গম্বুজের খিলান ভেঙে পড়বে পড়বে করছে, প্রবেশপথ জড়িয়ে গিয়েছে লতাপাতা প্রাচীন গুল্মে। টুনুর চোখে পড়ল, অনাদৃত সাপের খোলস পড়ে আছে একপাশে। খিলানের গায়ের জঙ্গলে সে হাত রাখল, ঠাণ্ডা সবুজ মনে হল পিচ্ছিল। গম্বুজের ভেতর যতটা অন্ধকার থাকার কথা চাঁদের আলোতে তা অনেক কম, এবং সে জন্যেই দেখতে পেল, বাইরের মতো ভেতর দিয়েও সিঁড়ি উঠে গেছে। তার মানে অনেকগুলো তলা আছে। ভেতরের দেওয়ালগুলো থেকে অদ্ভুত আকারের ঝোপঝাড় ঝুলে আছে, মাটিতেও। টুনু সিলিঙের দিকে তাকাল। এক ঝলক মনে হল, সার সার ফাঁসির দড়ি যেন ঝুলছে। চোখ কচলে আবার তাকাল। কিছু নেই, শুধু কড়িবরগার গায়ে কালো কালো দাগ। 

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল টুনু। বারে বারে অজগরের মতো পা জড়িয়ে ধরছে লতাপাতা, খচমচ করে ছুঁচো বা কিছু একটা পালিয়ে গেল অন্ধকারে, কিন্তু থামলে চলবে না। একটার পর একটা কক্ষ পেরিয়ে উঠে চলল ওপরের দিকে, যেখানে ছাদ। ক্যালকুলাস বাইরেই থেকে গেল, তার গন্তব্য মনে হয় ওটুকুই ছিল। 

ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি লাগল টুনুর, মাথার ওপর ঝুলে থাকা আকাশের পেট ছিঁড়ে তারাদের দল হুড়মুড়িয়ে নেমে আসবে যেন। এত এত রাক্ষুসে ঝকমকে তারা দেখে আকাশকে তার মনে হচ্ছিল অবাক ক্যাঙ্গারু, আর ছাদ তখন চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে ছুটে আসছে। চারদিকে যতদূর চোখ চালাও ধু ধু সবুজ বমি উগরে দিচ্ছে অরণ্য, বাতাসে গাছের দল মাথা নাড়াচ্ছে, ঘুলঘুলির ভেতর হাওয়া ঢুকে নীচ থেকে ভেসে আসা সি সি শব্দটা শুনেও টুনুর ভয় করল না। সে নিচু হয়ে দেখল, ছাদময় ছড়িয়ে আছে মাছের কাঁটা। একপাশে শুকোতে দেওয়া একটা জাল। একানড়ে তাহলে এখানেই মাছ ধরে এনে শুকোতে দেয়! নিচু হয়ে একটা কাঁটা তুলল, শিশু মাছের কঙ্কাল, চাপ দিলেই গুঁড়িয়ে যাবে হয়তো। মুড়োটির মাংস খুবলে খেয়ে শুধুই ফাঁকা করোটি তার দিকে শূন্য তাকিয়ে আছে। 

হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা ভাঙা  চিরুনি। আরো একটু এগিয়ে, জামার বোতাম। সেই সব বাচ্চাদের, একানড়ে যাদের এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছে? তাকে যদি আটকে রাখে, অনেকদিন পর অন্য কেউ এসে কী খুঁজে পাবে? হয়তো একটা পেন্সিল, বা জামার টুকরো। বাকিটুকু ততদিনে শিশু মাছের কঙ্কালের গায়ে আটকে থাকা মাংসের মতোই অদৃশ্য হয়ে যাবে। 

টুনু ছাদের একপ্রান্তে গেল। অনেকটা নীচে এখন গম্বুজের চৌহদ্দি, প্রাচীরের সীমানা। ক্যালকুলাস কি ঘুমিয়েই পড়ল এতক্ষণে? 

হঠাৎ টুনুর মনে হল, পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল টুনু। পেছনে ঘুরলেই নেই হয়ে যাবে, কিন্তু এখন আলতো টোকা দিলেই সে সোজা নীচে আছড়ে পড়বে ঘাড়ভাঙা পুতুলের মতো। 

অথবা সুতনু সরকারের মতো। 

সুতনুর বেস্ট ফ্রেন্ড যে ছিল, সেই রোহণ আগরওয়াল নাকি দিনের পর দিন হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছে ছাদের ওই পাঁচিলটার দিকে, যেখান থেকে সুতনু পড়ে যাবার পর প্রবেশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খেত না, ক্লাস করত না, শুধু বসে বসে পাঁচিল দেখত। তারপর তো তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়েই নিল তার বাবা মা। টুনু কতদিন ভেবেছে রোহণের পাশে গিয়ে বসে, আঙুল দিয়ে তাকে একবার ছোঁয়, তার সমস্ত বিভ্রান্তি ও ভয় জমাট বেঁধে যে স্থবির রূপ নিয়েছে সেটাকে কেটে কেটে ভেতরে বইয়ে দেয় মখমলের কোমলতা। কিন্তু কোনও দিনই এগোতে পারেনি। আর আজ পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে তার সুতনু নয়, রোহণের কথাই মনে হচ্ছে বেশি করে। সে পড়ে গেলে কেউ কি ওভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে এই গম্বুজের দিকে? যদি এখনই ঠেলা মারে, পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে? তার নিঃশ্বাস টুনুর ঘাড়ের কাছে পড়ছে, তার একটাই পা দিয়ে বারবার ব্যাল্যান্স করে নিচ্ছে, কাঁধের ঝোলাটা মাটিতে নামাবে কি না এখনো স্থির করে উঠতে পারছে না, হয়তো তার আগেই এক হাতে ধাক্কা মারবে আলতো। 

এক দমে নীচে এসে হাঁফাতে লাগল টুনু। কী ভয়ঙ্কর এই রাত, সে বাড়ি ফিরবে কী করে? কী আছে এই গম্বুজে যে ক্যালকুলাস তাকে টেনে নিয়ে আসল? দূরে নাকি নদী বয়ে যাচ্ছে একটা, যেখান থেকে একানড়ে মাছ ধরে নিয়ে আসে।

মুহূর্তের মধ্যে টুনুর প্রাণপণ ইচ্ছে হল, ঠেলা মারবার আগে সে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়ুক। এই গ্রামের অনেক বাচ্চা মরে গেছে, এবার তার পালা। কিন্তু একানড়েকে জিততে দিলে হবে না। তার আগেই ও নিজে লাফ দেবে। টুনু পায়ের পেশি শক্ত করে গোড়ালি উঁচু করল, সম্মোহিত তাকাল নীচের দিকে। কিছুদিন আগেই মামাবাড়ির কুয়োর কুচকুচে কালো জলের অতলান্ত অন্ধকার দেখে তার মনে হয়েছিল একবার লাফিয়ে পড়ে। কিন্তু এই অন্ধকার বনভূমির আকর্ষণ আরো করাল, দুর্বার তার পিচ্ছিলতা। টুনুর ঘাড় উঁচু হয়ে উঠল অজান্তেই। পেছনে যে দাঁড়িয়ে, সে আরেকটু কাছে আসলেই, এবারেই… 

কেউ আসল না। শুধু হা হা করে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের মতো। 

নিঃশ্বাস ফেলে পিছিয়ে আসল টুনু। আর একটু হলেই সে লাফাতে যাচ্ছিল। একানড়ে কি সেটাই চায়? তাই ক্যালকুলাসকে দিয়ে ডেকে আনা? কিন্তু সারা ছাদে কেউ নেই সে বাদে, আর অবসাদ আক্রান্ত মৃত মাছেদের কঙ্কাল বেয়ে, লতাগুল্মের জটিলতা ভেদ করে তার মাথার দিকে উঠে আসছে একটা প্রচণ্ড রক্তের ভাপ। তার চোখ জ্বালা করল, বুঝল মাথা ভারী হয়ে আসছে, ফ্যাকাসে রুগ্ণ লাগল নিজেকে, আর তখন সে সিঁড়ির দিকে ছুট লাগাল। বেশিক্ষণ এখানে থাকলে সত্যিই ঝাঁপ দেবে হয়তো। 

এক দমে নীচে এসে হাঁফাতে লাগল টুনু। কী ভয়ঙ্কর এই রাত, সে বাড়ি ফিরবে কী করে? কী আছে এই গম্বুজে যে ক্যালকুলাস তাকে টেনে নিয়ে আসল? দূরে নাকি নদী বয়ে যাচ্ছে একটা, যেখান থেকে একানড়ে মাছ ধরে নিয়ে আসে। কিন্তু এই গম্বুজ বলো বা নদী, তাকে যদি কিছু বলতেও বা চায়, আপাতত টুনু নির্বোধের মতো সে সঙ্কেতকে আকণ্ঠ পান করতে চাইলেও বুঝে উঠতে পারে না। সে যেন দিদার জানালা ধরে বসে থাকা অথবা মায়ের আসতে না চাওয়ার মতোই অজ্ঞেয়। টুনু এলোমেলো এদিক ওদিক ঘুরতে লাগল। প্রাচীর ফাটিয়ে যে অরণ্য দখল নিতে আসছে গম্বুজের একদা দক্ষ আড়াল, তাকেই ভেদ করে আবার ফিরে যেতে হবে, কারণ ক্যালকুলাসকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। 

‘আহহ !’ টুনু কাতরে উঠল। পা কেটে গেল কীসে? ভাঙা শামুক? গম্বুজের দেওয়ালের গা ঘেঁষে বসে পড়ল। অনেকটা কেটেছে, কালচে রক্ত নেমে আসছে। টুনু চোখ চালাল ঝোপঝাড়ের মধ্যে। 

একটা ছুরি। ফলাটি মরচে পড়ে লাল। বেকায়দায় ছুরিটার ওপর গোড়ালি পড়ে গিয়েছিল। টুনু হাতে তুলে দেখল, চিকচিকে কিছু রক্ত এখনো ইতস্তত করছে ছুরিটার ফলায়। একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে পায়ের রক্ত মুছে নিল, কিন্তু তাতেও থামছে না। আরেকটা পাতা চেপে ধরল টুনু। জ্বালা করছে অল্প। তখন তার চোখ পড়ল দেওয়ালের গায়ে। 

অনেকগুলো নাম লেখা পরপর। খুব গভীরভাবে খোদাই করা হয়েছে, অনেক ঝড়জলেও মুছবে না। ‘দেবু’, ‘ছোটন’, ‘বাপ্পা’, ‘গণেশ’, ‘বাবান’–এরা কারা? গ্রামের ছেলেপুলে? খেলতে খেলতে এখানে এসে নিজেদের নাম লিখেছে, যেমন টুনুরা করে স্কুলের ট্যাঙ্কের গায়ে? ছুরিটাও কি তাহলে তাদেরই? নাহলে এই ভুতুড়ে গম্বুজে একলা ছুরি কার প্রত্যাশাতেই বা পড়ে থাকবে? তখন জোরে হাওয়া দিল, কেঁপে উঠল বেতের জঙ্গল, একরাশ ধুলো উড়ে গেল এদিক সেদিক, দেওয়ালের গা থেকেও, আর আচ্ছাদন সরে গেলে যেমন হয়, টুনু দেখল, দুটো নামের পাশে পাশে আরো কিছু যেন লেখা। না কি, আঁকা? 

দেবু? 

ছোটন 

বাপ্পা? 

গণেশ   

কৃষ্ণ 

বাবান 

টুনু সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকল। দুটো নামের পাশে জিজ্ঞাসাচিহ্ন, বাকিগুলোর পাশে নেই। কেন? এরা কারা? আর, খুব কাছে, কিন্তু খুব আস্তে, কারা ফিসফিস করছে না? যেন একাধিক গলা, নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। টুনু চারপাশ তাকাল। কেউ নেই। শুধু একটা বক গাছের ডাল থেকে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।

 নিবিষ্ট কান পাতল টুনু। হ্যাঁ, ফিসফিস করছে, কিছু অবোধ্য ভাষায়। বোঝা যাচ্ছে না কিছুই, কিন্তু সে জানে না কেন মনে হচ্ছে যে কথাগুলো তাকে শুনতে হবে স্পষ্ট করে। বুঝতে হবে, কী চায়, কে থাকে এই গম্বুজে, যে টুনুকে ডেকে নিয়ে আসল, এই নামগুলোই বা কারা! কথাগুলো কোথা থেকে ভেসে আসছে? না, আশেপাশে নয়। যেন তার মাথার ওপর দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে সরসর করে। মাথার ওপর দিয়ে, মানে যে বলছে, সে তাহলে… 

 টুনু ওপরে তাকাল। অনেকটা ওপরে গম্বুজের মাথা। সেখানে কেউ একজন দাঁড়িয়ে টুনুকে দেখছিল এতক্ষণ, মাথা তুলতেই সরে গেল। টুনু শুধু দেখল তার অপস্রিয়মাণ ছায়া গম্বুজের দেওয়ালে পিছলে যাচ্ছে।

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আগের পর্বের লিঙ্ক – [১] [২] [৩] [] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *