পঁয়ত্রিশ বছর পর আজ কি অবশেষে দেখা হবে কেদারের সঙ্গে সরস্বতীর? গল্পে গল্পে কি উঠে আসবে কী ভাবে পিয়ানোর চাবির ওপর খেলা করে যেত সরস্বতীর আঙুল? সুরেলা টুংটাংয়ে কেদারকে কি আজ আরও একবার সেই গানটা শোনাতে বলবেন সরস্বতী? আজও কি কেদার তেমন অপলকে তাকিয়ে গাইতে পারবেন, “চরণ ধরিতে দিও গো আমারে, নিও না নিও না সরায়ে!” তাপস পালের মৃত্যুতে হয়তো এমনই দৃশ্যকল্পের জন্ম হচ্ছে কোথাও! সকলের অগোচরে!

বাংলা সিনেমার জগতে আশির দশক শুরুই হয়েছিল এক মহীরুহ-পতন দিয়ে। সে বছরই ২৭ জুলাই চলে গিয়েছিলেন উত্তমকুমার। বাঙালির রোম্যান্সের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন মহানায়ক। কিন্তু সে বছরই পরিচালক তরুণ মজুমদার টলিউডে জন্ম দিয়েছিলেন একটা ছোট্ট চারাগাছের। ধীরে ধীরে বাঙালির রোম্যান্সের হাহাকারে আদরের প্রলেপ বুলিয়ে দিতে শুরু করে সেই চারাটিই, দাদার কীর্তির ‘কেদার চাটুজ্যে’ দিয়ে যার গোড়াপত্তন। জুলাইতে মহানায়কের বিদায়ের তিন মাসের মধ্যে ‘দাদার কীর্তি’ মুক্তি পেল কলকাতায়। এবং নবাগত নায়ক তাপস পাল মাতিয়ে দিলেন বাঙালিকে। সুপার ডুপার হিট সেই ছবির পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। মহুয়া রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর জুটি নিয়ে তখন জোর চর্চা। এর মধ্যেই মহুয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় ছবি ‘সাহেব’-ও সুপারহিট। এরপর ৮৪-তে ‘পারাবত প্রিয়া’। আবার সেই দেবশ্রী-তাপস-মহুয়া। এবং সুপারহিট। বাঙালি দর্শক তখন মজেছে তাপসের বয় নেক্সট ডোর ইমেজে।

Film Poster Abodh
মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে বলিউডে তাপসের প্রথম কাজ – অবোধ। ছবি- wikipedia

সে বছরেই তাপসের পা পড়ল বলিউডে। প্রথম ছবি ‘অবোধ’। নায়িকা অষ্টাদশী মাধুরী দীক্ষিত। সেটা তাঁরও প্রথম ছবি। তাপস কিন্তু খুব দ্রুতই মুম্বই ছেড়ে ফিরলেন নিজের শহরে, নিজের ইন্ডাস্ট্রিতে। হয়তো বুঝেছিলেন, মধ্যবিত্ত দ্বিধাগ্রস্ত ভীরু প্রেমিক বাঙালির নায়ক হিসেবে তখন তাঁকেই প্রয়োজন! একের পর এক ছবি করে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে একটা সময় প্রায় একাই টেনে নিয়ে গিয়েছেন তাপস। টালিগঞ্জের বক্স অফিসে লক্ষ্মীর কৃপাদৃষ্টি বর্ষিয়েছে তাপসের কল্যাণেই। তরুণ মজুমদারের সঙ্গে জুটি বেঁধে একটার পর একটা সুপারহিট ছবি উপহার দিয়েছেন। তখনও বাংলা সিনেমায় আর্বান-রুরাল ভাগাভাগি বলে বিশেষ কিছু ছিল না। তাই যেমন গ্রামবাংলায়, তেমনই শহর কলকাতায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠেন তাপস পাল। সমসাময়িক নায়ক চিরঞ্জিত, রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গেও ছিল তাঁর গভীর সখ্য।

১৯৮৫-তে তপন সিনহার ছবি ‘বৈদূর্য রহস্য’তে মুনমুন সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন তাপস। তারপর সার দিয়ে হিট ছবি। জহর বিশ্বাসের পরিচালনায় অনুরাগের ছোঁয়া (১৯৮৬), তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় ভালোবাসা ভালোবাসা (১৯৮৬), আগমন (১৯৮৮), আপন আমার আপন (১৯৯০), অঞ্জন চৌধুরীর পরিচালনায় গুরুদক্ষিণা (১৯৮৭), পরশমণি (১৯৮৮), হরনাথ চক্রবর্তীর পরিচালনায় মঙ্গলদীপ (১৯৮৯), বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নীলিমায় নীল (১৯৯১)- আশি এবং নব্বইয়ের দশক জুড়ে রুপোলি পর্দায় পাশের বাড়ির ছেলে ইমেজ নিয়েই রাজত্ব করেছেন তাপস। মহুয়া রায়চৌধুরীর অকালমৃত্যু তাঁকে শোকাহত করলেও তার পরেও বাংলা ছবিকে বেশ কিছু হিট জুটি উপহার দিয়েছিলেন তাপস। দেবশ্রী রায়, শতাব্দী রায়, ইন্দ্রাণী হালদার, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর অনস্ক্রিন রসায়ন মাতিয়ে রাখত দর্শককে। পাশাপাশিই শুরু করেছিলেন যাত্রা করা। সেখানেও মুনমুন-তাপস এবং শতাব্দী-তাপসের নামে লম্বা লাইন পড়ত টিকিট ঘরের সামনে।

নতুন সহস্রাব্দের শুরুতেই বাঙালিকে একটা চমক দিলেন তাপস। পুরোপুরি বাণিজ্যিক ছবির নাচ-গান করা নায়ক দেখা দিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি ‘উত্তরা’-য়। চরিত্রের নাম নিমাই। সে এক প্রত্যন্ত গ্রামের রেলের সিগন্যালম্যান যে কিনা অবসরে কুস্তি করতে ভালোবাসে! নায়িকা উত্তরার ভূমিকায় ছিলেন জয়া শীল। সমরেশ বসুর গল্প অবলম্বনে তৈরি এই ছবিতে নিজের জাত চেনালেন তাপস। তাঁর বন্ধু কুস্তিগীরের ভূমিকায় যোগ্য সঙ্গত ছিল শঙ্কর চক্রবর্তীর। ভেনিস, টরন্টো, লস এঞ্জেলেস, পুসান ফিল্মোৎসবে জয়জয়কার পড়ে গেল উত্তরার। বুদ্ধদেব পেলেন জাতীয় পুরস্কার। তাপসের ভাগ্যে পুরস্কারের শিকে না ছিঁড়লেও তাঁর অভিনয় দক্ষতায় চোখ কপালে তুলেছিলেন ফিল্ম-সমালোচকরাও। এরপর বুদ্ধদেবের আরও একটি ছবি ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’-এও অভিনয় করেছিলেন তাপস। নিজের রোম্যান্টিক হিরোর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ধরা দিয়েছিলেন অন্য এক অবতারে, যা ততদিন পর্যন্ত বাঙালির কাছে অচেনাই থেকে গিয়েছিল।

শেষ জীবনে নানা বিতর্ক, পারিবারিক বিবাদ, রাজনৈতিক গোলমাল, দীর্ঘ কারাবাস তাঁকে অসুস্থ করে তুলেছিল। আশির দশকের রুপোলি পর্দাজোড়া সেই বিখ্যাত সহজ সরল হাসি মুছেই গিয়েছিল একরকম। স্নায়ুরোগে শয্যাশায়ী হয়ে প্রায় ঘরবন্দিই থাকতেন। স্ত্রী নন্দিনী এবং মেয়ে সোহিনীর সাহচর্যে থাকতেই পছন্দ করতেন সবচেয়ে বেশি। ১ ফেব্রুয়ারি মেয়ে আমেরিকা চলে যাওয়ার পরেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন বলে জানায় পরিবার। সেই রাতেই প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে তাঁকে ভর্তি করা হয় মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে। ভেন্টিলেশনেও দেওয়া হয় সঙ্গে সঙ্গেই। তবে ৬ ফেব্রুয়ারি ভেন্টিলেশন খুলে নেওয়া হয়। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছিলেন তাপস। ১৭ ফেব্রুয়ারি, সোমবার রাতে কলকাতায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু মুম্বই বিমানবন্দরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোর ৩:৩৫ মিনিটে থেমে যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া। বাঙালির রেট্রো যুগের রোম্যান্স এক নিমেষেই তলিয়ে যায় মৃত্যুর অন্ধকারে।

টালিগঞ্জের অভিনেতা-অভিনেত্রী-পরিচালক-কলাকুশলীরা সকলেই তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে বারবার বলেছেন তাঁর সেই প্রাণখোলা হাসির কথা, তাঁর সহজ সরল জীবনযাত্রার কথা, তাঁর স্বভাবের মাধুর্যের কথা। টেলিভিশনের পর্দায় কান্নায় ভেঙে পড়েন নায়িকা তথা সাংসদ দেবশ্রী রায়। রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ১৫-২০টা ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছি। আমি মনে করি বাংলা ইন্ডাস্ট্রির উনি একজন অনবদ্য অভিনেতা যাঁর কোনও রিপ্লেসমেন্ট আর হবে না কোনও দিন।” ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক ছবিতে কাজ করেছেন তাপসের সঙ্গে। কিন্তু তাঁর স্মৃতিচারণাতেও বারবার উঠে আসে তাপসের মনকাড়া হাসির কথাই। বলেন, “তাপসদা একজন অসম্ভব সুন্দর মানুষ ছিলেন। ওঁর হাসিটা ভোলা যায় না। তাপসদা এমন একজন নায়ক যাঁর ফুটপ্রিন্ট যতদিন বাংলা ছবির ইতিহাস থাকবে, থেকে যাবে।” তাঁর প্রথম বলিউড নায়িকা মাধুরী দীক্ষিত-ও এদিন আবেগঘন ট্যুইট করে স্মরণ করেন তাপসকে।

তবে শুধু নায়িকাই বা কেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অগ্রজপ্রতিম অভিনেতা থেকে এ যুগের নায়ক-সাংসদ দেব, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায় থেকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও গভীর শোকপ্রকাশ করেন।

তাঁরই সমসাময়িক নায়ক তথা বন্ধু চিরঞ্জিৎ এদিন দৃশ্যতই ছিলেন যন্ত্রণাক্লিষ্ট। তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে প্রতিযোগিতার চেয়েও সৌহার্দ্যই যে চিরকাল মুখ্য হয়ে থেকেছে সে কথা বলেন একাধিকবার। তাপসের সুপারস্টারডম নিয়ে যে তাঁর মনে কোনও সন্দেহ নেই, মনে করিয়ে দেন সেই কথাও। বলেন, “ও তো সুপারস্টার ছিলই। সাহেব এবং দাদার কীর্তিতে ওর অভিনয় আমি কোনওদিন ভুলব না। মনে হচ্ছে নিজের ভাইকে হারালাম। সিনেমা জগতের অপূরণীয় ক্ষতি।” তাপসের কাছের মানুষ হয়ে ওঠার সহজাত ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেন পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীও। বলেন, “আমি পরিচালক ও নায়ক এই সম্পর্ক আমাদের মধ্যে ছিল না। একসঙ্গে খাওয়া-ওঠা-বসা সব করেছি। খুব হইহই করে কাজ করত। খেতে ভালোবাসত। সেই মানুষটা আর নেই আমি ভাবতেই পারছি না। পারিবারিক বন্ধুকে হারালাম।”

যাঁর হাত ধরে সমান্তরাল ছবিতে তাপসের হাতেখড়ি, সেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত অবশ্য মনে করেন, টলিউড তাপসের অভিনয় প্রতিভাকে ব্যবহারই করতে পারেনি। তাঁকে চিরকালই একই ধরনের চরিত্রে বারবার কাস্ট করা হয়েছে। হয়তো ইচ্ছে করলেই ভার্সেটাইল অভিনেতা হিসেবে নাম করতে পারতেন তাপস, কিন্তু সেই সুযোগ বাংলা ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে দিল কি? বুদ্ধদেববাবুর কথায়, “তাপস অসম্ভব উঁচু দরের অভিনেতা। ওর তুল্য অভিনেতা ওর সমসময়ে টালিগঞ্জে প্রায় ছিলেনই না। যে কটা ছবিতে অভিনয় করেছে সেটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ওর যথার্থ মূল্যায়ণই করতে পারেনি টালিগঞ্জ।”

এই আক্ষেপ কি গোপনে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসত তাপসের বুক থেকেও? সে প্রশ্নের জবাব পাওয়ার কোনও উপায় না-রেখেই চলে গেলেন আম-বাঙালির আপনজন তাপস পাল।

 

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *