রোজকার মতো আজও বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিল অনিরুদ্ধ ও রঞ্জনা। গন্তব্য: বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরের কবরখানা, যার ভেতরে চক্কর মারা ওদের লকডাউনের প্রিয় রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলের একটি সুন্দর শহরে ওদের বাস… তা-ও প্রায় তিনবছর হতে চলল। অথচ এই শহরটাকে ওরা চিনতে শিখেছে লকডাউন, অথবা বলা ভালো, ‘ওয়র্ক ফর্ম হোম’-এর কল্যাণে। আর এই নতুন-চেনা পর্বের সেরা আবিষ্কার এই কবরখানা। 

অনিরুদ্ধ আর রঞ্জনা আগে বহুবার এটার পাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেছে আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছে জায়গাটার শান্ত, স্নিগ্ধ সৌন্দর্য নিয়ে। মুগ্ধ হয়ে দেখেছে কখনও গ্রীষ্মের উজ্জ্বল দিনে হাইড্রেনজিয়ার ঝকঝকে ফুটে থাকা অথবা হেমন্তের হাল্কা মিঠে রোদ্দুরে ওক, মেপলের লাল, হলুদ, কমলার অপার্থিব রঙবাহার। কিংবা রাতের অন্ধকারে কোনওক্রমে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিসিয়ে বলা ‘তেনাদের বাড়ি’, অথবা একে অন্যকে ঠেলা মেরে ‘গোরস্থানে সাবধান’– এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কোনওদিন গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢোকার তাগিদ অনুভব করেনি।

আসলে এই কয়েকমাস আগেও তো অনি-রঞ্জা দু’জনের জীবনই ছিল একই ছন্দে বাঁধা। সাতসকালে অফিস বেরিয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে বাড়ি ফেরা। শনি-রবিবার বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি, লংড্রাইভ অথবা কাজের ব্যস্ততা। সবমিলিয়ে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর যেন ঝড়ের গতিতে কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ বিনা মেঘে বাজ পড়ার মতো কোথা থেকে এসে পড়ল চেনা পৃথিবীর ছন্দ উল্টে দেওয়া এক অচেনা রোগ, তার দাপটে ভীত, সন্ত্রস্ত আমজনতা। সবার মুখে উঠল মুখোশ। জারি হল লকডাউন। শুরু হল অফিসের বদলে বাড়ি থেকে কাজ করার নতুন রোজনামচা। 

মাসকয়েক কেটে গেল নিজেদের ‘হোম-অফিস’ ঠিকঠাক সাজিয়ে গুছিয়ে নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হতে, বা বলা ভালো বদলে যাওয়া জীবনের তালে তাল মেলাতে। রঞ্জনা বেছে নিয়েছে রান্নাঘরের পাশে তার প্রিয় পড়ার ঘরটি, যাতে অফিসের কাজের ফাঁকে সামলানো যায় ছোটখাটো বাড়ির টুকিটাকি। আর অনির পছন্দ বাইরের দিকের ঘর যেখান থেকে সোজাসুজি দেখা যায় ওদের ছোট্ট বাগান আর লন পেরিয়ে উন্মুক্ত চওড়া রাস্তা। কাজের ফাঁকে অনির চোখ দেখতে থাকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া হরেক বয়সের মানুষ আর তাদের ভিন্ন ভিন্ন হাঁটার ভঙ্গি আর সঙ্গী বিভিন্ন জাতের সারমেয়দের।

অবশেষে একদিন ডিনারের সময়ে রঞ্জনার কাছে কথাটা পাড়ল অনিরুদ্ধ।
– দ্যাখ রঞ্জা, আমি রোজ দেখি কত মানুষ হাঁটতে বেরয়, শরীর আর মন দুটোই তাতে তাজা থাকে। আমরাও সকাল সকাল কাজ শুরু করে বিকালের দিকে একটু হেঁটে আসতে পারি। গরমকাল তো প্রায় এসেই গেল, বল?
অনি কথা শেষ করার আগেই রঞ্জা লাফিয়ে উঠল।
– দারুণ বলেছিস! কী করে আমার মনের কথাটা তুই টের পেয়ে যাস বলতো?
অনি মুখটিপে হেসে বলল,
– তুই কি আমার আজকের চেনা? কোন আদ্দিকালের বদ্দিবুড়ি তুই, তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।
সত্যি, সেই কোন ছাত্রবেলা থেকে দু’জনের বন্ধুত্ব। তারপর প্রেম, বিয়ে, চাকরি নিয়ে আমেরিকা আসা, দীর্ঘ সফরের সঙ্গী দু’জনে।

 

আরও পড়ুন: আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের কলমে: হাসি গল্পের শেষে

 

কথামতো পরদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ট্র্যাকসুট আর স্নিকার শোভিত হয়ে শুরু হয়ে গেল হাঁটাপর্ব। প্রথমদিন বৃত্তাকার রাস্তাটা একচক্কর মেরেই দু’জনেই বেশ একটু ক্লান্ত হয়ে ফিরল বাড়িতে।  কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে হাঁটার পরিধি যেমন বাড়ল, তেমনি আলাপও হয়ে গেল বেশ কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে। আর বিশেষ বন্ধু হয়ে উঠলো জেনিফার ওরফে জেন। 

হাসিখুশি জেন একদম রঞ্জনার বয়সি। দু’জনের কাজের ক্ষেত্রও এক, তাই হৈহৈ করে এগিয়ে চলল বন্ধুত্বের পানসি। জেনই একদিন ওদের টেনে নিয়ে গেল কবরখানার ভেতরে। জায়গাটা ঘুরে দেখতে দেখতে অনি-রঞ্জার চোখের হাল্কা সংকোচ বদলে গেল অপার মুগ্ধতায়। চোখজুড়নো নীল আকাশ, উঁচু, উঁচু গাছগুলোতে কচি পাতার সমারোহ, ছোট্ট পুকুরে জল টলটল করছে, তার ধারে একটা সুন্দর চার্চও দাঁড়িয়ে আছে পুরনো ইংল্যান্ডের গন্ধ মেখে। সবমিলিয়ে কী যে মন ভালো-করা শান্তি চারিদিকে। এরপর থেকে অনি-রঞ্জা দু’জনেই তাকিয়ে থাকে বিকেলটার দিকে। পৌঁছে যায় তাদের পছন্দের গন্তব্যে, তারপর মনের আনন্দে আবিষ্কার করতে থাকে বিশাল জায়গাটার আনাচকানাচ। 

Daliahs
ফলকের পাথর ঘিরে বিশাল আকারের অপূর্ব কিছু ডালিয়া

দিন কাটে, মাস যায়। কচিপাতা বদলায় সবুজ পাতায়, ফুলে নুয়ে পড়ে মিষ্টি ডগউড, রডোডেনড্রনের উদ্ধত রূপ বিহ্বল করে চোখ। তবে রঞ্জা সবচেয়ে অবাক হয়ে দেখে, বেশিরভাগ কবরের উপরে যে নামের ফলক, তার চারপাশ ঘিরে রঙবেরঙের মরশুমি ফুলের মেলা। চোখে পড়ে মৃতদের আত্মীয়স্বজন যত্ন করে পরিচর্যা করছে ফুলগাছগুলো। দেখে মনটা ভরে যায়। এরকমই একটা সুন্দর পাথরের ফলকে ‘রিচার্ডসন’ লেখা যে কবরটা, এখন ওটা রঞ্জনার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ হল, ফলকের পাথর ঘিরে বিশাল আকারের অপূর্ব কিছু ডালিয়া ফুল। তারা যেন রূপে, রঙে, গর্বে, স্বর্গের অপ্সরা! অন্তত রঞ্জনার তো তাই মনে হয়। ফুলগুলো কী এক অমোঘ আকর্ষণে ওকে টানতে থাকে, বিশেষ করে ভেলভেটি ঘন মেরুন রঙের ওপর সাদার ছিটে দেওয়া ডালিয়াটা। রঞ্জনার মনটা ছটফট করে খুব কাছে গিয়ে একবার দেখতে। কিন্তু অনিরুদ্ধর কড়া বারণ আছে এ ব্যাপারে। তাই দূর থেকে দেখেই খুশি থাকতে হয়।

একদিন হাঁটতে গিয়ে রঞ্জনা দেখল এক মাঝবয়সী মহিলা মাটিতে বসে একমনে ডালিয়া গাছগুলোর পরিচর্যা করছেন। সেদিন হঠাৎ অফিসের একটা দরকারি ফোন আসায় অনিরুদ্ধ কথা বলতে ব্যস্ত বেশ কিছুটা দূরে। রঞ্জনা এই সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া করল না। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল ভদ্রমহিলার দিকে। কোভিডের নিয়ম মেনে ফুট দশেক দূরে দাঁড়াতেই মুখ তুলে তাকালেন মহিলা, তারপর একটু অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দূর থেকে যেটা ভালো বুঝতে পারেনি, কাছ থেকে ভদ্রমহিলাকে দেখে বুঝল, ইনি কমবয়সে অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। এখন মধ্যবয়সেও ওঁর লাবণ্য চোখ টেনে নেয়। তবে অনভিজ্ঞ হলেও বুঝল, ইনি পুরোপুরি সাদা নন। কারণ মুখোশে ঢাকা হলেও ওঁর চোখের রং কালো, চুল কালো। 

রঞ্জনার এলোমেলো চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল ভদ্রমহিলার মিষ্টি ‘হ্যালো’ ডাকে। সামান্য এগিয়ে ও শুরু করে দিল আলাপচারিতা, যার মূলে ছিল ওর ডালিয়ামুগ্ধতা আর হয়তো বা কিছু অজানা কৌতুহল। কেন, ও নিজেই জানে না। একে অন্যের পরিচয় নিতে নিতে এগলো টুকটাক কথাবার্তা। ভদ্রমহিলার নাম অলিভিয়া ডেভিস। উনি একজন অবসরপ্রাপ্ত নার্স, এ শহরেরই অন্যপ্রান্তে থাকেন। স্বামী ডাক্তার ছিলেন। দুই ছেলেমেয়ে, দুজনেই বিবাহিত। মহিলা একাধারে ঠাম্মা, দিম্মা দুটোই। এই কবরটা অলিভিয়ার বাবা-মায়ের, যাঁরা আমৃত্যু এ শহরের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর মায়ের ছিল অসম্ভব ডালিয়াপ্রীতি। তাঁর বাগানের ডালিয়া ছিল শহরবিখ্যাত। কথা আরও এগনোর আগেই ফিরে এলেন দুই ভদ্রলোক, সাময়িক কুশল বিনিময় করে তখনকার মতো দু’জনে দু’পথ ধরল। 

কয়েকমাস আগেও তো অনি-রঞ্জা দু’জনের জীবনই ছিল একই ছন্দে বাঁধা। সাতসকালে অফিস বেরিয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে বাড়ি ফেরা। শনি-রবিবার বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি, লংড্রাইভ অথবা কাজের ব্যস্ততা। সবমিলিয়ে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর যেন ঝড়ের গতিতে কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ বিনা মেঘে বাজ পড়ার মতো কোথা থেকে এসে পড়ল চেনা পৃথিবীর ছন্দ উল্টে দেওয়া এক অচেনা রোগ, তার দাপটে ভীত, সন্ত্রস্ত আমজনতা। সবার মুখে উঠল মুখোশ।

অলিভিয়ার সঙ্গে আরও বারকয়েক দেখা হয়েছে রঞ্জনার। কিন্তু সেভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি, কিন্তু প্রতিবারই রঞ্জনার মনে হয়েছে, ডালিয়া নিয়ে ওর অনেককিছু জানার আছে। অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে ডালিয়ার ওই হাসিতে। হঠাৎ করেই একদিন সুযোগ হয়ে গেল। অফিসের কাজে আটকে গেল অনিরুদ্ধ। রঞ্জা একাই বেরিয়ে পড়ল জেনের সঙ্গে হাঁটতে। মাঝরাস্তায় পৌঁছনোর আগেই জেনের স্বামী কেভিন গাড়ি নিয়ে হাজির। ওদের এক আত্মীয়ের হার্ট আ্যাটাক হয়েছে তাই রাস্তা থেকেই জেনকে তুলে সোজা হাসপাতাল যাবে। ওদের পাঠিয়ে দিয়ে রঞ্জনা ধরল কবরখানার পথ। ফিরে যাবার কোনও মানেই নেই কারণ মোটে ছ’টা বাজে, এখনও রোদ্দুর রয়েছে। চারিদিকে অনেক চেনামুখ হাঁটছে। ও খুশিমনে তাদের দলে ভিড়ল। কিছুটা যেতেই চোখে পড়ল রিচার্ডসনদের কবর আর অলিভিয়াকে। ও পা চালাল সেইদিকে।  দু’ এক কথার পর উনি জানালেন, আজ উনিও একা এসেছেন। ডাক্তার সাহেব আসেননি। রঞ্জনার কৌতূহল আর বাধা মানলো না। অলিভিয়ার কাছে নরমসুরে ও জানতে চাইল ওঁর মায়ের কথা। অলিভিয়াও যেন অপেক্ষা করছিলেন প্রশ্নটার। তাই উৎসুক হয়ে শুরু করে দিলেন কথা।

অলিভিয়ার মা ছিলেন মেক্সিকান মেয়ে, পরমাসুন্দরী এবং গুণবতী। তাঁর হাতের ছুঁচের কাজ লোকে মুগ্ধ হয়ে দেখত। আর ছিল ফুলের বাগান করার অদম্য নেশা। আরও আশ্চর্যের হল বাগানে শুধু একটাই ফুল ফোটাতেন। সেটা হল ডালিয়া। অলিভিয়ার বাবা বেঞ্জামিন রিচার্ডসন ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। কর্মসূত্রে মেক্সিকো যেতেন। এভাবেই কোনও একদিন অলিভিয়ার মা ‘লিয়া’কে দেখেন এবং গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন। ভালোবাসাটা দু’তরফেই গভীর ছিল। তাই ছোটোখাটো বাধা কাটিয়ে বিয়েতে পূর্ণতা পেতে দেরি হয়নি। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে এদেশে চলে আসেন লিয়া। বেশ কয়েকবছর এদিক ওদিক কাটিয়ে অবশেষে থিতু হন এই শহরে। অলিভিয়া ও তাঁর দিদি সোফিয়া দু’জনেরই জন্ম অন্য শহরে। এই শহরে জন্মেছিল তাদের একমাত্র ভাই লিও, যে মাত্র আট বছর বয়সে এক অজানা রোগে মারা যায়। 

 

আরও পড়ুন: সংগ্রামী লাহিড়ীর গল্প: স্বরসাধনা

 

স্বামী, সন্তান, অর্থ, সবই ছিল লিয়ার। কিন্তু তাঁর মনে কোথাও এক শূন্যতা ছিল। মেক্সিকোকে মনে মনে অসম্ভব মিস করতেন। অলিভিয়ার বাবা স্ত্রীকে খুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। বছরে তিন থেকে চারবার মেক্সিকো ভ্রমণ ছিল রুটিনের মতো। লিয়ার সবচেয়ে খুশির সময় ছিল গরমকাল। সারাদিন তাঁর ডালিয়া বাগান নিয়ে মশগুল হয়ে থাকতেন। তবে তাঁর ঝলমলে হাসিও ম্লান করে দিত তাঁর হাতে ফোটানো অপূর্ব ডালিয়ার দল। বলতে বলতে অলিভিয়া যেন ফিরে গেলেন তাঁর কিশোরী বয়সে, অমলিন হাসিতে অমূল্য স্মৃতি ভাগ করে নিলেন কন্যাসম এক বিদেশিনীর সঙ্গে। ভাগ করে নিলেন মায়ের সঙ্গে তাদের দুইবোনের ডালিয়া বাগানে কাটানো অসাধারণ কিছু মুহূর্ত। 

Maroon Dalia
পা চালিয়ে পৌঁছে গেল সেই ভেলভেটি মেরুন ডালিয়ার একেবারে কাছে

স্বামীর অকালমৃত্যুর পর লিয়া নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাঁর এই ডালিয়াবাগান। অবশেষে লিয়া ক্যান্সারে মারা যান ২০১৫-তে, আশি বছর বয়সে। অলিভিয়া ভিজেচোখে বললেন, “মা বলতেন, এই ডালিয়াদের মধ্যেই বেঁচে থাকব আমি, থাকবে আমার আত্মা। তাই আমি প্রত্যেক গরমকালে মায়ের হাতের এই ডালিয়ার বাল্ব এনে যত্ন করে বসাই আবার শীতের আগে তুলে নিয়ে যাই।” দু’জনে কথায় এমন মগ্ন ছিল, কখন যে বেলাশেষের রোদ্দুর ঢেকে গেছে কালোমেঘে, খেয়াল করেনি। জোরে হাওয়া দিতেই দু’জনের ঘোর ভাঙল। অলিভিয়া পৌঁছে দিতে চাইছিলেন, রঞ্জনা জানালো কাছেই বাড়ি। তাছাড়া অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজাও হয়নি। উনি গাড়িতে যেতে যেতে “এনজয়” বলে হাত তুলে দেখালেন। দুজনের মনখোলা হাসিতে এক অসমবন্ধুত্ব জীবন্ত হয়ে উঠল।

রঞ্জনা সবে পা বাড়াচ্ছিল ফেরার পথে। অকস্মাৎ আকাশ যেন আরও কালো হয়ে এলো। কোথা থেকে হাহা করে ছুটে এলো ঘূর্ণি বাতাস। আর কী এক টানে রঞ্জনা পা ফেলে ফেলে চলে যেতে লাগল সেই ডালিয়া বাগানের দিকে। ফেরার পথ আর যেন সে দেখতেই পাচ্ছে না। অন্ধের মতো পা চালিয়ে পৌঁছে গেল সেই ভেলভেটি মেরুন ডালিয়ার একেবারে কাছে আর বাহ্যজ্ঞানশূন্যের মতো হাত বাড়ালো ফুলের দিকে। পাপড়িগুলো যেন ডাকছে তাকে। বলছে তাদের স্পর্শ করে দেখতে। মাথা নাড়ছে আধো অন্ধকারে। 

এবার পাপড়িতে আঙুল ছোঁয়ালো রঞ্জনার। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে, বিস্ময়ে গা যেন শিউরে উঠল । হাতে এ কার স্পর্শ! এ তো ফুল নয়! কোনও জীবন্ত মানুষের নরম, পেলব গাল! মনে হল যেন বিদ্যুতের ঝলকে অবশ হয়ে গেছে রঞ্জনার সমস্ত শরীর। কিন্তু হাত সরছে না পাপড়ি থেকে। ঠান্ডা হাওয়াতেও ঘাম হচ্ছে রঞ্জনার। জামা ভিজে যাচ্ছে। এ কার মুখ ছুঁয়ে আছে সে? এবার সব শক্তি এক করে রঞ্জনা পা বাড়াতে চাইল এখান থেকে দূরে। বড় বড় পদক্ষেপ ফেলতে থাকল কবরের পাশ দিয়ে চলা রাস্তায়। চোখ প্রায় বন্ধ করে চলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু একচুলও সরতে পারল না।  

এভাবে কতক্ষণ কেটেছে রঞ্জনা জানে না। আচমকাই তার মনে হল, প্রকৃতি যেন শান্ত হয়ে এসেছে। চোখ খুলল রঞ্জনা। দেখল, যেমন এসেছিল তেমনই মিলিয়ে গেছে ঘূর্ণি হাওয়া। কালো মেঘ সরে গেছে। অকাল আঁধার ফিকে হয়ে এসেছে। হঠাৎ তীরের ফলার মতো একঝলক সূর্যরশ্মি এসে পড়ল রিচার্ডসনের কবরে। ডালিয়ার দল হেলেদুলে হেসে তাকে পথ করে দিল দেখার জন্য, আর অবাক বিস্ময়ে বিহ্বল রঞ্জনা পড়ল, পাথরের ফলকে বেঞ্জামিন রিচার্ডসনের পাশে জ্বলজ্বল করছে তাঁর স্ত্রীর পুরো নাম– ডালিয়া রিচার্ডসন।

 

পরিশিষ্ট: ডালিয়া মেক্সিকোর জাতীয় ফুল। সেখানে মেয়েদের ডালিয়া নামকরণ খুবই চালু। আর ডালিয়া নামের মেয়েদের আদর করে ডাকনামে লিয়া বলেও ডাকা হয়ে থাকে।
*ছবি সৌজন্য: Gardeningknowhow, Pinterest

সাহানা ভুঁইয়ার জন্ম, বেড়ে ওঠা কলকাতায়। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী। তবে দীর্ঘদিন আমেরিকা প্রবাসী। বাংলা না ভুললেও বানানে সমস্যা হয়। প্রিয় শখ শুধু ফুলের বাগান করা আর দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ানো। ছোটবেলা থেকে ফুটবলের অন্ধ ভক্ত। বার্সেলোনার মাঠে গিয়ে মেসির ফ্রি কিকে গোল দেখা এ যাবৎ জীবনের সেরা পাওনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *