এই যে, শুনুন, বেশি রং নেবেন না তো!
চামড়ার রংয়ের ক্ষেত্রে এই রং নেওয়া যে কতদূর যেতে পারে, তা আমাদের সবার হাড়ে হাড়ে জানা আছে, আমরা যারা ভারতীয়। আমরা, যারা কেষ্টঠাকুরটি আর রামচন্দ্রকে পুজো করে থাকি।
দুর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্র কী করে আর্যদের দেবতা হলেন? আর্যরা সব ইউরোপ-আগত, ঘোটক-চড়াও, বেজায় ফর্সা। কালো হয়েও রাম কিন্তু সেই আর্যসুলভ ব্যবহারই করলেন। মানে, শূদ্রকে কাটলেন। শূর্পনখার নাক কান কাটাকে সমর্থন জানালেন। শেষমেশ সো কলড অনার্য রাবণকেও বধ করলেন। তবু তিনি যে গৌরাঙ্গ নন এটা তো সত্যিই। এখনো পর্যন্ত সেই ধাঁধার সমাধান হল না। হল না কৃষ্ণকায় বিষ্ণুর ত্বকের রঙের সঙ্গে আমাদের ভারতীয়দের সাহেব ভজনার শ্বেতাঙ্গ-প্রীতি ও কালো চামড়ার প্রতি চাপা বর্ণ বিদ্বেষের সমঝোতা।
আমার দক্ষিণ ভারতীয় বান্ধবী বলেছিল, দক্ষিণ ভারতে প্রায় সবার রঙ চাপা। কৃষ্ণত্ব সেখানে নতুন নয়। তবু সেই সমাজও চূড়ান্ত বর্ণবিদ্বেষী। সেই সমাজেও মেয়েদের হীনম্মন্যতার কারণ তাদের গায়ের রং। সেখানেও ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির বিক্রি খুব…! আহা, ভাবা যায় এমন একটা কোম্পানি খোলার কথা, যা বেঁচেই আছে বর্ণবিদ্বেষের ওপরে?
আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, একটা অদ্ভুত সমাপতন। তখন ১৯৯২-৯৩…। সদ্য কবিতা লিখতে এসেছি, আর পত্রিকার পাতায় মেয়েদের ত্বক নিয়ে মাতামাতি দেখতে দেখতে খুব প্রেমসে লিখে ফেলেছি “বিশেষ ত্বক সংখ্যা” নামে একটি কবিতা। “ত্বকের বিশেষ কোনও বিকল্প ব্যবস্থা নেই। দ্রুত উন্নত ত্বকের জন্য প্রয়োগ করুন স্নিগ্ধ কল্পভাষা: দি অরিজিনাল।” অথবা “ত্বক মানে শিল্প আর অনুভূতি। চূড়ান্ত নিভিয়া/ আমাদের যে কোনও সম্পর্ককে দেয় অনাবাসী ঔজ্জ্বল্য।” তা সেই কবিতার একটি লাইন লিখে কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। “ত্বক মানে বর্ণগুচ্ছ, শেড কার্ড”…
চারিপাশে দেওয়ালের রং অর্থাৎ ডিস্টেম্পার কালারের বিজ্ঞাপনে শেড কার্ড দেখার অভিজ্ঞতা থেকে লাইনটি এনেছি ত্বকের ক্ষেত্রেও। ভেবেছি কী স্মার্ট লাইন! ও মা, ক’দিন পরেই দেখি এক ত্বক ফর্সা করার ক্রিমের বিজ্ঞাপন মেয়ে পত্রিকার পাতায়। চামড়ার শেড কার্ড ও বাজারে এসে গিয়েছে। মিলিয়ে নিন আপনার রং। সেটা গমরঙা না চকোলেট বাদামি নাকি অতিশ্বেত বা অতিবাদামি. ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজের গালের পাশে শেড কার্ড রেখে নিজেই বেছে নিন সঠিক রঞ্জক।
না কোনও অতিরঞ্জন না। ত্বক এখনও আমাদের অনেক কিছুকেই নির্ধারণ করে চলেছে।
২
ভারতীয় উপমহাদেশের তো হবেই এই জঞ্জাল। আমরা তো ব্রিটিশদের পদানত ছিলাম। ত্বকের রং নিয়ে বাড়াবাড়ি করা আমাদের কলোনিয়াল হ্যাং ওভার। এসব কথা বলে পার পাবেন না। গোটা পৃথিবীতেই তো বর্ণবিদ্বেষের ছাউনি পাতা। আফ্রিকার গল্পগুলো ভুলেই যান, সেই সব নেলসন ম্যান্ডেলা-কাহিনির অতি খ্যাতি, দক্ষিণ অ্যাফ্রিকার অ্যান্টি অ্যাপারথাইড আন্দোলন নিয়ে সবাই অল্পবিস্তর জানেন। কিন্তু আজও , কালো চামড়ার আফ্রো-আমেরিকান মানুষে, হলুদ বাদামি এশীয়/ভারতীয়/চিনে/কোরীয় মানুষে, স্পেনীয়ভাষী বাদামি চামড়ার লাতিন আমেরিকার মানুষে ভরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের মনের ভেতর মূল সুর ত সেই বর্ণবিদ্বেষেরই।
রাজনৈতিকভাবে সঠিক হবার জন্য অধুনার বিদেশি সিরিয়াল থেকে সিনেমা, মার্কিনি যাবতীয় প্রডাক্ট আজকাল রং সচেতন। ত্বকের সঠিক প্রয়োগের জন্য যে কোনও ছায়াছবিতে আজকাল তাই প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে একজন কালো চামড়ার আফ্রো-আমেরিকানকে রাখা হয়। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে থাকে এশীয় বংশোদ্ভুত কেউ। তবু মূল চরিত্র, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলুদচুলো সাদাচামড়াদের দখলেই থাকে অধিকাংশ। মূল ধারার ছবির এই তাকিয়াকালাম নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায়। সদ্যকার পুনর্নির্মিত শার্লক হোমসের সিরিয়াল “এলিমেন্টারি”-তে ওয়াটসনকে লিঙ্গের বেড়া পার করে মেয়ে করে দেওয়া হল। বানানো হল এশীয় বংশোদ্ভুত লুসি লিউকে ডক্টর ওয়াটসন। কিন্ত কারও কি আজও সাহস হবে শার্লককে ভারতীয় বংশোদ্ভুত করে দেখাতে? অথবা আফ্রো-আমেরিকানকে কোনও বিখ্যাত নায়িকার স্থলাভিষিক্ত করতে?
২০০২ সালে শিকাগো গিয়ে আফ্রো-আমেরিকানদের পাড়ায় গিয়েছিলাম। সেখানে রবিবারের গির্জের গান এক বিশেষ বিশিষ্ট বিষয়। শোনার মতো সেই সোল মিউজিক। সেই গির্জেতে আমার দিদির সঙ্গে ঢুকেই চমকে উঠেছিলাম। গির্জের যিশুর চেহারা আফ্রো-চেহারা। বাদামি চামড়ার কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশদামের সেই যিশু সাদা আলখাল্লায় অপরূপ। সঙ্গের চেরাব বা দেবশিশুরাও সবাই আফ্রো-চেহারার। কোথাও সাদা চামড়া নেই। কালো মেয়েরা সেদিন সোল মিউজিক গমগমে গলায় গাইতে গাইতে সমবেতভাবে কাঁদছিলেন, নাচছিলেন, অভিভূত হয়ে সবাই সাপের মত দুলছিলেন। সে এক মহান দৃশ্য। দেখতে দেখতে গলা বুজে আসে। কান্না পায়। আনন্দে, হর্ষে শরীর রোমাঞ্চিত হয়। কালো যিশুর প্রতি প্রেমের সেই আকুলতা দেখে মনে হয় আমাদের ‘কালো জগতের আলো’-র কথা। মনে হয় কৃষ্ণমূর্তি নিয়ে মাতামাতি করা বৈষ্ণবদের কথা। তবে ঐ গির্জের পেছনে কত বড় যুদ্ধ আছে, কতদিনের লড়াই আছে, বিশাল অপমানের বঞ্চনার ইতিহাস আছে, তা জেনে ভেবে কল্পনা করে শরীরে কাঁটা দেয়।
পরে উগান্ডাতে গিয়েও দেখেছি কালো যিশুমূর্তি। সারা পৃথিবীর মাত্র কত শতাংশ মানুষ শ্বেতাঙ্গ বলতে পারেন? তবু শ্বেতাঙ্গ তার ক্ষমতার ব্যবহারে বিশ্বের রূপ-গুণ-কীর্তির অতুল্য আদর্শ হয়েছে। লড়াই লড়তে লড়তে চলেছে বাকি পৃথিবী।
৩
এমন শুনি, যে খ্রিষ্টধর্মের পথ কেটে বের করা হয়েছে পেগান ধর্ম/সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে করে। সেখানেও হত্যা আর লাঞ্ছনার ইতিহাসই। আর সেই পথেই মেয়েরা কালোরা আর বাঁ-দিক হয়ে গেল শয়তানের দিক…। নারীর অবমূল্যায়ণ ঘটল। তার নাম হল উওম্যান বা দুঃখী মানুষ বলে। তেমনি নারী হল শয়তানের হাতধরা দালাল মাত্র। কালোকে শয়তানের অংশ ভেবে নেওয়া, সবটাই জড়িয়ে রইল পাকে পাকে। “সিনিস্টার” শব্দটি এল সিনিস্ত্রা শব্দ থেকে যার অর্থ বাম। বাঁ হাতের বা বাঁদিকের ব্যবহারও খারাপের প্রতীক হল…। এসব অবশ্য আমি জেনেছি ড্যান ব্রাউন সাহেবের দাভিঞ্চি কোড পড়ে।
এই সময় থেকেই সাদা বড়, আর কালো ছোট, এমন একটা ভাবনা এসে ঘাড়ে চাপল আমাদের। তার আগে দুই প্রান্তের পরিমিতি আর ভারসাম্য ছিল পেগান বা প্রকৃতিসম্পৃক্ত সংস্কৃতিতে। মেয়েদের সম্পর্কে বর্ণনায় এর পর থেকে কেবলই শ্বেতাঙ্গিনীদের প্রশংসা। মেয়েদের স্তন সর্বদা শাঁখের মতো সাদা। মজার কথা হল আমাদের জীবনানন্দের লেখাতেও মেয়েদের স্তন হয়ে উঠেছে শঙ্খের মত। “স্তন তার/করুণ শঙ্খের মতো, দুধে আর্দ্র, কবেকার শঙ্খিনীমালার!” তবে এই যে এক মাত্রিক বিবরণ তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দেবারও লোক ছিল। ইংরেজি সাহিত্যের মাতব্বর শেকসপিয়ারের কলম ( 1564-1616) ভাষার এই আধিপত্যবাদকে উল্টে দেন, যখন সনেট নং ১৩০ এ নিজের প্রিয়াকে তিনি বর্ণনা করেন এভাবে,
My mistress’ eyes are nothing like the sun;
Coral is far more red than her lips’ red;
If snow be white, why then her breasts are dun;
If hairs be wires, black wires grow on her head.
তাঁর প্রিয়ার বুককে মেটে রঙের (ডান= ডাস্কি= ডাল ব্রাউন) বলতে বাধে না তাঁর। তার চুল কালো পাকানো তারের মত হয়ে ওঠে। ডার্ক লেডির এই সনেট সিরিজে তিনি অবাধে বলতে পারেন একটি কালো মেয়ের কথা। আর সেখান থেকেই ঝাঁপিয়ে আমাদের মনে আসবেই রবীন্দ্রনাথের কথা। ‘কালো! তা সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ!’
বিশ্বের সংস্কৃতির অলিগলি আনাচে কানাচে তবু সাদার আধিপত্য আর কালোর হেরে যাওয়া। দৈনন্দিন মুখের কথাতেও তাই এসে পড়েছে সাদা কালোর দ্বৈততা বা ডাইকোটোমি। ঠিক যেন সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, সু-কু এইসব শব্দবন্ধের লাগোয়া পাশাপাশি। সহজ উপমিতিতে তাই সাদা =ভালো আর কালো মানেই খারাপ। এই শব্দচেতনা ঘুচতে ঘোচাতে অনেক দিন লেগে যাবে। তবু আজকাল কোনও প্রতিবাদে নিজের ফেসবুক ডিপি কালো করে দেবার আগে দু’বার ভাববেন। অনেকেই আজকাল প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে চাইছেন লাল বা বেগুনি রংয়ের ব্যবহার করছেন। এ ভাবেই ধীরে ধীরে হয়তো ঘুচবে আমাদের রং সংস্কার।
কলকাতার বাসিন্দা | নব্বই দশকের কবি | কৃতি ছাত্রী | সরকারি আধিকারিক | একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত | উল্লেখ্যোগ্য গ্রন্থের নাম পিশাচিনী কাব্য (১৯৯৮)‚ আবার প্রথম থেকে পড়ো (২০০১)‚ মেয়েদের প্রজাতন্ত্র (২০০৫) | কবিতাগদ্যে মননশীল্‚ গল্পেও স্বচ্ছন্দ |
ভালো লেখা। তবে ক’টা কথা: – জীবনানন্দের কবিতার উদ্ধৃত অংশে স্তনের রঙ নিয়ে কোনো ইঙ্গিত নেই; বরং দুগ্ধবতী স্তনের আকৃতি শঙ্খের আকৃতির সঙ্গে তুলনীয় – এমনটাই মনে হয়।
সাদা-কালোর সঙ্গে ভালো-মন্দ এভাবনার উৎস সম্ভবতঃ দিন-রাত, আলো-আঁধার অভিজ্ঞতা থেকে জাত।
সাদা পাথর (white marble) কালো পাথর (কষ্টি পাথর) এর তুলনায় নরম (রসায়নগত কারণে) – তাই যেখানে তা অপ্রতুল সেখানকার প্রাথমিক স্থাপত্যে তার ব্যবহার। দক্ষিণ ও মধ্য ও উপকূলীয় ভারতে বাদামী বেলে পাথর যেমন বেশী ব্যবহৃত, কোথাও দেবতা কালো ব্যাসল্টে, কিন্তু সাদা মার্বেল ঐ রাজস্থানে।
রাম ও কৃষ্ণের গাত্রবর্ণের আর্থসামাজিক যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ হবে। পরে করা যাক।
দুর্দান্ত লেখা