জরাজীর্ণ চিৎপাত দুপুরবেলা চোখ খুলতেও কষ্ট হচ্ছিল, তবুও ধীরে ধীরে মাথা তুলে পায়ের দিকে তাকাল টুনু। কালচে হয়ে আছে জায়গাটা, রক্ত জমাট বেঁধে আছে বলেই হয়ত বা। জ্বরটাও সেই থেকেই আসছে কী না, কে বলতে পারে! পরশু রাত্রিবেলা জঙ্গল থেকে সে কীভাবে ফিরেছে, ঠিক কী ঘটেছিল, কাকে দেখেছিল, সবই যেন আবছা, ছিন্ন স্বপ্নের মতো উড়ে উড়ে এক মলিন জাল তৈরি করেছে তার ঝিমন্ত মাথার চারপাশে, যাকে ছিঁড়েখুঁড়ে আসল মুখের খোঁজ পাওয়া  অসম্ভব হয়ে উঠছে। সেদিন থেকেই টাটিয়ে উঠেছে পা, মাটিতে চাপ দিতেও কষ্ট লাগে। দিদাকে কিছু বলেনি, ঠোঁট চেপে সহ্য করছে দুইদিন ধরে। তার ওষুধের বাক্সে যে বাড়তি ক্যালপল ছিল সেগুলোই খেয়ে যাচ্ছে, যেরকম মা জ্বর হলে তাকে দিত। দিদার তাকে নিয়ে ভাবার অবসর নেই, সে নিজের মনেই যেন কাঁদছে হাসছে খেলছে খেলনাবাটি, নাহলে চোখ মেলে তাকালে দেখত টুনুর ছলছলে চোখ, লালচে গাল, ঠোঁটের শুকনো মামড়ি। এখন দিগন্তজোড়া শীতের মরশুম। পাঁচটার মধ্যেই বাগান আর মাঠ ঘিরে প্রাণপণ চিৎকার জুড়ে দেয় ঝিঁঝিঁপোকাদের দল, গম্ভীর অন্ধকার জ্বাল দিতে থাকে প্রাচীন বাড়ি ঘিরে, স্যাঁতস্যাঁতে ভাপ ছড়ায় কম্বল, আর একলা তালগাছের মাথার ওপর দিয়ে ভেসে আসা কালো হাওয়া টুনুর মাথার ভেতর ঢুকে পাক খেতে থাকে–একানড়ে তাকেও নিয়ে যাবে, ঠিক যেরকম নিয়ে গেছে অন্যদের।

বিশ্বমামার ঘরে আর যেতে ইচ্ছে করে না, যদিও এখন গুবলুকে হয়তো দাওয়ার এককোনায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে তার মায়ের হাত খালি, হয়তো পেছনের পুকুরপাড়ে বসে কাপড় কাচছে, কি ভিজিয়ে রাখছে সর্ষের খোল, আর বিশ্বমামা কাঠ ভাঙছে।  বসে বসে গল্প করা যেত খানিক, কিন্তু রীণামামিমা ব্যস্ত, তার রৌদ্রাক্ত হাসি টুনুর জন্য জমা ছিল না অনেক আগে থেকেই। সেবার মেলায় রীণামামিমার কোলে মুখ গুঁজে যেটুকু শিহরণ জমা হয়েছিল, সেটুকুও আপাতত নোনাধরা পাঁচিলের গায়ে ঘুঁটের চিমসে গন্ধের মতো একটুকরো তলানি হয়েই একলা মনে, ওটুকু খুশির গোপন তহবিলও যদি তছরুপ হয়ে যায়, তাই টুনু নীচে নামেনি আর। আর বিশ্বমামাও এ বাড়িতে কাজ করে, যাকে হয়তো বা চাকরই বলা যায়, যদিও মা তাকে বলেছিল এরকম শব্দ উচ্চারণ না করতে, তবুও টুনু বুঝতে পারে যে ঠিক সমানে সমানে মেশার মতো নয় তারা। যদিও অনেকদিন হল, বলা যায় জন্ম থেকেই এখানে, বিশ্বমামা বলেছিল তারা আসলে ভাতুয়া, তার আসল নাম বিশ্বদেব বাগাল, যার আদি বাড়ি সুন্দরবনের কাছে। ভাতুয়া মানে কী, টুনু জানে না। কিন্তু গম্ভীর ও নির্ভরযোগ্য বিশ্বমামা, তার নরম স্পর্শ, এবং ভোরবেলা কুয়ো থেকে জল তুলে স্নান করার সঙ্গে সঙ্গত রেখে তার গুনগুনে গান, সেটুকুও টুনু লোভীর মতো চাখতে চেয়েছিল একদা, এ বাড়িতে তাকে কিছুটা ভালবাসা ওই দু’জনই দিয়েছিল। এখন আর মনে করতে ভাল লাগে না। 

কী হয়েছে দেখার জন্য জানালা খুলে চোখে পড়ল, অনেক লোক জমা হয়েছে নীচে। চিৎকার করছে কেন? কাঁদছেও যেন কেউ, গলাটা চেনা না? কিছু বোঝবার আগেই টুনু শুনতে পেল দোতলায় উত্তেজিত একদল পায়ের আওয়াজ।

মনে থেকে গিয়েছে শুধু গম্বুজের দেওয়ালের গায়ে পরপর কয়েকটা নাম, যাদের টুনু চেনে না। দুটো নামের পাশে জিজ্ঞাসাচিহ্ন কেন, জানে না সেটাও। অথবা তার কানে হিমেল বাতাসের মতো ফিসফিস করে হয়তো বা কিছু বলে গিয়েছিল কেউ, সেটুকু অন্ধকারেই। সারা রাত টো টো জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে মেচেতা পড়া জ্যোৎস্নার কাছে ও সন্ধানী আলোর কাছে সে এই নামগুলোর তল্লাশি চালিয়ে গিয়েছে। যখন জ্বর পায়ের পাতা বেয়ে একটা মিষ্টি বিষের মতো আততায়ী  হয়ে ধেয়ে আসে, তখন আধো আচ্ছন্নতার মধ্যে তার কানে আবার ফিসফিস করে সেই নামগুলো কেউ যেন বলতে থাকে, বারবার। একানড়ে যদি তাকে তালগাছের মাথায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে, অথবা লুকিয়ে ফেলে গম্বুজের অন্ধকারে, তাহলে আর খুঁজে পাবে না কখনো। কিন্তু ভয় লাগে না তবুও, কেন যে লাগে না! এদিকে টুনু ভিতু ছিল বরাবরই। বরং তালগাছের দিকে তাকিয়ে ভারী আর অবসিত হয়ে ওঠে তার বুক, যখন ক্যালকুলাসকে মনে পড়ে। আর আসেনি, টুনু রাত্রিবেলা জানালা দিয়ে বাগানের ভেতর অনেক খুঁজেছে, নাম ধরেও ডেকেছে, সাড়া পায়নি কোনও। 

এখন ঝিম ঝিম দুপুর, সারা বাড়ি নিস্তব্ধ, দিদা রান্নাঘরে থাকে এই সময়টায় আর দাদু ঘুমায়। ঘণ্টাখানেক আগে মা ফোন করেছিল, তখন খেতে বসেছে সে আর দাদু। সেই একইরকম মরা নদীর গলায়– ‘আমি আসছি আর কয়েকদিনের মধ্যেই’, ‘তুই লক্ষ্মী হয়ে থাক বাবা, শরীর খারাপ বাধাস না’, ‘আসবার সময়ে আরো কয়েকটা ফেলুদা নিয়ে আসব’, ‘অফিসের ছুটি পাচ্ছি না তো কী করব বল! কিন্তু দিদা তো কত খুশি হয়েছে তুই আসায়, আরো কয়েকদিন না থাকলে দিদার মন খারাপ করবে না?’ মানে নেই এসব কিছুরই, বলতে হয় বলে বলা। বহুদূর ফেলে আসা এক নির্জন ফেরিঘাটের মতো মায়ের মুখ মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে ফিরে আসে, যেখানে হাহাকার করে বয়ে চলা কালো বাতাস বাদে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। টুনুর আজকাল মনেও হয় না কিছু, চোখ বুজলেও মা-কে বেশি দেখে না। বরং দেখে জ্যোৎস্না রাত্রে গাছের দল সরে সরে যাচ্ছে হাওয়াতে, আর উঁকি দিচ্ছে গম্বুজের ভাঙা মাথা। অথবা, তালগাছ চলে এসেছে তার জানালার কাছে, এবার টোকা দেবে।

তার মনে পড়ে, গম্বুজ থেকে সে যখন বাইরে বেরিয়েছিল, দেখেছিল দেওয়ালের গায়ে খোদাই করা রাক্ষসাকার একটি মুখ, যার সঙ্গে পাঁচুঠাকুরের মুখের অনেকটাই মিল। আবছা আবছা এসবই মনে পড়ে, যখন পাঁচুঠাকুর বলো অথবা তালগাছ, তার ভেতরের ভয়টাকে ঝাল মশলা দিয়ে কষিয়ে রান্না করে অসাড় মাংসের ড্যালা বানিয়ে দিতে দিতে সেসব ছবিও খুব চেনা লাগে, তখন সে বোঝে, তার আর আসানসোলে ফেরা হবে না। এটুকু ভাবতে ভাবতেই টুনু অনুভব করে আবার ঝাঁক বেঁধে জ্বরের দল তার পা বেয়ে গুটি গুটি ওপরে উঠছে, ব্যাথায় নীল হয়ে যাচ্ছে কোমরের নীচ থেকে। কানে এসে ধাক্কা মারা ফিসফিসানিগুলো আপাতত অগ্রাহ্য করতে চায়, যে আবোলতাবোল একঝাঁক নামকে চেনে না, শুধুই গম্বুজের গায়ে খোদাই দেখে কল্পনা করে নিয়েছে, জ্বরের ঘোরে সেগুলো তার কানে ঘুরে ফিরে আসার মানেই হল, জেগে থাকলে আরো বেশি শরীর খারাপ করবে, ভুল বকবে, এবং দিদা বিরক্ত হবে আবার। 

অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিল টুনু, যখন ভাঙল ততক্ষণে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে বাইরে। ঘুমের মধ্যেই সে আবার স্বপ্ন দেখেছে গম্বুজের, বুঝেছে যে একানড়ে তাকে আবারো কিছু বলতে চায়। কিন্তু তার জন্য টুনুকেই আবার চিঠি লিখতে হবে। টুনু শুয়ে শুয়েই কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকল, মনে পড়ল সার সার ঝুলতে থাকা ফাঁসির দড়ি। গলার ভেতরটা শুকিয়ে গেছে, ঠোঁট চাটতে গেলে খড়খড়ে। জানালা খুললেই মশার দল ঢুকবে, সরু সরু পিনপিনে, আর বাগানের থিকথিকে কাদার ভেতর দিয়ে উনুনের ধোঁয়ায় সমাচ্ছন্ন থাকবে বিশ্বমামার চিলতে ঘরের সামনেটুকু, যা চোখে গেলে জ্বালা করে, তবুও সে স্বপ্নে তালগাছ দেখেছে বলেই মনে হচ্ছিল আরেকবার জানালা খুলে দেখে, সত্যিই আগের জায়গাতে আছে কী না। সে উঠে বসল বিছানায়, এবং তখন কানে গেল নীচের উত্তেজিত হইচই। 

মানে নেই এসব কিছুরই, বলতে হয় বলে বলা। বহুদূর ফেলে আসা এক নির্জন ফেরিঘাটের মতো মায়ের মুখ মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে ফিরে আসে, যেখানে হাহাকার করে বয়ে চলা কালো বাতাস বাদে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

কী হয়েছে দেখার জন্য জানালা খুলে চোখে পড়ল, অনেক লোক জমা হয়েছে নীচে। চিৎকার করছে কেন? কাঁদছেও যেন কেউ, গলাটা চেনা না? কিছু বোঝবার আগেই টুনু শুনতে পেল দোতলায় উত্তেজিত একদল পায়ের আওয়াজ। সে পেছন ফিরে দেখল দাদু, বিশ্বমামা আর আরো অনেকে এসে দাঁড়িয়েছে তার দরজায়। সকলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, দাদু তার মধ্যে আলো জ্বালল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘টুনু, গুবলুকে দেখেছিস? এই ঘরে এসেছিল?’ 

‘না তো !’ অবাক হল টুনু, গুবলু এতই বাচ্চা যে নিজে নিজে কোথাও যেতে পারবে না, দাদুও জানে। বিশ্বমামার ফ্যাকাসে মুখ দেখে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’ 

বিশ্বামার ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু আওয়াজ বেরোল না গলা দিয়ে। উত্তর দিল অন্য একজন, যাকে টুনু চেনে না–‘দুপুর থেকে গুবলুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

আগামী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১। 

আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *