১৯৪৭ সালে ‘দো ভাই’ ছবিতে শচীন দেববর্মনের সুরে গাওয়া নারী-কণ্ঠের একটি গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেল। এই গানটির মাধ্যমেই সারা ভারতে হিন্দি ছবির নেপথ্যগায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রথম জনপ্রিয় করে তুললেন গীতা রায়, যিনি পরে গীতা দত্ত নামেই সর্বজন পরিচিত হন। শুধু প্রথম প্রতিষ্ঠালাভ নয়, এই গানটির ভেতর দিয়ে যেন অজান্তে তাঁর পরবর্তী জীবনের গঠনবিন্যাসের সারকথাটিও বলে দিয়েছিলেন গীতা দত্ত। গানটির কথা—‘মেরা সুন্দর স্বপ্না বিত্ গ্যয়া…’। 

সত্যিই তো, সারাটা জীবন ক্ষণিকের জন্য গড়ে ওঠা সুখস্বপ্নগুলো আশা জাগিয়ে মুহূর্তে চুরমার হয়ে গিয়েছে তাঁর, আর সেই বিষণ্ণতার ঘোমটাতেই আবৃত হয়ে থেকেছেন গীতা দত্ত। অকালে সরেও গেছেন জগৎসংসার থেকে। আরও অদ্ভুত বিষয়, এই গানে রবি ঠাকুরের যে গানটির সুরের প্রভাব স্পষ্ট, সেখানেও ‘বসন্ত’ কান্নাময়— ‘রোদনভরা এ বসন্ত…’কিছু কিছু আশ্চর্য ‘নির্ধারণ’ বোধহয় জীবনে করা থাকে, যা অনেক কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। গীতা দত্ত তাঁর গোটা শিল্পীজীবনে, তুলনারহিত মোহময়ী সুরের মাদকতায় ভরা এক তীব্র আকর্ষণী ক্ষমতাসম্পন্ন কণ্ঠমাধুর্যে যে শ্রোতাদের ক্ষতবিক্ষত করলেন, তার যোগফল একরাশ যন্ত্রণার প্রকাশ বলেই যেন মনে হয়। 

বাংলাদেশের ফরিদপুরের সম্ভ্রান্ত রায়চৌধুরী পরিবারে ১৯৩০-এর ২৩ নভেম্বর জন্ম হয় গীতার। পদবী ছোট করে হয় ‘রায়’ বাবা দেবেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর ছিল জমিদারি। আভিজাত্য আর বৈভবে ভরা ছিল গীতার বাল্যকাল। মা অমিয়াদেবী কবিতার ভক্ত ছিলেন— পড়তেন খুব। মায়ের প্রতিই মেয়ের টান ছিল বেশি। হবেই তোসেই ছোট্ট মেয়ের বুকটাও তো সুরে ঠাসা ছিল, যা মাঝে মাঝেই এলোমেলোভাবে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসত

বাবা-মায়ের এটা নজর এড়াল না। পণ্ডিত হীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী নিযুক্ত হলেন গীতার গানের শিক্ষক হিসেবে। ব্যস, আর কী চাই? সুরের দুনিয়ায় ঢুকে পড়ে এত আনন্দ হল যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ করে যেতে একটুও কষ্ট হত না, দশ বছরের মেয়েটার। কিন্তু, ‘আনন্দ’ বা ‘সুখ’ চিরকালই তো গীতার সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছে— উঁকি মেরে পালিয়ে গেছে। ওই বয়স থেকেই তার শুরু। জমিদারি-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হলেন গীতার বাবা দেবেন্দ্রনাথ। এক লহমায় বর্ণাঢ্য জীবন বর্ণহীন হয়ে গেল। দারিদ্রে আক্রান্ত পরিবার নিয়ে চলে আসতে হল কলকাতায়। দেবেন্দ্রনাথ চাকরি নিলেন একটি অটোমোবাইল কোম্পানিতে। বাসা নিলেন আমহার্স্ট স্ট্রিটে। গান শেখা শুরু হল বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ হরেন্দ্রনাথ নন্দীর কাছে।

Geeta-Roy with harendranath nandi
সঙ্গীতশিক্ষক হরেন্দ্রনাথ নন্দীর সঙ্গে গীতা দত্ত

সময়টা ১৯৪২‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ। মেদিনীপুরের আগস্ট আন্দোলনের কথা তো চিরস্মরণীয়। কিন্তু, সেপ্টেম্বরে কলকাতাতেও তীব্র আন্দোলনের প্রকাশ ঘটেছিল। সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যু জুড়ে প্রচণ্ড যুব বিক্ষোভ, পুলিশ-মিলিটারির সঙ্গে যুব সম্প্রদায়ের চূড়ান্ত সংঘাত, ব্যাপক ধরপাকড়-লাঠি-গুলি সবমিলিয়ে সে এক সাংঘাতিক অবস্থা! গীতার বাবা দেবেন্দ্রনাথও ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন এই আন্দোলনে। পুলিশের নজর পড়ল তাঁর দিকে। 

কোম্পানি দেবেন্দ্রনাথকে মুম্বই বদলি করে দিল। পরিবারসহ তাঁকে কলকাতার পাট চুকিয়ে ওই ১৯৪২ সালেই পাড়ি জমাতে হল মুম্বই। এখানেও যা বিস্ময়ের, তা হল, এরকম পরিস্থিতি তৈরি নাহলে তো গীতার মুম্বইয়ে আসাই হত না! ফলে, ওই অবস্থায় কলকাতায় থাকলে ভারতমাতানো কণ্ঠশিল্পী গীতা দত্তকে আমরা কতটা পেতাম, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় কি? কারণ, মুম্বই আসার কয়েক বছরের মধ্যেই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা।

Geeta-Roy-singer
তরুণী গীতা, তখন রায়।

টাকাকড়ির যা অবস্থা, মুম্বই এসে নিজে নিজেই গানের চর্চা চলল। ঘটনাচক্রে গীতার সঙ্গীশিক্ষক হরেন্দ্রনাথ নন্দীও তখন মুম্বইতে। মাঝে মাঝে তাঁর কাছেও শিখতে যেতেন গীতা। একদিন ঘরে বসে গাইছেন— ‘বিনতি শুনো মেরি ঘনশ্যাম…’‘ঘনশ্যাম’ বোধ হয় সত্যিই গীতার ‘বিনতি’ সেদিন শুনেছিলেন। গীতারা যে বাড়িতে থাকতেন, তার নীচের তলায় একটি নাচগানের ইস্কুল ছিল। সেখানে গান শেখাতে আসতেন সেসময়ের মুম্বই-ফিল্মজগতের প্রতিষ্ঠিত সুরকার পণ্ডিত হনুমানপ্রসাদ। সেদিনও তিনি আসছিলেন শেখাতে। বাড়ির কাছে পৌঁছতেই, গীতার গান তাঁর কানে এল। অপূর্ব সুমধুর কণ্ঠের টানে, সেই সুরের পথ ধরে এগিয়ে, গীতাদের ঘরে কড়া নাড়লেন তিনি। গীতার সঙ্গে কথা-টথা বলে, তাঁর কাছ থেকে আরও কয়েকটি গান শুনলেন পণ্ডিতজি। শুনে এতটাই মোহিত, যে সাগ্রহে গীতাকে শেখাতে শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের সুরে ‘বৈরম খান’ ছবিতে গীতাকে গান গাওয়ালেন। অবশ্য সমবেত কণ্ঠে। তা হোক, এভাবে ভারতীয় সংগীত-দুনিয়ায় এক কিন্নরীর প্রবেশ তো ঘটল! এজন্য শ্রোতাকুল চিরকাল পণ্ডিতজির কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে বাধ্য।

সময়টা ১৯৪৬। মুম্বইতে ততদিনে গড়ে উঠেছে আইপিটিএ-র মতো প্রগতিবাদী সংগঠন। এইসব জায়গাতেও যাতায়াত ছিল গীতার। তবে সিনেমাজগতে একের পর এক সুযোগ এলেও নেপথ্যগায়িকা হিসেবে তাঁর পায়ের তলার জমিটা কিছুতেই পাকা হচ্ছিল না। প্রসঙ্গত, গীতার সহোদর মুকুল রায়ও ছিলেন সংগীতজগতের মানুষ। পরবর্তীকালে সুরকার হিসেবে মুম্বইতে অল্পবিস্তর নামও করেছিলেন। সেই তিনিও রয়েছেন বোনের পাশে। তবুও, প্রায় ১৪-১৫টা ছবিতে গাওয়ার পরও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অবশেষে, স্বাধীনতার বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দো ভাই’ ছবি থেকে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল, যা শুরুতেই উল্লিখিত।

Geeta-Dutt-Talat-Mahmood-Mukul-Roy-Hasrat-Jaipuri
গীতা দত্তের বাঁ পাশে বসে তাঁর দাদা মুকুল রায়। পাশে বসে তালাত মাহমুদ এবং পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর মাথার উপর দিয়ে ঝুঁকে রয়েছেন হসরত জয়পুরী। মুম্বইয়ের একটি রেকর্ডিং স্টুডিওতে।

প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে, সংগীত পরিচালকদের নজর পড়ল গীতার ওপর। তাঁরা বোধ হয় বুঝেছিলেন জোয়ারিতে পরিপূর্ণ, স্বকীয় মিষ্টতায় ভরা, গায়নশৈলীর নাটকীয়তা ধরে রাখার মতো অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কণ্ঠের এরকম গায়িকা এর আগে সেভাবে দেখা যায়নি। এর ফলে, আমীরবাই, রাজকুমারি, খুরশিদ, জ়োহরাবাই, শমসাদ বেগম প্রমুখের খানদানি ঘরানা এবং নূরজাহান, সুরাইয়ার নায়িকা-গায়িকার প্রভাব পেরিয়ে অচিরেই মুম্বই ফিল্ম সংগীতে স্পষ্ট দুটি স্বতন্ত্র নারীকণ্ঠের ধারার জন্ম হল। যাঁরা জন্মদাত্রীর ভূমিকা নিলেন, তাঁরা হলেন লতা মঙ্গেশকর ও গীতা দত্ত। গোটা পাঁচের দশক জুড়ে নেপথ্যগায়িকা হিসেবে মূলত রাজত্ব করলেন এঁরা দু’জনেই। আশা ভোঁসলের দাপটের শুরু অনেক পরে, পাঁচ দশকের শেষের দিক থেকে। তখন অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক কারণে, গীতা দত্ত অনেকটাই স্তিমিত। কী সেই কারণ? আসছি সেই প্রসঙ্গে।

১৯৫১ সাল। শচীনদেব বর্মনের সুরে ‘বাজ়ি’ ছবির গান রেকর্ডিং করতে এসেছেন গীতা দত্ত। গাইছেন সেইসব অসামান্য গান— ‘তদবির সে বিগড়ি হুয়ি…’, ‘ইয়ে কৌন আয়া…’ছবিতে উচ্ছলতায় ভরপুর গীতা বালির অভিনয়ের সঙ্গে গীতা দত্তের গান যেন খাপে খাপে মিলে গিয়েছে। যাই হোক, সেদিন রেকর্ডিংয়ে আভিজাত্যে ভরা অপরূপ সৌন্দর্যময়ী গীতা দত্তের মাদকতাময় গলা— ওখানে উপস্থিত ছবির প্রযোজক-পরিচালক গুরু দত্তকে পাগল করে দিল। তিনি গীতার প্রেমে পড়লেন। গীতা তো সদাই ভালোবাসার পিয়াসী, প্রেমপ্রার্থী। বন্ধন গড়ে উঠতে দেরি হল না। কিন্তু সেদিন এই সম্পর্ক গড়ে ওঠার মধ্যে দিয়েই বোধহয় একইসঙ্গে বোনা হয়ে গিয়েছিল সৃষ্টি ও ধ্বংসের বীজ। 

Geeta and Lata
ভারতীয় সঙ্গীতজগতের দুই দিকপাল- গীতা দত্ত ও লতা মঙ্গেশকর

গীতা দত্ত তখন দাপটের সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। প্রতিনিয়ত সুপারহিট গান। সময়টা ১৯৫২সেইসময় অমৃতসর থেকে লাহোর হয়ে মুম্বইয়ে পা রাখলেন এক তরুণ সংগীত পরিচালক। নাম— ও.পি নাইয়ারআত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক সংগীতপুরুষ। তা নাহলে, প্রথম হিন্দি ছবি ‘আসমান’-এর রেকর্ডিংয়ে এককথায় লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া চারখানি গান অপছন্দের কারণে বাতিল করে দিতে পারেন? সেইসময় কোথায় লতা আর কোথায় আনকোরা ও.পি. নাইয়ার! শুধু তাই নয়, এরপর আর কোনওদিন কোনও গান লতাকে দিয়ে গাওয়াননি। এতদসত্ত্বেও, নিজেকে সুরকার হিসেবে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যেতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। তবে, একথা অনস্বীকার্য, এ জায়গায় পৌঁছতে সেই পাঁচের দশকে ও.পি. নাইয়ারের সবচেয়ে বড়ো ভরসা ছিলেন গীতা দত্ত। ও.পি. নাইয়ার-গীতা দত্ত— হিন্দি ফিল্ম সংগীতের এক অমোঘ সংযোগ।

আরপার, মি. অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ, সিআইডি. হাওড়া-ব্রিজ— এই জুটির আরও অনেক ছবির নাম করা যায়। তবে শচীন দেববর্মনও কম যাননি গীতা-কণ্ঠ ব্যবহারের ক্ষেত্রে— দো ভাই, বাজ়ি, পেয়াসা, সুজাতা; কত আর বলা যায়। এছাড়া, হেমন্তকুমার, সলিল চৌধুরী, মদনমোহন, রবি, তিমিরবরণ, কানু রায়-সহ অনেকেই গীতা দত্তের অসামান্যতাকে মান্যতা দিয়েছেন নিজেদের সুরে তাঁকে দিয়ে গান গাইয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনে হিন্দি ‘জ্বলজ্বলা’ ছবির সুরকার প্রবাদপ্রতিম পঙ্কজকুমার মল্লিকও মূল নারীকণ্ঠ হিসেবে বেছেছিলেন গীতা দত্তকে। ইতিমধ্যে গুরু-গীতার প্রেম পরিণয়ে পরিণতি পেয়েছে ১৯৫৩-র ২৬ মেগীতার সে বড়ো সুখের সময়! কিন্তু সে তো তাঁর জীবনে বেশিদিন স্থায়ী হওয়ার নয়। হলও না। কারণ? 

Guru dutt and Geeta Dutt
১৯৫৩ সালে বিয়ে হয় গুরু দত্ত ও গীতা রায়ের।

গীতা দত্ত তখন তরতর করে এগিয়ে চললেও গুরু দত্ত তখনও পায়ের তলায় জমি সেভাবে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সংঘাতের শুরু এইভাবেই। ইন্ধনও ছিল। কিছু সাংবাদিক প্রচার করলেন, গীতা দত্তের খ্যাতি ও অর্থের জন্যই গুরু দত্ত তাঁকে বিয়ে করেছেন। ব্যাস্, আগুনে ঘি পড়ল। গুরু দত্ত কড়া নির্দেশ দিলেন, তাঁর ছবি ছাড়া অন্য কোথাও গীতার গান গাওয়া চলবে না। এ হয় নাকি! গীতা বাঁচবেন কীভাবে? তাঁর গানের জগতে তখন তুঙ্গ সময় চলছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে গীতাকে তার তিন সন্তানের (ছেলে তরুণ-অরুণ ও মেয়ে নীনা) মুখ চেয়ে বড় সংঘাতের মধ্যে না গিয়ে গুরু দত্তের এই ভয়ংকর নির্দেশ মেনে নিতে হল। কিন্তু, গানে ভরা একটি মানুষ কতদিন এভাবে থাকতে পারেন? ফলে, এক অদ্ভুত উপায় নিলেন গীতা। গুরু দত্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে লুকিয়ে গিয়ে গান রেকর্ডিং করে, আবার স্বামীর ফেরার আগে বাড়িতে ঢুকে পড়তেন। এক অবিস্মরণীয় শিল্পীর কী মর্মান্তিক জীবনযাপন! 

আরও পড়ুন: সঞ্জয় সেনগুপ্তের কলমে: নীল যমুনার জল

কিন্তু এভাবে কি আর ভালো করে গান গাওয়া সম্ভব? কারণ, গানের চেয়ে ঘড়ির দিকে মনটাকে বেশি রাখতে হত গীতাকে। তাছাড়া, একটি নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে যাওয়ার উপায় না থাকাতে সংগীত পরিচালকদের সবসময় এই সময়জনিত শর্ত মেনে গীতাকে গাওয়ানো সম্ভব হত না। ফলে, তাঁরা গীতাকে এড়িয়ে যেতে বাধ্য হলেন। নিজের কোনওরকম খামতি না থাকা সত্ত্বেও অনেক পরিশ্রমে গড়ে তোলা এই অসম্ভব জনপ্রিয়তা যদি পারিপার্শ্বিকতার অন্যায় চাপে মুখ থুবড়ে পড়ে, তাহলে গীতা দত্তের মতো অগাধ প্রতিভাময়ী কণ্ঠশিল্পীর বেঁচে থাকার পথটাই তো গুলিয়ে যায়। অবশ্য, গুরু দত্তের এহেন আচরণকে এককথায় ‘অন্যায়’ বলা যায় কি না, তাই-বা কে জানে? তিনিও তো ছিলেন এক ভাঙাচোরা হৃদয়সম্পন্ন রোমান্টিক পুরুষ। তা নাহলে, ১৯৬৪-তে আত্মহননের পথ কেনই বা বেছে নিলেন? 

আসলে, এইসব আশ্চর্য চরিত্রের মানুষদের অন্তরে নিজেদেরই প্রতিভার চাপে যেসব প্রশ্নোত্তরের খেলা চলে, তা বোঝার ক্ষমতা বোধহয় আমাদের মতো গড়পড়তা-মেধাবিশিষ্ট লোকেদের পক্ষে সম্ভব নয়। দরকারও নেই তার। শুধু দেখা যাক পরিণতির ধরনটা কী হল?

স্বাভাবিক কারণেই গীতার কাজ কমে প্রায় শূন্যে ঠেকার উপক্রম হল। একাকীত্ব গ্রাস করল। এরসঙ্গে যোগ হল এক বিখ্যাত অভিনেত্রীর সঙ্গে গুরু দত্তের সম্পর্কের ঘটনা। গীতা দত্ত আক্রান্ত হলেন মানসিক অবসাদেনজর এড়াল না গুরুদত্তের। মরিয়া চেষ্টা হিসেবে গীতাকে নায়িকা করে ‘গৌরী’ নামে একটি বাংলা ছবির পরিকল্পনা করলেন। গীতাকে সে কথা বলাতে নতুন করে যেন নিজেকে ফিরে পেলেন তিনি। শুটিংয়ের দিন একবুক আনন্দ নিয়ে হাজির হলেন সেটে। কাজও চলল বেশ কিছুদিন। ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন শচীন দেববর্মন। তাঁর সুরে ‘জানি ভোমরা কেন কথা কয় না’ এবং ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ গানদু’টি গীতার গলায় রেকর্ডও হয়ে গেল। কিন্তু ক্রমেই গুরু-গীতার সম্পর্কের রসায়ন নষ্ট হতে লাগল। ছবির কাজ মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেল। এরপর দুজনের একসঙ্গে থাকাও মুশকিল হয়ে পড়ল। বারেবারেই যৌথজীবন ব্যহত হতে লাগল। 

তছনছ হয়ে যাওয়া গীতার সঙ্গী বলতে তখন তাঁর তিন সন্তান। সঙ্গে আর এক বন্ধু জুটলো, অচিরেই যা হল প্রিয়তম সঙ্গী— মদ। সর্বক্ষণ মদে ডুবে থাকতে লাগলেন। কিছুদিন আগেও যাঁর রূপ ও গানের উত্তাপে চারিদিক ঝলসে যেত, কয়েক বছরের মধ্যেই তার এই পরিণতি, যেন মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। তবুও এ অবস্থাতেও তিনি গান করেছেন, রেকর্ডে গেয়েছেন। সে সম্পর্কে দুটি ঘটনার কথা বলব। তবে, তার আগে বাংলা গানের জগতের কথা তো কিছু বলতেই হয়।

গীতা দত্তের গাওয়া বাংলা গানের সংখ্যা হিন্দির ধারেকাছে না গেলেও কয়েকটি মাইলস্টোন কিন্তু তারই কণ্ঠনিঃসৃত। এরকম কিছু নমুনা পেশের মাধ্যমে একইসঙ্গে বহু শ্রোতার সুর-স্মৃতিকে উসকে দেওয়া যাক— ‘ঐ সুরভরা দূর নীলিমায়’, ‘একটু চাওয়া আর একটু পাওয়া’, ‘শচীমাতা গো’, ‘কৃষ্ণচূড়ার আগুন তুমি’, ‘কত গান হারালাম’, ‘কাচের চুড়ির ছটা’ (ছবি – ডাকহরকরা), ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ’ (ছবি- পৃথিবী আমারে চায়), ‘ঝনক ঝনক কনক কাঁকন’ (ছবি – ইন্দ্রাণী) ‘বাঁশি বুঝি সেই সুরে’ (ছবি- সাথীহারা), ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’ (ছবি- হসপিটাল), ‘এই মায়াবী তিথি’ (ছবি- সোনার হরিণ) এবং ‘তুমি যে আমার’ (ছবি- হারানো সুর) ইত্যাদি। গীতা দত্তের শেষ বাংলা প্লেব্যাক ছিল ‘বধূবরণ’ (১৯৬৭) ছবিতে, কমল দাশগুপ্তের সুরে। এই ছবিতে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন।  

geeta-dutt-puja
একান্তে পুজোর ঘরে

এখানে ‘তুমি যে আমার’ গানটি নিয়ে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। ১৯৫৭ সালের ছবি ‘হারানো সুর।’ ছবির নায়কই প্রযোজক। অর্থাৎ উত্তমকুমার। পরিচালক অজয় কর। নায়িকা সুচিত্রা সেন। ছবিতে দু’টি গান ছিলপুরুষকণ্ঠের গানটি গাইবেন ছবির সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজেই। নারীকণ্ঠের গানটির জন্য হেমন্ত ভাবলেন গীতা দত্তের কথা। চমকে উঠলেন প্রযোজক ও পরিচালক। কারণ, তখন সুচিত্রা মানেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, যেমন উত্তম মানেই হেমন্ত। ফলত, তাঁরা আপত্তি জানালেন। এ ঝুঁকি নেওয়াই যাবে না। কিন্তু, হেমন্তবাবু অনড়। তিনি বললেন, এ গানের যা সুরচলন, মুড, দৃশ্যের যা দাবি— গীতা ছাড়া আর কেউ এ গানকে সঠিকভাবে ফোটাতে পারবে না। আরও বললেন, যদি তাঁর কথা মানা না হয়, তিনি এ ছবিতে কাজ করবেন না। অগত্যা, সবাইকে পিছু হটতে হল। গীতা দত্ত গাইলেন— ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার…’এক ভরপুর রোমান্টিক দৃশ্যে সে গানে ঠোঁট মেলালেন সুচিত্রা সেন। তারপর, কী হল, লেখার কোনও প্রয়োজন নেই। শুধু বলব— ধন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

এবার বিধ্বস্ত গীতা দত্তের দুটি রেকর্ডিংয়ের ঘটনার কথা বলে গীতা-কথায় ইতি টানবপ্রথমটি হিন্দি ‘সাহেব বিবি ঔর গুলাম’ ছবির কথা। ১৯৬২ সাল। গুরু দত্তের ছবি। ছবির সুরকার হেমন্তকুমারের আহ্বানে গাইতে এসেছেন গীতা দত্ত। গানটিতে যিনি ঠোঁট নেড়েছিলেন, তিনিও মানসিকভাবে সদা-বিপর্যস্ত মহিলা— মীনাকুমারী। আবার, যে চরিত্রের জন্য এতকিছু, গল্পের সেই ছোটগিন্নী পটেশ্বরীও স্বামীর মনোরঞ্জন করে, তাকে কাছে রাখার জন্য মদ খেয়ে চুর হয়ে গান গাইছেন। তার মানে, চরিত্র-অভিনেত্রী-নেপথ্যগায়িকা— সবের মধ্যে একেবারে রাজযোটক মিল। হেমন্তবাবু সুরও করেছেন জবরদস্ত— ‘না যাও সাঁইয়া চুরাকে বঁইয়া…’গান রেকর্ডিংয়ের আগে হেমন্ত বললেন গীতাকে যে, এ গান কান্নার ভাব নিয়ে গাইতে হবে। গীতা একচিলতে করুণ হেসে বলেছিলেন, চেষ্টা করে তাঁকে কান্নার ভাব আনতে হবে না। গান গাইলে এমনিতেই কান্না বেরিয়ে আসেকান্না তাঁর নিত্যসঙ্গী।

Geeta Dutt Family
স্বামী, সন্তান, সঙ্গীত– এই তিন নিয়েই ছিল গীতা দত্তের ভুবন

দ্বিতীয় ঘটনায় আসি। বাংলা গানের রেকর্ডিং। স্থান মুম্বই। দুটি গানই অবিস্মরণীয় নন-ফিল্ম আধুনিক। সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায়। ঘটনাটা স্বয়ং অনল চট্টোপাধ্যায়ের বয়ানেই শোনা যাক— 

‘…’৬২ সালে আমার পুজোর গানের শিল্পী ছিলেন গীতা দত্ত। গান দু’টোর একটা হল “কৃষ্ণনগর থেকে আমি কৃষ্ণ খুঁজে এনেছি…”, আরেকটা “কত গান হারালাম…” দু’টো গানের কথা, সুর প্রায় সম্পূর্ণই ভিন্ন মেজাজের। যাই হোক, ঠিক হল রেকর্ডিং, এমনকী রিহার্সালও হবে বম্বেতেই। গীতা দত্ত তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। থাকেন নিজের মায়ের কাছে। কলকাতায় বসেই তথ্যগুলি আমি জেনে গিয়েছি। কিন্তু, বম্বেতে পৌঁছে গীতার বাড়িতে গিয়ে দেখি আরও সাংঘাতিক অবস্থা। গীতার অবিন্যস্ত বেশবাস, পাঁচ বছরের মেয়ের মতো অস্বাভাবিক কথা বলার ভঙ্গি, সব কিছু দেখেশুনে গান-টান তখন আমার মাথায় উঠে গেছেগীতাকে দিয়ে রেকর্ড করানো তো দূরের কথা, গানগুলি তোলানোই প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছে।’

GEETA-DUTT-in-the-Bengali-film-Badhubharan-1967
‘বধূবরণ’ ছবিতে নায়িকা-গায়িকা গীতা দত্ত

‘যাই হোক, ধরে-বেঁধে কোনোক্রমে গানগুলি তোলালাম, তোলালাম মানে কি, আমিই গাইলাম, ও শুধু শুনল। রেকর্ডিং-এর দিন আবার আরেক বিপত্তি। দশটায় টাইম। গীতা ঢুকল লাঞ্চ-ব্রেকের পর। আশঙ্কায় আমি তখন কাঠ। গীতা প্রথম গানটা (“কৃষ্ণনগর থেকে আমি”) গাইল রীতিমতো নাচতে নাচতে। দ্বিতীয় গানটা (“কত গান হারালাম”) গাইল মুখ নীচু করে, নিথর ভঙ্গিতে। গানের শেষে কাছে গিয়ে দেখলাম, দু’চোখে শুধু জলের ধারা। অসম্ভব হিট করেছিল ওই দু’টো গানই। প্রতিভা কাকে বলে, আরও একবার সেটা টের পেলাম।…’

এই প্রতিভাকে কি আদৌ কোনও মাপকাঠিতে পরিমাপ করা সম্ভব? ভেবে দেখুন পাঠক, ১৯৬২ সালেই তাঁর এরকম মানসিক ও শারীরিক অবস্থা। এরপর ১৯৬৪-তে গুরু দত্তের প্রয়াণের পর তিনি সবদিক থেকে একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান। অথচ তারপরেও আমরা দেখি, ১৯৭১ সালে বাসু ভট্টাচার্যের ‘অনুভব’ ছবিতে কানু রায়ের সুরে তাঁকে ঝলসে উঠতে। ‘মেরা দিল যো মেরা হোতা’, ‘কোই চুপকে সে আকে’, ‘মুঝে জাঁ না কহো মেরি জান’-এর মতো গান গাইলেন পরপর। এখানেই শেষ নয়। যে বছর তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, সেই ১৯৭২-এও দু’টি ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন। আর সে গান শুনে বোঝার উপায় নেই, আর কয়েক মাসের মাথায় জীবন থেকে ছুটি নেবেন শিল্পী। সেই যে ১৯৫৯ সালে ‘কাগজ় কে ফুল’ ছবিতে গেয়েছিলেন ‘ওয়ক্ত নে কিয়া কেয়া হসিঁ সিতম’… সে গান যে তাঁর জীবনের ছত্রে ছত্রে সত্য হয়ে উঠবে, সে কথাই কি কেউ বুঝতে পেরেছিল? 

Geeta-Dutt
গানের বাগানের পারিজাতটি অকালে ঝরে গেল।

১৯৭২-এর ২০ জুলাই। সিরোসিস অফ লিভারে আক্রান্ত গীতা দত্ত বেঁচে থাকার মতো দুঃসহ কাজ থেকে অব্যাহতি নিলেন। আমাদের আফশোসের সঙ্গে লজ্জার পাহাড় জমানো ছাড়া আর কাজ কী? অজানার উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন করতেই ইচ্ছে করে, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই যিনি ‘গানের রানি’ হয়ে উঠলেন, তাঁর অতদিন ধরে জীবন্মৃত অবস্থায় থেকে এইভাবে অকালপ্রয়াত হওয়ার কি কথা ছিল? নিবন্ধের শুরুতে উল্লিখিত গানটি ছাড়াও ‘দো ভাই’ ছবিতে গীতা দত্তের গাওয়া আরও একটি একক-কণ্ঠের গান ছিল, যার মাধ্যমে মনে হয় যেন গীতা দত্ত সংগীতজীবনের শুরুতেই এক চিরসত্য বার্তা দিয়েছিলেন— ‘ইয়াদ্ করোগে, ইয়াদ্ করোগে, ইকদিন হামকো ইয়াদ্ করোগে…’অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে, শুধু শ্রোতাদের ব্যাপারে অবশ্যই বলা যায়, তাঁরা কিন্তু শুরু থেকেই এই কিংবদন্তী শিল্পীকে মনে রেখেছেন, আজও রেখে চলেছেন এবং ভবিষ্যতেও রাখবেন। কারণ, অধিকাংশ ভারতীয় সংগীতপ্রেমীর হৃদয়ের একটা অংশের নামই হল— গীতা দত্ত।

*তথ্যসূত্র:

১. YESTERDAY’S MELODIES TODAY’S MEMORIES /Manek Premchand. 
২. ‘গানের কাগজ’ (বর্ষ ২ সংখ্যা ৬ বইমেলা ফেব্রুয়ারি ২০০৯)
৩. ‘সারেগা’ পত্রিকা ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০০২
কৃতজ্ঞতা: সঞ্জয় সেনগুপ্ত, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

*ছবি সৌজন্য: Learning and Creativity, Wikipedia, Facebook, Pinterest

Aveek Chottopadhyay Author

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।

3 Responses

  1. এই লেখা পড়ে বেশ কিছু সময় পুরানো স্মৃতি ফিরে এল আর ফলশ্রুতি হিসাবে বেদনার মুক্তি হল অশ্রুধারায় । একটি অনুষ্ঠানে পেমেন্টের টাকা নিয়ে তিনি কিছু খান নি । বিমানবন্দরে যাবার সময় গাইতে গাইতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন । খুব সুন্দর এই লেখা, লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ।

  2. অদ্ভুত মাদকতা ময় কন্ঠে র অধিকারী, টোনাল বিউটি তাকে বলে, যেটা লতা জী বা সন্ধ্যা দেবী র। গলায় পাই। আরো অনেক। কিছু দেবার ছিল। বঞ্চিত হলাম আমরা। স্মরণ করি এই অদ্বিতীয়া কে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *