্যাঁচাবি না৷ দৌড়বি না৷ হ্যাঁ, আপনার ফাইলটা এখন কার কাছে আছে?…
আমরা দু টাকা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম৷ রেডগার্ড মানে বুঝেছিলাম, কুকুরের দল৷ খোকন বলেছিল, তোকে আমি বারবার ভালো নামটা মনে করিয়ে দিয়েছি৷ তবু ভুল করলি৷ তার ওপর ‘ঘোষ’ বানানটা ভুল লিখলি৷ তোকে সামনে রাখাই ভুল হয়েছিল৷
যেন মাত্র দু-টাকা চাঁদা পাওয়াটা আমার দোষে৷ এটা ঠিক যে, ভালো নামটা ভুলে গিয়েছি৷ ‘ঘোষ’ বানান ভুল লিখেছি৷ কিন্তু তার আগেই তো তিনি দু-টাকার নোটটা বেছে নিয়েছেন৷ আলাদা করে রেখেছেন৷ আমরা যে ‘সংসদ’ মানে জানি না, সেটা কি আমার একার দোষ?
আমাদের ক্লাব ‘পূর্ব কলিকাতা ছাত্র সংসদ’৷ সত্যি বলছি, ‘সংসদ’-এর মানে আমরা কেউ তখন জানি না৷ কোনও দাদা হয়তো শব্দটা বলেছিল, আমাদের মনে ধরেছিল৷ কত না-জানা, না-বোঝা নিয়ে জীবনটা চালিয়ে দিয়েছি৷ ছোটবেলাটা সেই অজ্ঞতা-চর্চার হাতেখড়িবেলা৷ ঢিপঢিপ বুকে তাঁর ঘরে ঢুকেছিলাম৷ ঘর মানে বিশাল হলঘর৷ বিরাট টেবিল ঘিরে চকচকে সব লোকজন৷ তাঁরা কেউ আমাদের চেনা নন৷ মণীশকে কাছেপিঠে দেখা গেল না৷ এই টেবিলকে যে সেক্রেটারিয়েট টেবিল বলে তা আমাদের জানবার কথা নয়৷
ভান্তু ঘোষের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বন্ধুরা ঝগড়া করেছি৷ আমার কিন্তু লোকটাকে তত খারাপ লাগেনি, কেউ কেউ যেমন বলে থাকে৷ কথা বলেছেন নরম গলায়, মিষ্টি হেসে৷ এটাও ঠিক যে আরও একটা সরস্বতী পুজো করার দরকার কী? স্কুলে পুজো, বাড়িতে পুজো৷ যদিও সব রিফিউজি-ঘরে পুজো হয় না, বন্ধুদের কারও না কারও ঘরে তো হয়৷ তিনি ভালো কথা বলেছেন৷ ‘ঘোষ’ বানান ভুল হবে কেন? তিনি বকাঝকা করেননি৷ আমার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন৷ আমাদের ভালো চান বলেই বলেছেন৷ মোট কথা ভান্তু ঘোষ, স্যরি আশুতোষ ঘোষকে আমার বেশ লেগেছে৷ বড়োলোকরা একটু মেজাজি হয়৷ কুকুরদের এড়িয়ে আমাদের বেরিয়ে আসার ব্যবস্থাও করে দিলেন৷ হ্যাঁ, একটা কথা, ‘রেডগার্ড’ বলার মধ্যে একটা ঘৃণা আছে৷ কমিউনিস্টদের ঘৃণা করেন৷ রাজনীতির লোকেরা এরকম করে থাকে৷ তবু, লোকটা তেমন মন্দ নয়৷ মাগনায় বিজয়া সম্মিলনে হেমন্ত, শ্যামল, সন্ধ্যা, মানবেন্দ্র, তরুণ, উৎপলা, ইলা বসু, সতীনাথের পুজোর নতুন গান, সিনেমার গান শোনার সুযোগ আর কে করে দেয় ভাই, এই গরিব তল্লাটে?

মুখে যতই বলি, ‘রেডগার্ড’ ব্যাপারটা ঠিক হজম হয়নি৷ রিফিউজি-জাতকরা অতি অল্প বয়সেই কংগ্রেস-কমিউনিস্ট বিবাদ, নেহরু-নেতাজি বিবাদ একরকম বুঝে যায়৷ এবং বুঝ-না-বুঝ কমিউনিস্ট ও নেতাজির সমর্থক হয়ে পড়ে৷
***
দেখা হওয়ার মতো পরিস্থিতি না হলেও ভান্তু ওরফে আশুতোষ ওরফে আশু ঘোষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের খবর একটা সময় প্রায় রোজ ছেপেছে খবরের কাগজ। তখন আমি স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি৷ যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাঙা, মধ্যরাতে প্রফুল্ল ঘোষের সরকার তৈরি, নিজের দল আইএনডিএফ তৈরি ইত্যাদি ঘটনায় আশুতোষ ঘোষের ‘টেবিল পলিটিকস’-এর কথা বহু আলোচিত হয়েছে৷ সে-প্রসঙ্গ অন্য পর্বে বলা যাবে৷
এখানে বলব ভান্তুবাবুর নব-দুর্গা পুজোর মারকাটারি আয়োজনের কথা৷ সেই ভান্তুবাবু, যিনি আমাদের ‘আবার একটা সরস্বতী পুজো’ করার প্রয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন৷ ভান্তুবাবুর বাড়ির উলটোদিকে, পার্ক সার্কাসমুখী সুন্দরীমোহন এভেনিউয়ের বাঁদিকে একটা খালি জমি ছিল৷ এখানে বিশপল্লী দুর্গোৎসব কমিটির পুজো হত৷ এই জমিতে নব-দুর্গা, অর্থাৎ নয় রূপে দুর্গাপ্রতিমার পুজো তথা মহোৎসবের আসর বসান ভান্তু ঘোষ৷ বিশপল্লীর পুজো সরে যায় গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারের পাশে কর্পোরেশন স্কুলের মাঠে৷ ভান্তু ঘোষের পুজো সম্ভবত কলকাতার প্রথম মেগাপুজো৷ পার্ক সার্কাস, কলেজ স্কোয়ার, ফায়ার ব্রিগেডের পুজোর কথা মাথায় রেখেই বলছি৷ ঠাকুর দেখতে জনপ্লাবন৷ মহা মহা ভিআইপির আগমন৷ বাঁশ দিয়ে রাস্তা ঘিরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ৷ পিছিয়ে দেওয়া বিসর্জন৷ সাম্প্রতিক বাংলার পুজো-রেনেসাঁয় যা যা উপসর্গ দেখা যায় সবই হাজির ছিল সেদিন৷ আজ থেকে কমবেশি পঞ্চাশ বছর আগে৷ সালটা মনে নেই৷ প্রতিমাশিল্পী ছিলেন তারাপদ বসু, যত দূর মনে পড়ে৷ সে-সময় বেশ কয়েকবার দেখেছি ভান্তুবাবুকে বাড়ির ফটকে৷ হয়তো প্রভাবশালীদের স্বাগত জানাতে হাজির থাকতেন৷
সেই খালি জমিতে একসময় ব্যাডমিন্টনের কোর্ট বানানো হল৷ চট দিয়ে চারদিক ঢাকা হল৷ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দীপা চট্টোপাধ্যায় এবং আরও কেউ কেউ খেলতে এলেন৷ কিছুদিন৷ তারপর সেই জমি ট্রাকের গ্যারাজ৷ বিশাল বিশাল পাঞ্জাব ট্রাক, দশটা বিশটা কি আরও বেশি৷
গত এপ্রিলে (২০২২) কাঠপোড়া দুপুরে ওই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে, জমিটা পাঁচিল-ঘেরা৷ পাঁচিলের গায়ে বিরাট বট কিংবা অশথ৷ শেকড়ের গায়ে হাইকোর্টের নোটিশ৷ সম্পত্তি মামলাধীন৷
কখনও কখনও ‘আবার একটা পুজো’র দরকার হয়৷ বাংলায় পুজোকে টাঁকশাল বানানোর কৌশলের সেটা আদিযুগ৷
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৬ জানুয়ারি ২০২৩
ছবি সৌজন্য: লেখক
মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন্যাস। বই আখ্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।