ভবানীপ্রসাদকে বলা হল বাজানোর জন্য তিনি পাবেন আধঘণ্টা মাত্র। উনি স্টেজ পেলেন এমন একটা সময়, যখন শ্রোতারা একটা ব্রেক নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একটু হাত পা ছড়াতে হবে, বাইরে গিয়ে চা-কফি খাবেন, সিগারেটে ফুঁ দিতে দিতে পরিচিতজনের সঙ্গে আলাপ করবেন, উদ্দেশ্য- কে কত উঁচুদরের সমঝদার তা অপরকে জানানোর। এ সময়ে সাধারণত অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত শিল্পীকে বসানো হয়,আসরে বাজাতে দেওয়া হয় অনেকটা অনুগ্রহ করে। সঙ্গী ছেলে দুটিই স্টেজে যন্ত্র এনে রাখল, ভবানীপ্রসাদের বসার জায়গা ঠিকমতো সাজিয়ে দিল, মাইকের লোকদের সঙ্গে ভাবসাব করে সাউন্ড চেক করে নিল বারেবারে। পাড়াতে আর নিজেদের অফিসে ফাংশান করিয়ে এ জাতীয় প্রয়োজনীয় খবরদারিতে পাকা ছিল দুটি ছেলেই। ভালোই হল। কারণ এ সবে ভবানীবাবুর মনোযোগ ছিল না। উনি তখন একটা কথাই ভাবছেন, শান্তিমোহনের ঠাট্টার উত্তর কীভাবে দেবেন।
একটি ছেলেমানুষ তবলিয়াকে ওঁর সঙ্গে দেওয়া হয়েছে। তাকে বললেন,
– রিহার্সাল দেওয়ার সময় হল না। দেখে দেখে বাজাবেন,অনেক রকম বদল হবে।
– তালফেরতা? সঙ্গতকার জিজ্ঞেস করল।
ভবানীপ্রসাদ একটু হাসলেন, কিছু বললেন না। হ্যাঁ, বদল তো হবেই। রাগ থেকে রাগে, মুড থেকে মুডে, লয় থেকে লয়ে। এ তো দাদুর আশ্চর্য সৃষ্টি সঙ্কেত রাগ। দাদু বলেছিলেন, ভবানীপ্রসাদের মনে আছে, বিরাট, বিস্তৃত কিছুর আভাস দিতে গেলে তাকে নিয়ম ভেঙে বাইরে আসতেই হবে। সঙ্কেত রাগের চলন শাস্ত্রবদ্ধ রাগের আরোহণ অবরোহণের সীমানার এ পারে ও পারে ঘোরাফেরা করবে। যেন খানিক বাঁধা রাস্তায় চলা, তারপর হোঁচট খেয়ে বেপথে কৌতূহল পরিক্রমা, আবার ফিরে আসা– চলতে থাকা খানিক আয়েসে, আবার কিছু্টা অজানা তাড়নায়। দাদু আরো বলেছিলেন, আধুনিক ছবিতে নির্দিষ্ট কোনও দৃশ্য মেলে না, কারণ শিল্পী জানেন জীবন অনির্দেশ্য চলমানতা এবং দৃশ্যগুলি স্থির বা স্থিত নয়। তাই চেনা বস্তু রূপসীমা ভেঙে আকার পালটাতে পালটাতে চলে। সঙ্গীতে ও সুরের বন্ধনহীন চলা তারই অনুকরণে। অসীম জীবনবিস্তারের যেমন স্পষ্ট রূপ নেই, এই নতুন রাগের চরিত্রও তেমনি অগ্রন্থিত। গ্রন্থনাহীন বলেই অস্পষ্ট, সঙ্কেতনির্ভর এবং রহস্যময়।
ভবানীপ্রসাদ একবার ভাবলেন, একটা ভূমিকা করলে হয়তো শ্রোতারা রাগভাঙা স্বরের ইমেজগুলি অনুসরণ করতে পারবেন। আপাত অসঙ্গতি যে একটা সামগ্রিক ভাবনার সুররূপ হয়ে উঠছে, সেটা বুঝতে তাঁদের সুবিধে হবে। কিন্তু সময় বড় কম! ব্যাখ্যা ছাড়াই বাজিয়ে দেখা যাক, কতটা গ্রহণ করতে পারেন এঁরা। সামনের সারিতে জনা সাতেক লোক এলিয়ে বসে আছেন। বড় ডোনার হবেন। ভবানীপ্রসাদের মনে হল, আগে এঁদের নিয়ে রিপোর্টার মহলে হাসাহাসি চলত। গানবাজনায় এঁদের অধিকার থাকুক না থাকুক আরামের সিটগুলোতে আছে। টানা রাত জাগার মাঝেমাঝে চোখ বুজিয়ে সুরে মগ্ন থাকার ভাণ করা যায়। পেছনের দিকে কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারাই প্রকৃত রসিক হবে, এই ভরসা করে ভবানীপ্রসাদ বাজনা শুরু করলেন।

কাফি-র একটি পরিচিত মুখড়া বাজালেন ঈষৎ অলঙ্কৃত চেহারায়। মাথা নাড়িয়ে সঙ্গতকারকে প্রথম থেকেই তবলা ধরতে বলেছেন। একটা মধুর ক্রীড়াচঞ্চল আবহাওয়া সৃষ্টি হচ্ছে। ভবানীপ্রসাদ কল্পনা করছেন শিশুর বিস্ময়বোধ– জীবনের সঙ্গে ক্রমপরিচয়ের যে রোমাঞ্চ উনি সুরের মাধ্যমে তুলে ধরতে চাইছেন, শ্রোতাদের মনে ধীরে ধীরে তা সঞ্চারিত হচ্ছে। হঠাৎ চলে গেলেন পরদা পালটিয়ে দেশ রাগে, একটু ঠমকযুক্ত চালে। যৌবনের উন্মেষ। যৌবনের উন্মাদনা বাড়ছে। চলে এল তেজি গরবী মালকোষ। শ্রোতারা ভাবলেন, সময় কম। তাই হয়তো রাগমালা বাজাচ্ছেন। কিন্তু তাল লয় বদলে যাচ্ছে ঘন ঘন।ভবানীপ্রসাদ এগোচ্ছেন… দিনরাতের রাগ মিলেমিশে যাচ্ছে, ঋতুর রাগে অন্য স্বর লেগে অন্য ব্যঞ্জনা এসে যাচ্ছে। এক অদ্ভূত বিশৃঙ্খলা কিন্তু একটা অবিচ্ছিন্ন গতি। একটা অবধারিত লক্ষ্যে পৌঁছোনোর নিশ্চিত সম্ভাবনা। পুরো ছবিটা যেন সুরে ফুটিয়ে তুলছেন সেতারী।
বদল তো হবেই। রাগ থেকে রাগে, মুড থেকে মুডে, লয় থেকে লয়ে। এ তো দাদুর আশ্চর্য সৃষ্টি সঙ্কেত রাগ। দাদু বলেছিলেন, ভবানীপ্রসাদের মনে আছে, বিরাট, বিস্তৃত কিছুর আভাস দিতে গেলে তাকে নিয়ম ভেঙে বাইরে আসতেই হবে। সঙ্কেত রাগের চলন শাস্ত্রবদ্ধ রাগের আরোহণ অবরোহণের সীমানার এ পারে ও পারে ঘোরাফেরা করবে। যেন খানিক বাঁধা রাস্তায় চলা, তারপর হোঁচট খেয়ে বেপথে কৌতূহল পরিক্রমা, আবার ফিরে আসা– চলতে থাকা খানিক আয়েসে, আবার কিছু্টা অজানা তাড়নায়।
সামনে একটা গুঞ্জন। দু’তিনটে উঁচু গলায় ছুড়ে দেওয়া কথা।
– খ্যাপামো হচ্ছে নাকি? পয়সা দিয়ে এই বাজনা শুনতে এসেছি?
– কাকে বসিয়েছেন মশাই? একটা রাগ ঠিক করে বাজাতে পারেন না।
পেছন থেকে কিছু অধীর শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে বোঝাতে চাইছেন এই অনুষ্ঠান বন্ধ করা হোক। ভবানীপ্রসাদ দেখলেন সামনে পরদা নেমে এল। শুনলেন কর্মকর্তাদের একজন বলছেন,
– উঠে পড়ুন। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাড়ি যান। এখানে গন্ডগোল হচ্ছে। পেছনের গেট দিয়ে বেরোবেন।
সঙ্গের ছেলে দুটি ভাল। ওরা যন্ত্র গুছিয়ে ওঁকে আড়াল করে বাইরে নিয়ে এল। সামনে উদ্যোক্তারা শ্রোতাদের বোঝাতে চেষ্টা করছেন। শিল্পী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরের শিল্পী বসবেন এবারে। গাড়িতে উঠতে উঠতে ভবানীপ্রসাদ শুনলেন এক শ্রোতা ওঁর দিকে তাকিয়ে বলছেন,
– আজকাল স্টেজে ওঠার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এঁরা ড্রিঙ্ক করেন। দায়িত্ববোধের বালাই নেই।
দায়িত্ববোধ? কার কাছে? ভবানীপ্রসাদের মাথার মধ্যে সব ধোঁয়ার মতো যেন।
অফিস থেকে ওঁকে পনেরো দিনের ছুটি দেওয়া হয়েছে। সম্পাদকমশাই নিজে দু’দিন এসেছিলেন। একটা নার্ভাস ব্রেকডাউনের মতো হয়েছিল ভবানীপ্রসাদের, একজন চেনা ডাক্তার দিয়ে ওষুধপত্র কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা উনিই করেছেন। পাশে বসে নরম গলায় বলেছেন, ভবানীপ্রসাদ এবার এডিটোরিয়াল বোর্ডে আসছেন, ওঁর কাজ এর পর থেকে অফিসে বসেই। সঙ্গীত সমালোচনার কাজ থেকে কেন ওঁকে ট্রান্সফার করা হল, সে সম্বন্ধে কিছু বলেননি। বরং বুঝিয়েছেন, যে ভবানীপ্রসাদের মত সিনিয়র লোককে এডিটোরিয়াল বোর্ডে আনবার কথা কিছুদিন থেকেই চলছিল। ভাষার ওপর ওঁর মুন্সিয়ানা সম্বন্ধে কারো সংশয় নেই। এ সবই ভালোবাসা থেকে আসা বিবেচনার কথা, ভবানীপ্রসাদ বুঝতে পারছেন। সঙ্গীত ওঁকে এত বড় একটা ধাক্কা দিল, সঙ্গীতের আওতা থেকে তাই সরিয়ে আনা হচ্ছে।
আচ্ছা, এঁরা কি সবাই ভাবছেন ভবানীপ্রসাদ সেতারী হিসেবে উদভ্রান্ত মানসিকতার মানুষ? ওঁর দাদু সেকালের লোক, রাগরাগিণী নিয়ে নানা উদ্ভট চিন্তা করবার অবসর আর অর্থ ছিল। সেটি উত্তরাধিকার হিসেবে মেনে সেই পথে চললে ভবানীপ্রসাদ আজকের সঙ্গীতমহলে উপহাসের পাত্রই হবেন। কিন্তু ওঁর সমস্ত অস্তিত্বই তো একাধিক সুতোর বুনুনি, টানের হেরফেরে তৈরি নকশা। তাতে জীবিকার প্রয়োজন আছে, শিক্ষার যোগ্যতার স্বীকৃতি আছে, সেই সঙ্গে মনের গোপনে আছে শৈশবের পরিচিত আশ্রয় ছেড়ে আসার যন্ত্রণা, এক অনতিক্রম্য একাকিত্ববোধ। সেই একাকিত্বে একমাত্র সান্ত্বনা পেয়েছেন সঙ্গীতে। দাদুর হাতের সেতার নিজের হাতে তুলে নিয়ে। এই অস্তিত্বের ধারণা উনি অন্য কাউকে দিতে পারবেন না, এত ব্যক্তিগত এই বোধ।

একটা কথা কখনওই বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। দাদুর রাগ তো তিনি স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছিলেন শান্তিমোহনের হাতে, বিনা দ্বিধায়। নিজের নামে তা চালানোর জন্য শান্তিমোহনের কোনও অসুবিধেই ছিল না। তাহলে তিনি ভবানীপ্রসাদের জন্য কেন খুলে দিতে চেয়েছিলেন পরিচিতির দরজা, পাদপ্রদীপের আলো? তবে কি এ অপরাধবোধ? নাকি আরো গুঢ় এ চাল? তিনি জানতেন ক্ষুব্ধ ভবানীপ্রসাদ মরিয়া হয়ে দাদুর সম্মান বাঁচাতে এমন কিছু বোকামি করে বসবেন যাতে তিনি চিরকালের জন্য হারাবেন শ্রোতাদের বিশ্বাস, তাদের ভালোবাসা। একবার তা গেলে শান্তিমোহনের জালিয়াতির কথা তিনি যতই প্রমাণ করতে চাইবেন, কেউই মানবেন না। কোথায় শান্তিমোহন আর কোথায় তিনি, কোনও তুলনাই তো চলে না।
জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের এক টুকরো চোখে পড়ল ভবানীপ্রসাদের। গোধূলির হালকা গোলাপি আলো। পাখিদের ঘরে ফেরার সময়। শুধু পাখিদের? মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠছে মূলতানী। চরাচরব্যাপী একটা নিজ নিকেতনে ফেরার সুর। এমনভাবে তো ভাবেননি আগে। সেতারটা একপাশে শোয়ানো, ম্রিয়মাণ যেন। খুব ভালবেসে তুলে নিলেন যন্ত্রটিকে। তার বেঁধে নিলেন। সঙ্কেত পাচ্ছেন একটা অনুভূতির, সমস্ত প্রকৃতি সেটি ভাগ করে নিচ্ছে ওঁর সঙ্গে। বাইরের আসরের নিন্দা প্রশংসায় আর কিছু আসে যায় না। মূলতানীর ঘাটে ঘাটে পা ফেলে ভবানীপ্রসাদ ফিরে আসতে চাইছিলেন নিজের মধ্যে– বড় শান্তির, নিরাপত্তার আশ্বাস সেখানে।
*ছবি সৌজন্য: Fineartamerica, Twitter, Openclipart
স্নিগ্ধা সেন পারিবারিক সূত্রে ওপার বাংলার হলেও আজন্ম কলকাতারই বাসিন্দা। চল্লিশ বছরেরও বেশি ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন, প্রথমে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনে, এবং পরে একাধিক ওপেন ইউনিভারসিটিতে। সাহিত্যচর্চার শখ বহুদিনের। আশি পেরিয়েও চর্চা চলছে পূর্ণ উদ্যমে। কলকাতার অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে - গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত দুটি বই – ‘হ্যামলেট’ এবং ‘ওদের কি খেতে দেবে’।
galpotar porinoti jene ekta swastir niswas neoa galo…….aro lekha porte udgrib hoye thakbo
…..bhalo thakben…. nomoskar