আগের পর্বের লিংক: [১] [২] [৩]
ভূত-পেত্নির ডোবার পাশে ঝুনুদাদের ফুলবাড়ি৷ কিন্তু বালক সেটা জানত না৷ জানত, এক নম্বর আর দু’ নম্বর কবরস্থানের মাঝখান দিয়ে যে পথ দূরে কোথাও গেছে, যে পথে ক্বচিৎ লোকজন দেখা যায়, বিকেলের পরে একজনকেও নয়, সেখানে বিরাট যে বটগাছটা আছে, তাতে ব্রহ্মদত্যি আছে, গাছের টংয়ে মাথা, জ্বলন্ত উনুনের মতো চোখ, রাস্তার এপার ওপার লোমওলা পা৷ এবার জানল, দুয়ারে ভূত৷
নয়নদার বাড়ি থেকে হেডফোনে গান শুনে বড়ো পুকুরের পাড় দিয়ে আসবার সময় বালক দেখে, ডোবার ওপর আলো জ্বলছে৷ ভালো করে বোঝবার আগেই মিলিয়ে গেল৷ আবার একটু পরেই জ্বলে উঠল ডোবার অন্য পাশে৷ সেটাও মিলিয়ে গেল৷ তখন সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ৷ পুকুরের ওপারে হারুদের পাড়ায় টিমটিমে আলো৷ এপারে ঘোঙা অন্ধকার৷ বালক ছুটপায়ে বংশীদাদের কুপি-জ্বলা উঠোনে পৌঁছে বুঝতে পারে সে ঘামছে৷ বুক ঢিব ঢিব করছে৷ মনে পড়ে, বটাদা একবার বলেছিল, ‘সন্ধ্যার পর ডোবার কাছে মোটে যাইবি না৷ মুতে পাইলেও যাইবি না৷ ভূতে ধরব৷’ ঝুনুদাকে জিজ্ঞেস করেছিল বালক৷ ঝুনুদা হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ওইটা তেনাগো আদিনিবাস৷ কুনঅ কুনঅ রাইতে বাইদ্যযন্ত্র লইয়া গানে বসেন তেনারা৷ ঝুনুদাকে হাসতে দেখে বটাদাকে সে লঘু করে দিয়েছিল৷’
নিজের চোখে আলো দেখার বেশ কয়েকদিন পর এক বিকেলে দিদিমা মনসাপালা শুনতে যাবার কথা বললে বালক জিজ্ঞেস করল, ডোবাটা কি ভূতের বাসা? পাকা পেয়ারার গন্ধ নিয়ে বর্ষার বাতাস তখন প্রথম পোয়াতির মতো ভারি হয়ে আছে৷ ‘পোয়াতি’ কথাটা দিদিমার মুখে শোনা৷ রানিবউদিকে বলেছিল৷ হ্যারিকেনের চিমনি থেকে ঘষে ঘষে যখন কেরোসিনের কালি মোছা হয়, পায়ে পায়ে বিকেল আসে৷ আলতো হাতে সন্তর্পণে কাজটা করছিলেন কিরণবালা৷ চিমনি ভাঙলে ঘোর অন্ধকার৷ বললেন,
‘ভয় পাইছস? কিছু দেখছস? কেউ কইছে? শোন, একটা মন্ত্র শিখাই৷ মনে মনে জপবি৷ ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি/রাম লক্ষ্মণ সাথে আছে করবি আমার কী? তার আগে নিজের বুকে ছ্যাপ দিবি তিনবার৷ আর, মনে রাখবি রিফুজিগো থেইকা চরম ভূত জগৎসংসারে নাই৷ শোন, মাতৃ ভাণ্ডার থেইকা শলাই আনতে হইব৷ ঘোড়ামার্কা৷ তর দাদু আনছে টেক্কামার্কা দুইখান৷ ঘোড়ামার্কার কাঠি লম্বা৷ হ্যারিকেন জ্বালাইতে সুবিধা৷ তর দাদুরে বুঝাইয়া পারি না৷ মাতৃ ভাণ্ডারে পাবি৷’

নয়নদা একটা হেডফোন বানিয়েছে৷ বাঁশ পুঁতে, তার বেঁধে, সেখান থেকে একটা তার ঝুলিয়ে জানালা দিয়ে ঘরে এনে হেডফোনে লাগিয়েছে৷ এরিয়াল না কী যেন বলে৷ হেডফোন নিজেই বানিয়েছে পার্ক সার্কাসের ‘নুরমহল’ সিনেমার পাশে এক ওমরমিস্ত্রির দোকান থেকে যন্ত্রপাতি এনে৷ কানে দিলে গান বাজে, কথা আসে৷ নয়নদা একদিন বিজ্ঞানী হবে৷ ওর মা বলেন৷ আকাশে যে গান বা কথা বা খবর বা খেলা ভেসে বেড়ায়, সব ধরে ফেলে ওই সরু তার৷ তার বেয়ে কানে আসে৷ শুনবি? শোন৷
সরু বাঁকানো টিনের পাতের দু-দিকে গোল গোল চাকতি লাগানো৷ সেটা কানের ওপর বসাতে হয়৷ চুপ করে শোন৷ গান হচ্ছে? হ্যাঁ৷ নড়াচড়া করিস না৷ কিছুক্ষণ শুনেছিল বালক৷ নয়নদার মা তাকে পছন্দ করেন না মোটে৷
‘রিফিউজিদের ঘরে ঢুকতে দিবি না৷ ওরা সব ক-টা চোর৷ খুন করতেও পারে৷ ওরা হাফ মুসলমান৷ মুসলমানদের সঙ্গে ঘর করেছে একশো বছর৷ হ্যাজাপচা জায়গার বাঙাল, আমাদের ঘরে আসে কোন সাহসে? তিনি বালকের কান থেকে হেডফোন খুলে নেন৷ বলেন, এবার যা৷ নয়ন পড়বে৷ ওকে বড়ো হতে হবে৷ বিজ্ঞানী হতে হবে৷ তোদের আর কী! চুরিচামারি করবি৷ সরকারের ভিক্ষে খাবি৷ ছোটোমোটো কাজ করবি৷ যা৷’
ঘরে ফেরার পথে বালক দেখেছিল সেই আলো৷ তখন দিদিমাকে কিছু বলেনি৷ দিদিমা বকতে পারে৷ নয়নদের বাড়ি যাওয়ায় মানা আছে তারও৷
আকাশে গান ভাসে, কথা ভাসে৷ ভেসে ভেসে তার বেয়ে নয়নদার ঘরে আসে৷ ডোবার ওপর আলো ভাসে৷ নিভে যায়৷ আবার ভাসে৷ সবই কি ভূতেদের কাণ্ড! বালক তখনও রেডিয়ো চেনে না, জানে না৷ পুকুর আর ডোবার মাঝখানে একফালি যে জমি আছে, সেটা তার প্রিয় জায়গা৷ দাড়িয়াবান্ধা কোর্ট আছে৷ বিকেলে বড়োরা খেলে৷ খুব ছুটোছুটি হয়৷ খালি গাগুলো ঘামে মাটিতে কাদা-কাদা হয়ে যায়৷ কানাইদা আর নারানদা দুই ক্যাপ্টেন দল করে৷ বালক চান্স পায় না৷ ছোট তো৷
জায়গাটা আরও একটা কারণে প্রিয়৷ ডোবার ডানদিকে কচুবন, কুলেখাড়ার ঝোপ আর করমচা গাছের মাঝখান দিয়ে সরু একটা পথ আছে ঝুনুদাদের ফুলবাড়ি যাবার৷ এক দৌড়ে এসে সে একসের-আধসের রজনীগন্ধা দোপাটি কি টগর গামছা বেঁধে নিয়ে যায়৷ দিদিমার মালা গাঁথা হয়ে গেলে এই পথ দিয়েই পৌঁছে দেয়৷ তাড়া থাকে এই নেয়া ও দেয়ায়৷ বর্ষায় পুকুর-ডোবা কানায় কানায় হলে এই পথে যাওয়া বিপদ৷৷ রংকলের মাঠ হয়ে ঘুরতে হয়৷
নয়নদা একটা হেডফোন বানিয়েছে৷ বাঁশ পুঁতে, তার বেঁধে, সেখান থেকে একটা তার ঝুলিয়ে জানালা দিয়ে ঘরে এনে হেডফোনে লাগিয়েছে৷ এরিয়াল না কী যেন বলে৷ হেডফোন নিজেই বানিয়েছে পার্ক সার্কাসের ‘নুরমহল’ সিনেমার পাশে এক ওমরমিস্ত্রির দোকান থেকে যন্ত্রপাতি এনে৷ কানে দিলে গান বাজে, কথা আসে৷ নয়নদা একদিন বিজ্ঞানী হবে৷
থপ্ শব্দ হল৷ পাকা পেয়ারা পড়ল উঠোনে৷ পড়েই থেঁতলে গেল৷ কিরণবালা বললেন,
‘সারাদিন পেয়ারা পড়ে৷ পইড়া পইড়া নষ্ট হয়৷ পাড়নের কেউ নাই৷ খাওনেরও নাই৷ পাড়ার পোলাপানগো গাছের কাছে আইতে দেয় না দারোগা৷ লাঠি লইয়া মারতে যায়৷ কীরকম লোক বুঝি না! নির্মলরে কমু কয়টা পাইড়া দিতে৷ বাড়িউলি অরে কিছু কইব না৷ তাগো ঘরের কাজকাম কইরা দেয় তো৷ কৃষ্ণদাস, আইজ রাইতে মনসাপালা হইব৷ বামুনপাড়া বাজারে৷ কৃষ্ণার মায়ে কইছে৷ তরে লইয়া যামু৷ ফিরতে রাইত হইব৷ তর দাদুর ভাত-তরকারি বাইড়া চাপা দিয়া রাইখা যামু৷’
তখনই সে ডোবার আলোর কথা বলেছিল৷ বলেছিল, রংকলের উলটাদিকের গলি দিয়া যামু৷ গলিটা অন্ধকার৷ শিবতলার মৈত্রী সঙ্ঘের রাস্তা দিয়া গেলে আলো আছে৷
মনসাপালা কোনটা? বেহুলা-লখিন্দর? রয়ানি গান? ঝুনুদাগো বাড়িতে কয় রাত শুনছি৷ মনসার চক্রান্তে সাপের কামড়ে মারা গেল লখিন্দর৷ চক্রান্ত মানে কী, দিদিমা? কলার মান্দাস ভাসে গাঙুরের জলে৷ মান্দাস মানে ভেলা৷ গাঙুর একটা নদী৷
সনকা কান্দিয়া বলে, আ লো অভাগিনী
এ তিন ভুবনে ইহা কোথাও না শুনি
শিশু যুবা অবলা যাহার পতি মরে
বিধবা হইয়া সে থাকে নিজ ঘরে৷
বিধবা কী, দিদিমা? পরে কমু৷ বাংলার নদী নেতা ধোপানির ঘাটে যায়৷ সেই ঘাটে স্বর্গের দেবদেবীদের বস্ত্র কাচা হয়৷ বস্ত্র কী?
ত্রিবেণীর গাঙ্গে নেত
দেবতার বস্ত্র যত
নিত্য কাচে সুবর্ণের পাটে৷
দিদিমা, দুই নম্বর কবরস্থানের পাশে ধোপার মাঠ আছে৷ বিরাট৷ শান্তির মা ওইখানে কাপড় কাচে৷ অনেকে কাচে৷ সবাই ধোপা আর ধোপানি৷ পাটে আছড়ানোর শব্দ৷ আর দড়িতে দড়িতে কাপড়জামা হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে৷

মাথায় সোনার পাট
নিত্য আইসে সেই ঘাট
কাচিবারে দেবতা বসন
দুষ্ট পুত্রে পাকে
তাহারে মারিয়া রাখে
পুনরপি জিয়ায় জীবন৷
মানে কী? নেতা ধোপানির পোলায় খুব দুষ্টামি করে৷ তারে আছাড় দিয়া মাইরা ফেলে নেতা৷ সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরনের সময় মরা পোলারে জাগায়৷ কী কও? জাদু জানে? ভূতের মন্ত্র? আকাশে গান ভাসে, কতা ভাসে৷ রয়ানি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত বালক৷ ঘুমজোড়া চোখে টলতে টলতে ঘরে ফিরত দিদিমার হাত ধরে৷
বামুনপাড়া বাজারে মনসাপালা এত আলো এনেছে যে রাতের অন্ধকার অনেক উঁচুতে দূরে আবছা আবছা হয়ে আছে৷ বড়ো ম্যারাপ৷ চারকোণে ডে-লাইট৷ বাজার কমিটির টালিঘরের সামনেও একটা৷ সেই ঘরে সাজগোজ মনসা, হনুমান, বেহুলা, লখিন্দর, চাঁদ সদাগরের৷ শতরঞ্জি-পাতা আসরে একটা কাঠের চেয়ার৷ চেয়ারের একপাশে হারমোনিয়ম-ঢোল-বাঁশি-ভ্যাঁপোঁ ইত্যাদি তুমুল জোরে বাজে৷ মনসার চক্রান্তে হনুমান সাগরে ঢেউ তুলেছে৷ মনসা খালি চক্রান্ত করে? কাজকাম নাই? হনুমান তো লোক ভালো৷ শোনে কেন মনসার কথা? বিশাল বিশাল ঢেউ৷ আকাশসমান৷ আছড়ে পড়ে চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙার ওপর৷ এ ডিঙা বাণিজ্যতরী৷ তরী বোঝাই বাণিজ্যের সওদা৷ অমূল্য সেসব৷ সাগরে ঢেউ, আকাশে তোড়ে বৃষ্টি আর বজ্রপাত৷ ডিঙা বাঁচানো দায়৷ ডিঙার সওদা বাঁচানো দায়৷ মাঝিদের বাঁচানো দায়৷ তবু সদাগর অনড়৷ যায় যাক প্রাণ৷ যে হাতে তিনি শিবের পুজো করেন, সেই হাতে চ্যাংমুড়ি কানিকে পুজো দেবেন না৷
মতিগতি মনসার
ঘা মারিয়া পদের
সাত ডিঙা ডুবাইল জলে৷
কান্দয়ে বাঙাল
হইনু কাঙাল
ভেসে গেল পোস্তের হোলা৷
বিপদ সাগরে
জলের উপরে
ভাসিয়া নিদান বেলা৷
ডুবাইয়া নায়
চাঁদ জল খায়
বিষহরী খলখল হাসে৷
চাঁদ সদাগরের দুর্ভোগ সত্যি সহ্য করা যায় না৷ জল ধাক্কা মারে, ডোবায় ভাসায়, সাপ ছোবল মারতে তায়, ধরবার মতো কিছু নেই, সাঁতরে যাবার উপায় নেই, অনন্ত সাগরজল, পান করবার মতো জল নেই৷ দিদিমা, তোমরাও কি এইভাবে জলে ভাসছিলা কোনও চক্রান্তে? বালক তখনও জানে না, কোনওদিন সে পড়বে শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’:
‘ভাইরে, জীবন তো শুধু একটাই কথা জানে৷ সেটা হল জয়৷ জয়ী হও, তবে মূল্য পাবে৷ হারুয়ার মালা গ্যেঁথ্যে বস্যে বস্যে কান্দে না পৃথিবী৷ ভেবে দেখো, কতো যুগ গেছে, কতো কোটি কোটি লোক হেরে ভেঙে তছনছ হয়্যা গেছে৷ তাদের কথা কি কোউ মনে রাখে? আগুতে তো জয়ী হও৷ তারেপর বড়ো মুখ করে এস্যা বরমাল্য চেয়ো৷ ভাইরে, দেশ তো এখন মনসার পূজারীরা কুক্ষিগত করে নেছে৷ সত্যকার দেশের অন্তর এখন তো খালি বেঁচ্যে আছে আমাদের বুকে৷’
বালক তখন জানে না, একদিন সে দেখবে ব্লাইন্ড অপেরার ‘মনসামঙ্গল’: বেহুলা কাঁদতে কাঁদতে গাঙুড় দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, ভেলায় মৃত স্বামীকে নিয়ে, নদীর দুপার থেকে প্রলোভন ছুঁড়ে দিচ্ছে পুরুষসমাজ, সদ্যবিধবার যুবতীশরীর পাবার জন্য নকশিকাটা একশো প্রলোভন৷ সমাজের ভেতরে থাকা যৌনবিকার গাঙুড়ের দু-পারে দিবালোকে চিৎকার করে৷ পালা সাঙ্গ হলে যে যার ঘরের দিকে যায়৷ রাত অনেক৷ বালক ঘুমিয়ে পড়েনি৷ দিদিমার হাত ধরে হাঁটে৷ কিরণবালা জিজ্ঞেস করেন, কেমন লাগল?
বালক কি বলেছিল, পুজো পাবার এত লোভ কেন? কেন পুজো পেতে এত নির্যাতন? ভূতের ভয়ের চেয়ে ঠাকুরের ভয় বেশি নয় কি?
*ছবি সৌজন্য: Pratidin, Artstation
মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন্যাস। বই আখ্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।
মধুময় একটা সময়কে তুলে ধরছেন। বড্ড বিষাদের। পড়তে ভাল লাগছে। মনসা পালা বাড়তি প্রাপ্তি