হেমন্তের চাঁদ রক্তাক্ত হয়, ভরা পূর্ণিমায় গোল থালাটির দিকে তাকালে স্পষ্টত যে ক্ষরণ। নিঃশব্দ অন্ধকার জঙ্গলের ওপর থমথমে চাঁদটি যখন জ্যোৎস্নার আঁচল বিছিয়ে দিচ্ছে মাঠময়, টুনুর মনে হয়েছিল এই আলোতে চরাচরের আপাদমস্তক সে মুখস্থ করে ফেলতে পারে। সন্ধ্যেবেলাই ঝট করে একবার বেরিয়ে তালগাছের নীচে চিঠি রেখে এসেছে, ফলত ঝিমঝিম রাত্রে সারা শরীরে সুখকর ব্যথাজ্বরকে চাখতে চাখতে টুনু ঘুমিয়েই পড়ত, কারণ অন্য অবকাশ কি উপদ্রব এই মুহূর্তে তার কাছে কিছুই ছিল না, যদি না অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে টেনে হিঁচড়ে যেতে হত বাথরুমে। যেহেতু সে আর বিছানায় হিসি করবে না, আর রাগিয়ে দেবে না দিদাকে, তাই ঘুমের আগে বাথরুমে যাওয়া, জল না খাওয়া তেষ্টা পেলেও, এগুলোই আপাতত রোজকার প্র্যাকটিস। এবং বাথরুমে যেতে গিয়েই টুনুর চোখে পড়ল ছোটমামার ঘর।
ঘরের দরজা খোলা, আবার। চাঁদের আলোতে বাইরের গাছপালা খোলা পাল্লার গায়ে নির্মাণ করেছে বিচিত্র সব ছক। ভেতরের অন্ধকার নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে তার প্রতীক্ষায়।
মৃদু হাসল নিজের মনেই–এ কী আশ্চর্য খেলা খেলছে তার সঙ্গে ! একটা করে চিঠি পাঠালেই যদি ছোটমামার ঘরের দরজা একবার করে খুলে যায়, যেন চিঠিগুলোই এক একটা চাবি, তাহলে কি এতদিন ধরে একানড়ে শুধুই অপেক্ষা করে গিয়েছে কবে তার সঙ্গে কেউ কথা বলবে? নাকি ওই ঘরের মধ্যে যে থাকে, সে ছোটমামাই হোক বা অন্য কেউ, অথবা ওই তালগাছের মাথায় যে, টুনুকে সত্যিই নিয়ে যেতে চায়?
ঘরের ভেতর সবই আগের দিনের মতো তকতকে। শুধু দেওয়ালের ছোপটাকে এবার স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আস্তে আস্তে নড়াচড়া করছে। বেড়ে উঠছে আয়তনে। টুনু ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখল।
জায়গাটা আবার ধকধক করছে, খুব মৃদু, এবং খুব হালকা পচনের গন্ধই ভেসে বেড়াচ্ছে আপাতত, কিন্তু বোঝা যায়, একটা নষ্ট চামড়ায় ঢাকা দুর্বল হার্ট যেন ব্লিড করতে করতে অবসন্ন নেতিয়ে পড়ছে। হার্টটার গায়ে কান রাখল টুনু, এবং পাথুরে দেওয়াল শীতল নৈঃশব্দ দিয়ে খানখান করে দিল তার ভেতরের চিৎকার। টুনু বুঝল, তার বুক আবার দ্রুত ওঠানামা করছে, গায়েও হয়তো উত্তাপ, কিন্তু খোলা জানালার আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। দেওয়ালের ছোপটা তার কানে শব্দহীন ফিসফিস করে জানাচ্ছে‒ জানালার কাছে যাও।
জানালার ধারে এসে দাঁড়াল টুনু। অমল জ্যোৎস্নায় তালগাছ দেখল, দেখল মাঠ মুখে নিয়ে বিশ্বমামার ঘুমন্ত ঘর, জানালার ধারে ঝুঁকে পড়া নারকেলপাতার জাফরি, এবং সে বাদেও বাগানে এক দ্বিতীয় অস্তিত্বকে।
কুকুরটা পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। যে চোখদুটি জ্যোৎস্নার অভাবে জ্বলজ্বলে হবার কথা, আপাতত দুটো অন্ধকারের ডেলা বাসা বেঁধেছে কোটরে। এখন পচা চামড়ার গন্ধটা টুনু আরেকটু স্পষ্ট করে পেল। এই গন্ধটা সে চেনে, নাক এবং হাতের স্পর্শ এক সময়ে তার ভেতর থেকে ঠিকরে আসা কান্নার সঙ্গ দিয়েছিল, যখন স্কুল ফেরতা টুনু হাঁটু মুড়ে বসে হাত বুলিয়ে দিত সেই তলতলে ত্বকে।
‘প্রফেসর ক্যালকুলাস !’ টুনু ফিসফিস করে বলল।
ভেতরে ঢোকবার আগে টুনু দেখল, চাঁদ ঝুলে রয়েছে প্রস্তরীভূত ক্যালকুলাসের নাকের ওপর। একটু টোকা মারলেই বেলোয়ারি অরণ্যের মাথায় অন্ধকার রক্ত ছিটিয়ে ভেঙেচুরে পড়বে।
ক্যালকুলাস নীরবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, একটি প্রস্তরমূর্তি, শরীরের একটি পেশিও নড়ছে না। তবুও টুনু বুঝল, তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। যখন আসানসোলের বাড়ির সামনের ফুটপাতে মরে যেতে যেতে সজল চোখে তাকিয়ে থাকত টুনুর জানালার দিকে, অথবা টুনু তার গায়ে কোমল হাত বুলিয়ে দিলে যখন হাত চেটে দেবার অক্ষম চেষ্টায় ঘাড় নুয়ে যেত তার, তখন টুনুর এক সমুদ্র মনখারাপের ওপর তেলের মতো ভেসে থাকত ক্যালকুলাসকে ভাল করে দেবার ইচ্ছে। মুদ্দাফরাশের গাড়ি এসে ক্যালকুলাসকে তুলে নিয়ে যাবার পরেও টুনু অনেকদিন তাকিয়ে থাকত জানালা থেকে, যদি একবার দেখা যায়। আর এতদিন পরে যখন সত্যিই দেখছে, বুঝতে পারছে যে ক্যালকুলাস তাকে নীচে নামতে বলছে, তখনো টুনুর উচ্ছ্বাস কেন হচ্ছে না তা ভেবে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল। শুধু মনে হচ্ছে, নীচে নামতে হবে, যেতে হবে বাগানে। ভয়, অথবা আনন্দ‒ সমস্তকেই ভুলিয়ে দিয়েছে, যেটুকু ক্যালকুলাসের হৃদয়।
বাগানে পা রেখে টুনু দেখল, ক্যালকুলাস তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই মুখ, সরু সরু পা, পেটের কাছের গভীর ঘা-টাও অবিকল, পচা গন্ধটা ভেসে আসছে যেখান থেকেই। শুধু দুই চোখে অন্ধকার, মণি নেই। টুনু এগিয়ে গিয়ে হাত রাখতে গেল, কিন্তু একটু সরে গেল ক্যালকুলাস। ভাঙা পাঁচিল টপকে পেরল, তারপর টুনুর দিকে আবার তাকাল। তখন টুনু দেখল চাঁদের রক্ত। এবং পাঁচিলের ওপর পা রাখল।
মাঠের ভেতর দিয়ে ক্যালকুলাস হাঁটছে, মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে দেখছে টুনু আসছে কি না। কিন্তু কিছুতেই কাছাকাছি আসতে দিচ্ছে না, যেন বা হাওয়ার স্রোত কেটে ভেসে যাচ্ছে সামনে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? তালগাছকে পেছনে ফেলে তারা হেঁটে যাচ্ছে, এবং থমথমে আকাশ, নিথর প্রকৃতি ও স্তব্ধ রাতপাখির দল কেউই টুঁ শব্দটি না ফেলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখে যাচ্ছে তাদের গতিপথ। তালগাছ পেরবার সময়ে টুনুর গতি কিছুটা মন্থর হয়েছিল, থেমেও গিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত, এবং ওপরে চোখ মেলেছিল যদি কিছু দেখা যায়। দেখেছিল ঝুপসি একটা মাথা, যার ভেতরকার আশ্চর্য অন্ধকারকে আপাতত কোনও সার্চলাইট দিয়েই ফুঁড়ে ফেলা যাবে না, জ্যোৎস্না তো নয়ই, এবং পিছু ফিরে চোখে পড়েছিল জাহাজের মতো তার মামাবাড়ি দূরে একলা দাঁড়িয়ে, যার একটা ঘরেই আপাতত আলো জ্বলছে। ছোটমামার ঘর। কিন্তু জানালায় কেউ দাঁড়িয়ে নেই।
মাঠ জুড়ে ছড়ানো মরা ঝোপ, মৃত শেয়াল, বেড়াল ও শামুকের খটখটে করোটির ভেতর ঢুকে চাঁদের আলো লুটোপাটি খাচ্ছিল, যাদের পায়ে পায়ে ঠেলে তারা এগিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতর। টুনু দেখল ঝুলে থাকা আকাশ ছোট হতে হতে কালো চাদরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, আর তার পথ রোধ করে রুখে আসছে নিম তেঁতুল কি বাঁশঝাড়ের লেঠেল বাহিনী। তবুও চোখের আশ্চর্য অন্ধকার কোটর দিয়েই হয়তো ক্যালকুলাস কেটে কেটে নিচ্ছে নিজস্ব রাস্তা, আপাতত টুনুর অন্য কাজ নেই যাকে অনুসরণ করা বাদে। দুইপাশের ধেয়ে আসা ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছে একটা শুঁড়িপথ, একবারও কোথাও ঠোক্কর না খেয়েই অভ্রান্ত চিনে নিচ্ছে ক্যালকুলাস। সাপের মতো হিলহিলে ভয় টুনুকে জড়িয়ে ধরতে যে চাইছে না তেমনটা না হলেও, সেই ভয়কে বাধ্য হয়েই সরিয়ে রাখতে হচ্ছে কিছুটা দূরে। নরম পাতার দল তার গায়ে এঁকে দিচ্ছে হিমেল আদর, আর টুনুর মনে হচ্ছে যদি ক্যালকুলাস একটু দাঁড়াত, সে হয়তো আবার হাত বুলিয়ে দিত তার গায়ে, যে স্পর্শে আকাশ হেসে ওঠে সমস্ত ভয়কে টান মেরে ছুড়ে ফেলে, এবং ক্যালকুলাসের জন্য অপেক্ষারত যাবতীয় বেওয়ারিশ গোরস্থান মিথ্যে হয়ে যায় এক লহমাতেই। কিন্তু ক্যালকুলাস বেশ কিছুটা আগে, এবং নিঃশব্দে হাঁটলেও টুনু বুঝতে পারছে যে তার গায়ে কিছুতেই হাত দিতে দেবে না। শুকনো পাতাদের দল মাড়িয়ে কতক্ষণ হাঁটছে তারা, হিসেব নেই, টুনু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ফেলে আসা পথ বুঁজে গিয়েছে অরণ্যে। চাইলেও আগের রাস্তায় আর ফিরে যেতে পারবে না।
কুকুরটা পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। যে চোখদুটি জ্যোৎস্নার অভাবে জ্বলজ্বলে হবার কথা, আপাতত দুটো অন্ধকারের ডেলা বাসা বেঁধেছে কোটরে।
একটা সরু ও মজা খাল, বুঁজে গিয়েছে ঝোপেঝাড়ে। হালকা লাফ মারলেই পেরনো যায়। তার পর চারধারে ছড়িয়ে আছে কত পাথর, ইটের টুকরো, ভাঙা মূর্তির নিষ্পলক, ধ্বসে যাওয়া পাঁচিল। তেমনই একটি ভগ্নস্তূপের উপর উঠে দাঁড়াল ক্যালকুলাস। গোল চাঁদকে পিছনে রেখে তার কালো মূর্তিকে দেখে টুনুর ভয় লাগল। যখন ক্যালকুলাস মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাল। টুনুও ঘাড় তুলল তখন।
ভাঙা পাঁচিলের ওপাশে উঁচু স্থাপত্য, ইট খসে খসে পড়লেও যার গম্ভীর মাথাটি আকাশের বুকে এখনো থমথমে। খুব একটা চওড়া নয়, বরং উঁচুর দিকেই বেশি। গা বেয়ে পাক দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি, কিন্তু কালের নিয়মে স্থানে স্থানে ভেঙে পড়েছে, অদৃশ্য হয়ে গেছে মাঝপথেই। আশেপাশে বেতের জঙ্গল, বাঁশবন মিলে ঘিরে ধরেছে, দেওয়াল ফাটিয়ে উঁকি দিচ্ছে অসংখ্য চারাগাছ। একটা বড় নিমগাছের ছায়া ভেঙে ছড়িয়ে আছে সমগ্র স্থাপত্যের ওপর, হাওয়াতে সরে সরে যাচ্ছে বারেবারে। তিরতির করে কাঁপছে বেতবন, আর আওয়াজ হচ্ছে সি সি। দিদা যেমন বলেছিল, একানড়ের গল্প বলতে গিয়ে। কানা ঘুলঘুলিগুলোকেও স্পষ্ট দেখা যায়, জ্যোৎস্না কোথাও এতটুকু মালিন্যের অবকাশ রাখেনি।
স্বপ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছে, ফলত গম্বুজটিকে চিনে নিতে অসুবিধে হবার কথাও ছিল না। এই সময়ে চরাচর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তার হাহাকার বাতাস গম্বুজের ভেতর ঢুকে হাতছানি দিল টুনুকে। ভেতরে ঢোকবার আগে টুনু দেখল, চাঁদ ঝুলে রয়েছে প্রস্তরীভূত ক্যালকুলাসের নাকের ওপর। একটু টোকা মারলেই বেলোয়ারি অরণ্যের মাথায় অন্ধকার রক্ত ছিটিয়ে ভেঙেচুরে পড়বে।
আগামী পর্ব প্রকাশিত হবে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আগের পর্বের লিঙ্ক [1] [2] [3] [4] [5] [6] [7] [8] [9] [10] [11] [12]
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।