ভুবনায়নের দয়ায় গোটা বিশ্বেই আকাঙ্খিত সৌন্দর্য্যের ব্যাপারটা একটা সর্বজনীন রূপ ধারণ করেছে। নারীকূলে যেমন “তন্বী শ্যামা শিখরদশনা”, পুরুষদের জন্য তেমনি হয়েছে “টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম।” নারী হোক বা পুরুষ, দীর্ঘ, নির্মেদ, সুঠাম শরীর, মুক্তোর মতো ঝকঝকে সাদা দাঁত, নিখুঁত, ভাঁজহীন ত্বক এখন সবার কাম্য। অথচ ইন্টারনেটের যুগের আগে দৃশ্যটা কিন্তু একদম অন্যরকম ছিল। বিভিন্ন দেশে তখন সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি ছিল একদম ভিন্ন।
জাপানের কথাই ধরা যাক। সাদা ঝকঝকে দাঁত নয়, প্রায় ন’শো বছর পর্যন্ত সেখানে কুচকুচে কালো দাঁতকেই নারী সৌন্দর্য্যের চরম নিদর্শন হিসেবে ধরা হত। ভ্রমরের পাখার মতো কালো দাঁতের সৌন্দর্য্য নিয়ে রীতিমতো ইনিয়ে বিনিয়ে কবিতা লিখতেন প্রাচীন জাপানের কবিরা! জাপানি এই কালো দাঁতের বিউটি রেজিমকে বলা হত “ওহাগুরো“ (Ohaguro)। জাপানি ভাষায় “হা” শব্দের অর্থ দাঁত, এবং “কুরো” শব্দের অর্থ কালো। এই দুইয়ের পূর্বে সম্মানসূচক “ও” যোগ করে সম্পূর্ণ শব্দটি হয় “ওহাগুরো”, যার আক্ষরিক অর্থ ‘কালো দাঁত।’ হান বংশের শাসনকাল (৭৯৪-১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) থেকে ইদো বংশের শাসন অবধি (১৬০০-১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) এই প্রথার প্রচলন ছিল।
প্রথমেই বলে রাখি, আধুনিক যুগের মানুষ হিসেবে ওহাগুরো অর্থাৎ কালো দাঁতের সৌন্দর্য্য ব্যাপারটি আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হলেও তৎকালীন সময় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ওহাগুরো কিন্তু যথেষ্ট বাস্তবোচিত এবং আদরণীয় ছিল। সেইসময় জাপানের রাজদরবারের হোমরাচোমরা কেউকেটা ব্যক্তিরা শুরু করেছিলেন কালো রঙে দাঁত রাঙানোর এই ফ্যাশন। কয়েক মাসের মধ্যেই মেয়েমহলে এই পদ্ধতি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে, এবং অচিরেই যুবতী নারীমাত্রেরই সাজের অন্যতম অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় ওহাগুরো।

দাঁত রাঙানোর জন্য এই কালো রঙটির উৎপাদনের পদ্ধতিও ছিল বেশ অভিনব। এর নাম ছিল “কানেমিজু” (Kanemizu)। সাকে (ভাত থেকে তৈরী জাপানি মদ), চা এবং ভিনিগারের মিশ্রণে লোহার গুঁড়ো ডুবিয়ে রাখা হত বেশ কয়েকদিন। লোহার সংস্পর্শে থেকে চা ও ভিনিগারের এই মিশ্রণ কালো রং ধারণ করলে এর সঙ্গে মেশানো হত মিহি করে গুঁড়োনো হরিতকী। এরপর ভিনিগার ও হরিতকীর সম্মিলিত বিশ্রী গন্ধকে নষ্ট করার জন্য তাতে মেশানো হত লবঙ্গ এবং দারুচিনির নির্যাস। ব্যস্, তৈরি হয়ে গেল কানেমিজু। এরপর এই মিশ্রণকে দাঁতে লাগিয়ে মেয়েরা তাদের সাজ সম্পূর্ণ করত। খুব ভালো রকমের চকচকে কালো দাঁত পেতে গেলে প্রতিদিন অন্তত একবার কানেমিজু দিয়ে দাঁত রাঙানো ছিল তখনকার দিনে একদম বাধ্যতামূলক। আজকালকার দিনে অবশ্য নাটক বা থিয়েটারে অভিনয়ের সময় জাপানের অভিনেতা এবং অভিনেত্রীরা টুথ ওয়াক্স এবং কালো কালির সাহায্য নেন। এতে যেমন তৎক্ষণাৎ কালো দাঁত পাওয়া যায়, তেমনি অভিনয়ের শেষে মিশ্রণটিকে সহজে তুলেও ফেলা সম্ভব।
কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। সেটা হল, ওহাগুরো পদ্ধতি ঠিক কতখানি বিজ্ঞানসম্মত ছিল এবং এমন অদ্ভুত প্রথার জন্মের আসল কারণই বা কী?

আধুনিক দন্ত চিকিৎসকদের মতে, দাঁত কালো রঙে রাঙানোর আসল উদ্দেশ্য ছিল দাঁতের সংরক্ষণ এবং হলদেটে রঙ ঢেকে দেওয়া। ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি। তৎকালীন জাপানে লিলি ফুলের মতো ধবধবে সাদা গায়ের রং মনে করা হত আদর্শ। এখন দেখুন, এমনিতে তো মানুষের পক্ষে অমন ত্বক পাওয়া সম্ভব নয়। তাই মুশকিল আসান করার জন্য মেয়েরা চালের গুঁড়ো থেকে তৈরি “ওশিরোই” (Oshiroi) ফাউন্ডেশন মাখতেন মুখে ও ঘাড়ে। এরপর ঠোঁট রাঙানো হত লাল বা পিচ ফলের রঙে। সাদা ধবধবে ত্বক এবং টুকটুকে লাল ঠোঁটের কারণে মেয়েদের দাঁতের রং দেখাত হলদে। বুঝতেই পারছেন, অমন সুন্দর সাজগোজ করার পর মুখে হলদে রঙা দাঁত কেমন বিশ্রী দেখায়! অতএব সেই সমস্যার সমাধান করা হল দাঁতকে কালো রঙে রাঙিয়ে। এছাড়াও কালো রঙের ওই তিতকুটে ল্যাকারের গুণে রোগ-জীবাণু-ব্যাকটেরিয়াও দাঁত থেকে থাকত বহুদূরে। ফলস্বরূপ অতিবৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কানেমিজু ব্যবহারকারীদের দাঁত থাকত অটুট।
বাস্তবিক এই দুটি কারণ ছাড়াও সামাজিক এবং দার্শনিক দৃষ্টিতেও ওহাগুরোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত তৎকালীন জাপানে। যেহেতু দাঁত ল্যাকারে রাঙানো যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়সাধ্য পদ্ধতি ছিল, সেই কারণে কালো দাঁত মানেই ধরা নেওয়া হত যে দাঁতের মালিক অতি উচ্চবংশজাত। এছাড়াও বিবাহিতা মেয়েদের মধ্যে বিবাহ পরবর্তী চিহ্ন হিসেবেও দাঁত রাঙিয়ে দেওয়া হত। পরবর্তীতে জাপানের গেইশা জেলা গিওনেও দেখা যায় সুন্দরী গেইশা নারীরা তাঁদের শৃঙ্গারের অত্যাবশ্যক উপকরণ হিসেবে কানেমিজুকে নিত্যসঙ্গী করে নিয়েছেন।

লেখিকা মুরাসাকি শিকিবু-র লেখা “The Tale of Genji” উপন্যাসে ওহাগুরোর সর্বপ্রথম উল্লেখ মেলে। এছাড়াও সমসাময়িক জাপানি কবিদের লেখায় প্রেমিকা বা নববধূর কালো দাঁতের সঙ্গে ভ্রমরের তুলনাও পাওয়া গিয়েছে। সেইসময়ের সাহিত্য এবং শিল্পকর্মগুলি থেকে জানা যায়, তখন জাপানে চকচকে কালো রঙের আবরণকে সৌন্দর্য্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হত। একইসঙ্গে মুখের ভেতর ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারির সঙ্গে পাশবিক প্রবৃত্তির তুলনা করতেন অনেকে। বিপরীতে কালো দাঁতের মাধ্যমে নবজাতকের মতো নির্মল হাসির সৌন্দর্য্য কামনা করতেন মেয়েরা। ওহাগুরোর জনপ্রিয়তার পেছনে কিন্তু এই কারণগুলিও যথেষ্ট দায়ী ছিল।
সুন্দরী হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মেয়েদের মধ্যে দাঁত কালো করার প্রবণতা তখন এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তৎকালীন জাপানের লোককথায় এবং গ্রামীণ গপ্পোগাছায় রীতিমতো এক পেত্নীর জন্ম হয়েছিল। আমাদের বাংলায় যেমন শাঁখচুন্নি, তেমনি জাপানের, বিয়ে করতে চাওয়া এই প্রেতিনীর নাম ছিল “ওহাগুরো বেত্তারি” (Ohagurro Bettari)। এই প্রেতিনীর নামের অর্থ হল “শুধুই কালো দাঁত”(Nothing but blackened teeth)।

জাপানের লোককথা অনুযায়ী, বিবাহেচ্ছুক কোনও তরুণী যদি বিয়ের আগেই মারা যেত, তাহলে তারা ওহাগুরো বেত্তারি হয়ে যুবকদের ভয় দেখিয়ে বেড়াত। গভীর রাত্রিতে বেত্তারি দিদিমণি বধূবেশে সজ্জিতা হয়ে করুণ সুরে গান গেয়ে মন্দিরের আশেপাশে ঘুরে বেড়ান । যুবকেরা তাঁকে দেখে আকর্ষণ অনুভব করলে তিনি শুধু মিষ্টি হেসে তেনার মুখটি দেখিয়ে দেন। ব্যস হয়ে গেল! তাতেই ভয় পেয়ে ছেলেদের দাঁতকপাটি লেগে যায়। বেত্তারির নাম সার্থক। তিনি বধূবেশে সুসজ্জিতা হলেও তাঁর মুখে দু’পাটি কালো দাঁত ছাড়া আর কিছুই নেই। চোখ, নাক, কান কিচ্ছু না। শুধুমাত্র কালো দাঁতে ঘেরা মস্ত বড় হাঁ! ভয় পাওয়ার মতোই চেহারা বটে। তবে আনন্দের ব্যাপার হল, বেত্তারির হাতে মৃত্যুর ঘটনা কখনও শোনা যায়নি, বধূরূপী এই প্রেতিনী শুধু ভয় দেখিয়েই মজা পান।
জাপান ছাড়াও ভিয়েতনাম, লাওস, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড এবং চিনের কিছু অংশে ওহাগুরো প্রথার প্রচলন ছিল বলে জানা গিয়েছে। দাঁত কালো করার এই প্রথা ইদো বংশের শাসনকালে জনপ্রিয়তা হারায়। এইসময় পাশ্চাত্যের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হওয়ায় জাপানের মানুষ নিজেদের পূর্বপ্রচলিত প্রথাগুলিকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে, এবং সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির উপায় হিসেবে কানেমিজুর আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বলাই বাহুল্য, চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ওরাল হাইজিনের ব্যাপারেও মানুষ আরও বেশি সচেতন হয়ে ওঠে, এবং স্বাভাবিকভাবেই টুথপেস্ট ও টুথব্রাশের প্রচলন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওহাগুরো প্রথা চিরতরে হারিয়ে যায়।
*তথ্যসূত্র:
https://livejapan.com
Zumbroich, Thomas J. (2009). “‘Teeth as black as a bumble bee’s wings’: The ethnobotany of teeth blackening in Southeast Asia”. Ethnobotany Research & Applications. 7: 381–398. doi:10.17348/era.7.0.381-398.
The Tale of Genji, Book by Murasaki Shikibu
Flynn, M. 1977. Black teeth: A primitive method of car-ies prevention in Southeast Asia. Journal of the American Dental Association 95(1):96-97
*ছবি সৌজন্য: jpninfo.com, livejapan.com, Pinterest
যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।