নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। একটি তথচিত্র দেখানো নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ কর্তারা জানিয়ে দিলেন, এখন থেকে ক্যাম্পাসের কোনও প্রেক্ষাগৃহে কোনওরকম রাজনৈতিক কর্মসূচি করা যাবে না। শিক্ষামহল এবং প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনীদের একাংশের দাবি, অসংখ্য ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্য বহনকারী প্রেসিডেন্সিতে কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত কার্যত নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। তাঁদের মতে, এমন পদক্ষেপ প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্যের সঙ্গে খাপ খায় না।

সম্প্রতি আনন্দ পট্টবর্ধনের ‘রাম কে নাম’ তথ্যচিত্রটি দেখানো নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে প্রেসিডেন্সিতে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রেক্ষিতে নির্মিত জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ওই তথ্যচিত্র দেখাতে চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন পড়ুয়াদের একাংশ। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁদের জানানো হয়েছে তথ্যচিত্রটি বিতর্কিত, তাই প্রেসিডেন্সিতে দেখানো যাবে না। এরপর মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, এখন থেকে ক্যাম্পাসের কোনও প্রেক্ষাগৃহেই রাজনৈতিক কর্মসূচি করার অনুমতি দেওয়া হবে না পড়ুয়াদের।

ডিন অফ স্টুডেন্টস অরুণ কুমার মাইতির কথায়, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও প্রেক্ষাগৃহ দেওয়া হবে না। মতাদর্শ নিরপেক্ষ ভাবে এই সিদ্ধান্ত সবার জন্য প্রযোজ্য। এর বেশি কিছু বলব না।” এই সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্সির ২০০ বছরের ঐতিহ্যের বিপ্রতীপ কিনা জানতে চাওয়া হলে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন অরুণবাবু।

প্রেম, পড়াশোনা, পলিটিক্স- এই তিন ‘পি’-এর সমাহার বলা হয় প্রেসিডেন্সিকে। ছাত্র রাজনীতির সমৃদ্ধ ইতিহাস প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্যের বিরাট অংশ দখল করে রেখেছে। বিশেষত, গত শতকের ছয়ের দশক থেকে বাংলার ছাত্র রাজনীতির ভরকেন্দ্রে অবস্থান করেছে প্রেসিডেন্সি। তারও আগে বিশ শতকের শুরুর দিকে সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনীতির হাতেখড়ি হয় এই কলেজে পড়ার সময়ই। অধ্যাপক ওটেনকে নিগ্রহ করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। পরবর্তীকালে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে প্রেসিডেন্সি। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় অতি বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি আবর্তিত হত প্রেসিডেন্সি থেকেই। বামফ্রন্ট আমলেও বিভিন্ন সময় ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক কর্মসূচি, সভা-সমিতি, সিনেমা বা তথ্যচিত্র প্রদর্শন প্রেসিডেন্সির প্রাত্যহিকতার অঙ্গ হিসাবেই পরিচিত হয়ে এসেছে এতদিন। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত কার্যত এই ধারাবাহিকতাতেই ছেদ ঘটাল। উল্লেখ্য, যে তথ্যচিত্রটি নিয়ে বিতর্ক, সেটি এর আগে অসংখ্যবার প্রদর্শিত হয়েছে প্রেসিডেন্সিতে। কোনও সমস্যা ছাড়াই।

প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপ সম্পর্কে সমালোচনায় সরব হয়েছেন প্রাক্তনীদের অনেকেই। নবনীতা দেবসেন জানিয়েছেন, ‘রাম কে নাম’-এর মতো ছবি ছাত্রছাত্রীদের ভালমন্দের ফারাক বুঝতে শেখায়। এই তথ্যচিত্র বন্ধের সিদ্ধান্ত যুক্তিহীন। তথ্যচিত্র বন্ধের সমালোচনা করেছেন নাট্যকার তথা রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “প্রেসিডেন্সিকে খাঁচায় পরিণত করার অপচেষ্টা হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকছে না। ডিরোজিও-র ক্যাম্পাসে এই ধরনের পদক্ষেপ অনভিপ্রেত।” প্রেসিডেন্সির এক সময়ের বিখ্যাত ছাত্রনেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমি এই সিদ্ধান্তে ফ্যাসিবাদের স্বর শুনছি। আশা করব কর্তৃপক্ষ প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্যের প্রতি যত্নবান হবেন।”

কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ পড়ুয়ারা। তাঁরা জানিয়েছেন, প্রেক্ষাগৃহের অনুমতি না পাওয়া গেলে পোর্টিকোয় তথ্যচিত্র দেখাবেন তাঁরা। আগামী শুক্রবার ওই প্রদর্শনী হওয়ার কথা। সেখানে উপস্থিত থাকবেন বিখ্যাত প্রাক্তনীদের কয়েকজনও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *