‘দে-দেবু, আস্তে চ্চল। আমি প-পারছি না জোরে হাঁটতে’। হাঁফাতে হাঁফাতে বাবান বলল।
একটুকরো আলো অতি আলগোছে আকাশের দূর প্রান্তরে ঝুলছে, ফলত ভোর চারটের অনচ্ছ অন্ধকার জামের খোসার মত পাতলা ও ভঙ্গুর। ভেজা মাটির ওপর ক্ষীণ তারাগুলো খসে পড়ল বলে, যদিও ঝোপঝাড়গুলো রক্তআভায় লাল হয়ে ওঠার এখনো কিছু দেরি। একটা রাত-পাখি নরম ডানায় ভর করে প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে দেবুর গা ঘেঁষে উড়ে গেল। মাঠের ধারে একা তালগাছটি ভিজে টুপটুপে চোখে যেন হিম কৌতুক, যাকে পেছনে ফেলে দেবু, বাবান আর বাপ্পা এগিয়ে চলেছে, বাবানের কাঁধভর্তি আমের বস্তাসমেত। দেবু দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘আমাকে দাও’।
বাবান পা বাড়িয়ে দিল, ‘কাঁটা ফ-ফুটেছে। ছা-ছাড়িয়ে দে’।
বাপ্পার অস্বস্তিকে চোখ ঠেরেই দেবু নির্বিকার মুখে বসে পড়ে বাবানের পা তুলে নিল নিজের কোলে। একটু পর উঠে দাঁড়াল, ‘বেরিয়েছে। তোমাকে বলেছিলাম, এসব পারবে না। যদি বাড়ির লোক জানে যে আম চুরি করে বেচে এসেছ, পিঠের চামড়া তুলে নেবে।’
বাবান বিদ্রোহীর ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকাল, ‘আমি ভ-ভয় পাই নাকি?’
বাপ্পা মাঠের ধারে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ বলে উঠল, ‘দোতলায় একটা বাচ্চা ছেলে রে দেবু ! আগে তো দেখিনি কখনো ! ঘুরতে এসেছে নাকি?’
‘কোথায়?’
‘জানালা খুলল মনে হল’।
‘ওরকম মনে হয়। ও বাড়িতে অনেক কিছু ঘটে। সন্ধেবেলায় কাদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, দরজা জানলা দড়াম করে খুলে যায়, হঠাৎ করে হাওয়া বয় শোঁ শোঁ। পুরনো তেলরঙ ছবি দুম করে পড়ে যায়।’
মুখেচোখে আতঙ্ক এঁকে বাবান দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘ঢপ ম্মারিস না দে-দেবু !’
‘তোমার বিশ্বাস হয় না?’
‘ন্না, শু-শুনব না এসব।’ বাবান কানে হাত চাপা দিল।
‘এই তালগাছটায়, তুমি জানো না? আমিই তো কতবার–‘
ধপ করে ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে উলটে পড়ল দেবু। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বাবান ক্রুদ্ধ স্বরে, ‘কতবার ব-বলেছি শশালা ! ফ-ফালতু ভ-ভ-ভ…’ রাগের সংগে উত্তেজিত শ্বাস আটকে মুখ লাল হয়ে উঠছিল, এদিকে দেবু মাথা নিচু করে নীরব। বাপ্পা কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে চেঁচাল, ‘তোরা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি, দেবু? এবার কিন্তু আলো ফুটে গেলে ধরা পড়ে যাব।’
কিছুক্ষণ সবাই নিশ্চুপে হাঁটতে থাকে। মাঠ, জঙ্গল, মাটি সবকিছুকে ঘিরেই জ্বাল দেওয়া দুধের মত ঘন হয়ে বসে শিশিরের সর। বাবান পরিস্থিতি হালকা করবার জন্য দেবুর দিকে তাকিয়ে বেখাপ্পা হি হি হাসে, ‘শোন, একদম ব্যাকসিট নে-নেব, আর পেপ- পেপসি নেব সাথে, হ্যাঁ? তার প-পরেও টাকা থাকবে অন্নেক। ব-বুঝলি? একটা সানগ-গ্লাস কিনব। তোকেও দ্দেব। হ্যাঁ?’
‘তোমার আমগাছ, তোমার টাকা, যা খুশি করবে।’ নির্লিপ্ত হাঁটে দেবু।
‘কে জানে ! দাদার বডি নিয়ে এসেছিল। ট্রাকটা ধাক্কা দিয়েছিল সাইড দিয়ে। মাথার একদিক ছিল না, ফেটে ঘিলু বেরিয়ে গেছিল, আর চোখটা ঝুলছিল। কিন্তু অন্যপাশটা একদম ঠিকঠাক ছিল, দেখে মনে হবে ঘুমোচ্ছে। আমি অনেকদিন স্বপ্ন দেখেছি, দাদা আমাদের ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর খুব চেষ্টা করছে চোখটাকে আবার সেট করে নিজের জায়গায় বসাতে, কিন্তু পারছে না। ভাল চোখটা থেকে জল বেরচ্ছে খালি।’
বাবান দাঁড়িয়ে পড়ে। সব হারানোর ভরসাহীন স্বর তার গলায়, ‘তু-তুই রাগ করলি? বল না, রাগ করলি দেবু? এই বাপ-পা, বোঝা ন্না ওকে। ও ঢ-ঢপ মারছিল তো ! এই দেবু—‘
দেবু নিশ্চুপে বাবানের দিকে তাকায়। বোঝা যায় না কী ভাবছে। বাবান মরীয়া হয়ে বলে চলেছে, ‘আজ ফা-ফাস্ট ব্যাট তোর। প্র-প্রমিস। ফি-ফিল-ডিং দিতে হ-হবে না। এই বাপ-বাপ্পা, বল না তুই কিছু।’
‘কী বলব। তুমি ফালতু ধাক্কা মারলে কেন! দেবু কিন্তু তোমার থেকে বড়।’
বাবানের রোগা শরীরটা কাশিতে বেঁকে যায়। কাশতে কাশতে নুয়ে পড়ে সে। এবার দেবু এগিয়ে এসে বাবানকে ধরে পিঠে থাবড়া মারে, ‘বলেছিলাম তোমাকে, এত ভোরে এসো না। আমরা যা পারি, তোমার দুর্বল শরীরে তা সহ্য হয়?’
কাশির মধ্যেই ফুঁসে ওঠে বাবান, ‘কে-ক্কে বলল আমি দুর্বল?’
‘আচ্ছা আচ্ছা দুর্বল নও। এবার পা চালাও। বেচতে হলে ভোর ভোর আড়তে যেতে হবে।’
তিনজনের মধ্যে বাপ্পা সবার পেছনে। তার মনে হচ্ছিল, দাদা পাশে পাশে হাঁটছে। বাপ্পা মাঝে মাঝেই বুঝতে পারে, দাদাকে। যেমন এখন, অকস্মাৎ শিরশিরিয়ে উঠল পেটের ভেতর, কারণ মনে হল ফেলে আসা তালগাছের দিক থেকে কেউ নীরবে নজর রাখছে। দাদা? ঝট করে পেছনে ঘুরে, শুধুই কুয়াশা, আর দূরের বড় বাড়িটার দোতলার জানালা বন্ধ করে দিল কেউ। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাপ্পা বলল, ‘দেবু, একটু বসে যা।’
‘দেরি হয়ে যাবে।’
‘জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাই কেউ দেখতে পাবে না। ছোটনরা আসুক আগে, একসাথে যাব।’
প্রায়ান্ধকার বনের ভেতর একটা বুড়ো তেঁতুলের তলায় কিছুটা ফাঁকা। শিশিরভেজা মাটি থেকে তাজা গন্ধ ভেসে আসছে, কাছে দূরে ঘন কুয়াশায় নিবিড় ডুবে আছে চরাচর। গাছ থেকে শুকনো পাতার স্তূপের ওপর টপ টপ জল পড়ার শব্দ হচ্ছে কাছেই কোথাও, তেঁতুলের ভেজা ছালের ভেতর লুকিয়ে একটা পোকা টিরির টিরির করে অবিশ্রান্ত ডেকে যাচ্ছে । বাপ্পা শুয়ে পড়ল। দেবু তার পাশে বসে ঠেলা মারল, ‘আড়ত কিন্তু সকাল সকাল খুলে যাবে।’
‘ছোটনরা এখানে আসবে বলেছে। একসাথে না গেলে খিস্তি করবে।‘
বাবান দেবুকে বলল, ‘তু-তুই সত্যি দেখেছিস? তা- তালগাছের মাথ-থায়?’
‘হ্যাঁ, গেলবার বড়দিনের আগে, তুমি যখন শীতের ছুটিতে পিসির বাড়ি গেছিলে। আমি, বাপ্পা, বিষ্ণু, গণেশ, আরো আরো, প্রায় দশজন মতন মিলে ভোরবেলা বাড়ি ফিরছিলাম। কুলডিহিতে মাচা শো হচ্ছিল, পোসেনজিত এসেছিল, বাড়ি থেকে ঢপ মেরে দেখতে গেছিলাম। ফেরার সময় দেখি, ঠিক মাঠের মধ্যিখানে, কুয়াশার মধ্যে স্যাট করে কেউ বাঁদিক থেকে ডানদিকে চলে গেল। তা আমরা ভেবেছি এখানকারই কেউ। হঠাৎ করে শুনি সামনে খচমচ আওয়াজ। যেন কেউ গা ঘষটাচ্ছে। গণেশ একটু দৌড়ে এগিয়ে গেল ‘কে রে’ বলে। আমরা একটু পেছনে ছিলাম। কাছে এসে দেখি, গণেশ সাদা কাগজের মত কাঁপছে। ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কথা বেরচ্ছে না। কোনওমতে হাত তুলে দেখাল। অস্পষ্ট দেখলাম, তালগাছ বেয়ে কেউ একটা উঠছে। আমি শুধু পা দেখেছিলাম, একটাই পা, ঠিক মানুষের পা নয়, যেন হাতির মত মোটা, ফোলা ফোলা, পায়ের পাতা বোঝা যাচ্ছিল না, শুধু কালো মোটা লোম, ধারালো বাঁকা নখ। আর ঝুলি ছিল একটা। ওটুকু দেখেই তো আমার হয়ে গেছে ! আর কিছু কুয়াশায় দেখা যায়নি। কিছু বোঝবার আগেই সড়সড় করে উঠে গেল।’
‘কি-কিন্তু তোরা তো তাল-তালগাছে উঠিস’। বাবান ভীতস্বরে বলল।
‘অনেকে থাকলে ভয় নেই তো। আমিই কত তাল পেড়েছি। ভয় শুধু দুপুরবেলা আর ভোরবেলা।’
বাপ্পা বলল, ‘ঘোষেদের বাচ্চাটা তো আগের মাসেই হারাল। এই নিয়ে তিনটে বাচ্চা এই বছর–‘
‘ধুর ওটা একানড়ে না। ছেলেধরা নিয়ে গেছে। ওদের পাড়ায় খুব আসছিল।’
‘জানি না। তবে সেদিন তোদের পেছনে ছিলাম বলে আমি আরেকটু বেশি দেখেছিলাম। যখন উঠছিল তালগাছ বেয়ে, গা ফেটে রক্ত গড়াচ্ছিল। কুয়াশায় অর্ধেক শরীর ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। যেটুকু দেখেছিলাম, মুখ দেখতে পাইনি, শুধু পিঠটুকু, সেখান থেকে কালো লোম বেরিয়ে আছে এখানে ওখানে। আর রক্ত গড়াচ্ছিল, পুঁজ পুঁজ। আমার দাদার কথা মনে পড়ছিল।’
কিছুক্ষণ সকলে চুপ করে থাকে। বাবান কাঠি দিয়ে আনমনে মাটির ওপর দাগ কাটছে। একটু পর মুখ তুলে অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘তোর দাদ-দাদা কি ভূত হ-হয়ে ঘুরছে?’
‘কে জানে ! দাদার বডি নিয়ে এসেছিল। ট্রাকটা ধাক্কা দিয়েছিল সাইড দিয়ে। মাথার একদিক ছিল না, ফেটে ঘিলু বেরিয়ে গেছিল, আর চোখটা ঝুলছিল। কিন্তু অন্যপাশটা একদম ঠিকঠাক ছিল, দেখে মনে হবে ঘুমোচ্ছে। আমি অনেকদিন স্বপ্ন দেখেছি, দাদা আমাদের ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর খুব চেষ্টা করছে চোখটাকে আবার সেট করে নিজের জায়গায় বসাতে, কিন্তু পারছে না। ভাল চোখটা থেকে জল বেরচ্ছে খালি।’
বাবান শিউরে উঠল, ‘ঢ-ঢপ মারবি না !’
‘তোমার এত ভয় যখন, শুনতে চাও কেন? আবার তো ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে কাঁদবে।’ দেবু বলল।
‘চু-চুপ কর। বেশি বকলে বা-বাবাকে বলে দ্দেব, তুই আম চু-চুরি করে বেচে সিনেমা দেক-দেখেছিস। ঠ্যাঙানি খেলে বু-বুঝবি।’
‘চুরি তো তুমি করেছ !’ বাপ্পা অবাক হল।
বাবান হি হি করে হেসে দেবুর দিকে তাকাল। দেবু অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘তুমি ছোটলোকদের ছেলেপিলের সঙ্গে মিশছ, এটা জানলে কি কম ক্যালান দেবে?’
‘তুই যখের গল্পটা বল’, বাপ্পা বলল।
‘ওটা ছোটন দেখেছে, ও আসলে বলবে। আমি শুনেছি ওর কাছ থেকে।’
হঠাৎ তাদের পাশ দিয়ে সড়সড় করে কী একটা চলে গেল জঙ্গলের ভেতর। বাবান আঁতকে উঠে জড়িয়ে ধরতে দেবু হেসে ফেলল, ‘আরে গোঁয়ারগেল, ডিম ছাড়বার সময় হয়েছে এখন।’
বাবান একটুখানি চুপ থেকে নিঃশ্বাস ছাড়ল, ‘তো-তোরা সবাই ভাবিস আমি ভী-ভীতু। দেখিয়ে দে-দেব একদিন।’
‘কী দেখাবে? একানড়েকে ধরে আনবে?’ দেবু হাসল।
শুকনো পাতায় পায়ের আওয়াজে সচকিত হয়ে উঠল তিনজন। ‘এই শালা দেবু’ বলে হাঁক পাড়ছে কে। দেবু উঠে দাঁড়াল, ‘ছোটন। দাঁড়া নিয়ে আসি, নাহলে কুয়াশায় খুঁজে পাবে না।’
দেবু আর বাপ্পা চলে যাবার পর জায়গাটা থমথমে হয়ে গেল। বাবানের মনে হল, এখুনি তেঁতুলগাছের মগডাল থেকে তার ওপর কেউ ঝাঁপিয়ে পড়লেও শুনতে পাবে না অন্যরা। চোখ বুজে ফিসফিস করল বাবান, ‘আমি ভিতু নই। একদিন দেখিয়ে দেব।’
পরবর্তী পর্ব : ১ ডিসেম্বর, সন্ধে ছটা।
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।