কমিক্সের ভক্ত আদিগন্তবিস্তৃত। জনপ্রিয় কমিক্স বইগুলো সুপারহিরো এবং সুপারহিরোইনের কর্ম-কল্পনার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্স, চাচা চৌধুরী, মায় বাঁটুল দি গ্রেট বা হাঁদাভোঁদাদের মাঝে কোনও বিশিষ্ট নারী চরিত্র দেখেছেন কখনও?
“আ, মাই বিউটি পাস্ট কম্পেয়ার…” গেয়ে ওঠেন মিলানিজ নাইটিংগেল বিয়াঙ্কা কাস্তাফিয়োর। “কই আমি তো আছি!” ঘোড়াড্ডিম আছেন। ওই তো বাষট্টি পাতায় বরাদ্দ মাত্র দেড় পাতা! বর্তমান বিশ্বের ১৪টি দেশের ক্ষমতাভার রয়েছে মহিলাদের হাতে। শেখ হাসিনা, জাসিন্ডা আরডেন, আং সাং সু কি প্রমুখ। ১৯৬০ সালে সিরিমাভো বন্দরনায়েকে শ্রীলঙ্কার দায়িত্বভার নিলে তিনি হন প্রথম গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। এই মহিলা নেত্রীদের নিয়ে সেসব দেশে এবং আমাদের পশ্চিম বাংলার মতো অঙ্গরাজ্যে কার্টুন আর ক্যারিকেচার প্রকাশিত হয় অহরহ, প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতায়, ম্যাগাজিনে। রাজনৈতিক কার্টুন। কিন্তু, কমিক্স একটি আকর্ষণীয়, বিনোদনমূলক এবং কখনও কখনও সমাজের সমালোচনামূলক আয়না সরবরাহ করলেও, তাতে মহিলা চরিত্রের অভাব চিরকালীন। এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিফলিত। নন-ফিকশন বা গ্রাফিক নন-ফিকশন, কমিক স্ট্রিপ থেকে শুরু করে ট্রেড পেপারব্যাক পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ফরম্যাটে বাজারময় কমিক্সে মহিলা চরিত্রেরা ব্রাত্য।
১৯৩৯ সালে পাল্প ম্যাগাজিনের প্রকাশক মার্টিন গুডম্যান ‘টাইমলি কমিক্স’ তৈরি করেন। টাইমলির প্রথম কমিক্স বই ছিল মার্ভেল কমিক্স নম্বর ১, যা বেশ কয়েকটি সুপারহিরো চরিত্রের বৈশিষ্ট্যযুক্ত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, ‘হিউম্যান টর্চ’ এবং ‘সাব-মেরিনার।’ এরপর, টাইমলি কমিক্স ১৯৪০-এর দশকে কমিকসের ‘স্বর্ণযুগ’-এ অনেক সুপারহিরো চরিত্রের আগমন ঘটিয়েছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাপ্টেন আমেরিকা, যিনি প্রথম হাজির হন ক্যাপ্টেন আমেরিকা কমিকস নম্বর ১-এ।

কাজেই মারভেল কমিকসের অগ্রপথিক হিসেবে টাইমলির নাম বলাই যায়। এখন, মারভেল এবং ডিসি, কমিক্সশিল্পে শীর্ষস্থানীয়। তবে এত বছরেও যে বিষয়গুলি সেখানে প্রায় অনালোচিত হয়ে থেক গিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে কমিক্সে নারী, এলজিবিটি ব্যক্তিত্ব বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি। নারী অবশ্য সৃষ্টির পর থেকেই কমিক্সে ভূমিকা রেখেছে- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌনতার প্রতীক বা ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবে, নায়িকা হিসেবে নয়।
১৯৪০ সালেই আবির্ভূত হন প্রথম মহিলা সুপারহিরো ফ্যান্টোমা। ফ্যান্টোমা, অন্যান্য প্রাথমিক মহিলা কমিক্স-নায়িকা ওয়ান্ডার ওম্যান এবং শীনার সঙ্গে স্বল্পবসনা ‘জঙ্গলদেবী’ গোত্রে পড়েন। এখনও পর্যন্ত মহিলা চরিত্রগুলি কমিক্সে খুব একটা ইতিবাচক কণ্ঠ বা স্থান খুঁজে পায়নি। কিছু কমিক্স, যেমন: লাভ অ্যান্ড রকেটস, গোস্ট ওয়র্ল্ড এবং ট্যাঙ্ক গার্লের মতো সিরিজ নারীদের শক্তিশালী চিত্রায়নের প্রচার করেছিল। কিন্তু প্রায়শই নারীবাদী তকমা পাওয়ার পাশাপাশি সূক্ষ্মভাবে যৌনতাকে ঢোকানো হয়েছে এইসব কমিক্সে।

আশির দশকে বাংলার একটি দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো ‘মডেস্টি ব্লেজ’। বাঙালির সম্ভবত সেই প্রথম মহিলা কমিক্স-নায়িকার সঙ্গে পরিচয়। ধারাবাহিক স্ট্রিপটি আমাদের কিশোর হৃদয়ে তুফান তুলেছিল। মডেস্টির ছিল অসামান্য যৌন আবেদন। মাঝেমধ্যেই ছাপা ছবিতে তিনি বিবসনা হতেন নির্দ্বিধায়। নায়িকার ‘সাইডকিক’ ছিলেন এক সুপুরুষ, উইলি। মাছে-ভাতে বাঙালি তখন উইলি হয়ে ওঠার স্বপ্নে বিভোর, মডেস্টির সান্নিধ্যলাভে।
ওদিকে, লুইস লেন কমিক্সের ইতিহাসে দীর্ঘতম চলমান মহিলা প্রতিবেদক চরিত্র। তাঁরও লক্ষ লক্ষ ভক্ত তাঁর প্রেমে নিবিষ্ট। কিন্তু এত বছরে তাঁর স্থান কোথায়? তিনি প্রতিটি সুপারম্যান চলচ্চিত্র এবং শত শত কমিক্সে হাজির। কিন্তু শুধুমাত্র একটি পার্শ্বচরিত্র হয়েই রয়ে গিয়েছেন – ‘সুপারম্যানের বান্ধবী’। যদি আপনি কোনও কমিক-কন বা আমাদের কার্টুন মেলায় লুইস লেন সম্পর্কে জানতে চান, তবে যে কেউ বলবেন, প্রথমত লুইস সুপারম্যানের বান্ধবী, দ্বিতীয়ত, একজন রিপোর্টার। আমাদের পপ সংস্কৃতিতে তিনি সুপারম্যানের রোম্যান্টিক অ্যাসোসিয়েশনের অঙ্গমাত্র। ডিসি ইউনিভার্সের ব্যাট-জ়োনে ফোকাস করলেও সেখানে ক্যাটওম্যান বা সেলিনা কাইল চরিত্রটি তার অত্যধিক যৌন চরিত্রায়নে ডার্ক নাইটের সঙ্গে শরীরী হন। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন পুরুষতান্ত্রিক কমিক্স জগৎ।

সুপারহিরোইনরা ডিসি এবং মারভেল উভয় বিশ্বেই বিদ্যমান। কিন্ত তাঁরা সর্বদা স্বল্পবসনা, সুস্তনী এবং লাইক্রা পোশাক পরিহিতা, যাতে বোঝা যায় তাঁর শরীরের প্রতিটি ভাঁজ, বিভঙ্গ। ক্যাটস্যুট সেক্সি নয়, সেক্সিস্ট। স্যুইসাইড স্কোয়াডের ‘হারলে কুইনকে’ ভাবুন। স্বর্ণকেশী, মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্প্যানডেক্স পরিহিতা (তাঁর জিমন্যাস্টিক ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য উপযুক্ত) একটি দুষ্টু নার্সের চরিত্র হলেও কর্সেট এবং হটপ্যান্টে বেমানান। আবার, ‘স্টারফায়ার’ তাঁর প্রথম সংখ্যাটিতে থেকেই একটি ছোট্ট বিকিনিতে তার পীনস্তনী চিত্রের কারণে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। ভুললে চলবে না মহিলা গুপ্তচর সুপারহিরো ‘ব্ল্যাক উইডো’-র কথাও, যার যৌন আবেদন অসীম। এরা কোন ধরনের রোলমডেল এবং সম্পর্কিত গল্প পাঠকদের জন্য সরবরাহ করছে?

কমিক্সে মহিলা কণ্ঠকে সংহত করা এখনও আগের মতো চ্যালেঞ্জিং, তবে ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষণ রয়েছে। পরিবর্তনগুলি অবশই পাঠকদের দ্বারা চালিত হওয়া উচিত। মহিলাদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত কিছু খুব ভালো কমিক্স এখন সাফল্য অর্জন করছে। আজ পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের যুগ। সত্যিকারের সাম্য অর্জনের জন্য দুটি জিনিস প্রয়োজন: একটি ভাল প্লটলাইন যা চরিত্রের লিঙ্গকে কেন্দ্র করে গল্প বলার আশ্রয় নেয় না, এবং এমন মহিলা চরিত্র যাদের ধারাবাহিক মূল মূল্য তাঁদের ব্যাক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য। বর্তমানে লক্ষ লক্ষ ‘মাঙ্গা’-উৎসাহী মহিলা পাঠক তৈরি হয়েছে যাঁরা দাবি করছেন এরকম গল্পের।
‘মাঙ্গা’ একটি জাপানি ঘরানার গ্রাফিক নভেল, যা সম্প্রতি সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়তার নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই একই সময়ে সমকামী চরিত্রগুলিও উঠে আসতে শুরু করেছে। যেমন ‘সিরিজ ওয়াই: দ্য লাস্ট ম্যান’। নারীর হাত দিয়ে সভ্যতার সম্পূর্ণ পুনর্বিন্যাসের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। নারীদের দেখার ধরন, আধিপত্যের তত্ত্ব এবং একজন নারী যেখানে নারী-প্রভাবশালী সমাজে থাকবে তার ধারণা উঠে আসছে ক্রমে। এছাড়া কমিক্সে জাতিগত সংখ্যালঘুদের দেখা যায়, কিন্তু তাঁরা সাধারণত স্টিরিওটিপিক্যাল, প্রায়শই সরাসরি বর্ণবাদী, অগভীর চরিত্রের। ‘টিনটিন ইন কঙ্গো’ ইয়াদ করুন। আজকাল, সেই অসাম্য দূর করতে এসেছে সুপারহিরো ‘স্টর্ম’, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা।

আসলে এটি কমিক্স জগতে পরিবর্তনের সময়। অনেক কমিক্স এবং গ্রাফিক উপন্যাস বাস্তব জীবনের চিন্তাশীল চিত্র তুলে ধরে। ‘স্লাইস-অফ-লাইফ’ কমিক্স প্রায়শই প্রাপ্তমনস্ক পাঠকদের কাছে মননশীল পাঠ হিসেবে জনপ্রিয়। সেই দিন হয়তো আর দূরে নেই যখন, ক্যাপ্টেন আমেরিকা হবেন মহিলা, বাঁটুল দি গ্রেট হবেন বাঁটুল-দিদি!
দ্যুতিমান দুঁদে আইপিএস অফিসার। বর্তমানে হাওড়ায় ডিসিপি সদর পদে কর্মরত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি ছাড়াও ওঁর স্নাতক স্তরের ভূগোলের রিমোট সেন্সিং ও ভূ-জলবিদ্যার ওপর দু'টি বই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাদৃত। সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকায় ধারাবাহিক কলাম লেখেন। এবং দ্যুতিমান শিল্পী। অ্যাক্রিলিক ও কোলাজ মাধ্যমে মূলত কাজ করেন। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-সহ বহু জায়গায় প্রদর্শনী হয়েছে। বই-পত্রপত্রিকায় অলঙ্করণ করেন নিয়মিত। ছবি আঁকা, বই পড়া ছাড়া শখ বেড়ানো, পাখির ছবি তোলা আর ম্যারাথন দৌড়নো।
অনেক অজানা তথ্য জানলাম। ধন্যবাদ স্যার ।
খুব ভাল লাগল ..স্যার. .অনেক তথ্য পেলাম।