সাল ২০৩০, ন্যাশানাল জেনেটিক ব্যুরো, নিউদিল্লি

ডঃ পরমার্থ চক্রবর্তীর চোখ দু’টো আনন্দে চকচক করে উঠল। হয়তো এই প্রথমবার ন্যাশনাল জেনেটিক ব্যুরোর কর্ণধার,অভিজ্ঞ, বর্ষিয়ান বিজ্ঞানীর চোখে আনন্দাশ্রু দেখা গেল। উনি ছুটে গেলেন ওঁর এয়ার ডিভাইসের কাছে। যন্ত্রটি ওঁর মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত করা আছে। মনে মনে যাকে ফোন করতে চাইছেন তার নাম শুধু ভাবতে হবে। এয়ার ডিভাইস মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময়ে সেই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ডিভাইসের অপর প্রান্তে একটি ভারী গলা ও স্ক্রিনে ব্যক্তিত্বময় মুখ ভেসে উঠল। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রধান ডঃ সৈয়দ মহম্মদ প্রথমেই জিজ্ঞাসু মুখে বলে উঠলেন,”বল ডক! এনি নিউজ?”

ডঃ চক্রবর্তী আবেগতাড়িত কণ্ঠে বললেন “আজকের তারিখটা মনে রাখ, আমার তৈরি করা এমব্রায়ো থেকে আলট্রা ক্লোন করে মানুষ তৈরি হবে, এবং ওদের প্রত্যেকের মধ্যে দ্যুতির মতো সমস্ত বৈশিষ্ট্য থাকবে, ওরা কোনও যন্ত্রণা বুঝবে না, নামমাত্র ক্ষিদে থাকবে, দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে কাটাতে পারবে। ওরা হবে অতিমানব, ডক্টর, আমি পেরেছি। এই এমব্রায়োগুলো আমার তপস্যার ফসল।” ডঃ সৈয়দ মহম্মদ আনন্দিত হয়ে বললেন “আমি হাউসকে বলেছিলাম, পারলে তুমিই পারবে। আমি খুব খুশি, ভারত তোমার জন্য গর্বিত।” এয়ার ডিভাইসে কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ডঃ চক্রবর্তী স্বগতোক্তি করলেন,”ওদের মধ্যে দ্যুতির মতোই তীব্র আত্মসম্মান বোধ থাকবে। ওরা আমার ব্রেনচাইল্ড। হ্যাঁ, আত্মসম্মানবোধ যা প্রত্যেক ভারতবাসীর থাকা উচিত।”

সাল ২০৫০, ডিসেম্বর, কলকাতা

“দ্যুতি মা, ছেলেটা কখন থেকে দোকানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওকে একটু দেখ কোন বইটা কিনবে।”
বাবার কথায় দ্যুতি সামান্য বিরক্ত হয়ে বইয়ের তাক থেকে সরে শুভায়নের দিকে এগিয়ে এল। দ্যুতির ঘন আঁখিপল্লবের ভেতরে টলটল করতে থাকা দু’চোখের দিকে শুভায়ন অপলকে তাকিয়েছিল। শুভায়নের খুব ইচ্ছে করছিল দ্যুতির ফর্সা কপালের ওপর ইতস্ততভাবে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো নিজের হাতে সরিয়ে দিতে। দ্যুতি বুঝি ওর মনের কথা জানতে পেরেই কপালের ওপর থেকে ছোট চুলগুলো সরিয়ে অবহেলাভরে জিজ্ঞেস করল “বল,আজ কী বই চাই? নাকি অন্যদিনের মতো আমি যে বইটা পড়ছি সেটাই কিনবে?”

এই ডিসেম্বরের সকালেও শুভায়নের বুকের ভেতরটা মোমগলা আগুনের মতো উষ্ণ হয়ে উঠতে লাগল। ও  মৃদু হেসে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। দ্যুতি নিজের অর্ধেক পড়া বইটা শুভায়নের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মজা করে বলল “তোমার জন্য কোনও বইই পুরোটা পড়তে পারলাম না।” শুভায়ন বেশ খুশি হল, ওর মনে পড়ল ঠিক ছ’মাস পরে ও দ্যুতিকে দেখছে। দ্যুতি ব্যাঙ্গালুরুতে একটি মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে চাকরি করে। ছুটি খুব কম পায়। এবার ডিসেম্বরে ক্রিসমাসের ছুটিতে বাড়ি এসেছে, দিন কয়েক থাকবে। এ খবর শুভায়ন দ্যুতির ভাইয়ের কাছ থেকে জোগাড় করেছে। বইটি নিয়ে দাম মিটিয়ে শুভায়ন চলে গেল। ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই দ্যুতির ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ক্ষণিকের জন্য। তারপরই ওর নজর পড়ল মধ্যমায় পড়ে থাকা আংটির দিকে। আংটির সাদা পাথরের রং ক্রমশঃ সবুজ হতে শুরু করেছে। দ্যুতি জানে এখন ওকে কী করতে হবে। এটা ন্যাশনাল ফোর্সের সংকেত। দ্যুতির আংটিটা একটি বিশেষ যন্ত্র। যন্ত্রটি সিগন্যাল কমিউনিকেটার হিসাবে কাজ করে। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, সংক্ষেপে এনআইএ-র আল্ট্রা সিকিওর আর্থ স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ওর কাছে এইরকম সংকেত পাঠানো হয়। ওই আংটি অনেকগুলো রং পরিবর্তন করতে পারে। 

 

আরও পড়ুন: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের কলমে: একানড়ে পর্ব ১

 

আংটিটার মাধ্যমে দ্যুতিও প্রয়োজনে কিছু বিশেষ সিগন্যাল এনআইএ-কে পাঠাতে পারে। সবুজ রং হওয়ার মানে দ্যুতির সঙ্গে এনআইএ যোগাযোগ করতে চাইছে। দ্যুতি দোকানে বসে সামান্য অনুসন্ধিৎসু নজরে ওর চারিপাশের পরিবেশ লক্ষ্য করতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব সাধারণ পোশাক পরা একজন বই বিক্রেতা ওর কাছে এসে নির্লিপ্ত মুখে অনেকগুলো বই দিয়ে চলে গেল। দ্যুতি দ্রুত বইগুলো নিয়ে দোকান লাগোয়া পেছনের দিকে ওর বাড়িতে মধ্যে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। বাবাকে চোখের ইশারা করল, বাবা শুধু বললেন,”ঠিক আছে।” ও নিজের ঘরে ঢুকে দরজা জানলা বন্ধ করে বইগুলো টেবিলের ওপর রাখল। বেশিরভাগ বই-ই বেশ পুরনো। দ্যুতি জানে ওকে কোন বইটি বাছতে হবে। ওপর থেকে পাঁচ নম্বর বইয়ের পঁচিশ নম্বর পাতার পঁচাত্তর নম্বর শব্দটি দ্যুতি খুঁজে বার করল। শব্দটি হল, ‘ল-খ-ন-উ’।

সাল ২০৫০, জানুয়ারি, লখনউ

লখনউ শহরে দ্যুতি এর আগে কখনও আসেনি। তবে রাজা বাদশাদের শহর নামে বরাবর পরিচিত এ শহরের প্রতি দ্যুতির একটা আলগা টান আছে। লখনউয়ের চৌধুরী চরণ সিং এয়ারপোর্টে দ্যুতি যখন নামল তখন সন্ধ্যা নামছে, শীতের হাল্কা চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে শহরটি। আধো আলোর একটা রহস্যময়তা আছে। কোনও কিছু স্পষ্ট হয় না। অল্প আঁধারের গায়ে যেন লেপ্টে থাকে কিছু অজানা ভয়।

এয়ারপোর্টের কৃত্রিম ঝাঁ চকচকে আলো থেকে বেরিয়ে অল্প অন্ধকারে দ্যুতি শ্লথ পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সহসা ওর মাথার ওপর দিয়ে কতগুলো পরিযায়ী পাখি কলকল করতে করতে উড়ে গেল।  ওর মনে হলো পাখিগুলো দিনের শেষে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাচ্ছে আর ও চলেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। মনে মনে ওর এক অদ্ভুত অনূভুতি কাজ করছিল। একঝলক ওর মায়ের মুখটা মনে পড়ল, বাড়ি থেকে বেরনোর আগে ওকে সজল চোখে বলেছিলেন, “মা, আমি জানি তুই পারবি।” আলগোছে ওর চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়েছিলেন। তারপরই কান্না গোপন করার জন্য দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছিলেন।

সবুজ রং হওয়ার মানে দ্যুতির সঙ্গে এনআইএ যোগাযোগ করতে চাইছে। দ্যুতি দোকানে বসে সামান্য অনুসন্ধিৎসু নজরে ওর চারিপাশের পরিবেশ লক্ষ্য করতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব সাধারণ পোশাক পরা একজন বই বিক্রেতা ওর কাছে এসে নির্লিপ্ত মুখে অনেকগুলো বই দিয়ে চলে গেল। দ্যুতি দ্রুত বইগুলো নিয়ে দোকান লাগোয়া পেছনের দিকে ওর বাড়িতে মধ্যে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।

ঠিক তখনই দ্যুতির চিন্তার জাল ছিন্ন করে হাফ ইঞ্চি বাই হাফ ইঞ্চির মাল্টিপল ডিভাইসটা ওর পকেটের মধ্যে একবার ভাইব্রেট করেই থেমে গেল। এই যন্ত্রটি বিভিন্ন সময়ে ভাইব্রেট করে এর ব্যাবহারকারীকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশ করে, যন্ত্রটির সেন্সরের মাধ্যমে চারপাশের আটশো মিটার ব্যাসের মধ্যের যে কোনও ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটের হদিশ দিতে পারবে। আবার লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে এটি পৃথিবীর যে কোনও জায়গার নাম জানিয়ে দেয়।

কিন্তু এই মাল্টিপল  ডিভাইসটি শুধুমাত্র দ্যুতির হাতেই কাজ করবে। দ্যুতির ডিএনএ-র সঙ্গে ডিভাইসটির কোডিং করা আছে। এছাড়াও দ্যুতির হার্টবিট খুব বেশি বা খুব কম থাকলে যন্ত্রটি কাজ করবে না। অর্থাৎ ওর যে কোনও অস্বাভাবিক শারীরিক পরিস্থিতিতে ডিভাইসটি কাজ করা বন্ধ করে দেবে।   

দ্যুতি আরও একটু এগিয়ে গেল। একটু যাওয়ার পরই একটা সাদা রঙের সেডান গাড়ি দেখতে পেল, যার নম্বর আগেই ম্যাগাজিনের মধ্যে থেকে ও জোগাড় করে নিয়েছিল। গাড়ির ড্রাইভার ডিকিতে ওর লাগেজ রাখার পর দ্যুতিকে পেছনের সিটের দরজা খুলে দিল। ও একটু মৃদু হেসে হিন্দিতে বলল, “ম্যায় ফ্রন্ট সিট পে বৈঠুঙ্গী।” ড্রাইভার কোনও কথা বলল না। শুধু সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হোটেলের গেটের সামনে চলে এল। এরমধ্যে দ্যুতি আবিষ্কার করল ড্রাইভার বোবা। সাধারণত এই সমস্ত টাস্কের জন্য ন্যাশনাল ইন্ট্যালিজেন্স এজেন্সি বাড়তি সতর্কতা হিসাবে এরকম ড্রাইভার ব্যবহার করে। 

 

আরও পড়ুন: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের কলমে: একানড়ে পর্ব ২

 

রিশেপশনে গিয়ে দাঁড়াতেই রিসেপশনিস্ট ওকে চোস্ত ইংরেজিতে ওয়েলকাম জানাল। একজন পোর্টারকে ডেকে ওর লাগেজ নিয়ে যেতে নির্দেশ দিল এবং কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলে ওকে রুমে যেতে অনুরোধ করল। হোটেলের ঘরে পৌঁছনোর পর প্রথমেই দরজা বন্ধ করে দ্যুতি পকেট থেকে ওর মাল্টিপল ডিভাইসটা বার করে হাতের মুঠোয় চেপে ধরল, এবং পকেটে রাখা খামের মধ্যে থেকে ওর চুলের একটা টুকরো বার করে ডিভাইসটার নির্দিষ্ট একটা ছিদ্রে ঢুকিয়ে দিল। ওর চুলের মধ্যে থেকে পাওয়া ডিএনএ-র প্যাটার্নের সঙ্গে যন্ত্রের কোডিং ম্যাচ হওয়ার পর যন্ত্র কাজ করতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে ডিভাইসের স্ক্রিনে সাংকেতিক হরফে লেখা ফুটে উঠল, যার মানে জায়গাটার নাম লখনউ। যন্ত্র সবুজ আলো বিকিরণ করতে শুরু করল। একটু পরেই আলোর রং হাল্কা হয়ে এল। অর্থাৎ দ্যুতির চারপাশে আটশো মিটার ব্যাসের মধ্যে সিসিটিভি বা মাইক্রোফোনের ফ্রিকোয়েন্সির মতো যন্ত্র থাকলেও ওর পনেরো ফুট ব্যাসের মধ্যে এরকম কোনও যন্ত্র নেই।

দ্যুতি হোটেলের করিডোর দিয়ে আসার সময় দেখেছিল সেখানে সিসিটিভি লাগান রয়েছে। কিন্তু ওর ঘরে এরকম কোনও যন্ত্র লুকনো নেই। তার মানে এই মুহূর্তে ওর ওপর কোনও গোপন যন্ত্র দিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে না। দ্যুতি নিশ্চিন্ত হল। দ্রুত ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় পোশাক ও টয়লেট্রিজ বার করে স্নান করতে গেল। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে গেল ছোটবেলার একটা ঘটনা।  

সাল ২০২৫, কলকাতা 

দ্যুতি তখন খুব ছোট, দু’বছর বয়স। একদিন হঠাৎই ওর বাড়ির দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ও পড়ে যায়। ওর মা দৌড়ে আসেন। কিন্তু এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেলেন। দ্যুতির মাথা ফেটে গিয়েছে, রক্তে কপাল, চোখ ভেসে যাচ্ছে। অথচ দ্যুতির সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, ও নির্বিকারভাবে উঠে মায়ের দিকে হেঁটে চলে আসছে। ওর মা দু’বছরের মেয়েকে নিয়ে ভয়ে আতঙ্কে কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার যখন ওর মাথায় স্টিচ করছিলেন তখনও ও একদম ভাবলেশহীন মুখে বসেছিল। ডাক্তার যখন ওকে জিজ্ঞেস করলেন, তখন ও বলল ওর নাকি কোনও ব্যথাই লাগছে না। তখন ওর মায়ের কাছ থেকে ডাক্তারবাবু জানতে পারলেন, দ্যুতি আর পাঁচটা বাচ্চার মতো খেতে চায় না। ওর ঘুমও খুব কম। অথচ সে কম ঘুম বা খাওয়ার জন্য কখনও অসুস্থ হয়ে পড়ে না। 

হোটেলের ঘরে পৌঁছনোর পর প্রথমেই দরজা বন্ধ করে দ্যুতি পকেট থেকে ওর মাল্টিপল ডিভাইসটা বার করে হাতের মুঠোয় চেপে ধরল, এবং পকেটে রাখা খামের মধ্যে থেকে ওর চুলের একটা টুকরো বার করে ডিভাইসটার নির্দিষ্ট একটা ছিদ্রে ঢুকিয়ে দিল। ওর চুলের মধ্যে থেকে পাওয়া ডিএনএ-র প্যাটার্নের সঙ্গে যন্ত্রের কোডিং ম্যাচ হওয়ার পর যন্ত্র কাজ করতে শুরু করল।

ডাক্তারবাবু আর কালবিলম্ব না করে দ্যুতির এই আপাত অস্বাভাবিকতা তাঁর ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। এরপর ওকে নিয়ে মা বাবাকে কিছু দিন দিল্লিতে হসপিটালে থাকতে হল কিছুদিন। সেসময় ওর শরীর নিয়ে ডাক্তার আর বৈজ্ঞানিকেরা প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত ওঁরা জানতে পারেন দ্যুতি, ক্রোমোজ়োম সিক্স পি (6p) নামক এক জটিল জিনগত ত্রুটির শিকার। কী এই অসুখ? বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের শরীরে ২৩ জোড়া ক্রোমোজ়োম থাকে। মাতৃজঠরে থাকাকালীন ক্রমাগত কোষ বিভাজনের সময়ে ক্রোমোজ়োম সিক্সের ‘p arm’-এর বেশিটাই অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে দ্যুতির শরীর থেকে। 

ক্রোমোজম সিক্সের বেশিরভাগ অংশ মানবশরীরে ব্যথা, বেদনা, ক্ষিদে, তেষ্টা ও অন্যান্য অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। দ্যুতির শরীরে ক্রোমোজ়োম সিক্স পি-এর বেশিরভাগ অংশই নেই বলে স্বাভাবিকভাবেই ওর  ওই বোধ বা অনুভূতিগুলোও নেই। কিন্তু ওর আত্মসম্মানবোধ ভীষণ তীব্র। কেউ ওকে অন্যায় কিছু বললে বা করলে দ্যুতি তার শেষ দেখে ছাড়ে।  

এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। ন্যাশানাল জেনেটিক ব্যু্রোর পক্ষ থেকে দ্যুতির মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ওখানকার কর্ণধার ডঃ পরমার্থ চক্রবর্তী নিজে ওঁদের সঙ্গে কথা বলেন। উনি দ্যুতির মতো অপার্থিব ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু মানুষ আলট্রা ক্লোনের মাধ্যমে তৈরি করতে চান বলে জানান। পরবর্তী সময়ে ন্যাশানাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির পক্ষ থেকেও ওদেরকে জানানো হয়, ওঁরা দ্যুতির এই আশ্চর্য ক্ষমতাকে দেশের সুরক্ষার কাজে লাগাতে চান। দ্যুতির এই বিশেষ ক্ষমতাকে ওঁরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করতে চান।

এগুলো দ্যুতি এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে যত সহজে ভাবতে পারছে তখন কিন্তু পরিস্থিতি তা ছিল না। এমনও দিন গেছে দ্যুতি পাশের ঘরে মা বাবার উত্তেজিত আলোচনা শুনতে পেয়েছে। মা কান্নায় জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে চলেছেন “আমার আদরের সোনাকে আমি কিছুতেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারব না।” ওর বাবা সান্ত্বনা দিয়েছেন “আমাদের তো গর্ব হওয়া উচিত, ক’জন মানুষ দ্যুতির মতো হয়?” 

শেষ পর্যন্ত এনইএ-র কঠিন ট্রেনিং পাশ করে দ্যুতি এখন দেশের একজন অন্যতম সিক্রেট এজেন্ট। সারা পৃথিবীর পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারা, ক্যারাটে, যুযুৎসুর প্যাঁচ পয়জারে ওস্তাদ, বন্দুকের অব্যর্থ টার্গেট করতে পারা, কম্যান্ডো ট্রেনিং নেওয়া, শরীরের অসম্ভব যন্ত্রণা সহ্য করতে পারা, অসামান্যা রূপসী ও বুদ্ধিমতী দ্যুতিকণা সেন এখন শুধু ওর পরিবারের নয়, সমস্ত দেশের গর্ব ও সম্পদ। ওর ডিপার্টমেন্টে ওকে “ক্লোমা” বলে ডাকা হয়। ওর ক্রোমোজ়োমের প্যাটার্নে মিউটেশন করে হুবহু ওর মতোই ক্ষমতা সম্পন্ন আরও পাঁচটি মানব-মানবী তৈরী করা হয়েছে। তারা সকলেই দ্যুতির মতোই সিক্রেট এজেন্ট। সেইজন্য ওকে বলা হয় “মাদার ক্লোন” বা সংক্ষেপে “ক্লোমা।” 

 

আরও পড়ুন: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের কলমে: একানড়ে পর্ব ৩

 

এরকম সিক্রেট এজেন্টদের একটা ক্যামোফ্লেজ় প্রয়োজন হয়। তাই ওকে ব্যাঙ্গালুরুর একটা আইটি সেক্টরে চাকরি দেওয়া আছে। সমাজের চোখে দ্যুতিকণা সেন একজন আইটি প্রফেশনাল। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে দ্যুতি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সম্বিত ফিরল হোটেলের ইন্টারকমের শব্দে।

দ্যুতি খুব দ্রুত টাওয়েল জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরল। ওর সদ্যস্নাত চুল থেকে বিন্দু বিন্দু জল টুপিয়ে মেঝের দামি টাইলসে পড়ছে। ভিজে শরীরের অনাবৃত অংশের ওপর ঘরের ডিম লাইট পড়ে যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে। সুডৌল স্তনদু’টো যেন আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আলো-আঁধারিতে। ভেজা চুলের মাদকতা বুঝি মহুয়ার নেশাকেও হার মানিয়ে দেবে। সরু কোমরের মোচড়ে ওর চলন দেখেই বোধহয় বিদ্যাপতি লিখে থাকবেন “গেলি কামিনী, গজহু গামিনী, বিহসি পাল্টি নেহারি।” ওর সৌন্দর্যের অনাবিল উজ্জ্বলতা, দেহসৌষ্ঠব যে কোনও বলিউড অভিনেত্রীকেও মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

ওর ডিপার্টমেন্টে ওকে “ক্লোমা” বলে ডাকা হয়। ওর ক্রোমোজ়োমের প্যাটার্নে মিউটেশন করে হুবহু ওর মতোই ক্ষমতা সম্পন্ন আরও পাঁচটি মানব-মানবী তৈরী করা হয়েছে। তারা সকলেই দ্যুতির মতোই সিক্রেট এজেন্ট। সেইজন্য ওকে বলা হয় “মাদার ক্লোন” বা সংক্ষেপে “ক্লোমা।” 

ইন্টারকমে “হ্যালো” বলতেই রিসেপশনিস্ট ডিনার করার কথা বলল। দ্যুতি ফোনে জানাল, ওর ডিনার যেন ওর ঘরেই দেওয়া হয়। আজ বড় ক্লান্তি আসছে। তাই লাউঞ্জে গিয়ে ডিনার করার কথা নাকচ করল দ্যুতি। এরপরই দ্যুতি এয়ার ডিভাইসে ডঃ পরমার্থ চক্রবর্তী ও ডঃ সৈয়দ মহম্মদের সাথে কনফারেন্স কল করল। ডঃ সৈয়দ দ্যুতিকে ‘ক্লোমা’ বলেই ডাকেন। ডঃ চক্রবর্তী আবার ওকে ‘মা’ বলে ডাকতেই বেশি ভালবাসেন। ওঁরা জানালেন, পরদিন সকালে ট্রেনে ওকে দিল্লি যেতে হবে। দুপুর বারোটা নাগাদ এনআইএ-র হেডকোয়ার্টারে মিটিং হবে এবং সেখানেই তৈরি হবে দ্যুতিদের সিক্রেট মিশনের ব্লু প্রিন্ট। দ্যুতি কনফারেন্স কল শেষ করার পর বুঝতে পারল যে ওকে ট্রেনে করে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য আছে। 

পরের দিন সকালে হোটেল থেকে চেক আউট করে একটা ক্যাবে উঠে লখনউ স্টেশনে রওনা দিল দ্যুতি। রাস্তায় গোমতি নদী পড়ল। কেন্দ্রীয় সরকার ২০৪৫ সালে নদীর মাঝখান দিয়ে ডাবল লেয়ারে গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা বানিয়েছে। নীচের লেয়ারটা পুরোপুরি নদীর মধ্যে ডুবে থাকে, তাতে যাত্রীরা গাড়ি করে যাওয়ার সময় নদীর মধ্যে প্রচুর মাছ, জলজ গাছ দেখতে পান। আর ওপরের লেয়ার দিয়ে গাড়ি যাওয়ার সময় মেঘগুলোকে আইসক্রিমের মতো হাতের মুঠোয় নেওয়া যায়। এককথায় অপূর্ব বললেও কম বলা হয়।

দ্যুতি লখনউ স্টেশনে পৌঁছল। ওর দিল্লি যাওয়ার রিজার্ভেশন আগেই করা ছিল। ও লাগেজ কনভেয়র বেল্টে তুলে দিল। নিজে ট্রেনের স্বয়ংক্রিয় দরজার পাশে লাগানো সেন্সরে ডানহাত মেলে ধরতেই ওর পুরো পরিচয় সমেত ট্রেনের কোচ ও সিট নং ডিসপ্লে হল। ওদিকে ততক্ষণে ওর লাগেজের প্রয়োজনীয় স্ক্যানিং করে ওর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। দ্যুতি আলট্রা ফাস্ট ট্রেনে চাপল। এটা ঘণ্টায় ৪০০ কিমি বেগে চলে। এত বেশি গতিবেগ হওয়ায় ট্রেন থেকে বাইরের দৃশ্য কিছুই দেখা যায় না। 

দ্যুতি মোটামুটি দেড় ঘণ্টার মধ্যে দিল্লি স্টেশনে নেমে গেল। তখন বেলা দশটা। স্টেশন লাগোয়া চত্বর ছেড়ে বাইরে আসতেই শীতের নরম রোদ ওর শরীরে এসে পড়ল। আর তখনই ওর আংটিটা সবুজ হতে শুরু করল। ও একটু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে রইল। পাঁচমিনিট পর ওর সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল। দ্যুতি খেয়াল করল আংটি আবার সাদা হয়ে গিয়েছে। কালবিলম্ব না করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ল দ্যুতি। উঠেই দেখল চালকের আসনে বসে আছে নিলয়। নিলয় হল দ্যুতির ক্রোমোজ়োম মিউটেশান করে বানানো ক্লোন ম্যান, হুবহু ওর মতো গুণসম্পন্ন। তবে ওর সঙ্গে দ্যুতির একটা জায়গায় পার্থক্য আছে। সেটা হল, নিলয় খুব খারাপ পরিস্থিতিতেও মশকরা করতে পারে। অ্যাম্বুলেন্সে উঠতেই নিলয় ওকে “হাই বেবস্” বলে চোখ মটকাল। দ্যুতি যখন ওকে ঘাড় ঝাঁকিয়ে ‘কী ব্য়াপার’ জিজ্ঞেস করল তখন নিলয় নির্বিকার মুখে জানাল, শত্রুপক্ষ ওকে ট্রেস করে ফেলেছিল। তাই প্ল্যান বি। এরপর সারা রাস্তা নিলয় দ্যুতিকে বস্তাপচা জোকস শোনাতে শোনাতে এনইএ-র হেডকোয়ার্টারে নিয়ে গেল।

সাল ২০৫০, জানুয়ারি, দিল্লি  

এখন ঠিক দুপুর বারোটা। ওভাল শেপের একটি ঢাউস টেবিলের চারিদিকে দশজন বসে আছে। দ্যুতি আর ওর ক্লোনিং করা পাঁচজন। তারা হল নিলয়, শাক্য, শৌর্য, অঙ্গদ ও সম্পূর্ণা। এছাড়াও আছেন ডঃ চক্রবর্তী, ডঃ সৈয়দ ও এনইএ এবং ন্যাশনাল জেনেটিক ব্যুরোর আরও দু’জন আধিকারিক। প্রজেক্টরে একটার পর একটা ছবি ডিসপ্লে হচ্ছে। কেউ কোনও কথা বলছে না। ডঃ চক্রবর্তীই প্রথম থমথমে গলায় স্পিকারে বলতে শুরু করলেন: 

– আমাদের কাছে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ন্যাশানাল জেনেটিক ব্যুরোর (সংক্ষেপে এনজিবি) একজন প্রথম শ্রেণির সাইনটিস্ট হয়ে ডঃ অয়নান্ত রায় এটা কীভাবে করলেন! আর তার সঙ্গে কিছু স্বার্থপর সাইনটিস্ট কীভাবে যুক্ত হলেন? ওঁরা একবারও নিজেদের দেশের কথা ভাবলেন না? অন্য দেশের বায়োলজিকাল ল্যাব থেকে মিউটেটেড ভাইরাস নিয়ে এলেন, যেটা মানুষের পানীয় জলে সামান্য মাত্রায় মিশিয়ে দিলে মানুষের পুরো নার্ভাস সিস্টেম মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে এবং একসপ্তাহের মধ্যে মানুষটির স্পাইনাল কর্ড অকেজো হয়ে পুরো শরীর প্যারালাইসড হয়ে যাবে। আর এটা হবে মানুষটি ওই ভাইরাস মেশানো জল মাত্র দশ লিটার পান করলেই!

এবার ডঃ সৈয়দ বলে উঠলেন:

– ওদের উদ্দেশ্য হল, অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে পঙ্গু করে দেওয়া। তাতে করে সরকারের সমস্ত নীতি ভেঙে পড়বে এবং একশো কোটি জনসংখ্যার দেশের তিরিশ শতাংশের যদি এমন অবস্থা হয় তবে সরকারের এক বছরের জিডিপির টাকার থেকেও বেশি টাকা লেগে যাবে এই সমস্ত পঙ্গু মানুষের চিকিৎসা ও দেখাশোনা করতে। পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক মানচিত্রে ভারত চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে।

স্টেশন লাগোয়া চত্বর ছেড়ে বাইরে আসতেই শীতের নরম রোদ ওর শরীরে এসে পড়ল। আর তখনই ওর আংটিটা সবুজ হতে শুরু করল। ও একটু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে রইল। পাঁচমিনিট পর ওর সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল। দ্যুতি খেয়াল করল আংটি আবার সাদা হয়ে গিয়েছে।

ডাঃ চক্রবর্তী কঠিন মুখে বললেন “ওদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে।” রাগে দ্যুতির মুখ লাল হয়ে উঠল। ও টেবিলের ওপর রাখা পেপারওয়েট এমন জোরে চেপে ধরল যে ওটা ওর হাতের মধ্যেই ভেঙে গেল। সৌভাগ্যক্রমে ওর হাত সামান্য কাটল। কিন্তু সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ না করে দ্যুতি বলে উঠল “ওরা কেউ বাঁচবে না।” ওর সঙ্গে বাকি পাঁচজনও বলে উঠল “ওরা শেষ হয়ে যাবে।”

ডঃ সৈয়দ বললেন:
– তোমাদের কী করতে হবে সেটা এই মাইক্রো ড্রাইভে আছ। মিঃ মুরারকা তোমাদের গাইড করবেন।

এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এনইএ-র আধিকারিক মুরারকা “স্যার” বলে সম্মতি জানালেন। দ্যুতি, নিলয়, শাক্য, শৌর্য, অঙ্গদ ও সম্পূর্ণার সারাদিন কেটে গেল অপারেশন “ভারত সুরক্ষা”-র ব্লু প্রিন্ট বুঝতে। ছ’ দিনের মধ্যে এই মিশন শেষ করতে হবে ওদের। অপারেশন লিড করবে দ্যুতি। যে কোনও পরিস্থিতিতেই ওরা এনইএর হেডকোয়ার্টার বা সরকারের কোনও আধিকারিকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবে না। যে রাজ্যগুলিতে ওরা যাবে, সেখানে এনইএ-র কিছু আলাদা সিক্রেট এজেন্ট নিযুক্ত করা আছে। প্রয়োজনে তারা এই ছ’জনকে সবরকমভাবে সাহায্য করবে। ওদেরকে সময়ে সময়ে এনইএ প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে। এই অপারেশনের কোর মেম্বারদের কিছু বিশেষ অস্ত্র দেওয়া হয়েছে, যা পৃথিবীর হাতে গোনা কিছু দেশের কাছে খুব অল্প সংখ্যায় আছে।     (চলবে)

Anuva Nath

অনুভা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সরকারি চাকরি করেন। লেখালেখি প্যাশন। সানন্দা ব্লগ, শুকতারা, এখন ডুয়ার্স, অপার বাংলা, প্রসাদ-সহ প্রচুর পত্রপত্রিকা, লিটিল ম্যাগাজ়িন, ওয়েবজিন ও সংবাদপত্রে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পেয়েছেন ছোটদের জন্য লিখে। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২০-তে, অমিয়া ভৌমিক স্বর্ণকলম পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১-এর বিচারক ও সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *